আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান ও কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন
১৫ ডিসেম্বর স্থির হয়ে গিয়েছিল যে, পরদিন বিকেলে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। খবরটি শােনামাত্র “বেদনাবিদ্ধ কুয়াশা মােড়া শীতার্ত ঢাকা শহরের বুকে ঝকঝকে সােনালি রৌদ্র যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। শতাব্দীর আনন্দ-উল্লাস আর বেদনার বুকে ধরে জেগে উঠল শহর। আপন শহরে পরিত্যক্ত পরবাসী হয়ে যাওয়া মানুষ ভেঙে পড়ল হু হু কান্নায় । কতকাল—কতকাল পরে গৃহ কপােত-কপােতিরা ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলল মুক্ত আকাশে। কোনাে মাংসভুক তাদের আজ তাড়া করে ফিরবে না।এ দিনের আবেগ আর উচ্ছলতার উত্তাপ শরীরে মেখে ঢাকার মানুষ করপুটে তুলে নেয় তার প্রিয় ঢাকা শহরের মাটি। চুম্বন করতে গিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতাে অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে যায় তার করপুট এবং সে সিক্ত মাটির সোঁদা গন্ধে মূর্ত হয়ে ওঠে বাংলা…। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে জয় বাংলা শ্লোগানে। এ এক অবিনাশী ক্ষণ। তুলনারহিত দণ্ড। হাজার বছরের একটি প্রহর। এমন প্রহরেই তাে জন্ম নেয় ইতিহাস। আনন্দ-উল্লাস। আর বেদনা-কষ্টের প্রতীক হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রের বুক চিরে উঠে এলাে নতুন এক দেশ—নাম তার বাংলাদেশ।” (বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন : মাসুদুল হক, পৃ. ৪৩৭)। এই বিজয়স্নাত অনুষ্ঠানে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান, যিনি বিজয়ী যৌথবাহিনী তথা মিত্রবাহিনীরও প্রধান বটে, জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা মিত্রবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করবেন।
অরােরা যুদ্ধকালীন যৌথবাহিনীর প্রধান বটে, কিন্তু তিনি তাে মূল বিজয়ী রাষ্ট্র বাংলাদেশ’-এর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার কথা ওসমানীর, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ-ভারত মিলে ‘যুগ্ম-কমান্ড’ গঠিত হলাে, যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানের মূল দায়িত্ব অর্পিত হলাে ভারতীয় কমান্ডের কাছে, তখন অভিমানহত ওসমানী পদত্যাগের হুমকি (যুদ্ধচলাকালীন এ কাজটা তিনি বারবার করেছেন) দিয়ে তা করেননি বটে, কিন্তু তখন থেকেই তিনি যুদ্ধবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। যেহেতু তিনি সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে যাননি, বা তাঁকে সরানােও হয়নি, অর্পিত দায়িত্ব পালন না করলেও পদাসীনই রয়ে গেছেন, তাই আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে মুজিবনগর তথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তারই প্রতিনিধিত্ব করার কথা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওসমানীকে অনুরােধও করেছিলেন। ওসমানী সে অনুরােধে সাড়া দেননি, বিধায় এ ব্যাপারে তাজউদ্দীনকে অন্য পথ অবলম্বন করতে হয়েছে।প্রশ্ন হলাে, দীর্ঘ ক’মাস যুদ্ধশেষে ইতিহাসের মােড়া শীতার্ত ঢাকা শহরের বুকে ঝকঝকে সােনালি রৌদ্র যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল শতাব্দীর আনন্দ-উল্লাস আর বেদনার বুকে ধরে জেগে উঠল শহর। আপন শহরে পরিত্যক্ত পরবাসী হয়ে যাওয়া মানুষ ভেঙে পড়ল হু হু কান্নায় ।
কতকাল—কতকাল পরে গৃহ কপােত-কপােতিরা ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলল মুক্ত আকাশে। কোনাে মাংসভুক তাদের আজ তাড়া করে ফিরবে না।এ দিনের আবেগ আর উচ্ছলতার উত্তাপ শরীরে মেখে ঢাকার মানুষ করপুটে তুলে নেয় তার প্রিয় ঢাকা শহরের মাটি। চুম্বন করতে গিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতাে অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে যায় তার করপুট এবং সে সিক্ত মাটির সোঁদা গন্ধে মূর্ত হয়ে ওঠে বাংলা…। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে জয় বাংলা শ্লোগানে। এ এক অবিনাশী ক্ষণ। তুলনারহিত দণ্ড। হাজার বছরের একটি প্রহর। এমন প্রহরেই তাে জন্ম নেয় ইতিহাস। আনন্দ-উল্লাস। আর বেদনা-কষ্টের প্রতীক হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রের বুক চিরে উঠে এলাে নতুন এক দেশ—নাম তার বাংলাদেশ।” (বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন : মাসুদুল হক, পৃ. ৪৩৭)। এই বিজয়স্নাত অনুষ্ঠানে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান, যিনি বিজয়ী যৌথবাহিনী তথা মিত্রবাহিনীরও প্রধান বটে, জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা মিত্রবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করবেন। অরােরা যুদ্ধকালীন যৌথবাহিনীর প্রধান বটে, কিন্তু তিনি তাে মূল বিজয়ী রাষ্ট্র বাংলাদেশ’-এর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার কথা ওসমানীর, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ-ভারত মিলে ‘যুগ্ম-কমান্ড’ গঠিত হলাে, যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানের মূল দায়িত্ব অর্পিত হলাে ভারতীয় কমান্ডের কাছে, তখন অভিমানহত ওসমানী পদত্যাগের হুমকি (যুদ্ধচলাকালীন এ কাজটা তিনি বারবার করেছেন) দিয়ে তা করেননি বটে, কিন্তু তখন থেকেই তিনি যুদ্ধবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।
যেহেতু তিনি সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে যাননি, বা তাঁকে সরানােও হয়নি, অর্পিত দায়িত্ব পালন না করলেও পদাসীনই রয়ে গেছেন, তাই আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে মুজিবনগর তথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তারই প্রতিনিধিত্ব করার কথা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওসমানীকে অনুরােধও করেছিলেন। ওসমানী সে অনুরােধে সাড়া দেননি, বিধায় এ ব্যাপারে তাজউদ্দীনকে অন্য পথ অবলম্বন করতে হয়েছে। প্রশ্ন হলাে, দীর্ঘ ক’মাস যুদ্ধশেষে ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়টির সাক্ষী হতে ওসমানী কেন অনীহা প্রকাশ করলেন? তিনি তখন ঢাকা এলেন না কেন? (আমাদের আলাে-আঁধারিমাখা ইতিহাসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনাে ব্যাখ্যা নেই। যিনি এর প্রকৃত ব্যাখ্যা ও কারণ বলতে পারতেন—ওসমানী, তিনি নিজেও এ ব্যাপারে আজীবন নিশ্রুপ থেকে গেছেন। যদিও একবার তিনি বলেছিলেন, তিনি একটা বই লিখছেন, তাতে ১৬ ডিসেম্বর তার ঢাকা নাযাওয়ার সত্যনিষ্ঠ কারণ ব্যাখ্যা করবেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেই রহস্যাবৃত কারণটি আজো আমরা জানতে পারিনি। ফলে এ প্রসঙ্গে নানা জন। নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন—এর মধ্যে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল, বুঝে ওঠা মুশকিল। মূলধারা ‘৭১’ গ্রন্থে মঈদুল হাসান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী বিভিন্ন সমরাঙ্গন সফর করার উদ্দেশ্যে ১১ ডিসেম্বর থেকে কলকাতায় অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যােগ দিতে পারেননি। বস্তুত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি আক্রমণে সিলেটে তাঁর হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয় এবং তিনি ও তার সহযাত্রীগণ অল্পের জন্য রক্ষা পান। পরে তিনি কলকাতা হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন ২৪ ডিসেম্বরে’ (পৃ. ২১৩)।
(বি. দ্র. : মঈদুল প্রথম বলেছেন, ১১ ডিসেম্বর থেকে ওসমানী কলকাতার বাইরে ছিলেন, তাই তিনি ঢাকায় আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। এ কথা বলার পর লেখকের হয়তাে বােধধাদয় হয়েছে, যে জন্য তিনি কলকাতার বাইরে আছেন, সেই কাজের পরিসমাপ্তি তাে ঘটে গেছে ১৫ ডিসেম্বরেই। কাজেই রণাঙ্গনজনিত ব্যস্ততার কারণে ওসমানী ঢাকা যেতে পারেননি, এমন খোঁড়া যুক্তি দেখালে ধােপে টিকবে না। এরপর তিনি বললেন, ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি আক্রমণে (কেউ বলেছেন, মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে) সিলেটে ওসমানীর হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল (১৬ ডিসেম্বর, শত্রুবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনে ওসমানী সিলেটে কী এমন জরুরি কাজ করছিলেন?)। কিন্তু মঈদুল তাঁর বইয়েরই ১৮৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘৭ ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী সিলেটে হেলিকপ্টারযোেগে অবতরণ করার পর মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় সিলেট শহর মুক্ত করে। মঈদুলের কথার সূত্র ধরেই বলি, সিলেট যদি ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে এর নয়দিন পর ওখানে যাওয়ার কী প্রয়ােজন পড়েছিল ওসমানীর? আর ৭ তারিখে যে জায়গাটি মুক্ত হয়েছে, সেই জায়গায় ১৬ ডিসেম্বর ওসমানীর হেলিকপ্টারকে গুলিবিদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা হঠাৎ করে উদিত হলাে কোথেকে?)।
এ বিষয়ে ‘৭১-এর দশ মাস’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন (পৃ. ৬৩৫), ‘প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর থেকে (মঈদুল বলেছেন ১১ ডিসেম্বর) সিলেট রণাঙ্গন পরিদর্শনে কলকাতার বাইরে ছিলেন। পূর্বাঞ্চল সীমান্ত সফর শেষে ফেরার পথে তাঁর হেলিকপ্টার গুলিবিদ্ধ হয়;… তার হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি চালানাের ঘটনাটি এতদিন ছিল রহস্যাবৃত। সম্প্রতি জানা গেছে (তথ্যসূত্রের উল্লেখ নেই), ভুলক্রমে মুক্তিবাহিনী থেকেই গুলি চালানাে হয়েছিল।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে ড. মােহাম্মদ হান্নান জানিয়েছেন (পৃ. ৪৪০) যে, ওসমানীর হেলিকপ্টার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বটে, তবে আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে তাঁর না আসার পেছনে ভিন্ন কারণ ছিল। লেখকের ভাষায়, “অক্টোবরের শেষ দিকে ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের যুগ্ম কমান্ড গঠন করা হয়। কর্নেল ওসমানী এর বিরােধিতা করেন, কার্যত তিনি পদত্যাগ করেন (মঈদুল বলেছেন, পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন, করেননি)। বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খােন্দকার—মূলত এই সময় প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আর এ জন্যই মূলত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে ওসমানী নয়, এ কে খােন্দকারই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন (এটি একেবারেই নতুন তথ্য বটে)।
মঈদুল, হান্নান, ত্রিবেদী—এই ত্রয়ী লেখক একটা ব্যাপারে একমত যে, ১৬ ডিসেম্বর ওসমানী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন, তাই ঢাকার আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। এবার আমরা অন্য তিনজনের লেখা উদ্ধৃত করব, যাঁদের মতে ১৬ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতাতেই ছিলেন (তাকে জড়িয়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার তথ্যটি—স্রেফ আষাঢ়ে গল্প), তিনি স্বেচ্ছায় ওই অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন। এই তিনজন লেখকের মধ্যে প্রথম দুজন দাবি করেছেন, ১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন যখন ওসমানীর বাসভবনে গিয়ে তাকে ঢাকায় যেতে অনুরােধ করেছিলেন, সেই সময়টিতে তাঁরা তাজউদ্দীনের সাথেই ছিলেন। তবে লক্ষণীয় যে, এই দুজন প্রত্যক্ষদর্শী-এম আর আখতার মুকুল ও মুহাম্মদ নূরুল কাদির একই বিষয়কে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, এর মধ্যেও অমিল আছে যথেষ্ট মুকুল তার ‘আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থে লিখেছেন (পৃ. ৩০৯), “তাজউদ্দীন আহমদ ধীর পদক্ষেপে তাঁর ছােট্ট অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে সচিবালয়ের অন্য পার্শ্বে অবস্থিত প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর সুরক্ষিত অফিসের দিকে এগিয়ে গেলেন। পিছনে আমরা কয়েকজন।… সামরিক পােশাক পরিহিত ওসমানী সাহেব নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন।… ওসমানী সাহেব তাকে করিডােরের আর এক কোনায় নিয়ে গেলেন। দুজনের মধ্যে মিনিট কয়েক কী কথাবার্তা হলাে আমরা তা শুনতে পেলাম না। এরপর দুজনেই আবার আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ওসমানী সাহেবের শেষ কথাটুকু শুনতে পেলাম, ‘ননা, নাে প্রাইম মিনিস্টার, মাই লাইফ ইজ ভেরি প্রেশাস, আই কান্ট গাে’ (না, না, প্রধানমন্ত্রী, আমার জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আমি যেতে পারব না)। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদকে তখন বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।”
একই ঘটনার অন্য একজন সাক্ষী নূরুল কাদিরের ‘দুশাে ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ নামক গ্রন্থে পাই (পৃ. ৩৩৯), “প্রধানমন্ত্রী আতাউল গনি ওসমানীর অফিস কক্ষে যেয়ে তাকে ঐদিন বিকালে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরােধ জানালেন।… সে সময় অনেকের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। জেনারেল ওসমানী উক্ত অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য ঢাকায় যেতে কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ তাঁর আত্মসম্মানবোেধ ছিল অসাধারণ। জেনারেল ওসমানী অকাট্য যুক্তি দেখালেন যে, যেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ যাচ্ছেন না, সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনিও যেতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সন্তুষ্টচিত্তে প্রধান সেনাপতির ঐ যুক্তি মেনে নিলেন।… তাই ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খােন্দকারকে… পাঠানাে হলাে।” একই বিষয়ে সিরাজ উদ্দীন আহমেদ তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামক গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় (পৃ. ৪৭৯) স্ববিরােধী দুটি মত উপস্থাপন করেছেন, যা হান্নান ও মঈদুলের মত থেকে একেবারেই ভিন্ন। সিরাজ উদ্দীন লিখেছেন, আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে, “ভারতীয় বাহিনী চাচ্ছে ওসমানী উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও সেনাপতি ওসমানীর সাথে আলােচনাকালে বিশিষ্ট সাংবাদিক চরমপত্র লেখক-পাঠক এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন।… তাজউদ্দীন আহমদ সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে ঢাকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুরােধ জানান। ওসমানী ভয় পেলেন, ঢাকা গেলে পাক সেনারা হয়তাে তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে।
সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আমি ঢাকা যেতে পারব ।” (বস্তুত এই মতটি মুকুলের মতের অনুরূপ। তবে এখানে বাড়তি কথা হলাে, ‘ওসমানী ভয় পেলেন বাক্যটি; এ বাক্য সেনাপতি ওসমানী চরিত্রের শশাচনীয় ভীরুতাকে তুলে ধরে, যিনি কি না একটা বিজয়ী বাহিনীর প্রধান হয়েও, বিজয়ের মাল্য গলায় পরার অনুষ্ঠানে যেতে পরাজিত আত্মসমর্পণকারী বাহিনীকে ভয় পাচ্ছেন, তাকে মেরে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন? প্রশ্ন হলাে, বন্দি বাহিনীর সামনে যেতে যিনি ভয় পান, তিনি এতদিন ওই বাহিনীর বিপক্ষেই কেমন করে যুদ্ধ পরিচালনা করে গেলেন? তাই বলা যায়, সিরাজ উদ্দীনের এই উদ্ধৃতাংশটুকু বালখিল্যতাদুষ্ট। তাছাড়া একজন সেনাপতি কি তাঁরই দেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরােধ এভাবে উপেক্ষা করতে পারেন?) লেখক সিরাজ উদ্দীন একটু পরেই তার পূর্ববর্তী মত থেকে সরে গিয়ে নতুন কথা বলেছেন, “জেনারেল ওসমানী অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় পদমর্যাদার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধান সেনাপতি মানেকশ থাকবেন না, সুতরাং একটি স্বাধীন দেশের সেনাপতি হিসেবে তার চেয়ে নিচের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়।” (হায়রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং এর লেখকগণ, মাত্র কয়েকটি লাইন আগে যে লেখক বলেছেন, মৃত্যুভীতি থেকে ওসমানী ওই অনুষ্ঠানে যাননি, এবার তিনিই বলছেন, যেহেতু ওসমানী একটা দেশের সেনাপ্রধান, কাজেই ওই অনুষ্ঠানে ভারতের সেনাপ্রধান উপস্থিত না হয়ে একজন নিম পদমর্যার অফিসার প্রতিনিধিত্ব করবেন বিধায় ওই অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হননি। একই সাথে দুটি পরস্পরবিরােধী, সাংঘর্ষিক মত প্রদান করা, বােধহয় আমাদের ইতিহাসেই সম্ভব।
এবার আসি মুকুল ও কাদিরের কথায়; একই সময়ে একই ঘটনাস্থলে থেকে মুকুল শােনলেন, ওসমানীর কণ্ঠ ‘না, না আমি ঢাকা যেতে পারব না। এবং এ কথা শােনার পর তিনি তাজউদ্দীনকে উত্তেজিত হতে দেখলেন; আর। নুরুল কাদির শােনলেন, ওসমানী কেন ঢাকা যাবেন না, এ সম্পর্কে তাজউদ্দীনকে প্রদেয় ওসমানীর যৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং তিনি এও দেখলেন যে, ওই ব্যাখ্যাকে তাজউদ্দীন সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছেন; সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র আমাদের ইতিহাসচর্চা। কথা হলাে, ওসমানী সেই অবিস্মরণীয় আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে যাননি, এর জন্য ইতিহাস থেমে থাকেনি, কিন্তু তিনি সেদিন কলকাতাতেই ছিলেন, নাকি সিলেট সীমান্তে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন—এটা কোনাে স্থূল বিষয় নয় যে, এ নিয়ে। ইতিহাসকারেরা কল্পিত উপাখ্যান তৈরি করে যাবেন। সেদিন তার ঢাকা না আসার প্রকৃত কারণটি ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকলে, বাঙালি যে ইতিহাসবিমুখ জাতি-বঙ্কিমচন্দ্র কথিত সেই অভিযােগটি আবারাে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যায় । যা হােক, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে ওসমানীর অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে সেদিন নানা মুনি নানা মত পেশ করেছিলেন। এর মধ্যে মিত্ৰবেশী ভারতের আগ্রাসনতত্ত্বেরও পূর্বাভাস দেখেছিলেন কেউ কেউ। তাদের অনুভূতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন যতীন সরকার, কীসের মুক্তিযুদ্ধ আর কীসের স্বাধীনতা; মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে ডিসেম্বর মাসে হিন্দুস্থানের সৈন্যরা আমাদের দেশের ভেতর ঢুকে পড়ে, আর পাকিস্তানের সৈন্যরা তাে আত্মসমর্পণ করে হিন্দুস্থানের সেনাপতির কাছেই। পাকিস্তানি সৈন্যদের রেখে যাওয়া বিপুল অস্ত্রশস্ত্র লুট করে হিন্দুস্থানি সৈন্যরাই তাদের দেশে নিয়ে যায়।
শুধু কি অস্ত্রশস্ত্রই? সােনাদানাসহ আরাে বেশুমার সম্পদই ওরা লুটপাট করেছে। কেবল লুটপাট করেই ওরা ক্ষান্ত হবে ভেবেছ? আস্তে আস্তে এই দেশটাকেই ওরা দখল করে নেবে না? এখনই-বা দখলের বাকিটা কী রেখেছে?… এই যাকে তােমরা স্বাধীন বাংলাদেশ বলছে, সেটি কি সত্যিই একটি স্বাধীন দেশ? যে সরকারটিকে দেখছাে, সেটি একটি স্বাধীন সরকার? আরে বাবা, এ সরকারটি তাে হিন্দুস্থানের পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়। হিন্দুস্থান যেমনভাবে এই পুতুলটাকে নাচাবে, তেমনভাবেই এটি নাচবে। এবং (লেখক) খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এদের এ-ধরনের কথাবার্তা ব্যাপক গ্রহণযােগ্যতা পেতে থাকে’ (পাকিস্তানের ভূতদর্শন, পৃ. ৩৭)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র