You dont have javascript enabled! Please enable it!
যুদ্ধ ছড়িয়ে গেল জাতিসংঘে
ভারত-বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান যখন রণাঙ্গনের যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন জাতিসংঘে ভারত-বিরােধী সর্বাত্মক কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৪ ডিসেম্বর, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপসংস্থা ডব্লিউএসএজি-র বৈঠকে মার্কিন ‘জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেন, পাকিস্তানের সামরিক সরবরাহ পরিস্থিতি এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়ে যেতে পারে। অ্যাডমিরালের কথা শুনে কিসিঞ্জারের একক ব্যগ্রতায় নিক্সন প্রশাসন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন আহ্বান করে। অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস রে আশা প্রকাশ করেন, ভারত উপমহাদেশের ক্রান্তিকালে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন কেউ যেন ভেটো প্রয়ােগ করে আলােচনার পথ রুদ্ধ করে না দেয়। সেই সাথে তিনি আরাে মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের কারণেই এই সমস্যার জন্ম। অধিবেশনের শুরুতেই চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে অ্যাখ্যায়িত করেন ভারতের লেলায়িত কুকুর’ হিসেবে। মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ দুই দেশের মধ্যে “অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমান্তের ভিতরে ফিরিয়ে নেয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে সমস্যার মূল কারণ তথা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর দীর্ঘ নির্যাতন এবং তার ফলে সৃষ্ট শরণার্থীর ভিড় ও সমস্যা জর্জরিত ভারতের অবস্থা বিবেচনা না করে ভারত ও পাকিস্তানকে একই মানদণ্ডে বিচার করায়, দোষী-নির্দোষ উভয়কে একই পাল্লাতে ওজন করায় সােভিয়েত প্রতিনিধি প্রস্তাবকে একতরফা বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়ােগ করেন। পােল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভােট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভােটদানে বিরত থাকে।’
(মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৮১)। অন্যদিকে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ দুটির প্রতি আহ্বান জানায়। আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, সিয়েরালিয়ন ও সােমালিয়া পাক-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উভয় দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। (‘৭১-এর দশ মাস : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, পৃ. ৫৫০)।  ওইদিন ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার ৮ কলামের শিরােনাম ছিল ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-করাচি ঘাঁটিতে ঘাটিতে বােমাবর্ষণ’ । একই পত্রিকার অন্য একটা শিরােনাম ছিল ‘স্থলে অন্তরীক্ষে জলে’। এসব শিরােনামযুক্ত খবরে মিত্রবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা এবং পাকবাহিনীর হতদ্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। অন্যদিকে পিকিং থেকে ‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি’ কর্তৃক প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভারত সরকার এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পাকিস্তানকে দ্বিধাবিভক্ত এবং পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করে নিজেদের সম্প্রসারণমূলক আকাক্ষা চরিতার্থ করাই ভারতের মূল উদ্দেশ্য। (‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৫৫৩, ৫৫৭)। ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়ােজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানে যে সংঘর্ষ চলছে, তা বন্ধ করার আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যাকে সমাধান করতে হবে।
পাক জঙ্গিশাহির অত্যাচার ও ফৌজি আক্রমণের ফলেই এ সমস্যার জন্ম। পােল্যান্ড এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করে, চীন ব্যতীত অন্য দেশগুলাে ভােটদানে বিরত থাকে মাত্র চল্লিশ দিন আগে একই সাথে জাতিসংঘের সাধারণ সদস্য ও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভের পর চীন তার প্রথম ভেটোটি প্রয়ােগ করে সােভিয়েত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে, যা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। একই দিনে আটটি দেশ মিলে একটি অভিন্ন প্রস্তাব (যুদ্ধবিরতি, সৈন্য প্রত্যাহার ইত্যাদি) নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে, প্রস্তাবটি মার্কিন প্রস্তাবের অনুরূপ হওয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়ন আবারাে এর বিপক্ষে ভেটো প্রয়ােগ করে। সােভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক তখন বলেন, পাক সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর কার্যকলাপের ফলেই পূর্ব বাংলায় বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তিনি আরাে বলেন, জাতিসংঘের এমন ৮৮টি সদস্যদেশ আছে, যার কোনােটিরই জনসংখ্যা এক কোটি নয়।
ওইদিন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযােগ দেয়ার জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু চীনের প্রবল আপত্তির কারণে সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। একই সময়ে ‘তাস’ মারফত সােভিয়েত সরকার এক বিবৃতির মাধ্যমে উপমহাদেশের এই যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে সর্বাংশে দায়ী করে বলে, পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে; এই সংঘর্ষ সােভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় এর সঙ্গে সােভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, তাই পরিস্থিতির অবনতি রােধকল্পে বিবদমান পক্ষের যে কোনােটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। বিবৃতিতে আরাে বলা হয়, পাক-ভারতের যুদ্ধ নিয়ে বাইরে থেকে কেউ যদি অযাচিত হস্তক্ষেপ করে, তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে উদাসীন থাকা সম্ভব নয় (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৮২, ‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৫৫৯)। বস্তুত সােভিয়েত ইউনিয়নের এই হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের মিত্র—ছােট ছােট দেশগুলাের জন্য পরম মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছিল।
ওই দিন জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবে অভিমত পােষণ করেন, ভারত ব্যাপক আকারে পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলা পরিচালনা করে পাক-ভারত উপমহাদেশের শান্তি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে, সেহেতু ধ্বংসাত্মক, বিচ্ছিন্নকরণ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা এবং একটা তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য চীন ভারতীয় কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করছে।.. ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পক্ষ সমর্থন করার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে এবং সেক্রেটারি জেনারেলকে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যথাসম্ভব শীঘ্র নিরাপত্তা পরিষদে রিপাের্ট দাখিলের অনুরােধ জানাচ্ছে’ (আমি বিজয় দেখেছি, পৃ. ৪১৪-৪১৫)। জাতিসংঘ সম্পর্কে তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় আমাদের প্রথম পর্ব’ শিরােনামে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লেখা হয়, ‘নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আবার বসিবে, রকমারি প্রস্তাব রচিত হইতে থাকিবে, ব্যাঙের ছাতার মতাে একটির পর একটি এখনই তাে গজাইয়া উঠিতেছে। গায়েনদের মধ্যে আছে বেলজিয়াম, আছে জাপান, ইতালি, সেই প্রস্তাবগুলি আসলে আমেরিকাই বকলম। সােভিয়েট প্রস্তাবটি উঠিলে তাহারই ঠিক একই পরিণতি ‘ভেটো পড়িবে। আমেরিকা যদিবা ছাড়পত্র দেয়, চীন না-ও দিতে পারে। সম্মুখে অতএব এখনাে দীর্ঘ পথ, সামনে শান্তি এখনাে দূরে। ভারত শান্তি চাহে, স্বাধীন দেখিতে চাহে বাংলাদেশকে।
৬ ডিসেম্বর : স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওই দিন লােকসভায় ভাষণ দানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং বলেন, ‘অবর্ণনীয় বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। শুধু ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে আমরা স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বিচার করেই স্বীকৃতি দিচ্ছি। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি হামলা প্রতিহত করার জন্য জীবনপণ সংগ্রামরত ভারতের জনগণ আজ একই লক্ষ্যের ও একই পথের পথিক…’ (‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৫৬৬)। স্বীকৃতি দানের একটু পরেই নয়াদিল্লিস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ভারতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। ভারত কেন, কোন প্রেক্ষিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করল, এর ব্যাখ্যা সবার সামনে তুলে ধরা হলাে এবং সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিল, জাতিসংঘ বা অন্য যে-কোনাে সংস্থা বা দেশ কর্তৃক উত্থাপিত অস্ত্র সংবরণ সংক্রান্ত আপসরফায় ভারত সাড়া দেবে না। ভারতের সাথে আলােচনায় বসার আগে অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে পাক দখলদার বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদান এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত বিপর্যয়ের খবর ওয়াশিংটনে পৌছার পরপরই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপসংস্থা ‘ডব্লিউএসএজি’-র বৈঠক জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হলাে। বৈঠকে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থার প্রধান রিচার্ড হেলমেসের সমীক্ষার সূত্র ধরে বলা হয়, আগামী দশ দিনের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর সৈন্যাধ্যক্ষমণ্ডলীর পক্ষে জেনারেল ওয়েস্টমােরল্যান্ড অভিমত ব্যক্ত করেন, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের প্রতিরােধের মেয়াদ বড়জোর তিন সপ্তাহ অবধি স্থায়ী হতে পারে। বস্তুত এ সব শােচনীয় সংবাদ শুনে কিসিঞ্জার এবার ভিন্নতর প্রক্রিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা করতে থাকেন। কিছু নতুন প্রশ্ন নিয়ে সম্ভাব্য পরিকল্পনার জাল বিস্তারে সচেষ্ট হন তিনি : পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিদের হত্যা করা শুরু হয়েছে কি না, যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সেদিনের মধ্যেই সম্পন্ন হবে কি না, ভারতের নৌ অবরােধ বেআইনি কি না, এ ব্যাপারে প্রতিবাদের খসড়া শীঘ্রই তৈরি করা যাবে কি না, জর্ডান ও সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানে। সমরাস্ত্র পাঠানাের পথে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনাে বাধা আছে কি না, যদি থাকেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেহেতু পাকিস্তানের পরাজয় রােধ করতে চান, সেহেতু সেই বাধাগুলি সহজেই অতিক্রমণের উপায় আছে কি না।’
(মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৮৩)। বস্তুত ওইদিনের বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাক-ভারত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে, এজন্য কতিপয় খােড়া যুক্তি বের করা। এক্ষেত্রে কিসিঞ্জারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার পরও, এবার পুরাে বিষয়টির সঞ্চালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই। তিনি সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে বলেন, মস্কো যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতকে সামরিকভাবে নিরস্ত্র না করে, তবে পরবর্তী মে মাসে প্রস্তাবিত রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। একই সাথে মার্কিন প্রশাসন ভারতের ওপর জাতিসংঘের চাপ বৃদ্ধির জন্য Uniting for Peace (এই পদ্ধতি প্রচলিত হয় ১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধের সময়। কোনাে বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে যদি মতানৈক্যের দরুণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিষয়টিকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে সাধারণ। পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভােটের প্রেক্ষিতে কোনাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও, এ পদ্ধতির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা জাতিসংঘকে দেয়া হয়নি।) ধারা প্রয়ােগ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ওইদিন প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্ডারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় হতাশা হয়ে মন্তব্য করেন, মার্কিন কর্মকর্তারা কথায় কথায় বলেন যে, ভারতই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষের সময় তারা গণতন্ত্রকে সমর্থন করেননি, সমর্থন করেছেন একজন জুলুমবাজ সামরিক একনায়ককে। মার্কিন প্রশাসন সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে ভারতবিরােধী অপপ্রচারে লিপ্ত হলেও, চোখ-কান খােলা রাখা মানবতাবাদী মার্কিন সুধীজন প্রকৃত ঘটনা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় অ্যান্টনি লিউইস মন্তব্য করেন, ভারতের উদ্বেগের পরিমাণ ও তার উপর চাপানাে অসহনীয় বােঝার কথা মনে রাখলে বলতে হবে, দেশটি বিরাট সংযম দেখিয়েছে। লন্ডনের বহুল প্রচারিত ডেইলি মিরর পত্রিকা মন্তব্য করে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিকামী মহিলা। লন্ডনের ফিনানসিয়াল টাইমসে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী একেবারে অপদার্থ না হলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পরাজয় যে আসন্ন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামের শিরােনামে লেখা হয়, স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে’; এতে বলা হয়, “বাংলাদেশের আজ বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সূর্যোদয়কে যাহারা অস্বীকার করে, তাহারা অন্ধ মাত্র, অস্বীকৃতির দৃষ্টিহীনতা সকালের রশ্মিজালকে মিথ্যা করিয়া দিতে পারে না। ‘জয় বাংলা’র যাত্রা শুরু হইয়াছে আগে, সেই পথ আজ নতুন একটি মােড় লইল, এবং এই পথও কুসুমাস্তীর্ণ নয়, রুধিরাক্ত।… দুয়েক দিনে যে জাতি এক হইতে পারিয়াছে, জয়ের পরেও সে যেন সেই ঐক্যকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে।” (‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৫৬৮, ৫৭০)। 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!