You dont have javascript enabled! Please enable it!
একটি নতুন দেশের জন্ম
পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর, ওইদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে যুদ্ধ বিরতি চলছে। অন্যদিকে চলছে বিপরীতধর্মী দুটি আয়ােজন। একদল বুকভরা উল্লাস নিয়ে তৈরি করছে আত্মসমর্পণের কাগজপত্র, অন্যদল লজ্জায়-বিষাদে মাথা চাপড়ে যাচ্ছে।  ১৬ ডিসেম্বর, সকাল আটটা। ঢাকার মিরপুর সড়কের হেমায়েতপুর সেতুর উপর জিপ রেখে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা চিরকুট লিখলেন একটা, ‘প্রিয়। আবদুল্লাহ, আমি এখানে এসে গেছি। তােমার খেলা শেষ। তােমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করাে।’ (নাগরা ও নিয়াজি ব্রিটিশ আর্মিতে একই সাথে কমিশন ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন পূর্ব পরিচিত, ‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৬৩৫)। নাগরা ওই বার্তাটি তার এডিসি মেজর শেঠি ও অন্য দুজন অফিসার মারফত পাঠিয়ে দিলেন নিয়াজির কাছে। বার্তাটি পাওয়ার পর জেনারেল নিয়াজি তার সহকর্মী জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন মিরপুরে, নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। দশটা চল্লিশ, নাগরা তার ক’জন সহকর্মী ও কাদের সিদ্দিকীসহ প্রবেশ করলেন ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টারে, নিয়াজির অফিসে। আত্মসমর্পণের দলিল লিখে নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব ঢাকা পৌছলেন দুপুরের পর। দলিলের অংশ বিশেষ এ রকম, The Pakistan Eastem Command agree to surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Singh Aurora, General Officers Commanding in Chief of the Indian and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all Pakistan land, air and naval forces as also all para-military forces and civil armed forces. These forces will lay down their armes and surrender at the place where they are currently located to the nearest regular troops under the Command Lieutenant General Jagjit Singh Arora” (Bangladesh Documents 2, page 550). 

পাকিস্তানি সেনানায়কগণ দলিলে ব্যবহৃত ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ’ এ অংশের ‘আত্মসমর্পণ’ ও ‘বাংলাদেশের কাছে’—এ ক’টি শব্দের ব্যাপারে আপত্তি জানালেন। উত্তরে জ্যাকব বললেন, দলিলটি দিল্লি থেকে যেভাবে এসেছে, এর বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটানাে যাবে । ইচ্ছে করলে আপনারা গ্রহণ করতে পারেন, অগ্রাহ্যও করতে পারেন। অনন্যোপায় নিয়াজি অবশেষে তার সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। (তবে নিয়াজি তার বই, ‘দি বিট্রেয়্যাল অব ইস্ট পাকিস্তান’-এ লিখেছেন, জেনারেল জ্যাকব তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন। তিনি নাকি নিয়াজিকে বলেছিলেন, শর্ত যদি পুরােপুরি না মানাে, তাহলে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত সকল লােকদের তুলে দেবেন মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই হুমকি শুনে ভারতীয় সেনাশর্ত তিনি মেনে নিয়েছিলেন)।  বিকেল তিনটের পর সস্ত্রীক ঢাকায় এলেন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা একই সাথে এলেন মুজিবনগর সরকার বা

বাংলাদেশের প্রতিনিধি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ আর খােন্দকার, এয়ার মার্শাল ধাওয়ান, রিয়াল এডমিরাল কৃষ্ণানসহ আরাে অনেকে। সেই সময়ে ঢাকার অবস্থার বর্ণনা করেছেন সিদ্দিক সালিক : অরােরা পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে এলেন। বিরাট সংখ্যক বাঙালি জনতা ছুটে গেল তাদের ‘মুক্তিদাতা ও তার পত্নীকে মাল্যভূষিত করতে নিয়াজি তাঁকে স্যালুট দিলেন এবং করমর্দন করলেন। একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্য। বিজয়ী এবং বিজিত দাঁড়িয়ে আছেন প্রকাশ্যে, বাঙালিদের সামনে। আর বাঙালিরা অরােরার জন্য তাদের ভালােবাসা এবং নিয়াজির জন্য তীব্র ঘৃণা প্রকাশে কোনােরকম গােপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে না।
‘উচ্চকণ্ঠে চিৎকার ও শ্লোগানের মধ্য দিয়ে তাদের গাড়ি রমনা রেসকোর্সে এলাে। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিশাল ময়দানটি বাঙালি জনতার উদ্বেল আবেগে ভাসছিল। তারা প্রকাশ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলের (জেনারেলদের নয় কেন?) দর্পচূর্ণের দৃশ্য দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।… পাকিস্তানি বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দলকে হাজির করা হলাে বিজয়ীকে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য। অন্যদিকে একটি ভারতীয় সেনাদল বিজিতের প্রহরায় নিযুক্ত হলাে। প্রায় দশ লাখ বাঙালি এবং কয়েক কুড়ি বিদেশি সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে লে. জেনারেল অরােরা ও লে. জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন। আত্মসমর্পণের নিদর্শনস্বরূপ জেনারেল নিয়াজি তার রিভলবার বের করে অরােরার হাতে তুলে দিলেন। আত্মসমর্পণ সম্পর্কিত আরেকটি বর্ণনায় পাই, ‘সম্পূর্ণ বিপরীত অনুভূতি নিয়ে আত্মসমর্পণ মঞ্চে এগিয়ে গেলেন দুই জেনারেল, অরােরা এবং নিয়াজি।… একজন শিহরিত আনন্দে, অন্যজন মুহ্যমান বিষাদে। মঞ্চের চারপাশে অগণিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। তাদের ক্যামেরাগুলাে আলাে ছড়াচ্ছে বারবার।… মঞ্চের মাঝখানে ফুলশােভিত একটা টেবিল। টেবিলের পাশে বসলেন দুই জেনারেল।… আত্মসমর্পণের দলিলে সই করতে গিয়ে নিয়াজি বড় বিপাকে পড়ে গেলেন। তার কম্পিত হাতের কলম থেকে কালি বেরােচ্ছে না। পাশের একজন নিয়াজির দিকে অন্য একটি কলম এগিয়ে দিলেন। পরাজিত জেনারেল এবার বহু কষ্টে স্বাক্ষর করলেন। তার চোখ থেকে নীরব ধারায় অশ্রু গড়াতে লাগল। আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে একশাে জন পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা এবং একশাে জন জওয়ান তাদের হাতিয়ার মাটিতে রাখল।
এই বহু আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটি দেখে দুলে উঠল উপস্থিত জনতা  ঢাকা নগরীর প্রতিটি বাড়িতে উড়ল বাংলাদেশের পতাকা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল নতুন একটা দেশ—বাংলাদেশ’ (মুক্তিযুদ্ধ। রাজদর্শন : বিধান মিত্র, পৃ. ২৪৫)। জেনারেল জ্যাকব জানিয়েছেন, বাঙালিরা নিয়াজির ওপর এতটাই ক্ষিপ্ত ছিল যে, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আগে ও পরে ভারতীয় সেনারা তাকে বিশেষ সুরক্ষা না দিলে তার প্রাণ সংহারের প্রবল সম্ভাবনা ছিল। জ্যাকব লিখেছেন, তিনি যখন নিয়াজিকে সাথে নিয়ে বিমানবন্দরে যান কলকাতা থেকে আগত জেনারেল অরােরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য, তখন কাদের সিদ্দিকী আগে থেকেই জেনারেল নাগরার সাথে অপেক্ষা করছিলেন সেখানে। জ্যাকব হঠাৎ দেখতে পান, কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে নিয়াজিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। তখন তিনি, “I sensed truble and asked the two paratroopers to shield Niazi. I walked toward Siddiqui. It was imperative that Niazi should livo to sign the instrument of surrender. I was afraid that Siddiqui may have come to shoot Niazi. (Surrender at Dacca, page- 141). আত্মসমর্পণ করার পরবর্তী পর্যায়েও নিয়াজির নিরাপত্তা বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন জ্যাকব : We were concerned about Niazi’s safety, there being hardly any troops available at the Racecource. We senior officers escorted him to an Indian Army Jeep. 
কিছুক্ষণ পর, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী লােকসভা ও রাজ্যসভায় আবেগময়ী ভাষণ দিলেন, I have an annoucement to make. The West Pakistan forces have unconditionally surrendered in Bangladesh. The instrument of surrender was signed in Dacca at at 16.31 hours I S T today by Lt.-General AAK Niazi on behalf of the Pakistan Eastern Command. Lt. General Jagjit Singh Arora, GOC-in-C of the Indian and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre, accepted the surrender. Dhaka is now the free capital of a free country. – -We hope and trust that the Father of the new Nation, Sheikh Mujibur Rahman, will take his rightful place among his own people and lead Bangladesh to peace, progress and prosperity.’
[বি. দ্র. : ১৭ ডিসেম্বর, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রথম পাতায় মােট ১৪টি খবর ছাপা হয়েছিল, এর মধ্যে ৮টি খবরই ছিল উপমহাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত এবং সবগুলােরই ডেটলাইন ১৬ ডিসেম্বর। এর মধ্যে জেমস পি স্টিরার-এর ‘উল্লাস আর পুষ্পস্তবক’ শিরােনামযুক্ত রিপাের্টটি ছিল এ-রকম : ‘পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের চরমপত্র গ্রহণের পরপরই আজ (১৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে এবং ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে উচ্চকিত ভারতীয় সৈন্যরা ট্রাক আর বাসে করে শহরের উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সামরিক ছাউনিতে প্রবেশ করে। কামানের নলে ফুলের মালা জড়িয়ে সশস্ত্র পাকিস্তানিদের পাশ কাটিয়ে ছাউনিতে হাজির হয়।… ঢাকা স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে ফেটে পড়ে। বিজয়ানন্দ উদযাপনে জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসে। বাঙালিরা ভারতীয় সৈন্যদের চুম্বন করে। তাদের দিকে ফুল ছুড়ে মারে। ফুল ছুড়ে মারে বিদ্রোহীদের (মুক্তিযােদ্ধা) দিকেও।… বাঙালিরা ‘জয় বাংলা’ ও শেখ মুজিব শ্লোগানে উচ্চকণ্ঠ হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারি মুসলমান—যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগিতা করে, তাদের ওপর প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য জনতা এগিয়ে গেলে বিদ্রোহীদের এক নেতা তাদের ঠেকিয়ে দেয় এবং বলে, ওরা এখন আমাদের বন্দি। আমরা তাদের মতাে নই। অবশ্যই আমাদের সভ্য হতে হবে’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৫৫৯)]। একদিকের যুদ্ধ শেষ হলাে বটে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে তখনও তুমুল যুদ্ধ চলছে। ওয়াশিংটনের আশঙ্কা, ভারত কি তবে কাশ্মির দখল করে নেবে? পশ্চিম পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলবে? কিন্তু না, ওয়াশিংটনের যুদ্ধোন্মাদদের মতাে বেকুব ছিলেন না নয়াদিল্লির কর্তারা। তাই পশ্চিম পাকিস্তান সময় রাত ৮ টায়, (নিউইয়র্ক সময় শুক্রবার সকাল ৯ টা ১০ মি) ভারত পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তৃপ্তিসহ ঘােষণা করলেন, “আমাদের বিবেচনায় এখন লড়াই চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭.১২.১৯৭১)।
বস্তুত ইন্দিরার এই ঘােষণা ওয়াশিংটন প্রশাসনের উদ্বেগের অবসান ঘটায়। আর এরই সাথে অবসান ঘটে কয়েকটি মহাদেশব্যাপী আন্দোলিত ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের। মাত্র ন’মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে, সশস্ত্রযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার জন্য সেটা যথেষ্টই কম সময়, কিন্তু ওই সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বরূপ বা মাহাত্ম বিচার করা ভুল হবে, কেননা ওই নয় মাসে আমরা যা হারিয়েছি, স্বাধীনতা আনয়নের জন্যে যে মূল্য দিয়েছি—বিশ্বের কোনাে জাতিকেই এতকিছু হারিয়ে, এত দাম দিয়ে কিনতে হয়নি স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের যে আকাশছোঁয়া অর্জন, এর সাথে কেবল বিজয়ের আনন্দই ছিল না, স্বজন হারানাের তীব্র হাহাকার ছিল, গত নয় মাস ধরে দেশি-বিদেশি শত্রু দ্বারা নিষ্পেষিত হওয়ার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশও ছিল, সেই হাহাকার-ক্ষোভের ভেতর দিয়ে অনেকের মনে তখন জ্বলে উঠল প্রতিশােধের অনল। অনেক আবেগ-উন্মত্ত মুক্তিযােদ্ধা স্বদেশি শত্রু-শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, আলবদর, বিহারি এমনকি রেডক্রস ঘােষিত অভয়াশ্রম, যেখানে পাকিস্তানের বেসামরিক লােকজন আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ‘হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল’-এর ওপরও চড়াও হতে চাইল। ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী কিংবা মুক্তিযােদ্ধাদের ইউনিট কমান্ডারগণ, শত চেষ্টা করেও স্বজনহারাদের আবেগ, ক্ষোভ ও ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না। ফলে দেশ স্বাধীন হলাে, আমরাও স্বাধীন হলাম, কিন্তু ‘স্বাধীনতা মানে যে শৃঙ্খলা, মানবিকতা, আইনের অধীনে থাকা—সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপলব্ধিতে আনতে পারলাম না অনেকেই।
স্বাধীনতা, আমার স্বাধীনতা
প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা, (কথাটি হুবহু মনে নেই, তবে এর মর্মার্থ এ-রকম) বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কথাটা খুব রূঢ়, চাঁচাছােলা হলেও অসত্য নয় মােটেই। পাঠান, মােগল, ব্রিটিশ, পাঞ্জাবি—শত শত বছর এদের অধীনে কাটিয়ে আমরা যখন স্বাধীন হলাম, রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার মর্মার্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা প্রত্যেক ব্যক্তিই যেন স্বাধীন হয়ে উঠলাম। আমাদের বােধের গভীরে সঞ্চারিত হলাে, আমাদের দেশ স্বাধীন তাে আমি নিজেও স্বাধীন। আমি কেবল আমার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, আমি আমার ইচ্ছেমতাে যা খুশি করব, যা খুশি…।’ ব্যক্তিক স্বাধীনতা যে রাষ্ট্র কর্তৃক কতগুলাে বিধি-বিধান, নিয়ম-নীতি দ্বারা সুসংবদ্ধ, স্বাধীন হয়েও আমি যে আইনের কঠোর অধীন, এ তত্ত্বটি আমাদের উপলব্ধিতে আসেনি। ফলে নবলব্ধ স্বাধীনতায় প্রমত্ত হয়ে আমরা ভুলেই গেলাম, আমাদের দেশি-বিদেশি অনেক শত্রু আছে, স্বদেশি শত্রুরা পরিস্থিতি বুঝে আপাতত গর্তে লুকিয়ে গেছে বটে, কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়ে এসে শক্তি সঞ্চয় করে যে কোনাে মুহূর্তে ছােবল মারতে পারে…।
‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা দেশে বা দেশের বাইরে থেকে আমাদের শত্রুতা। করেছে, তাদের ছিল নানা রং, রূপ ও প্রকৃতি। শত্রুতার ধরন ছিল বহুমাত্রিক। দেশে যারা শান্তি কমিটি করেছে, রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স হয়েছে, হানাদার পাকিস্তানি শাসকদের তৈরি গভর্নর মালেকের পুতুল মন্ত্রিসভায় যােগ দিয়েছে—এরা সবাই তাে চিহ্নিত, ঘােষিত ও প্রকাশ্য শত্রু। …কিন্তু যেসব শত্রু ছিল অচিহ্নিত, অঘােষিত ও অপ্রকাশ্য, তাদের শত্রুতার কোনাে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধরন ছিল না। এই বহুরূপীরা নানারকম মিত্রের রূপ ধারণ করেই। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষদের মধ্যে মিশে থেকেছে। এরা দেশের ভেতরেও ছিল, দেশের বাইরে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাও বনে গিয়েছিল। দেশের। ভেতর থেকে যারা মিত্রের রূপ ধরে শক্রর দায়িত্ব পালন করেছিল, তাদের। সেই শত্রু-মিত্রের দ্বৈতরূপটি বজায় রেখে কাজ করতে হতাে খুবই সতর্কতার। সঙ্গে, দু’পক্ষের যে কারাে কাছে যে-কোনাে সময় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ও। আশঙ্কা ছিল। দেশের বাইরে গিয়ে যে কপট মানুষগুলাে মুক্তিযুদ্ধের মিত্র। সেজে বসেছিল, তাদের কাজ ছিল অনেক সহজ, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ও আশঙ্কা ছিল অনেক কম।…

নতুন করে যে কনুইয়ের গুতােগুতি শুরু হলাে, তার ধাক্কায় অনেক আসল মুক্তিযােদ্ধাই দৃশ্যপটের বাইরে ছিটকে পড়ল; আর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল না যাদের, তাদের অনেকে পেয়ে গেল। বীরমুক্তিযােদ্ধার পরিচিতি, সীমাহীন হয়ে উঠল তাদের দাপট সত্যি সত্যিই যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, এ-রকম অনেক যুদ্ধফেরত মুক্তিযােদ্ধার ভেতরও। মতলববাজি স্পষ্ট হয়ে উঠল, তারাও নানা ধরনের কোটারি সৃষ্টি করে ধূর্তামির প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ল’ (পাকিস্তানের ভূতদর্শন : যতীন সরকার, পৃ. ২২, ২৩)। | বস্তুত স্বাধীনতার নামে গুটিকতকের স্বেচ্ছাচারিতা, কতিপয় মুক্তিযােদ্ধার । স্বার্থ-নিমগ্নতা, বর্ণচোরাদের অপতৎপরতা, পরাজিত পক্ষের প্রতি। বিজয়ীপক্ষের কারাে কারাে আদর্শবর্জিত দুর্বলতা—সব মিলিয়ে সদ্যস্বাধীন। দেশটি এমনই পাঁকে পড়ে গেল যে, এ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে। পড়ল। স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরই নতুন প্রােপাগান্ডা শুরু হয়ে গেল, এতে কেবল ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা শত্রুরাই নয়, যুক্ত হলাে ছদ্মবেশী । মিত্ররাও—তারা বঙ্গবন্ধুর বন্দিত্বকে সুকৌশলে উপস্থাপন করল ‘আত্মসমর্পণ হিসেবে, মুজিবনগর সরকারের সুবিধাবঞ্চিতরা তাজউদ্দীনকে অপবাদ দিল, ‘ভারতের বিশ্বস্ত দালাল’ হিসেবে, কিছু মতলববাজ দেশে অবরুদ্ধ হয়ে। জীবন-যাপনকারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিসহ সকলকে বাছবিচারহীনভাবে।

বিশেষায়িত করল পাক হানাদারদের সহযােগীশক্তি হিসেবে, বিপরীতে ভারতের আশ্রয়ে থেকে মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্টদেরকে ওরা অপবাদ দিল ‘হাজি’ নামে, বন্দি পাকসৈন্যদের যাবতীয় অস্ত্র সরঞ্জামাদি ভারতের কজায় চলে যাওয়াকে উপস্থাপন করা হলাে ‘ভারতবশ্যতা হিসেবে,এই বহুমুখী সাংঘর্ষিক, অপরিণামদর্শী প্রচার-প্রচারণা, শত্রু-মিত্রকে চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতা, ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুকে সচেতনভাবে আশ্রয়, প্রশ্রয়দান-হায়, আমাদের অর্জিত রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় স্বাধীনতা, অর্জনের মাত্র ক’দিনের মধ্যেই কালিমাযুক্ত, ক্ষতবিক্ষত, আলাে-আঁধারিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
কিন্তু কেন?  এ সম্পর্কে একটি রূপকধর্মী উদাহরণ উদ্ধৃত করছি প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও তাত্ত্বিক যতীন সরকারের বই থেকে, একাত্তরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনাে এক বিকেলে একদল মুক্তিযােদ্ধার উদ্যোগে ময়মনসিংহের টাউন হল ময়দানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। …খুব বেশি লােকসমাগম হয়নি। …সভার বক্তা তথা উদ্যোক্তারা… জানালেন যে মাত্র যুদ্ধ শেষ করেই তারা দেশে ফিরে এসেছেন।… বক্তৃতা যখন চলছিল, তখন বক্তৃতা-মঞ্চের পাশ থেকে হঠাৎ একজন লােক গলার সমস্ত জোর একত্র করে হাঁক ছাড়ল—’নারায়ে তকবির। শ্রোতাতের প্রায় সবাই বেমক্কা এমন চিঙ্কার। শুনে হকচকিয়ে গেলেও মঞ্চের কাছ থেকে পনেরাে/বিশ জন লােক ‘নারা’র জবাবে সমস্বরে বলল—’আল্লা আকবর’। কয়েকবার এ রকম স্লোগান চলার। পর সেই লােকটি আরাে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল—পাকিস্তান’। সভার শ্রোতাদের মধ্যে এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ হয়তাে খুব মারাত্মকই হতাে, কিন্তু সে-রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বদলে সকলকে উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়তে হলাে।

কারণ দেখা গেল : ওই লােকটি পাকিস্তান’ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে নিজের দু’কান টেনে ধরেছে, এবং পরক্ষণেই কান ছেড়ে দিয়ে নিজের দু’গালে চড় কষাচ্ছে, আর জিভ কামড়ে ধরে মাটিতে উঠ-বস করছে। দু-তিন মিনিট ধরে এমন সে করেই চলল, আর তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রোতারা সশব্দ হাসির সঙ্গে দিল করতালি” (পাকিস্তানের ভূতদর্শন, পৃ. ২৩-২৪)। হ্যা, ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও, আমরা এমনই দেশপ্রেমিক ছিলাম যে, কেউ যখন চৈতন্যের ভেতর থেকে, খােদ একটা জনসভায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে কপট দুঃখ প্রকাশের জন্য নিজের দু’গালে চড় কষিয়েছে, আমরা তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, হাততালিও দিয়েছি, একবারও ভাবিনি যে, ওই লােকটা নিজের গালে যে চড় কষাচ্ছে, সে ওই চড়গুলাে মূলত তার গালে দিচ্ছে না, সে চড় কষাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গালে, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির গালে। সেদিন, বিজয় লাভের মাত্র কদিন পরই, আমরা স্বাধীনতাবিরােধীদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে পুরােপুরি ব্যর্থ হয়েছি, আজও হচ্ছি, কেবলই ব্যর্থ হচ্ছি; তাহলে কি মুনতাসীর মামুনের কথাই ঠিক? বঙ্গবন্ধু একটা অনিচ্ছুক ও অপ্রস্তুত জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন? হয়তাে বা, কিন্তু স্বাধীনতার মর্ম ও তাৎপর্য গ্রহণে, এর মাহাত্ম ধারণে আমরা কি এখনও অনিচ্ছুক জাতিই রয়ে গেছি? এর উত্তর মামুনের মতাে কোনাে ধীমান ব্যক্তির কাছ থেকে জানার অপেক্ষায় রইলাম।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!