ঢাকার পতন প্রায় আসন্ন-এ উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর, ৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মালেক ও সামরিক নেতৃত্ব সসৈন্য পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর ঢাকা থেকে জেনারেল নিয়াজি একটি সংকেতবাণী পাঠান ইয়াহিয়ার কাছে : (১) আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে পুনর্বিন্যাসকরণ সম্ভব নয়। বাঙালিরা আরাে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। শত্রুকে তারা সবরকমের সাহায্য করছে। বিদ্রোহীদের তীব্রতর অ্যামবুশের কারণে রাতে সৈন্য পরিচালনা সম্ভব নয়। বিদ্রোহীরা শত্রুকে ফাকের মধ্য দিয়ে এবং পশ্চাতে পথ দেখিয়ে পরিচালনা করছে। বিমানঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত তিনদিনে কোনাে মিশন পরিচালিত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। (২) শত্রুর হামলায় ভারী যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ ব্যাপকভাবে ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে। সৈন্যরা বিমান ও ট্যাঙ্কের গােলার মুখে রয়েছে সর্বক্ষণ। (৩) পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও সঙ্কটপূর্ণ-ঢাকা রক্ষার জন্য যদি সম্ভব হয় বিমানবাহী সৈনিকের পুনঃসমাবেশ ঘটানাে হােক (৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৫৯৪)। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে সিদ্দিক সালিক জানিয়েছেন, নিয়াজি প্রেরিত ওই বার্তার জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফিরতি বার্তায় জানিয়ে দেন, আন্তর্জাতিকভাবে যাবতীয় ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। কিন্তু আমাদের বিচ্ছিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি আপনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার সিদ্ধান্তই আমি অনুমােদন করব, আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছি (পৃ. ১৯৫)।
নিয়াজি কিংবা রাও ফরমান আলীর ত্রিশঙ্কু অবস্থার খবর চীনের কাছে। তখনও অজ্ঞাত ছিল, তাই ১০ ডিসেম্বর রেডিও পিকিং-এর মাধ্যমে ভারতকে হুমকি দিয়ে বলা হলাে, ভারত যেন সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘যুদ্ধবিরতি’র প্রস্তাব মেনে নেয়, নতুবা লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে। ভারতের প্রতি চীনের এই কড়া হুশিয়ারি, যৌথবাহিনীর হাতে পড়ে পড়ে মার খাওয়া নিয়াজি-বাহিনী বা পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক কর্তৃপক্ষের কান অবধি পৌছেনি, তাই নিয়াজির প্রতি ইয়াহিয়ার নির্দেশ মােতাবেক গভর্নরের সামরিক সচিব রাও ফরমান আলী ত্বরিতগতিতে ছুটে যান ঢাকায় অবস্থানকারী জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরির কাছে এবং তাঁকে অনুরােধ করেন, তিনি যেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আয়ােজন, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থাদি গ্রহণ, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সকল সদস্যকে সসম্মানে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার জন্য যথযথ পদক্ষেপ নেন। ফরমান আলীর প্রস্তাব বিস্ময়াবিষ্ট পল মার্ক হেনরি তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকাস্থ আমেরিকান, রাশিয়ান, ব্রিটিশ ও ফরাসি কনসালকে অবহিত করেন। এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। এই প্রস্তাব সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনা করার জন্য যখন জোর প্রস্তুতি চলছিল, তখন হঠাৎ করে সংবাদ পাওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘যুদ্ধবিরতি’ সংক্রান্ত এ ধরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। বস্তুত যে প্রস্তাবের নির্দেশদাতা ইয়াহিয়া খান নিজেই, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর তিনিই কেন ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিলেন? প্রকৃত তথ্য হলাে, ইয়াহিয়া খান স্ব-উদ্যোগে এ প্রস্তাব নাকচ করেননি, নাকচ করতে বাধ্য হয়েছেন।
ওই প্রস্তাব জাতিসংঘের সদর দপ্তরে যাওয়ার সাথে সাথেই, তা চলে যায় মার্কিন সরকারের কানে, তখন বলদর্পী মার্কিন সরকার প্রস্তাবটি নাকচ করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি চাপ প্রয়ােগ করে এবং সেই সাথে আশ্বাসের বাণী শােনায়, সপ্তম নৌবহর রওনা হয়েছে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। অতএব ভয় নেই আর…; (বড় যুদ্ধবাজের আশ্বাস পেয়ে ছােট যুদ্ধবাজ ইয়াহিয়ার নিভে যাওয়া আশার জোনাকি আলাে হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে ওঠে, তিনি মার্কিনি বন্ধুত্বের উষ্ণতা-শীতলতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন ঢের, তাই মার্কিনি মতের বিরােধিতায় না গিয়ে বাধ্য ছেলের মতাে তা মেনে নেন, এবং নিজের সহকর্মীদের মৃত্যুকূপে অবস্থানের সময়সীমা আরাে ক’দিন বাড়িয়ে দেন)। দুঃখজনক বিষয় এই যে, বিপর্যস্ত পাকবাহিনী আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় না, তারা চায় ‘সম্মানজনক-যুদ্ধবিরতি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগটি সমর্থন না করে, বরং যুদ্ধানিচ্ছুক পর্যুদস্ত একটা বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রণােদনা দিয়ে খুব দ্রুত শান্তি-প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে তােলে। ১০ ডিসেম্বর, ভারতীয় বাহিনীর মেঘনা অতিক্রমণের সংবাদ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করতে সক্ষম হয়, পাকিস্তানের পরাজয় আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, তখন সে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অবধি পৌছানাের সময়দানের জন্য একটি নতুন কূটচালের আশ্রয় নেয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অতি সক্রিয় হয়ে ওঠেন, তিনি সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভকে ‘বিবদমান প্রতিপক্ষ যে যেখানে আছে, সেই স্থানে অবস্থান অর্থাৎ নিশ্চল যুদ্ধবিরতি’র প্রস্তাব করেন এবং সেই সাথে কড়া ভাষায় হুমকি দেন, ভারত যদি এ প্রস্তাবে সম্মত না হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। ব্রেজনেভের কাছে হুশিয়ারি বার্তা পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি নিক্সন, তিনি ওয়াশিংটনস্থ সােভিয়েত প্রতিনিধি ভােরেন্টসভকে ডেকে এনে ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অংশবিশেষ এবং ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার সংক্রান্ত ১৯৬২ সালের স্মারকলিপি পড়ে শােনান এবং এই অঙ্গীকার রক্ষার জন্য মার্কিন সরকারের সংকল্প ব্যক্ত করেন’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৯৩)।
একদিকে নিক্সন দেন-দরবার করে চলেছেন সােভিয়েত নেতৃত্বের সাথে, অন্যদিকে কিসিঞ্জার কুমন্ত্রণা দিয়ে চলেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়াকে। ১০ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার সিআইএ-সংগৃহীত ভারতীয় চক্রান্ত (পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী ধ্বংস ও আজাদ কাশ্মির দখল প্রসঙ্গ) সম্পর্কে হুয়াং হুয়ার সাথে বিশদ আলােচনা করেন এবং ভারত-সােভিয়েত আঁতাত চীন নিয়ন্ত্রিত তিব্বত ও সিংকিয়াং ভূখণ্ডে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে—এমন একটা সন্দেহমূলক ধারণা হুয়াং হুয়ার মনে সঞ্চারিত করে দিতে সক্ষম হন। ফল পাওয়া গেল সাথে সাথেই, হঠাৎ উত্তেজিত হুয়াং হুয়া বলে বসেন, এ প্রেক্ষিতে ‘অস্ত্রাগারে শেষ রাইফেলটি থাকা পর্যন্ত চীন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে’। চীনা প্রতিনিধির এমন প্রত্যয়ী বক্তব্যকে উপমহাদেশীয় বর্তমান সংকটে ‘চীনের সামরিক হস্তক্ষেপের বিলম্বিত আভাস’ হিসেবে কিসিঞ্জারের বিবেচনায় প্রতিভাত হয়। উল্লসিত কিসিঞ্জার তখনই হুশিয়ারিসহ সােভিয়েত প্রতিনিধি ভােরেন্টসভকে জানিয়ে দেন, যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতকে রাজি করাতে না পারে বা এ বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টির মীমাংসার জন্য সপ্তম নৌবহর প্রেরণসহ শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। | বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের এসব চাতুর্যপূর্ণ প্রচারণা—‘ভারত আজাদ কাশ্মির দখল করে নিতে পারে’, ‘রুশ-ভারত আঁতাত চীনা ভূখণ্ডে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, এবং পাকসেনাদের সসম্মানে প্রত্যাবর্তনের সুযােগ করে দেয়ার জন্য নিয়াজি-প্রেরিত প্রস্তাব নিক্সন-কিসিঞ্জার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়া’, ১৯৫৯ সালের স্মারকের দোহাই দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা-প্রসঙ্গে উদ্ভট প্রচার চালানাে’, চীনকে দলে ভিড়ানাের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ—এর পিছনে নেপথ্য কারণ ছিল। একটাই—ভারতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়ােগের জন্য নিজের দেশে অনুকূল প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা অর্থাৎ যুদ্ধবিরােধী মার্কিন জনমতকে ভারত-প্রসঙ্গে তাঁতিয়ে তােলা। ক’দিন ধরে প্রচার-প্রচারণা চালানাের পর যখন মনে হলাে, উদ্দেশ্য অনেকটা সিদ্ধ হয়েছে, তখন, ১১ ডিসেম্বর ভােরেন্টসভকে চূড়ান্ত হুমকি প্রদান করেন কিসিঞ্জার, আগামী দিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারত যদি ‘যুদ্ধবিরতি না করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়ােগ করতে পারে, সােভিয়েত নেতৃত্ব অনেক আগেই এটা অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই পূর্ব সতর্কতা হিসেবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর এলাকায় তারা নৌশক্তি বৃদ্ধি করে চলছিল। সপ্তম নৌবহর যখন ভারত মহাসাগর থেকে থেকে কয়েকশাে মাইল দূরে, মালাক্কা প্রণালীর ওপারে, এর আগেই পাঁচটি সাবমেরিনসহ ষােলটি যুদ্ধ ও সরবরাহ জাহাজ এ অঞ্চলে অবস্থান করছিল, মস্কোর দূরদর্শী নেতৃত্বের বার্তাবাহক হিসেবে। এর আগে, ৬ ডিসেম্বর, উপমহাদেশীয় রণাঙ্গন পরিস্থিতি অনুধাবন করার জন্য ‘কসমস ৪৬৪’ নামের একটি পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন। এর ফলে চলমান সপ্তম নৌবহরের গতিবিধিও ওই উপগ্রহের পর্যবেক্ষণ-আওতায় এসে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক সরঞ্জামাদির সমাবেশ-বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সােভিয়েত অবস্থান অনেক সুবিধাজনক পর্যায়ে থাকলেও, তা নয়াদিল্লির সপ্তম নৌবহর-সংক্রান্ত উদ্বিগ্ন মনােভাবকে বিন্দুমাত্র প্রশমিত করতে পারেনি। এই বিশাল ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধযানের আগমন, নয়াদিল্লির কর্তাব্যক্তিদের ‘যুদ্ধের নতুন মােড় ও সীমাবৃদ্ধি’ বিষয়ে আতঙ্কিত করে তুলল। সিকিম-ভুটানের উত্তর সীমান্তে চীনা সৈন্যের ‘যুদ্ধংদেহী’ বিপুল সমাবেশ, অন্যদিকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী নৌবহরের জিঘাংসাসহ আগমন, জম্মু ও কাশ্মির সীমান্তে পাকিস্তান বাহিনীর বেপরােয়া আক্রমণ—সব মিলিয়ে নয়াদিল্লি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি, উপমহাদেশীয় যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে মার্কিনিরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করবে (ননা ওয়ে বাট সারেন্ডার : ভাইস এডমিরাল এন কৃষ্ণান, পৃ. ৫৩)। তাদের সামনে। তখন দুটি উপায়, একটা খুব লজ্জাজনক, অন্যটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হয় মার্কিন প্রস্তাব অনুযায়ী ‘নিশ্চল স্থিতাবস্থা বা রাজনৈতিক মীমাংসা (যাতে নিজ দেশের দৃশ্যত খুব ক্ষতি হবে না, তবে ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে ঢের, সেইসাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল) মেনে নেয়া, না হয় সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা।
বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লি অবশ্য দোলাচলবৃত্তিতে ভােগেনি, ১০ ডিসেম্বর রাতের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্থির ও প্রত্যয়ী সিদ্ধান্ত নিলেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটা যাবে না। এরপর সপ্তম নৌবহরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য ভারতের দুর্বল নৌশক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার, ঢাকা অভিমুখে সামরিক অভিযানের গতি বৃদ্ধি এবং মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সােভিয়েত সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ডি পি ধরকে মস্কো প্রেরণ—এই তিনটি সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা একে একে ঘােষণা করেন’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ-১৯৬)। এর পরদিনই ডি পি ধর মস্কোর। উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। [বি. দ্র. : নেপালের কাঠমান্ডুস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে। কর্নেল মেলভিন হােস্ট ১০ তারিখে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে অবহিত করেন যে, সেখানকার সােভিয়েত দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে নিকোলাই লেগিনভ চীনা দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে চাও কিয়াং চিহ-কে নাকি ডেকে বলেছেন, ‘যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অতিশয় আগ্রহী হওয়া উচিত হবে না। তাতে ইউনিয়ন অব সােভিয়েত সােশ্যালিস্ট রিপাবলিক প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটাবে। তাদের হাতে এমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রচুর রয়েছে যা দিয়ে তারা…’ অর্থাৎ লেগিনভ এটাই বােঝাতে চেয়েছেন যে, চীন যদি আসন্ন যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে নামে, তাহলে সিনকিয়াং প্রদেশে লন নর হ্রদের বিশাল এলাকাজুড়ে চীন যে পারমাণবিক বােমা তৈরির প্রকল্প গড়ে তুলেছে, তা সােভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে (মাসুদুল হক অনূদিত গ্রন্থ বারুদে জন্ম যার, পৃ. ৫৭)। ১০ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হােসেন, পিপিআই সংবাদ সংস্থার প্রধান সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমদ এবং পিপিআই-এর রিপাের্টার সৈয়দ নাজমূল হককে স্ব স্ব বাসভবন থেকে আলবদর বাহিনী অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তিনজনকেই নির্মমভাবে হত্যা করে।
হতে পারত আরাে একটা বিশ্বযুদ্ধ। ইতঃপূর্বে খবর রটে গিয়েছিল যে, মিত্রবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা প্রতিরােধ করতে না পারায় আতঙ্কিত নিয়াজি সংগােপনে পালিয়ে গেছেন পশ্চিম পাকিস্তানে। খবরটি যদিও অসত্য ছিল, তবে অচিরেই ঢাকা পতনের আশঙ্কা আত্মপ্রচারপ্রিয় নিয়াজিকে নির্বাক ও হতভম্ব করে রেখেছিল, দু-তিন দিন তিনি। জনসমক্ষে আসেননি, কোনাে বিবৃতিও দেননি। ১১ ডিসেম্বর, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে নতুন একটা বার্তা পেলেন নিয়াজি, কেবল আপনার জানার জন্য বলছি, মার্কিন সপ্তম নৌবহর খুব শিগগির সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে চীনা সৈন্যরা নেফা সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে ভারত ও রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।’—এ খবর পেয়ে নিয়াজির বিপর্যস্ত মন চাঙ্গা হয়ে উঠল, তিনি সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে হাজির হলেন এবং প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, আমি আপনাদের দেখাতে এসেছি যে, আমি পালিয়ে যাইনি। আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই কেবল ঢাকার পতন ঘটতে পারে।
[বি. দ্র. : (১১ ডিসেম্বরের বিকেল। ব্রিগেডিয়ার কাদির ও তার ব্যক্তিগত স্টাফরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে। হঠাৎ তারা দেখতে পান, ৯ কিলােমিটার দূরে, কালিহাতিতে বিমান থেকে সৈন্য নামছে। নিয়াজিপ্রদত্ত খবর অনুসারে তারা ভাবলেন, অবতরণরত প্যারাট্রুপাররা চৈনিক হবে নিশ্চয়ই; তারা খুবই উৎসাহিত বােধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের উৎসাহে পড়ল ছেদ, তারা সবিস্ময়ে দেখলেন, আগত প্যারাট্রুপাররা চৈনিক নয়—ভারতীয়)—বাঙালি হত্যা ও পাকিস্তানের ভাঙ্গন, পৃ. ৪২৫।] নিয়াজি যখন আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘােষণা দিলেন, তখন রণাঙ্গনের প্রকৃত অবস্থা বিন্দুমাত্রও তার অনুকূলে ছিল না। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পর্যদস্ত পাকসৈন্যরা কেবলই পিছু হটছে, মারা যাচ্ছে, আত্মসমর্পণ করছে, কিংবা চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল উপকূলবর্তী এলাকা থেকে ভিনদেশি পতাকা ব্যবহার করে জাহাজযােগে পালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবরুদ্ধ করার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং অংশত উপকূলভাগে সপ্তম নৌবহরের সংযােগ প্রতিষ্ঠার কাজ অপেক্ষাকৃত দুরূহ। করার জন্য ১১ ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দর এবং কক্সবাজার, চালনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল উপকূলভাগের অবকাঠামাে, ছােট-বড় সকল জাহাজ, নৌযান প্রভৃতির ধ্বংস সাধনে ভারতীয় নৌবাহিনীর। বিমান ও যুদ্ধজাহাজ ব্যাপকভাবে নিযুক্ত করা হয়,-বঙ্গোপসাগরের জাহাজগামী নৌপথগুলি সংকীর্ণ ও প্রায়শ অগভীর হওয়ায়, অনুমান করা হয়, সপ্তম নৌবহরের বৃহদায়তন জাহাজগুলির পক্ষে উপকূলের নিকটে নােঙ্গর করা অসাধ্য ব্যাপার।
তাদের বিমান আক্রমণ ও হেলি উত্তোলন ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও, পর্যাপ্ত সংখ্যক উপকূলীয় জলযানের অভাবে স্থলভাগের সঙ্গে সংযােগ প্রতিষ্ঠা অথবা পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের কাজ বহুলাংশে বিঘ্নিত করে। তােলার জন্য এমন পদক্ষেপ নেয়া হয় (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৯৭, ২০১)। ঢাকার অবস্থাও সুরক্ষিত নয় খুব। ইতােমধ্যে চীন-মার্কিননির্ভর হয়ে ওঠা পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিজস্বতা হারিয়ে কাতর হয়ে চেয়ে আছে ‘সাদা ও হলুদ’ বন্ধুদের দিকে, কখন আসবে তারা? অবরুদ্ধ পাকবাহিনীর কাতর ব্যাকুলতার মাঝখানে আশ্বাসের বাণী শােনান সিজিএস জেনারেল গুল হাসান, তিনি টেলিফোনে নিয়াজিকে জানিয়ে দেন, ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নের আগেই পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে বন্ধুরা এসে যাবে। জেনারেল গুল হাসানের কাছ থেকে উদ্দীপক সংবাদ প্রাপ্তির পর ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নতুন একটা সিদ্ধান্ত নেয়, সারা শহরে চব্বিশ ঘণ্টাব্যাপী কারফিউ জারি করে ঘরে ঘরে তল্লাশি অভিযান চালাতে থাকে। ওইদিনই, ১২ ডিসেম্বর, রবিবার পাকবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা ও তাদের অনুগত বেসামরিক প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কয়েকজন রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট হাউজে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন এবং দেশের ২৫) জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা বা ‘গুম’ করার নীলনকশা প্রণয়ন করেন।
(বি. দ্র. : ক’দিন পর, ২৮ ডিসেম্বর, ঢাকা থেকে পাঠানাে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার রিপাের্ট থেকে জানা যায়, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় কর্মরত সকল উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তাকে ১৩ ডিসেম্বর গভর্নর ভবনে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল ভয়ঙ্কর—সবাইকে গ্রেপ্তার করা বা হত্যা করা। সৌভাগ্যবশত খবরটি জানাজানি হয়ে যায়, ফলে সংশ্লিষ্ট অফিসারবৃন্দ ওই সমাবেশে অনুপস্থিত থাকেন এবং প্রাণে বেঁচে যান)। ১১ ডিসেম্বর ডি পি ধর গেলেন মস্কোতে আর কুজনেটসভ এলেন। নয়াদিল্লিতে। দুজনই দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে সম্ভাব্য চীন-মার্কিন আক্রমণ সম্পর্কে মতবিনিময় করেন এবং তা যৌথভাবে মােকাবিলা করার জন্য অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। ইতঃপূর্বে সােভিয়েত নেতৃত্বের প্রতি নিক্সন বা কিসিঞ্জারের হুশিয়ারি জ্ঞাপন, ভারতকে যুদ্ধবিরত রাখার জন্য সময় বেঁধে দেয়া—ইত্যাদি শিষ্টাচারবর্জিত হুমকি মস্কো কেবল শুনেই গেছে, কখনাে কোনাে প্রতিবাদ করেনি বা অগ্রাহ্য করবার মানসিকতাও দেখায়নি। সবকিছু করে গেছে ঠাণ্ডা মাথায়, নীরবে, উদ্দেশ্য ছিল—কালক্ষেপণ করা, মার্কিন বাহিনী সক্রিয় হওয়ার আগেই ভারত যাতে যুদ্ধ সমাপ্তির প্রান্তসীমায় পৌছে যেতে পারে।
সােভিয়েত-সংযমের বড় পরিচয় পাওয়া যায়, সপ্তম নৌবহর প্রেরণ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ঢাকঢােল পিটিয়ে সারা বিশ্বকে জানান। দিয়েছে, সেখানে বঙ্গোপসাগর ও এর আশেপাশে যােলটি যুদ্ধজাহাজ মােতায়েন করে রাখার পরও তাদের মুখ থেকে না কোনাে সতর্কবাণী, না কোনাে হুশিয়ারি বা ভারতের প্রতি না কোনাে উন্মুক্ত আশ্বাসমূলক বক্তব্য—একটি বারের জন্যও উচ্চারণ করা হয়নি। প্রতিপক্ষকে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য যা যা করার দরকার, মস্কো সবই করেছে যথােপযুক্তভাবে, যেমন মার্কিন নৌশক্তি মােকাবিলা করার জন্য যথাস্থানে বিপুল নৌশক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে রেখেছে, যুদ্ধ থেকে চীনকে নিবৃত্ত করার জন্য সিংকিয়াং সীমান্তে লক্ষাধিক সৈন্য মােতায়েন করে রেখেছে। মস্কোর এই দুটি কূটনীতিমিশেল সামরিক পদক্ষেপ—একদিকে যেমন প্রত্যক্ষ যুদ্ধ থেকে চীনমার্কিনকে বিরত রাখতে সমর্থ হয়েছিল, তেমনি গােটা পৃথিবীকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আরেকটা ভয়ঙ্কর মহাযুদ্ধের করাল গ্রাস থেকে।
ইতঃপূর্বে কিসিঞ্জার সােভিয়েত প্রতিনিধি ভােরেন্টসভকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, মস্কো যদি ১২ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের পূর্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভারতকে যদি রাজি করাতে না পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বস্তুত পশ্চিম দুনিয়ায় সেই ১২ ডিসেম্বর (আমাদের এখানে তখন ১৩ ডিসেম্বর) ছিল রবিবার, ছুটির দিন। তা সত্ত্বেও হােয়াইট হাউজের খাস কামরা ‘ওভাল অফিস’এ নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং আলেকজান্ডার হেগসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গণ্যমান্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ভারতবিষয়ে সােভিয়েত জবাব জানার জন্য। নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রমণের দু’ঘণ্টা আগেই ‘যুদ্ধবিরতি’ প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে সােভিয়েত তরফ থেকে জবাব এলাে, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। সােভিয়েত উত্তরের কৌশলগত দিক বিবেচনায় নিয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বুঝতে বাকি রইল না যে, সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানের পরাজয় রােধ করা সম্ভব নয়। সেই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের যৌক্তিকতা এবং সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত মানতে ভারতের অবাধ্যতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ের জন্য সেদিনই নিক্সন নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার নির্দেশ দেন। এবং এই প্রথম ‘হট লাইন’ (পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানাের নিমিত্তে সর্বশেষ চেষ্টা ও যােগাযােগের মাধ্যম হলাে ‘হট লাইন’) মারফত ক্রেমলিনকে ‘গুরুতর পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ‘হট লাইন’ মারফত নিক্সনের কথা শেষ হওয়ার পরপর নতুন এক বার্তা পেলেন কিসিঞ্জার, জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়ার কাছ থেকে।
ওই বার্তায় হুয়া জানিয়েছেন, পিকিং থেকে জরুরি সিদ্ধান্ত এসেছে, এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কিসিঞ্জার যেন অনতিবিলম্বে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পিকিং থেকে আগত সিদ্ধান্তটি কী তা না জেনেই যুদ্ধ-উন্মাদ নিক্সন-কিসিঞ্জার মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান যে, চীন নিশ্চয়ই পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার বার্তা পাঠিয়েছে। উল্লাস-উত্তেজিত নিক্সন তখন কিসিঞ্জারকে বলেন, তার পক্ষ হয়ে কিসিঞ্জার যেন হুয়াং হুয়াকে আশ্বস্ত করেন, পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে লড়তে এসে চীন যদি সােভিয়েত দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েতকে শায়েস্তা করার জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ব্যবস্থা’ যে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার—তা নিক্সন নিজেই স্বীকার করেছেন ১৯৮৫ সালে, ‘টাইম ম্যাগাজিন’ পত্রিকার সাথে ঘনিষ্ঠ এক সাক্ষাৎকারে। হুয়াং হুয়া তার বার্তায় কিসিঞ্জারের উপস্থিতি কামনা কামনা করলেও, সেখানে অর্থাৎ নিউইয়র্কে গেলেন কিসিঞ্জারের সহকারী আলেকজান্ডার হেগ। হুয়াং হুয়া পিকিং থেকে আগত বার্তাটি হেগকে অবহিত করলেন, যার মর্মার্থ হলাে, চীন পাক-ভারত যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়, সে কেবল সংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আবারাে আলােচনা করতে ইচ্ছুক। চীনের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত বার্তা শুনে যুদ্ধসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সময়ের প্রয়ােজন, বিধায় বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার পথ—এমন অনতিদূরে থাকা সপ্তম নৌবহকে নিশ্চল থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।
পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে চীনের হঠাৎ করে সরে যাওয়া, পাক-মার্কিন নেতৃত্বকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয় এবং এ প্রেক্ষিতে নিয়াজিকে নতুন করে খবর পাঠানাে হয়, ১৩ ডিসেম্বর থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই মিত্র তাকে সহায়তা দেয়া সংক্রান্ত যে বার্তা ইতঃপূর্বে প্রেরণ করা হয়েছিল, অনিবার্য কারণবশত সেই সিদ্ধান্তের কার্যক্রম আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। চীনের মত পরিবর্তন করানাের জন্য, অর্থাৎ যুদ্ধে নামতে তাকে রাজি করানাের নিমিত্তে পাক এবং মার্কিন প্রশাসন নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন, পিকিং ও ইসলামাবাদ-সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়, কিন্তু সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে চীন বারবার অসম্মতিজ্ঞাপন করতে থাকে। এর ফলে ভারত আক্রমণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী কঠোর মনােভাবে খানিকটা শিথিলতা পরিদৃষ্ট হলেও, তা চেপে রেখে অস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল করে রাখা সপ্তম নৌবহরকে আবারাে সচল করা হয় বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল
১৩ ডিসেম্বর, নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত মার্কিনি প্রস্তাব সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক তৃতীয় ভেটো প্রয়ােগের ফলে বাতিল হয়ে যায়। ভারতকে ‘যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি করানাের জন্য অব্যাহত মার্কিন চাপ প্রয়ােগ প্রসঙ্গে ওই দিন ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘের মহাসচিব বরাবর লিখিত পত্রে জানান, তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনীর কার্যক্রম প্রসঙ্গে কোনাে মন্তব্য করতে পারেন না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজেদের মাতৃভূমিকে দখলমুক্ত করার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কিত বাস্তবের দাবি ও বক্তব্য জাতিসংঘকে অবশ্যই শুনতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি ফৌজ সরিয়ে নিতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে পাক শাসকচক্রকে আলােচনায় বসতে হবে। এখন অনেক দেশ আমাদেরকে শান্তির ললিতবাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু গত নয় মাস ধরে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ তাণ্ডব চলেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করা হয়েছে, তখন সেই শান্তিবাদীরা কোথায় ছিলেন? ভারত দীর্ঘদিন যাবৎ সংযত আচরণ করেছে, শান্তি স্থাপনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে,… এখন ভারতের শর্তে এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে শান্তি আসছে এবং আসবে (‘৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৬১৩)। মজার ব্যাপার হলাে, একদিকে ভারত বলছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখা—ভারতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, অন্যদিকে বাংলাদেশ বলছে, আমরা যেহেতু জাতিসংঘের সদস্য নই, তাই জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত কোনাে প্রস্তাব আমরা মেনে নিতে বাধ্য নই।
আমরা আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। যুদ্ধবিরতি’ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের এই সাজানাে খেলা—তখনকার প্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যবহ ভূমিকা পালন করেছে। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা ও নগণ্য সংখ্যক এলাকা ছাড়া পুরাে বাংলাদেশেই মিত্রবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ঢাকাও তখন চারদিক থেকে মিত্রবাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ, এ শহরের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। চরম মুহূর্তে চীনের নাটকীয় ইউটার্ন, মার্কিন সহায়তা জ্ঞাপনে পূর্ববর্তী কঠোর ও দৃঢ় মনােভাবের ক্রমিক অবসান, ঘরের দুয়ারে শত্রুবাহিনীর অব্যাহত অগ্রাভিযান ইত্যাদি অনুষঙ্গের আলােকে পরবর্তী করণীয় ঠিক করার জন্য পূর্ব বাংলার বেসামরিক প্রশাসন জরুরি বৈঠক আহ্বান করে গভর্নর ভবনে। একটি পাকিস্তানি সিগন্যাল থেকে নয়াদিল্লির বিমান সদর দপ্তর সেই গােপনীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের আগাম খবর জেনে যায়। গভর্নর ভবনে ওই বৈঠক চলাকালীন মেঘালয়ের শিলং বিমানঘাঁটি থেকে ছ’টি মিগ-২১ নির্ভুল রকেট হামলা চালায়। বৈঠকিদের ওপর। ভীত সন্ত্রস্ত গভর্নর মালেক ও তার মন্ত্রিসভা সাথে সাথে সম্মিলিতভাবে পদত্যাগের ঘঘাষণা দেয়। বস্তুত গভর্নর মালেক ও তার পারিষদের একযােগে পদত্যাগ—নিয়াজির মনােবলকে পুরােপুরি নিঃশেষিত করে দেয় এবং তিনি ঘন ঘন দুর্গতবার্তা পাঠাতে থাকেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বরাবর।
শেষপর্যন্ত ইয়াহিয়া তার দূরবর্তী ‘বন্ধুনির্ভরতা’র অবাস্তব অবস্থানের অবসান ঘটিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাঠান নিয়াজির কাছে, যার শেষকথা, “You should now take all necessary measures to stop the fighting and preserve the lives of all armed forces personnel, all those from West Pakistan and all loyal elements. (Pakistan’s Crisis in Leadership, page- 187). ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারত ও ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল; এরপর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ থেকে সােভিয়েত সরকার-নিয়ন্ত্রিত কাগজগুলােতেও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা হতে থাকে, যা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় মনােভাবেরই প্রতিফলন বলে বিবেচিত করা যায়। ১৪ তারিখ রুশ সরকারের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা সম্পর্কে ‘দি টাইম’ মন্তব্য করেছিল (১৫ ডিসেম্বর), “The Soviet Government newspaper ‘Izvestia’ last night refered to the administration of the Republic of Bangladesh beginning to work in liberated areas’ – This was the clearest indication so far of Soviet diplomatic support for the Indian recognition of Bangladesh.” সােভিয়েত পত্রিকার এমন বক্তব্য অবশ্য মােটেই অসত্য। ছিল না, কারণ ১৩ ডিসেম্বর থেকে যশাের, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা প্রভৃতি স্থানে মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়ে গিয়েছিল। যশােরে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান ওয়ালিউর রহমান। সাতক্ষীরার এসডিও হিসেবে নিযুক্তি পান কে সি দাশ। খুলনা। জেলায় এসপি পদে নিয়ােগ দেয়া হয় পঙ্কজ মিত্রকে। খুলনা-বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় এম এ মােমেন ও সৈয়দ কামাল বখত-এর ওপর (‘৭১-এর দশ মাস, পৃ.৬৬২)। এদিকে মুজিবনগর সরকার এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়ে শত্রুমুক্ত সবগুলাে জেলায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বৈঠকে উল্লেখ করা হয় যে, ইতােমধ্যে বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে যশাের ও নােয়াখালীর ফেনীতে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং টেলিফোন লাইন সচল করা হয়েছে।
পূর্বাঞ্চল যখন ক্রমান্বয়ে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, পাকিস্তান তখন তার। সমন্ত শক্তির সমাবেশ ঘটায় পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে। অবশ্য সেখানেও শক্তির ভারসাম্য বজায় ছিল না, কারণ ভারতের ১ লাখ ৯৫ হাজার সৈন্যের বিপরীতে পাকিস্তান জমায়েত করতে পেরেছিল ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্য। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌছায়, শিয়ালকোট শহরসহ, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরও ভারতের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পাকিস্তানের আকাশশক্তি কার্যত শেষ হয়ে যাওয়ায়, আমেরিকার অনুমতি সাপেক্ষে জর্ডান। থেকে ১০টি এফ ১০৪ এস মার্কিনি বিমান নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তাতেও ফল এলাে না কোননা, তাই বিশ্ব জনমত ভারতের বিপক্ষে উস্কে দেয়ার জন্য নিয়াজি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা আরাে একটা ঘৃণ্য, কুৎসিত, দানবিক অপকর্ম করে বসে।
৮ ডিসেম্বরের মধ্যরাত পেরিয়ে ৯ তারিখ শুরু হয়েছে মাত্র হঠাৎ তেজগাঁও রহমত-ই-আলম ইসলামিয়া মিশন এতিমখানা’র শত শত শিশুর ওপর বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করা হয়। পরদিন পত্রিকায় খবর এলাে, “গত বুধবার রাতে ঢাকার অসামরিক এলাকায় ভারতীয় যুদ্ধবিমানের ভারী বােমা বর্ষণে কমপক্ষে ৭৫ জন মারা যায়, আহত হয়েছে এর চেয়েও বেশি।… যখন সমস্ত ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন নিহতের সংখ্যা তিন অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে’ (দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার, ১০.১২.১৯৭১)। বস্তুত পাকিস্তানি শাসকচক্র এই বােমা হামলার দায় ভারতের ওপর চাপাতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের এই দাবি তকালীন ঢাকাবাসীরা তাে বিশ্বাসই করেননি, এমনকি ঢাকায় অবস্থানরত দুই বিদেশি—জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরি এবং মার্কিন কনস্যুলেটের কন্সাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক, তাঁদের মনেও সন্দেহের জন্ম দেয়। ১০ তারিখে তাঁরা যান বিধ্বস্ত ঘটনাস্থলে, পেয়ে যান দুটো অবিস্ফোরিত তাজা বােমা, সেগুলাে গাড়িতে তুলে নেন সকলের অগােচরে। এরপর এই শিশুহত্যার ওপর পল মার্ক হেনরি রিপাের্ট পাঠান জাতিসংঘের মহাসচিব বরাবর, আর স্পিভাক রিপাের্ট পাঠান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্টদূত যােশেফ ফারল্যান্ডের কাছে (পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন ও জর্জ ক্লিফোর্ড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে স্পিভাকের রিপাের্টটি সংগ্রহ করেন)। হেনরি ও স্পিভাক মূলত অভিন্ন রিপাের্টই তৈরি করেছিলেন, যার শিরােনাম দেয়া হয়েছিল, রাতের দুবৃত্ত; স্পিভাকের ভাষায়, ‘প্রমাণের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরি ও আমি বিশ্বাস করি এবং আমাদের দুজনের বিবেচনায় চূড়ান্ত হিসেব হচ্ছে, গত রাতে ঢাকার অসামরিক এলাকায় বােমা বর্ষণ করেছে ঢাকা বিমানবন্দরে রাখা পাকিস্তান সরকারের বিমান। এই হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে কলঙ্কিত করা।’
তাঁরা দুজন বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযােগ পােক্ত করতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী জাতিসংঘ চত্বরে, কিংবা রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকাতেও (হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল) বােমা ফেলতে পারে। এই বিবেকহীন বর্বরতার প্রতিবিধান করার জন্য হেনরি ও স্পিভাক জাতিসংঘসহ সবার সহায়তা কামনা করেন। কিন্তু বাঙালি হত্যার অন্যতম খলনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলী পরবর্তীকালে হেনরি ও স্পিভাকের রিপাের্টটিকে বানােয়াট, কল্পনাপ্রসূত উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তানকে কলঙ্কিত করার জন্য ভারতীয় সরকার বানােয়াট কাহিনী তৈরি করে। তার মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুবৃত্ত, অসভ্য ও বর্বর জাতি হিসেবে চিত্রিত করে। তথ্য মাধ্যমের ওপর ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা প্রচারণার ব্যাপারে ভারতকে সব রকমের সাহায্য করে’ (হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড, পৃ. ১৫৫)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র