You dont have javascript enabled! Please enable it!
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড : নীলাকাশে ছেয়ে যাওয়া মেঘ
ইয়াহিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধবিরতি টানার অনুমতি পাওয়ার পর নিয়াজি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতীয় বিমান। আক্রমণের ক’দিন আগেই ঢাকার ট্রান্সমিটার বিকল হয়ে গিয়েছিল, ফলে এর মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপন করা সম্ভব ছিল না, বিধায় অনন্যোপায় নিয়াজি ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাকের শরণাপন্ন হন। এবং বেশ ক’টি শর্তযুক্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ভারতীয় সেনাপতি মানেকশ’র কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে জনাব স্পিভাককে অনুরােধ করেন। স্পিভাক ‘যুদ্ধবিরতি’ বিষয়ক প্রস্তাবটি দিল্লিতে না পাঠিয়ে প্রেরণ করেন ওয়াশিংটনে। সেখানকার কর্মকর্তারা বার্তাটির সত্যতা (প্রকৃতপক্ষে সময়ক্ষেপণ করার জন্য) ইয়াহিয়া কর্তৃক যাছাইয়ের জন্য সেটি পাঠিয়ে দেন ইসলামাবাদস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের কাছে। সেখান থেকে এই বার্তার সত্যতার সপক্ষে যথাযথ প্রমাণাদি পাওয়ার পর সেটি প্রেরণ করা হয়। নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং-এর কাছে। কিটিং আরাে দেড় ঘণ্টা সময় কাটিয়ে সেটি হস্তান্তর করেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে [(আত্মসমর্পণমূলক প্রস্তাবটি স্পিভাকের হস্তগত হয় বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র বিভাগ সেটা গ্রহণ করে সন্ধ্যে ৭.৪৫ মিনিটে; সেটি ফারল্যান্ড কর্তৃক যাচাই-বাছাই হতে হতে রাত ৩.৩০ বেজে যায়; সেখান থেকে কিটিং-এর কাছে পৌছে দুপুর ১২.৫৬ মিনিটে; কিটিং আরও দেড়ঘন্টা পরে অর্থাৎ ২.৩০ মিনিটে সেটি হস্তান্তর করেন যথাস্থানে) দি এন্ডারসন পেপার, পৃ. ২৬৭-৬৮]।
শান্তিপ্রতিষ্ঠার অতিগুরুত্বপূর্ণ এই বার্তা নিয়ে ওয়াশিংটনের চাতুর্যপূর্ণ কালক্ষেপণের কারণ কী? এর যথাযথ কারণ বােধহয়, ‘যদিও যে কোনাে বার্তা তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর যে কোনাে প্রান্তে পাঠাবার মতাে ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল, তবু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ এই বার্তা—যা অবিলম্বে পৌছলে ঢাকায় বন্দি কিছু বুদ্ধিজীবীসহ অনেকের প্রাণ হয়তাে রক্ষা পেত-সংশ্লিষ্ট প্রাপকের কাছে তা পৌছাতে প্রায় একুশ ঘন্টা অতিবাহিত হয়। এই অসাধারণ বিলম্ব থেকে অনুমান করা চলে, বার্তাবাহক মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করার সকল অবশিষ্ট সম্ভাবনা ইতােমধ্যে অন্বেষণ করেছেন’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ২১০)। লাখ লাখ মানুষের জীবনকে জিম্মি করে ওয়াশিংটনের এমন নির্মম মানবিকতাবর্জিত চাতুর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত এর আগেও আমরা লক্ষ করেছি। ১০ ডিসেম্বর, গভর্নর মালেক ও জেনারেল নিয়াজি কর্তৃক প্রস্তাবিত এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক অনুমােদিত ‘যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব’ দুই যুদ্ধ-উন্মাদ নিক্সন-কিসিঞ্জারের বাধার মুখে কার্যকর করা যায়নি। এর ফলে যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে পারত ডিসেম্বরের ১১/১২ তারিখ, সেটির সময়কাল আরাে ক’দিন বেড়ে গেল। এ ক’দিনে যারা হত হয়েছেন, যত সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, এই দায় কার? ক’টি ক্লান্ত, যুদ্ধানিচ্ছুক, মুমূর্ষ মানুষকে যুদ্ধের জন্য দাঁড় করিয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সেদিন কী অর্জন করতে চেয়েছিল? পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটির পরাজয় রােধ? নাকি ভিয়েতনাম যুদ্ধে খুইয়ে যাওয়া সম্মান ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার? যুক্তরাষ্ট্রের একটা হটকারী, অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের জন্য আমরা স্বাধীনতা থেকে সরে গেছি পাঁচদিনের দূরত্বে, হারিয়েছি অগণিত প্রাণ-আবারাে পাকিস্তান প্রদত্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে সেই দেশেরই কূট-প্রতারণার ফলে আমরা স্বাধীনতা থেকে সরে গেছি আরাে দুদিন দূরে এবং ওই দুদিনের প্রথম দিনটাতে আমরা হারিয়েছি, আমাদের দেশসেরা ক’জন জ্ঞানী, গুণী মহাত্মাকে।
একাত্তরের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার জন্য আমরা কেবল পাকিস্তানের দোষ খুঁজেই তুষ্ট হয়ে থাকি, একবারও ভাবি না যে, তখন পাকিস্তান নামক ‘ছাগলটি যে খুঁটির জোরে নেচেছিল, সেটি নিছক নির্লিপ্ত খুঁটিই ছিল না, এর প্ররােচনা, দুর্বুদ্ধি দান বা সরাসরি আঘাতে আমরা কম রক্তাক্ত হইনি, কম ঐশ্বর্য হারাইনি।  মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে, অর্থাৎ ২৫ মার্চের কালােরাতে ড. গােবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মােঃ মনিরুজ্জামানসহ বেশ ক’জন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। ৭ নভেম্বর, ইসলামি ছাত্রসংঘ যেদিন সারা দেশে ঘটা করে বদর দিবস’ পালন করে, প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পিত আয়ােজন (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৪২৫)। ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া কর্তৃক সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর বুদ্ধিজীবীদের কাছে মৃত্যুর পরওয়ানা সংবলিত চিঠি পৌছুতে থাকে। চিঠির কথা ছিল এরকম, “তােমাদের মনােভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনােটাই আমাদের অজানা নয়। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তােমার নিস্তার নেই। এ চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও’ (একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃ. ১৪১)। এ সময় পাকবাহিনীর বেশ ক’জন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার বশির, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম প্রমুখের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বদরবাহিনীর অসংখ্য সদস্যকে বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়।
এ সম্পর্কে ভারতের খ্যাতিমান সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দি নিউ এজ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সদ্যগঠিত ‘গণহত্যা তদন্ত কমিটির সভাপতি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের (ক’দিন পর, স্বাধীন দেশে, তিনি নিজেও শহীদ হয়েছিলেন) বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বজনরা যখন নিহত ভাইদের দেহের অবশেষ ঢাকার বধ্যভূমিতে খুঁজে ফিরছিলেন, তখন আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, দখলদার পাকিস্তানিরা নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করে কাপুরুষােচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি, ঘটনা তা ছিল না। কেননা এই হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছেন, তারা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি স্থানীয় এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী মনােভাবের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। “আলবদর বাহিনীর ধর্মান্ধ ও মূর্খ লােকদের কাছে সব লেখক ও অধ্যাপকই এক রকম ছিলেন। কিন্তু হত্যাকারীরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে। এ থেকে একটা সিদ্ধান্তেই পৌছানাে যায় যে, আল বদরের এই স্বেচ্ছাসেবকরা অপরের ইচ্ছা কার্যকর করার বাহন ছিল মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, কারা এই খুনিদের পেছনে ছিল? সংগৃহীত দলিল ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি থেকে জানা যায়, শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তানদের হত্যার কাজে নিয়ােজিত অন্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত গুণ্ডাদেরকে আলবদর বাহিনীকে যারা সংগঠিত করে, তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে জড়িত। “পূর্ব-উল্লিখিত পাকিস্তানি জেনারেলের (বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক জেনারেল রাও ফরমান আলী) ডায়রিতে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, ইতঃপূর্বে।
দুজন আমেরিকান নাগরিক ঢাকা সফর করে, এরা হলাে হেইট ও ডুসপিক। এদের নামের পাশে ছােট ছােট অক্ষরে ইউএসএ ও ডিজিআইএস অর্থাৎ ডিরেক্টর জেনারেল অব ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস লেখা ছিল। আর লেখা ছিল—“রাজনৈতিক ৬০-৬২, ৭০’। অপর এক জায়গায় লেখা—দুজন আমেরিকান পিআইএ-র একটি বিশেষ বিমানে ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে।  “হেইট ও ডুসপিক কে? ঢাকার দৈনিক বাংলার রিপাের্টে দেখা যায়, হেইট ১৯২৮ সালে জন্ম গ্রহণ করে। সে ১৯৪৬-‘৪৯ সাল পর্যন্ত সৈন্য বাহিনীতে চাকরি করেছে। ১৯৫৩ সাল থেকে সে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৫৪ সাল থেকে সে আমেরিকান দূতাবাসের রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ হিসেবে বহু দেশ ভ্রমণ করেছে। সে কলকাতা ও কায়রােতেও ছিল। সিআইএ-র এজেন্ট ডুসপিকের সাথে গত বছর সে ঢাকায় ফিরে আসে এবং রাও ফরমান আলীর সাথে তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা তৈরি করে। জেনারেলের শােবার ঘরে এই তালিকা পাওয়া গেছে। নিহত বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, আলবদর বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যার কাজে বিদেশি মুখােশ, ছদ্ম পােশাক ও ছােরা ব্যবহার করা হয়েছে। গণহত্যা তদন্ত কমিটির রিপাের্ট থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। “স্বভাবতই পাকিস্তানি সেনাপতি ও সিআইএ-চরদের মধ্যকার এই যােগাযােগ গােপন ব্যাপার ছিল। আলবদর বাহিনীর সাধারণ কর্মীরা এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। আবার এই সন্ত্রাসবাদী সংস্থার হােতারা এবং জামায়াতে ইসলামী দলের নেতারা অনুগামীদের মনােবল বাড়ানাের আশায় আমেরিকা ও পিকিং নেতাদের সাথে পাকিস্তানের সামরিক একনায়কের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা প্রচার করত। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার জামায়াতে ইসলামীর সম্পাদক-প্রকাশিত এক প্রচারপত্রের ভাষা হলাে : বিদেশে আমাদের বন্ধুরা আছেন।
চীন ও আমেরিকা আমাদের সমর্থক বন্ধু দেশ।” উল্লেখ্য, রাও ফরমান আলীর ডায়রিতে যে দুজন সিআইএ এজেন্টের নাম পাওয়া গিয়েছিল, তারা ইন্দোনেশিয়ায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল এবং সেজন্য ইন্দোনেশীয় সরকার তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারও করেছিল’ (একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃ. ১২০-২১ থেকে  [বি. দ্র. : বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে জহির রায়হান অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর তথ্য মােতাবেক বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জেনারেল রাও ফরমান আলী, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় ও ধরন সম্পর্কে উপদেশ দানকারী দুজন আমেরিকান-হেইট ও ডুসপিক, পরিকল্পনা কার্যকরকারী হলাে আলবদর বাহিনী। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত তথ্য উদঘাটিত হওয়ার আগেই ৩০ জানুয়ারি ‘৭২ ‘গণহত্যা তদন্ত কমিটির সভাপতি জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। আমাদের বিজয় লাভের প্রায় দেড় মাস পরে ‘জহির রায়হানকে নিখোজ করে দেয়া তথা এমন একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আলবদর বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ তারা তখন নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, বা জহির রায়হান কর্তৃক প্রণীতব্য রিপাের্ট নিয়ে তাদের নতুন ভীতির কারণ ছিল না, কেননা তারা তাে এর আগের অপকর্মের জন্যই দোষী সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জেনারেল রাও ফরমান আলী বা অন্য কোনাে পাকিস্তানি দ্বারা জহির রায়হান নিহত হওয়ার কারণ দেখি না। কেননা পাকিস্তান আর্মি অফিসাররা তখন ভারতীয় সেনাদের কজায় বন্দি। বাকি রইল মার্কিন সিআইএ–যারা পরাজিত পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী হলেও বন্দিত্বের শেকল থেকে মুক্ত ছিল। তৎকালীন মার্কিনি জনগণ নিক্সন-কিসিঞ্জারের যুদ্ধনীতিকে সমর্থন করেনি, এর উপর এই যুদ্ধে নিক্সন-কিসিঞ্জারের শােচনীয় পরাজয়ের কারণে ওই দেশের জনগণ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল খুব। এর মধ্যে যদি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে মার্কিনি সম্পৃক্ততা বেরিয়ে যেত, তথ্য উদঘাটনের যে কাজটা সুচারুভাবে করে যাচ্ছিলেন জহির রায়হান, তাহলে নিক্সন-কিসিঞ্জারের গদিতেই টান পড়ত হয়তাে।
অতএব অনুমান করতে পারি, জহির রায়হানের রিপোের্ট যাতে বেরােতে না পারে, সেজন্য মার্কিন প্রশাসন তৎপর ছিল খুব এবং এর সূত্র ধরেই অঘটনপটিয়সী সিআইএ-ই হয়তাে জহির রায়হানকে ‘নিখোঁজ’ করে দিয়েছিল। গণহত্যা তদন্ত কমিটি’তে জহির রায়হান ছাড়াও এহতেশাম চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এনায়েতুল্লাহ খান, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ গণ্যমান্য তাে সদস্য হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, একজন ‘নিখোঁজ হওয়ার পর বাকি সদস্যরা অসমাপ্ত তদন্তকাজ থামিয়ে দিয়েছিলেন কেন? তাদের মধ্যে কি ‘নিখোজভীতি কাজ করেছিল? এ বিষয়ে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হলাে, ওই তদন্ত কমিটি যা কিছু তথ্যপ্রমাণ উদ্ধার করেছিল, এর একাংশও কমিটির কারাে কাছেই সংরক্ষিত রইল না, পুরােটাই হস্তগত হয়ে গেল জনৈক ভারতীয় সাংবাদিকের এবং তা নিয়ে তিনি স্বদেশে চলে যান, এ তথ্যাদি তিনি আর ফেরত দেননি, আমরাও চেষ্টা করিনি তা ফেরত পেতে—ব্যাপারটা আষাঢ়ে গল্প মনে হয় না? ‘জাতীয় তদন্ত কমিটির গােপনীয় রিপাের্ট-ফাইল একজন বিদেশি সাংবাদিক মেরে দিয়েছেন, এটা বিশ্বাসযােগ্য তথ্য? ব্যাপারটা কি এমন হতে পারে না, একটা মার্কিনি চক্র জহির রায়হানকে ‘নিখোঁজ’ করে দিয়ে তাঁর অনুসন্ধানমূলক রিপাের্টটিকে ‘গায়েব করে দেবার নিমিত্তে তা পাচার করে দিয়েছিল ওদেরই আস্থাভাজন ভারতীয় সাংবাদিকটির কাছে? কিন্তু গােপনীয় একটা রিপাের্ট ভারতীয় সাংবাদিকের হাত অবধি পৌছে দিল কে? বাইরের কারাে দ্বারা এমন কাজ করা সম্ভব কি?
নিশ্চয়ই নয়, তাহলে এ কাজটা করেছে ভেতরের কেউ, কিন্তু কে সে? ২১ ডিসেম্বর, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের জোর সমর্থক প্রাক্তন ব্রিটিশ মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার ও তাদের সহায়তাকারী বঙ্গদেশীয় দালালদের চিহ্নিত করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন; এ ব্যাপারে একটা আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে তদন্ত কাজ পরিচালনার জন্য তিনি আহ্বান রেখেছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে আমরা স্টোনহাউজের শরণাপন্ন হইনি, আর জহির রায়হান ‘নিখোঁজ’ হবার পর, হয়তাে নিজেরা ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টাও করিনি। জহির রায়হান ‘নিখোঁজ’ হবার পর ৮ ফেব্রুয়ারি ‘৭২, তাঁর পরিবারকে কথা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু—জহির রায়হানের অন্তর্ধানসহ সকল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত চালানাে হবে এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে এর রিপাের্ট পাওয়া যাবে, কিন্তু সেই রিপোের্ট আলাের মুখ দেখেনি আর]।
‘যুদ্ধবিরতি নয় ‘আত্মসমর্পণ
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন জেনারেল নিয়াজি—এই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৫ ডিসেম্বর আবারাে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথভাবে প্রস্তাব করে বলে যে, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা দরকার। আর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এবং রাজনৈতিকভাবে সকল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। পােল্যান্ড কর্তৃক উত্থাপিত অন্য আরেকটা প্রস্তাবে বলা হয়, পাকভারত সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। ওই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আগত সহকারী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো অমার্জিত ভাষায় জাতিসংঘের সমালােচনা করে বলেন যে, এটি জালিয়াতি ও ধোঁকাবাজির পীঠস্থান, যে কেবল কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে বেড়ায়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমালােচনা করে তিনি বলেন, এই দুটি দেশ সুস্পষ্টভাবে কোনাে পক্ষ না নেয়ার কারণেই পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে কোনাে চুক্তি সম্পাদিত হতে পারল  ভুট্টো আরাে বলেন, এটাই বােধহয় আমার শেষ বক্তৃতা, আমরা এখানে আত্মসমর্পণ করতে আসিনি। এরপর তিনি সবাইকে বিস্ময়াবিষ্ট করে দিয়ে ‘যাচ্ছি চললাম যুদ্ধ করতে বলে খসড়া প্রস্তাবের পাতাগুলাে ছিড়তে ছিড়তে অধিবেশন স্থল থেকে বেরিয়ে যান। এ দিকে ১৪ ডিসেম্বর, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায় নিয়াজি প্রেরিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মার্কিনি চাতুর্যের কারণে যথাস্থানে পৌছতে অযথা কালক্ষয় হয়েছে একুশ ঘণ্টা, এবার নতুন জটিলতা দেখা দিল এজন্য যে, নিয়াজির প্রস্তাবে কেবল যুদ্ধবিরতির কথা আছে, আত্মসমর্পণের কথা নেই।
নিয়াজি-প্রেরিত প্রস্তাবের মূলকথা হলাে, ‘যুদ্ধবিরতির পর অস্ত্রশস্ত্র সমেত পাকিস্তানি বাহিনীকে কোনাে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে স্পষ্টতই দক্ষিণ উপকূলভাগে—জমায়েত হওয়ার পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। ১৯৪৭ সাল থেকে যেসব বহিরাগত পূর্ব বাংলায় বসবাস করে এসেছে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এর মার্চ থেকে পাকিস্তানি শাসনের সঙ্গে সহযােগিতা করেছে, তাদের যাতে কোনাে ক্ষতি না হয় তার মধ্যে নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ২১১)। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখলেন যে, নিয়াজির এ প্রস্তাবে ফাক ও ফাকি আছে যথেষ্ট। (১) এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গত মার্চ মাস থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের অনুকূলে কাজ করেছে, তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে; প্রশ্ন হলাে, উল্লিখিত সময় থেকে পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হয়ে যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন জাতীয় ঘৃণ্য কাজ করেছে, এদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কেবল বাংলাদেশ সরকারই সংরক্ষণ করে। (২) পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্রসমেত দক্ষিণের কোনাে উপকূলবর্তী এলাকায় জমায়েত হবার সুযােগ করে দিলে, তারা যে বঙ্গোপসাগরপামী সপ্তম নৌবহরের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে, এর কি কোনাে নিশ্চয়তা আছে? (৩) এই প্রস্তাবে কাশ্মির সীমান্তের চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে কোনাে কথাই নেই; (৪) বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল সৈন্যকে যদি অস্ত্রসমেত পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের সুযােগ দেয়া হয়, ওই পরাজিত সৈনিকরা কাশ্মির এলাকায় গিয়ে প্রতিশােধ গ্রহণের স্পৃহায় মত্ত হয়ে উঠবে না, এর কি কোনাে নিশ্চয়তা আছে?
সকল অনিশ্চয়তার সমাধানকল্পে মানেকশ নিয়াজির ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং রণাঙ্গনের সার্বিক অবস্থা তার অনুকূলে বিধায় দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বললেন, ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণই হতে পারে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার একমাত্র ভিত্তি। আমি আশা করি, আপনি বাংলাদেশে অবস্থানরত আপনার আজ্ঞাবহ সৈনিকদের অবিলম্বে যুদ্ধ থামাতে বলবেন এবং আমার আগুয়ান সেনাবাহিনীকে যেখানেই দেখা যাবে সেখানেই তাদের কাছে। আপনার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার হুকুম দেবেন। এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে যদি ইতিবাচক সাড়া পাই, তাহলে আমি পূর্বাঞ্চলীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরােরাকে নির্দেশ দেব, তিনি যেন আপনার বাহিনীর বিরুদ্ধে। আকাশ ও স্থল আক্রমণ আপাতত বন্ধ রাখেন (ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৬ ডিসেম্বর, ‘৭১)।
মানেকশ-র এই চরম শর্ত অগ্রাহ্য করা নিয়াজির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ পাকিস্তানি বাহিনী তখন মিত্রবাহিনী কর্তৃক চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। পালিয়ে যাওয়া বা প্রতিরােধ গড়ে তােলা—কোনােটাই সম্ভব নয় আর। সপ্তম নৌবহরের স্থলসংযােগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে স্থানটুকু দরকার, তা-ও এখন মিত্রবাহিনীর করায়ত্তে। কাজেই কোনাে বিদেশি শক্তি বা নিজেদের শক্তি কোনােটাতেই বিন্দুমাত্র ভরসা করার উপায় নেই নিয়াজির। অনন্যোপায় নিয়াজি সিদ্ধান্ত নেন, শর্তহীন আত্মসমর্পণের এবং এ প্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল ছয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান। আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়। এর পরে অবশ্য জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলির মাধ্যমে ‘যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরাে ছ’ঘণ্টা বাড়ানাের জন্য ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন, যাতে অস্ত্র সমর্পণ-প্রক্রিয়া স্থির করার জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে পাওয়া যায়।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!