You dont have javascript enabled! Please enable it!
আক্রান্ত ভারত : সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা
৩ ডিসেম্বর, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসেছেন কলকাতায়। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় ভাষণ দেবেন তিনি। এখানে তাঁর আসার কথা ছিল ৪ তারিখ। সে অনুযায়ী উদ্যোক্তারা পােস্টার, লিফলেটও ছাপিয়ে ফেলেছিলেন।  ১ ডিসেম্বর, দিল্লি থেকে জানানাে হলাে, ইন্দিরাজির কলকাতা আগমনের তারিখ একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। এই নিয়ে কলকাতার বাঙালি সমাজে,  বিশেষত মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থীদের মাঝে কত কী জল্পনা-কল্পনা। এবার ইন্দিরা কি নতুন কোনাে কথা শােনাবেন? স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করবেন? যথাসময়ে ইন্দিরা মঞ্চে উঠলেন, ভাষণও দিলেন। তার কথায় নতুনত্ব কিছু নেই, রণহুঙ্কার নেই। নিক্সন-কিসিঞ্জার বা ইয়াহিয়া-নিয়াজির আগ্রাসন সম্পর্কে একটা কথাও নেই। শরণার্থী সমস্যা, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের শােচনীয় নীরবতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে তিনি যখন কথা বলছিলেন, (অনেকের লেখায় বলা হয়েছে, ভাষণ শেষে তিনি যখন বিশিষ্টদের সাথে মতবিনিময় করছিলেন, তখন তাকে চিরকুটটি দেয়া হয়েছিল; আর ইন্দিরা গান্ধীর নিজের কথা, তিনি যখন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন  একজন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে চিরকুটটি দিলেন, মাই টুথ, পৃ. ১৫৬) তখন একজন জেনারেল, জগজিৎ সিং অরােরা ইন্দিরার হাতে ছােট্ট একটা চিরকুট তুলে দিলেন। ইন্দিরা কিছুক্ষণ বাকহীন হয়ে রইলেন, তারপর অতি ভাষণ শেষ করে রওনা হয়ে গেলেন দিল্লির উদ্দেশে।
কিছুক্ষণের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, ভারতের বেশ ক’টি স্থানে বিমান ও স্থল হামলা করেছে পাকিস্তান। ওইদিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ছিলেন পাটনা সফরে, অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন ছিলেন বােম্বেতে। দুজনকেই জরুরি ভিত্তিতে দিল্লি আসতে বলা হলাে; এরপর মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকের সম্মতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। মধ্যরাতে (তখন ডিসেম্বর ৩ অতিক্রান্ত হয়ে ৪ তারিখ হয়ে গেছে) প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ  Thor : I speak to you at a moment of grave peril to our country and to our people. Some hour ago, soon after 5.30 p m on December 3, 1971, Pakistan launched a full-scale war against us. … Today the war in Bangladesh has become a war on India. This has imposed upon me, my Government and the people of India great responsibility. We have no other option but to put our country on a war footing. Our brave officers and Jawans are at their post mobilized for the defence of the country. An emergency has been declared for the whole of India. Every necessary step is being taken and we are prepared for all eventualities. Aggression must be met and the people of India will meet it with fortitude and determination and with discipline and utmost unity. 
ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে, বাংলাদেশ-ভারতের মিলিত বাহিনী, পরবর্তীকালে যা পরিচিতি পেয়েছে মিত্রবাহিনী হিসেবে, ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নেতৃত্বে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিমিষের মধ্যে শত শত ভারতীয় যুদ্ধবিমান। আকাশে উড়ল, স্বল্প সময়ের মধ্যে কুর্মিটোলা, তেজগাঁও, চট্টগ্রাম, যশাের, কুমিল্লাসহ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত সকল বিমানঘাঁটিতে সফল হামলা চালাল। প্রথম দিনেই পাকিস্তানের ১০টি এফ ৮৬ স্যার জেট, ৩টি পর্যবেক্ষণ বিমান ও ১টি টারবাে প্রুফ বিমানসহ মােট ১৪টি বিমান ভূপাতিত হলাে, রানওয়েগুলােতে পুকুরের মতাে গর্ত তৈরি হলাে, এবং বলা যায় ওই একদিনের আক্রমণেই পাকিস্তানের আকাশযুদ্ধের শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে পড়ল। নৌবাহিনীর অবস্থাও তথৈবচ, বিশাখাপত্তনম উপকূলের কয়েক মাইল দূরে ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রাজপুত-এর ডেপথ-চার্জে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী নৌ যুদ্ধযান পিএনএস গাজি টুকরাে টুকরাে হয়ে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গাজিতে ৮৯ জন অফিসারসহ অগণিত নৌসেনা ছিলেন, তবে মৃতদেহ পাওয়া যায় মাত্র তিনজনের। অন্যদিকে বাংলাদেশভারতের স্থলবাহিনী সীমান্তের বিভিন্ন দিক দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। একদল আসে কোচবিহার থেকে রংপুর অভিমুখে, একদল আসে পঞ্চগড় হয়ে দিনাজপুরের দিকে, একদল কুষ্টিয়া দিয়ে ঢুকে তিন ভাগ হয়ে যাত্রা করে খুলনা, যশাের ও ফরিদপুরের দিকে একদল তুরা দিয়ে ঢােকে দুই ভাগ হয়ে জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা এবং ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে যাত্রাপথে তারা প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়েছে বটে, তবে সেই প্রতিরােধব্যবস্থা তছনছ করে দিতে খুব বেশি বেগ পপাহাতে হয়নি মিত্রবাহিনীর। মিত্রবাহিনীর রণনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা কখনাে পাকসেনাদের ঘাটি বরাবর অগ্রসর হতাে না, শত্ৰুৰ্ঘাটিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেত। এই রণকৌশল পাকবাহিনীকে দ্বন্দ্বে ফেলে দিত, কেননা স্বাভাবিক ধারণাবশত তারা মূল সড়কগুলাে আগলে বসে থাকত, কিন্তু মিত্রবাহিনী মূল সড়ক ব্যবহার না করে হাঁটত অন্য পথ দিয়ে, কাজেই পাকবাহিনী বুঝতে পারত না মিত্রবাহিনী ঠিক কোন পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে।’ (‘৭১-এর দশ মাস : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, পৃ. ৫৪৭)।

৩ ডিসেম্বর, পাকবাহিনী কর্তৃক ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে দুই দেশের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও, ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘােষণা করেন পরদিন, অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর। টিভি ও বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া বলেন, Our enemy has once again challenged us…march forward. Give the hardest blow of Allah ho Akbar to the enemy…Pakistan Paindabad. | একই দিনে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এক জরুরি বার্তায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘In view of the direct aggression committed by Pakistan against your country on 3rd of December, the freedom forces of Bangladesh are ready to fight the aggressive force of Pakistan in Bangladesh, in any sector or in any front. Our joint stand against military machinations of Pakistan would be further facilated, if we enter into formal diplomatic relations with each other.’

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!