You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে
পাকিস্তানের ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ
অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের ডেকে পাঠানাে হচ্ছে : লাহাের থেকে লােকজন অপসারণের কাজ চলছে

নয়াদিল্লী, ১৫ অক্টোবর-পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং পূর্ববঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত সাফল্য আতঙ্কগ্রস্ত ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাঞ্চলে ও পূর্বাঞ্চলের পাক-ভারত সীমান্ত অঞ্চলসমূহে ব্যাপকভাবে ও প্রচুর পরিমাণে সৈন্যসমাবেশ এবং অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম মজুদ করছে।
পাঞ্জাব ও কাশ্মীর সীমান্তে তিন লক্ষাধিক পাক সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে। জেনারেল টিক্কা খানকে পশ্চিমাঞ্চলের সামরিক ঘাঁটিগুলির কমাণ্ডার হিসেবে নিয়ােগ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত পাক সৈন্য বাহিনীর অফিসারদের পুনরায় ডেকে এনে বিভিন্ন কাজে বসানাে হচ্ছে।
পশ্চিমের ঘাঁটিগুলির জন্য টিক্কা খান কমাণ্ডার হিসেবে নিযুক্ত
পূর্বাঞ্চলের ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তেও পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ সৈন্য সমবেশ করছে। এছাড়াও মেঘালয় ও অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলেও তাদের মধ্যে সাজ সাজ রব দেখা দিয়েছে।
জয়পুরের সংবাদে বলা হয়েছে যে রাজস্থানের বারমার ও গঙ্গারামপুরেও প্রচুর পরিমাণে পাক সৈন্যের সমাবেশ করা হয়েছে।
এ-পির সংবাদদাতা এ্যান… জেটলিন তাঁর রিপাের্টে বলেছেন যে পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী লাহােরে যুদ্ধের হিড়িক লেগে গেছে। তিনি আরও জানিয়েছেন যে শহর থেকে লােকজন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নয়াদিল্লী থেকে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, দেশের পশ্চিমঞ্চলের সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে যে এইসব সীমান্ত অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে পাক সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে এবং পাক সৈন্যদের গতিবিধি ও প্রস্তুতি এক অশুভ ইঙ্গিত বহন করে এনেছে। পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চলের জন্য বাঙলাদেশ থেকে সৈন্য তুলে আনতে কার্পণ্য করছে না।
বাঙলাদেশে পাঁচ ডিভিসন সৈন্য দিয়ে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মােকাবিলা করা হচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাঙলাদেশ থেকে এক ডিভিসন সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত-পাক সীমান্ত অঞ্চলে পাঠানাে হয়েছে। জানা গেছে যে জেনারেল টিক্কা খানকে পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলির কমাণ্ডার হিসাবে নিয়ােগ করা হয়েছে।
এখানকার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনুমান যে পশ্চিম পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক ঝড় ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই পাকিস্তানের সামরিক শাসক গােষ্ঠী পাক-ভারত সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে চাইছে।
পাঞ্জাব ও কাশ্মীর সীমান্তে তিন লক্ষাধিক পাক সৈন্যের সমাবেশ করা হয়েছে। পাকিস্তানী সাঁজোয়া বাহিনী ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সীমান্তের পাকিস্তানী গ্রামগুলি থেকে গ্রামবাসীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাক সেনাদের চলাচলে কয়েক দিন কয়েক মাইল ধরে কেবল ধুলাে উড়েছে।
পাক সৈন্য গােষ্ঠী অবসরপ্রাপ্ত সেনাদলের অফিসারদের ডেকে পাঠিয়ে সামরিক ও বেসামরিক কাজে তাদের নিয়ােগ করেছে। সৈন্যদলের ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাঞ্জাব ও উপজাতি এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবক গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিশ্বস্ত মহলের সংবাদ হল যে ইয়াহিয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে কাশ্মীর। পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি পয়েন্টের উপর দ্রুত ও চকিত আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়েই ইয়াহিয়া তার যুদ্ধ প্রস্তুতি চালাচ্ছে।
সংবাদে প্রকাশ, বিভিন্ন পক্ষে মার্কিনী অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে এসে পৌছােচ্ছে। এই রকমই একটা দেশ হল ইরান। ইরান থেকে মার্কিনী বিমান, স্পেয়ার পার্টস ও সামরিক সাজ-সরঞ্জাম এসে পৌঁছেছে। এছাড়াও এক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মার্কিন প্রতিনিধি দল সম্প্রতি পাকিস্তান সফর করে গেছেন।
ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি ইরান সফর করে ইরানের কাছ থেকে হাল্কা ধরণের বােমারু বিমান ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে।
পাকিস্তানের কূটনীতিকরা সারা বিশ্বে ভারত কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তান আক্রমণ করবে বলে আজ অপপ্রচার চালিয়ে নিজেদের ঘৃণ্য চক্রান্ত আড়াল করার চেষ্টা করছে। এইসব পাক কূটনীতিকরা প্রচার করছে। যে মুক্তিফৌজের ছদ্মবেশে ভারতীয়রা লড়াই করছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন যে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে আগামী ৪ সপ্তাহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং পাকিস্তানী পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
কলকাতা থেকে স্টাফ রিপাের্টার জানাচ্ছেন যে, পাকিস্তান জঙ্গী বাহিনী পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সীমান্ত জুড়ে যুদ্ধের ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু করেছে বলে জানা গেল। ইউ, এন, আই ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, পাকিস্তান ত্রিপুরা থেকে পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্র ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। ভারী কামান, অস্ত্রপূর্ণ গাড়ি প্রভৃতিতে সজ্জিত হয়ে পাকফৌজ ভারত সীমান্তের খুব কাছে ঘাটি গাড়ছে। রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং যশাের জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বড় বড় সব বাড়ি, স্কুলঘর পাকফৌজ বাজেয়াপ্ত করেছে। এবং গত কয়েকদিন ধরে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী গ্রামের উপর পাক-বাহিনীর গােলাগুলি বর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
রায়গঞ্জ থেকে ইউ, এন, আই জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি এলাকায় আজও পাকফৌজ গােলাগুলি চালায়। গত পনের দিন ধরে পাকফৌজ এই কুকীর্তি করে চলেছে। পাকফৌজ আজ গুলি চালালে ভারতীয় রক্ষীবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। দশ জন পাকসৈন্য মারা গেছে বলে অনুমিত হচ্ছে। পাকিস্তানের গােলাগুলিতে দুই জন বি এস এফ এবং চার জন অসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
সংবাদ সরবরাহ সংস্থা আরও জানাচ্ছে, পাকিস্তান রংপুরের লালমণিরং হাটে অবস্থিত তার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটিতে বম্বার এবং ফাইটার বিমান জড়াে করেছে। রংপুর জেলা পশ্চিম-দিনাজপুর জেলার বিপরীতে অবস্থিত। বেনাপোেল এবং নাভারনে পাক-ফৌজের ব্যস্ত আনাগােনা চোখে পড়ছে।
পাকিস্তানের ৩ লক্ষ ৯৭০০০ সশস্ত্র সেনা যুদ্ধের জন্য মহড়া চালাচ্ছে বলে বাঙলাদেশের কাগজ দি পিপল’ সংবাদ দিয়েছে। রাওয়ালপিণ্ডিতে ফৌজীর সদর দপ্তরের নির্দেশে এই মহড়া চলছে। পাক ফৌজের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ১০০০০ হাজার নৌ সৈন্য এবং ১৭০০০ হাজার বিমান বাহিনীর। পাক ফৌজের হাতে ১০৫০ টি ট্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০টি আমেরিকান ট্যাংক। নৌ বাহিনীর চারটে সাবমেরিণ রয়েছে। বিমানবাহিনীর একটি চাইনীজ লাইট বােম্বার স্কোয়াড্রন (এল-বি-এস), দুটো আমেরিকান এল-বি-এস, একটি ফরাসী এল বি এস, এছাড়া স্যাবার জেট প্রভৃতি রয়েছে।
দূরভিসন্ধি ব্যর্থ করুন
বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (সভাপতিঃ অধ্যাপক মােজফফর আহমদ) সাপ্তাহিক মুখপত্র নতুন বাঙলার সাম্প্রতিক সংখ্যায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগানাের জোর পাঁয়তারা : এই দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করুন” এই শিরােণামায় এক নিবন্ধ বেরিয়েছে। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রশ্নটিকে ভারত-পাকিস্তান বিরােধ হিসাবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সীমান্তে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ নিপ্রদীপ মহড়া চালাচ্ছে। বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী ও নিরস্ত্র জনগণের উপর উস্কানীমূলকভাবে গুলিবর্ষণও করছে।
যশাের ও কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকায় রাস্তার দুই ধারের পাট ও ইক্ষুক্ষেত এবং বন-জঙ্গল সাফ করার ফরমান জারী করা হয়েছে। সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় গ্রামবাসীদের সাঁজোয়া গাড়ী চলাচলের উপযােগী রাস্তা মেরামতে বাধ্য করা হচ্ছে।
নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে, পাক-সামরিক চক্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল পাক-সামরিক চক্র কেন এই যুদ্ধ লাগাতে তৎপর এবং তার চেয়ে সামরিক দিক থেকে বহুগুণে শক্তিশালী ভারতের মত একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগানাের সাহসই বা কোথা থেকে আসে?
নিবন্ধটির লেখক নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তিনি বলেছেন প্রথমতঃ পাকিস্তান বাঙলাদেশের জনগণের উপর আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াব্যাপী প্রচার করবে যে, ভারত পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে চায়। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সে ভারতের কাজ বলে অভিহিত করতে থাকে। কিন্তু দিন যত যেতে থাকে বাঙলাদেশের মুক্তি সগ্রাম ততই জোরদার হওয়ায় এবং হাজারাে উস্কানীর মুখেও ভারত বরাবর সংযত আচরণ প্রদর্শন করায় আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের এই দূরভিসন্ধি সফল হতে পারে নি। পক্ষান্তরে, পাকিস্তানই দুনিয়ার সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে।
নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, দ্বিতীয়তঃ বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আজ এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত। বাঙলাদেশে আজ গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই গেরিলা যুদ্ধের নিকট কাকে না নতি স্বীকার করতে হচ্ছে? পালের গােদা আমেরিকা ইন্দোচীনে খাবি খাচ্ছে। তাে আর পিণ্ডির জঙ্গীশাহী ত কোন ছার। সুতরাং উপরােক্ত পরিস্থিতিতে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান একটি যুদ্ধের জিগির একটি সংঘর্ষ বাধানাের অপচেষ্টা করছে। নিবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে, অর্থাৎ গােটা দুনিয়াকে বােঝান হয়েছে যে ব্যাপারটা আসলে ভারতের সঙ্গে বাঙলাদেশ বা বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বলে কোন জিনিস নেই।
নিবন্ধটিতে আরও মন্তব্য করা হয় যে, বলা বাহুল্য পাকিস্তানকে এই ব্যাপারে বরাবরের ন্যায় এবারও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মদত দিয়ে চলেছে। আর এইখানে নিহিত রয়েছে তার শক্তির উৎস। দ্বিতীয়তঃ গণচীনের বর্তমান নেতৃত্ব রয়েছে তার পেছনে কল্পিত যেকোন আক্রমণ মােকাবিলায়, অতএব তাকে আর কে পায়। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, বাঙলাদেশ নয় এ ভারত পাকিস্তান বিরােধ।
রাজস্থানের আন্তর্জাতিক সীমারেখা বরাবর পাক সৈন্য মােতায়েন
জয়পুর থেকে ইউ এন আই জানাচ্ছে, রাজস্থানের আন্তর্জাতিক সীমারেখা বারমার ও গঙ্গারামপুর অঞ্চলে পাকিস্তান প্রচুর পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে।
সীমান্তের ওপার থেকে যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়, সমপ্রতি পাকিস্তানীরা সীমান্তে। গত কয়েকদিন সীমান্ত বরাবর পরীক্ষামূলকভাবে বিপুল পরিমাণে পাক-সেনাবাহিনী, বিশেষ করে রাত্রের দিকে টহল দিচ্ছে।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, বারমার অঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি থেকে অধিবাসীদের জোর করে বাড়িঘর জমিজমা কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষিত মুজাহিদদের গােলাবারুদ সরবরাহ করে ঐ সব গ্রামে বসবাস করতে দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র: কালান্তর, ১৬.১০.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!