You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানকে সরবরাহকৃত মারণাস্ত্রের পরিসংখ্যান - সংগ্রামের নোটবুক
পাকিস্তানকে সরবরাহকৃত মারণাস্ত্রের পরিসংখ্যান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর ফুলব্রাইটের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এপ্রিল (‘৭১)-এর শেষদিকে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের কাছে অস্ত্রবিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছিল। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, পাকিস্তানে অতিগােপনে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল পেন্টাগন। কিন্তু অস্ত্র সরবরাহের এই গােপন তথ্য হঠাৎ করে ফাঁস হয়ে যায় জ্যাক এন্ডারসনের মাধ্যমে। ফাসকৃত এই গােপন দলিল, পরবর্তীকালে পরিচিতি লাভ করে ‘এন্ডারসন দলিল হিসেবে। সেই দলিল মােতাবেক জানা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ডিভিশন সৈন্যকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত করার এবং তাদের প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে পেন্টাগন। 
এছাড়া একটি জলবাহী জাহাজ, দুটি আকর্ষক জাহাজ ও একটি তেলবাহী জাহাজ আমেরিকা ইতালির কাছ থেকে ক্রয় করে এবং তা পাকিস্তানকে পাঠিয়ে দেয়। একটি ডুবােজাহাজ (পিএনএস গাজী) পাকিস্তানকে ধার দেয়া হয়। মার্কিন সামরিক সহায়তায় পাকিস্তানের সকল বিমানঘাটিকে ন্যাটোর মান অনুযায়ী তৈরি করা হয়। অনেকের হিসাব মতে, পাকিস্তানকে দেয়া মার্কিন সহায়তার মূল্যমান ১২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ‘৭১-এর জুন মাস থেকে চীন প্রতিদিনই ১০০টি লরিভর্তি সমর উপকরণ পাঠাতে পাকিস্তানে। এছাড়া পাঠিয়েছিল একদল সামরিক বিশেষজ্ঞ, যাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতাবিরােধী শক্তিকে গেরিলাযুদ্ধ বিরােধী প্রশিক্ষণ দান। চীন পাকিস্তানকে আরাে সরবরাহ করেছিল দুটি পদাতিক বাহিনী গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সামরিক উপকরণ, যার মধ্যে ছিল একে রাইফেল, হালকা ও মাঝারি মেশিনগান, ৬০ এম এম, ৮ এম এম, ১২০ এম এম মর্টার ও ১০০ এম এম ফিল্ডগান, ২২৫টি টি-৫৯ মাঝারি ট্যাঙ্ক। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জন্য চীন পাঠিয়েছিল ১ স্কোয়াড্রন ১১-২৮ বােমারু বিমান ও ৪ স্কোয়াড্রন মিগ-১৯ এবং নৌবাহিনীর জন্য বহু সংখ্যক গানবােট ও উপকূলীয় যান। ইরানের মাধ্যমে পশ্চিম জার্মানি সরবরাহ করেছিল ৯০টি এফ-৮৬ স্যার জেট, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ৬টি আলুম এফ হেলিকপ্টার, ২৪টি মিরেজ, ৩টি ফাইটার ও ৩টি ডুবােজাহাজ। ইরান দিয়েছিল ২৪টি লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবহন বিমান।
সৌদি আরব, লিবিয়া, সুদানও সমরাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল। বস্তুত বাইরে থেকে আসা এই বিশাল সমরাস্ত্র—সবই পাকিস্তান ব্যবহার করেছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। (ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড—অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, পৃ. ৩০, ৩১, ৪১, ৪২)। | [বি. দ্র. : মার্কিনিরা বাঙালির স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য আরাে যেসব ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহরের মাধ্যমে, এর মধ্যে ছিল— ক, ইউএসএস এন্টার প্রাইজ, যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যুদ্ধজাহাজ, এটি ৭৫ হাজার টনের বিশাল ভারবাহিত যান, যা ৫৭ দিনে ত্রিশ হাজার মাইল। পুনঃতেল বহন ছাড়াই চলতে পারে। স্বাভাবিকভাবে ২৮৭০ জন। পারসােন্যাল সত্ত্বেও জাহাজটি আরাে দুই হাজার লােকসহ ১০০টি বিভিন্ন ধরনের বিমান বহন করতে পারত।
খ, ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে ছিল ‘দি ত্রিপােলি’ নামের ১৭ হাজার ১০ টন সম্পন্ন একটি বড় ধরনের এমফিবিয়ান অ্যাসল্ট যুদ্ধজাহাজ, যা ৪টি বড়, ২৪টি মাঝারি এবং ৪টি পর্যবেক্ষক হেলিকপ্টার বহন করতে সক্ষম ছিল। তাছাড়া জাহাজটি ২১০০ জন অফিসার বা নৌসেনাসহ একটি নৌ ব্যাটালিয়নকে অস্ত্র, যানবাহন ও অন্যান্য উপকরণসহ বহন। করার ক্ষমতা রাখত।  গ, অন্য একটি জাহাজ ‘দি কিং’ মিসাইল ও টর্পেডাে দ্বারা সজ্জিত ছিল। সে। ভূমি থেকে ভূমি বা শূন্যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষমতা রাখত। ঘ, ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের সাথে আরাে ছিল ডেস্ট্রয়ার, টারটার, পারমাণবিক বােমা বহনে সক্ষম অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। কথা হলাে, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এসব মারণাস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, অবস্থা জোর প্রতিকূলে না থাকলে সে ওই অস্ত্রগুলাে অবশ্যই ব্যবহার করত। তাতে গুটিকয় ‘যুদ্ধপাগলের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ বা গােটা পৃথিবীর কী শােচনীয় দশাই না হতাে, কল্পনা করতেও কষ্ট হয় খুব।]
নতুন প্রেক্ষাপট : চেষ্টা, অপচেষ্টা ও দুশ্চেষ্টা
বাঙালি সমাজে কাউকে কষে গালি দেয়ার জন্য যেসব প্রাণীর নাম বেশি বেশি উচ্চারিত হয়, এর মধ্যে অভাগা প্রাণীটি হলাে—কুকুর। এই প্রাণীটি প্রভুভক্ত হিসেবে খ্যাত, এর অন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলাে, ভূমিকম্প হওয়ার অনেক আগেই তারা এর পূর্বাভাস পেয়ে যায়। ‘৭১-এর এপ্রিল-মে থেকে যুদ্ধকালীন যে শ্রেণিটি বর্বর পাকসেনাদের পক্ষ হয়ে ‘শান্তি কমিটি, ‘রাজাকার, আলবদর’ নাম ধারণ করে হত্যা-ধর্ষণসহ নানাবিধ কুকর্মে লিপ্ত হয়েছিল, অক্টোবর মাসে এসে তারা অনেকেই যেন কুকুরের মতাে পূর্বাভাস পেয়ে গেল, পাকসেনাদের পতন আসন্ন। যে রাজাকাররা অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় ‘শহীদি-শপথ নিয়েছিল, অক্টোবর মাস থেকে তারা মুক্তিবাহিনী দেখলে প্রতিরােধ গড়া তাে দূরের কথা, পড়িমরি করে পালিয়ে যাওয়া শুরু করল। কোথাও কোথাও রাজাকাররা গায়েপড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সন্ধি করতে লাগল, যার মূল শর্ত হলাে, সন্ধ্যের পর মুক্তিবাহিনী যদি কোনাে পাক ক্যাম্পে হামলা চালায়, তাহলে রাজাকাররা কোনাে প্রতিরােধ গড়া থেকে বিরত থাকবে, বিনিময়ে তাদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযােগ দিতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে এ রকম সন্ধির স্বরূপ প্রথম দেখা যায় ২৮ অক্টোবর, লৌহগঞ্জে। ওইদিন লৌহগঞ্জ থানায় কর্মরত ছিল ত্রিশ জন সশস্ত্র পাকিস্তানি পুলিশ, সাতান্ন জন রাজাকার।
সন্ধ্যের পর, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আগেই থানাটি রাজাকারশূন্য হয়ে যায়, ফলে স্বল্প জনবল নিয়ে মুক্তিযোেদ্ধাদের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ পাকপুলিশের সবাই বেঘােরে প্রাণ হারায়। অনুরূপ ঘটনা ঘটল ঢাকার নবাবগঞ্জে। সেখানে কর্মরত ছিল উনচল্লিশ জন রাজাকার, ঘটনার দিন সন্ধ্যের আগেই বত্রিশ জন রাজাকার উধাও হয়ে গেল, বাকি সাতজন কোনাে প্রতিরােধ না গড়েই মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এরপর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডজন তিনেক পাকিস্তানি পুলিশসহ থানাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল (আমি বিজয় দেখেছি, পৃ. ২৫০)। বস্তুত এসব খবর চারদিকে চাউর হতে সময় লাগেনি খুব, তাই দিনদিন এমন ঘটনা সংক্রামক ব্যাধির মতাে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।  একদিকে রাজাকার বাহিনীর লক্ষণীয় অসহযােগিতা, অন্যদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদের কাছে তৃতীয় ব্রিগেড ও ১০টি ব্যাটালিয়ন সৈন্য চেয়ে মাত্র দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য প্রাপ্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক অবস্থা তদারকিতে উচ্চপর্যায়ের কোনাে কর্মকর্তার ঢাকায় না আসা—এসব বৈরী অবস্থা জেনারেল নিয়াজিকে হতাশার সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়; খুব সুরক্ষিত স্থানেও পাক পদস্থ কর্মকর্তারা যে নিরাপদ নয় আর, এর প্রমাণ পেলেন নিয়াজি ২৩ অক্টোবর, গেরিলাবাহিনী কর্তৃক ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী বনানী এলাকায় প্রাক্তন গভর্নর মােনায়েম খানের হত্যাকাণ্ড দেখে। তার হতাশা, মনােযন্ত্রণার প্রতিফলন দেখা যায় তারই লেখাতে : “It is a pity that during these eight months neither the President and the C-in-C nor the Principal staff officer, Adjutant General, Quarter Master General, and Master General Ordinance, ever visited us. General Hamid COS and General Gul Hasan did not bother even to ring me up…’ জেনারেল নিয়াজির খেদ আরাে বেড়ে যায়, তার প্রেসিডেন্টের কথা শুনে, ২১ নভেম্বর ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী যৌথভাবে পাকসেনাদের ওপর তীব্র আঘাত হানার পর ইয়াহিয়া নাকি বলেছিলেন, What can I do for East Pakistan? I can only pray (The Betrayal of East Pakistan, page-191-200).
হ্যা, ইয়াহিয়া তখন প্রার্থনা করছিলেন বটে, তবে তা পূর্ব পাকিস্তানে। অবস্থানরত সৈন্যদের জন্য নয়, তিনি প্রার্থনায় বসেছিলেন যাতে চীন ও আমেরিকা অতি তার পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে যায়। ইতােমধ্যে ইয়াহিয়াসহ পাকিস্তানের সকল যুদ্ধবাজ সামরিক কর্মকর্তাগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ভারত-বাংলাদেশের যৌথ আক্রমণ প্রতিরােধ করার শক্তি তাদের নেই, এক্ষেত্রে চীন-মার্কিন সহায়তাই কেবল রক্ষা করতে পারে অত্যাসন্ন শােচনীয় পরাজয়। এক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা খুব। বেশি স্পষ্ট না হলেও, ওয়াশিংটনের তৎপরতা লক্ষণীয় বেশ; ২১-২২ নভেম্বর, বয়রা-চৌগাছায় পাক-ভারতের মধ্যে সীমিত সংঘর্ষের পর ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ’-এর বৈঠকে হেনরি কিসিঞ্জার যুদ্ধ শুরু করার জন্য ভারতকে দায়ী করেন এবং অঙ্ক্ষিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু খােদ মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরই কিসিঞ্জারের সাথে ভিন্নমত পােষণ করে, বরং তারা আরাে কিছু দাবি-দাওয়া মানার জন্য পাক সরকারকে চাপে রাখার কথা বলে। কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার তখন পাকিস্তান রক্ষায় এতই বেপরােয়া যে, তারা না নিজের দেশের জনমত, না বিশ্বজনমত—কোনােকিছুকেই বিবেচনায় আনতে অনিচ্ছুক, পাকিস্তানের হতদ্দশাকে তারা যেন ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বহুদাবিভক্ত করতে না পারার ব্যর্থতাজনিত জ্বালা, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করার অক্ষমতাজনিত ক্রোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির মুখে পাকিস্তানের ভরাডুবির আশঙ্কা—এই সমস্ত কিছুর ফলে পুঞ্জীভূত মার্কিনি উত্তাপ অংশতঃ নির্গত হয় সােভিয়েত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
ফলে সূচনায় যা ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট, তা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বলদর্পী বুদ্ধিভ্রংশতায় উপমহাদেশীয় সংকটে পরিণত হয় এবং মার্কিন প্রশাসনের ন্যায়নীতি বিবর্জিত পৃষ্ঠপােষকতা ও ভ্রান্ত পরামর্শের ফলে এই সংকটের জটিলতা ও পরিসর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মার্কিন প্রশাসনের চিরাচরিত বিশ্ব পাহারাদারীর মনােবৃত্তির প্রভাবে পাকিস্তানের আট মাস আগের অভ্যন্তরীণ সংকট বিশ্ব সংঘাতের রূপ ধারণ করে।” (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৭৩)। | নিজ দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’-এর কার্যনির্বাহী উপসংস্থা ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ’-এর যুদ্ধবিষয়ক সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে কিসিঞ্জার দ্রুত চলে যান নিউইয়র্কে এবং সেখানে জাতিসংঘের সদ্য নিযুক্ত চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়ার সাথে একান্তে কথা বলেন। হুয়াং হুয়াকে তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশীয় রাজনীতির খুঁটিনাটি দিক ব্যাখ্যা করেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে পাকিস্তানের পক্ষে যে প্রস্তাবটি উপস্থাপিত হবে, এই খসড়াটি হুয়াং হুয়াকে পড়ে শােনান। কিন্তু কিসিঞ্জার আবারাে আশাহত হন এজন্য যে, হুয়াং হুয়া তার কথায় প্রত্যাশিত সাড়া না দিয়ে শীতল জবাব দেন, চীন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানকে সমর্থন জানাবে, তবে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের ব্যাপারে চীন নিজে কোনাে ভূমিকায় না গিয়ে পাকিস্তান কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের অপেক্ষায় থাকবে। চীনের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট কিসিঞ্জার আবারাে শরণাপন্ন হন ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ (ডব্লিউএসএজি)-এর, জোর চেষ্টা চালান স্টেট ডিপার্টমেন্টের সমর্থন নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা অধিবেশন ডাকতে। তার উদ্দেশ্য ছিল নিরাপত্তা পরিষদে ‘বয়রা-চৌগাছায় ভারতীয় হামলাকে আগ্রাসন হিসেবে উপস্থাপিত করে চীনসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলাের সমর্থন আদায় করে নেয়া এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধবিরােধী মার্কিনি ও বিশ্বজনমতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা। কিন্তু মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট আবারাে নিজদেশের প্রবল জনমতকে বিবেচনায় নিয়ে কিসিঞ্জারের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেয়।
এবার যুদ্ধবাজ নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র নতুন হিসেব-নিকেশ শুরু করে—পাকিস্তান প্রশ্নে সােভিয়েত অবস্থান ঘাের মার্কিনবিরােধী, চীনের অবস্থানও আশাপ্রদ নয়, ইন্দিরা গান্ধীর ফ্রান্স সফরের পর ফরাসি সরকারের সমর্থন হেলে আছে ভারতের দিকে, ফলে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে বাকি রইল কেবল ব্রিটেন। ২৬ নভেম্বর, প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং পাকিস্তান-প্রসঙ্গটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন। কিন্তু হিথ এ ধরনের উদ্যোগ নিতে অসম্মতি জানান; নিক্সনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কিসিঞ্জার আবারাে ধরনা দেন চীনের কাছে, আবারাে তিনি প্রাপ্তিহীন হয়েই ফিরে আসেন। প্রশ্ন হলাে, নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন তাে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ডাকতে পারত, কিংবা এ ব্যাপারে নিক্সন নিজেই নির্দেশ দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে রাজি করাতে পারতেন। নিক্সন প্রশাসন তা করেনি, প্রথমত, প্রবল জনমতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান বিষয়ে আর কিছু করতে গেলে সেটা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে, দ্বিতীয়ত, এই কাজটিই অন্যকে দিয়ে করাতে পারলে জনমত পরিবর্তনের বড় কোনাে সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার খুবই লক্ষণীয় যে, একদিকে নিক্সন-কিসিঞ্জার দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক পর্যায়ে আলােচনা করে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিলেন, অন্যদিকে বৃহত্তর যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি হিসেবে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহেই সপ্তম নৌবহরকে সচল করেছিলেন বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।
কিন্তু অন্যকে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকানন, কোনাে বৃহৎ শক্তিকে কাছে টানতে পারা, মার্কিন ও বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করা—সকল বিষয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর সপ্তম নৌবহরের অগ্রযাত্রায় ছেদ টানা হয়। | ইতঃপূর্বে বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত চুক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, বহিঃশত্রু দ্বারা পাকিস্তান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তার সার্বিক সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। এবার ২ ডিসেম্বর, হঠাৎ করে পাকিস্তান নিজেকে আক্রান্ত দেশ হিসেবে দাবি করে বসে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তা কামনা করে। এক মাস আগে ওয়েলার্ট-উত্থাপিত এমন দাবি স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পাকিস্তানের তরফ থেকে অনুরূপ দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে কে কলকাঠি নাড়িয়েছিলেন, এটা বোেঝ যায় ৩ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার প্রদত্ত বক্তব্য থেকে। ওইদিনই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপসংস্থা ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের জরুরি সভা ডাকা হয় এবং এতে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকাসহ পাকিস্তানের জন্য সম্ভাব্য সকল সহায়তা অন্বেষণের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্তরিক সমর্থন কামনা করেন। তখন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের প্রচেষ্টা ছিল : (১) নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েত ভেটোর আশঙ্কা সত্ত্বেও উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার জন্য জাতিসংঘকে যতদূর সম্ভব ব্যবহার করা; এবং (২) ১৯৫৯ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার অধীনে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের উপকূলভাগের উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু করা। একমাত্র প্রথম লক্ষ্য অর্জনের পরেই দ্বিতীয় ও মূল পদক্ষেপ গ্রহণ করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সম্ভব ছিল’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৭৭)।
২৩ নভেম্বর, ইয়াহিয়া-ঘােষিত দশ দিন’ নিঃশেষিত হওয়ার আগের দিন পাকিস্তান নিজেকে আক্রান্ত হিসেবে দাবি করা এবং পরের দিন ভারতীয় স্থাপনার ওপর আগ্রাসী বিমান হামলা এবং হামলা চালানাের ছ’ঘণ্টার মধ্যেই (তখনও আক্রান্ত দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনাে রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি) মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে কিসিঞ্জারের আলােচনাপর্যালােচনা ইত্যাদি বিষয় থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণ, এটা কেবল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সিদ্ধান্তজাত পদক্ষেপ নয়, এর পেছনে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বড় ধরনের প্রভাব ছিল। বস্তুত এই দুজন যুদ্ধবাজ উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য আপাত-গ্রহণযােগ্য কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু যুৎসই কারণ না পেয়ে অগত্যা পাকিস্তানকে ‘আক্রান্ত হিসেবে প্রতিপন্ন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের মনােভাবও ছিল অনুরূপ প্রায়, মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত পাকসেনাদের বেগতিক অবস্থা দেখে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার মনে হলাে, এভাবে পড়ে পড়ে মার খেয়ে আত্মসমর্পণ করার আগে দুই মিত্রশক্তি চীন-মার্কিনকে জাগিয়ে ভােলা দরকার, কারণ এই দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসলামাবাদের বিপর্যয়কালে নিশ্চয়ই নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকবে না। এমন স্বপ্ন ও আকাক্ষার বশবর্তী হয়ে, (সেইসাথে মার্কিন প্ররােচনায় প্রভাবিত হয়ে) ৩ ডিসেম্বর, পাকসেনারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিমানবন্দরগুলােতে বিমান হামলা চালায় এবং পূর্ব পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে একযােগে স্থল হামলা শুরু করে। ভারত আক্রমণের আগে পাকিস্তানি সমরবিদদের মনে দুটো ধারণা কাজ করেছিল-(১) পশ্চিমাঞ্চলে জম্মু ও কাশ্মিরের একাংশ দখল করে নিতে হবে; তাতে পূর্বাঞ্চলের কোনাে ভূখণ্ড যদি ভারতের দখলে চলেই যায়, তাহলে জম্মু ও কাশ্মিরের দখলকৃত অংশ নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে দর কষাকষি করা যাবে।

ভারত নিশ্চয়ই নিজের ভূখণ্ডের দাবি ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানের দখল করা ভূখণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাইবে না। (২) পূর্ব পাকিস্তানের নদীনালাবেষ্টিত ভূখণ্ডে খুব দ্রুত অগ্রসর হওয়ার মতাে সামরিক সরঞ্জামাদি ভারতের নেই; তাছাড়া পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনী নিজেদের অঞ্চলে দুর্গ ও বাঙ্কার খনন করে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এই দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভারতীয় বাহিনী খুব সুবিধে করতে পারবে, এমন আশঙ্কা পাকিস্তানিরা আমলে নেয়নি। বস্তুত পাকিস্তানের সমর পরিকল্পনায় কেবল ভারতীয় বাহিনীকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, বাংলা মায়ের দামাল মুক্তিযােদ্ধা বা পাকিস্তান-বিদ্বেষী স্থানীয় জনগণকে কোনাে বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি। পাকিস্তানি রণনীতির এই ভুল সিদ্ধান্ত ভারতীয় বাহিনীর জন্য মহা আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। তাছাড়া আরাে কটি জায়গায় ভ্রান্তনীতির ফাঁদে পা দিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমত, গত মার্চ মাস থেকে হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ এসব অপকর্মে পাকিস্তান বাহিনী এতই মশগুল থেকেছে যে, যুদ্ধ করার মতাে নৈতিক সাহস ও মনােবল ইতােমধ্যে তারা হারিয়ে ফেলেছে। এর উপর অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবল আক্রমণ, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত গেরিলা হামলা ইত্যাদির ফলে পাক-সৈন্যরা ছিল পরিশ্রান্ত, উদ্যমহীন। তাছাড়া পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর—তারা অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের আঁচ পেয়ে ইতােমধ্যে পালিয়ে গেছে অনেকেই। এমন পরিবেশে সবেমাত্র যুদ্ধে নামতে যাওয়া ভারতীয় বাহিনী এবং স্বাধীনতাপাগল মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার মতাে শক্তি পাকবাহিনীর মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না; দ্বিতীয়ত, ইয়াহিয়া-চক্র ধারণা করেছিল, বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র তাদের দুই মিত্র, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ত্বরিতগতিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে, অন্তত বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় রােধকল্পে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও পূর্বতন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করবে। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন। সে উদ্যোগটি নিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু সােভিয়েত বাধার মুখে তাদের সে পরিকল্পনাটি ভেস্তে গিয়েছিল।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র