এবার যুদ্ধবাজ নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র নতুন হিসেব-নিকেশ শুরু করে—পাকিস্তান প্রশ্নে সােভিয়েত অবস্থান ঘাের মার্কিনবিরােধী, চীনের অবস্থানও আশাপ্রদ নয়, ইন্দিরা গান্ধীর ফ্রান্স সফরের পর ফরাসি সরকারের সমর্থন হেলে আছে ভারতের দিকে, ফলে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে বাকি রইল কেবল ব্রিটেন। ২৬ নভেম্বর, প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং পাকিস্তান-প্রসঙ্গটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন। কিন্তু হিথ এ ধরনের উদ্যোগ নিতে অসম্মতি জানান; নিক্সনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কিসিঞ্জার আবারাে ধরনা দেন চীনের কাছে, আবারাে তিনি প্রাপ্তিহীন হয়েই ফিরে আসেন। প্রশ্ন হলাে, নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন তাে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ডাকতে পারত, কিংবা এ ব্যাপারে নিক্সন নিজেই নির্দেশ দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে রাজি করাতে পারতেন। নিক্সন প্রশাসন তা করেনি, প্রথমত, প্রবল জনমতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান বিষয়ে আর কিছু করতে গেলে সেটা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে, দ্বিতীয়ত, এই কাজটিই অন্যকে দিয়ে করাতে পারলে জনমত পরিবর্তনের বড় কোনাে সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার খুবই লক্ষণীয় যে, একদিকে নিক্সন-কিসিঞ্জার দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক পর্যায়ে আলােচনা করে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিলেন, অন্যদিকে বৃহত্তর যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি হিসেবে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহেই সপ্তম নৌবহরকে সচল করেছিলেন বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।
কিন্তু অন্যকে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকানন, কোনাে বৃহৎ শক্তিকে কাছে টানতে পারা, মার্কিন ও বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করা—সকল বিষয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর সপ্তম নৌবহরের অগ্রযাত্রায় ছেদ টানা হয়। | ইতঃপূর্বে বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত চুক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, বহিঃশত্রু দ্বারা পাকিস্তান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তার সার্বিক সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। এবার ২ ডিসেম্বর, হঠাৎ করে পাকিস্তান নিজেকে আক্রান্ত দেশ হিসেবে দাবি করে বসে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তা কামনা করে। এক মাস আগে ওয়েলার্ট-উত্থাপিত এমন দাবি স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পাকিস্তানের তরফ থেকে অনুরূপ দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে কে কলকাঠি নাড়িয়েছিলেন, এটা বোেঝ যায় ৩ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার প্রদত্ত বক্তব্য থেকে। ওইদিনই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপসংস্থা ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের জরুরি সভা ডাকা হয় এবং এতে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকাসহ পাকিস্তানের জন্য সম্ভাব্য সকল সহায়তা অন্বেষণের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্তরিক সমর্থন কামনা করেন। তখন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের প্রচেষ্টা ছিল : (১) নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েত ভেটোর আশঙ্কা সত্ত্বেও উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার জন্য জাতিসংঘকে যতদূর সম্ভব ব্যবহার করা; এবং (২) ১৯৫৯ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার অধীনে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের উপকূলভাগের উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু করা। একমাত্র প্রথম লক্ষ্য অর্জনের পরেই দ্বিতীয় ও মূল পদক্ষেপ গ্রহণ করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সম্ভব ছিল’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৭৭)।
২৩ নভেম্বর, ইয়াহিয়া-ঘােষিত দশ দিন’ নিঃশেষিত হওয়ার আগের দিন পাকিস্তান নিজেকে আক্রান্ত হিসেবে দাবি করা এবং পরের দিন ভারতীয় স্থাপনার ওপর আগ্রাসী বিমান হামলা এবং হামলা চালানাের ছ’ঘণ্টার মধ্যেই (তখনও আক্রান্ত দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনাে রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি) মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে কিসিঞ্জারের আলােচনাপর্যালােচনা ইত্যাদি বিষয় থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণ, এটা কেবল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সিদ্ধান্তজাত পদক্ষেপ নয়, এর পেছনে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বড় ধরনের প্রভাব ছিল। বস্তুত এই দুজন যুদ্ধবাজ উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য আপাত-গ্রহণযােগ্য কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু যুৎসই কারণ না পেয়ে অগত্যা পাকিস্তানকে ‘আক্রান্ত হিসেবে প্রতিপন্ন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের মনােভাবও ছিল অনুরূপ প্রায়, মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত পাকসেনাদের বেগতিক অবস্থা দেখে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার মনে হলাে, এভাবে পড়ে পড়ে মার খেয়ে আত্মসমর্পণ করার আগে দুই মিত্রশক্তি চীন-মার্কিনকে জাগিয়ে ভােলা দরকার, কারণ এই দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসলামাবাদের বিপর্যয়কালে নিশ্চয়ই নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকবে না। এমন স্বপ্ন ও আকাক্ষার বশবর্তী হয়ে, (সেইসাথে মার্কিন প্ররােচনায় প্রভাবিত হয়ে) ৩ ডিসেম্বর, পাকসেনারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিমানবন্দরগুলােতে বিমান হামলা চালায় এবং পূর্ব পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে একযােগে স্থল হামলা শুরু করে। ভারত আক্রমণের আগে পাকিস্তানি সমরবিদদের মনে দুটো ধারণা কাজ করেছিল-(১) পশ্চিমাঞ্চলে জম্মু ও কাশ্মিরের একাংশ দখল করে নিতে হবে; তাতে পূর্বাঞ্চলের কোনাে ভূখণ্ড যদি ভারতের দখলে চলেই যায়, তাহলে জম্মু ও কাশ্মিরের দখলকৃত অংশ নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে দর কষাকষি করা যাবে।
ভারত নিশ্চয়ই নিজের ভূখণ্ডের দাবি ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানের দখল করা ভূখণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাইবে না। (২) পূর্ব পাকিস্তানের নদীনালাবেষ্টিত ভূখণ্ডে খুব দ্রুত অগ্রসর হওয়ার মতাে সামরিক সরঞ্জামাদি ভারতের নেই; তাছাড়া পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনী নিজেদের অঞ্চলে দুর্গ ও বাঙ্কার খনন করে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এই দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভারতীয় বাহিনী খুব সুবিধে করতে পারবে, এমন আশঙ্কা পাকিস্তানিরা আমলে নেয়নি। বস্তুত পাকিস্তানের সমর পরিকল্পনায় কেবল ভারতীয় বাহিনীকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, বাংলা মায়ের দামাল মুক্তিযােদ্ধা বা পাকিস্তান-বিদ্বেষী স্থানীয় জনগণকে কোনাে বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি। পাকিস্তানি রণনীতির এই ভুল সিদ্ধান্ত ভারতীয় বাহিনীর জন্য মহা আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। তাছাড়া আরাে কটি জায়গায় ভ্রান্তনীতির ফাঁদে পা দিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমত, গত মার্চ মাস থেকে হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ এসব অপকর্মে পাকিস্তান বাহিনী এতই মশগুল থেকেছে যে, যুদ্ধ করার মতাে নৈতিক সাহস ও মনােবল ইতােমধ্যে তারা হারিয়ে ফেলেছে। এর উপর অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবল আক্রমণ, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত গেরিলা হামলা ইত্যাদির ফলে পাক-সৈন্যরা ছিল পরিশ্রান্ত, উদ্যমহীন। তাছাড়া পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর—তারা অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের আঁচ পেয়ে ইতােমধ্যে পালিয়ে গেছে অনেকেই। এমন পরিবেশে সবেমাত্র যুদ্ধে নামতে যাওয়া ভারতীয় বাহিনী এবং স্বাধীনতাপাগল মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার মতাে শক্তি পাকবাহিনীর মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না; দ্বিতীয়ত, ইয়াহিয়া-চক্র ধারণা করেছিল, বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র তাদের দুই মিত্র, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ত্বরিতগতিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে, অন্তত বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় রােধকল্পে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও পূর্বতন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করবে। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন। সে উদ্যোগটি নিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু সােভিয়েত বাধার মুখে তাদের সে পরিকল্পনাটি ভেস্তে গিয়েছিল।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র