You dont have javascript enabled! Please enable it!
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা এবং…
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ অনুধাবন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল তকালীন মুসলিম বিশ্ব। ওই যুদ্ধের সময় পৃথিবীর বহু দেশ আমাদের সমর্থন দিয়েছে, কোনাে কোনাে দেশ নিরপেক্ষ। ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কোনাে মুসলিম দেশ আমাদেরকে সমর্থন দান তাে দূরের কথা, নিরপেক্ষ ভূমিকাও পালন করেনি, সবগুলাে দেশ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে মিলিটারি শাসনাধীন পাকিস্তানকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে। তাদের চোখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল, ‘ইসলামী ঐক্য-বিরােধী অপ্রয়াস’ বা ‘ইসলামী সংহতির প্রতি হুমকি’। তাই ‘৭১ সালে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) জেদ্দা সম্মেলনে সংস্থাভুক্ত ২২টি দেশ অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌছায় যে, ‘জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে যেতে হবে। ওই অধিবেশন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সমর্থন জানানাের পাশাপাশি, যেসব বিদেশি শক্তি পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশের ষড়যন্ত্র করছে, তাদেরকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানানাে হয়। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের মনস্তত্ত্বটি ছিল এ রকম—‘পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ। তার সাথে প্রতিবেশী হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ভারতের সম্পর্ক সর্বদাই শত্রুভাবাপন্ন। তাই ভারত নিজের স্বার্থে পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রটি আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কতিপয় বিপথগামী বাঙালি ছাত্র-যুবাকে লেলিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের ঐক্য বিনাশের জন্য। ভারতীয় ষড়যন্ত্র, যার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে নাস্তিক কমিউনিস্টের দেশ সােভিয়েত ইউনিয়ন—মুসলিমবিরােধী এই ‘রুশ-ভারতীয় চক্রান্তকে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে অবশ্যই প্রতিহত করতে   হবে।’
যুক্তিবর্জিত ধর্মীয় উন্মাদনা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, ইরান ওই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা ঘােষণা করেছিল; অন্য দেশগুলাে পাকিস্তানকে প্রয়ােজনীয় সহযােগিতা প্রদান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল। মিশরই একমাত্র দেশ, যে কি না আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী ছিল। পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা থেকে বিরত রাখার জন্য মার্কিন কংগ্রেস যখন নিক্সন প্রশাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছিল, তখন সৌদি আরব, লিবিয়া, ইরানসহ বেশ ক’টি মুসলিম দেশ জঙ্গিবিমান, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর ইরান বিবৃতি পাঠিয়েছিল ২৯ মার্চ, ইরান বিশ্বের সকল দেশের প্রতি পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানাচ্ছে।’ (দ্য পাকিস্তান অবজারভার, ৩১.০৩.১৯৭১)।  ইসলামী সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল ও মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুর রহমান ২৯ মার্চ বলেন, ইসলামী সেক্রেটারিয়েট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’ (পাকিস্তান অবজারভার, ৩১.০৩.১৯৭১)।  অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার আলেম সমাজ, আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ এবং খতিবগণ পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারত যেন হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে প্রভাব খাটানাের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল। একই ধরনের আহ্বান জানিয়ে বার্তা প্রেরণ করেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। পাকিস্তানের অখণ্ডতা, শান্তি ও সংহতি কামনা করে ইন্দোনেশিয়ার মসজিদে মসজিদে মুনাজাত করা হয়েছিল। (দৈনিক সংগ্রাম, ০১.০৫.১৯৭১)।
জানুয়ারির ৩০ ‘৭১ তারিখে, কথিত দুই কাশ্মিরি তরুণ ভারতীয় ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান ‘গঙ্গা’ ছিনতাই করে পাকিস্তানের লাহােরে নিয়ে যায় এবং ফেব্রুয়ারি ২ তারিখে সকল যাত্রীকে মুক্তি দিয়ে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিমানটি উড়িয়ে দেয়। এ প্রেক্ষিতে ভারত তার আকাশসীমার উপর দিয়ে সকল পাকিস্তানি বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে শ্রীলঙ্কা, তাদের কলম্বাে বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযােগ দেয় পাকিস্তানকে। পাকিস্তান তখন সৈন্য, অস্ত্র, গােলাবারুদ, নানাবিধ যুদ্ধসরঞ্জামাদি কলম্বাের উপর দিয়ে নির্বিঘ্নে নিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তানে, কিছুদিন পরে সেই যুদ্ধাস্ত্রগুলাে বাঙালি নিধনযজ্ঞে ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই একাত্তরে গণহত্যার দায় কিছুটা হলেও শ্রীলঙ্কার কাঁধে বর্তায় বৈকি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ইসরাইলের ভূমিকা ছিল খুবই কৌতূহলােদ্দীপক; বাঙালির ওপর পাকবাহিনীর পাশবিকতা ও বেপরােয়া ধ্বংসলীলার নিন্দা করে ইসরাইলের সংসদ একটা প্রস্তাব পাস করেছিল ২ জুলাই ‘৭১; এরপর শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে রাষ্ট্রটি ওষুধ, খাবার, কাপড়চোপড়ও প্রেরণ করেছিল। ইসরাইলের এই সাহায্য-উদ্যোগের মধ্যে ‘মানবিকতাবােধ’ কতটুকু ছিল তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু এর মধ্যে কূটনৈতিক কৌশল যে যথেষ্ট ছিল তা বােঝা যায় সহজেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গােটা মুসলিম বিশ্বের অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, এ প্রেক্ষিতে সংগ্রামরত বাঙালিকে সাহায্য করে ইসরাইল বাঙালি মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জন করতে চেয়েছিল।
কিন্তু মুজিবনগর সরকার অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, ইসরাইলি সহায়তা গ্রহণ করলে মুসলিম বিশ্ব প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়বে এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন যে ইসলামবিরােধী, ভারত-সােভিয়েত-ইসরাইল রাষ্ট্রের সুনিপুণ চক্রান্ত মাত্র, তা প্রমাণ করার জন্য আরাে মরিয়া হয়ে উঠবে। তাই মুজিবনগর সরকার ইসরাইলি ফাঁদে পা না দিয়ে তাদের সহায়তা দানের উদ্যোগকে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিল (বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, ড. সৈয়দ আনােয়ার হােসেনের প্রবন্ধ, পৃ. ৪০২)। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জাপানিদের ভূমিকা অপরিসীম হলেও, এ বিষয়টি বরাবরই অনালােচিত থেকে গেছে। ‘জলশূন্য পথের পাশে পড়ে থাকা মৃতদেহ ভক্ষণরত কয়েকটি কুকুরের ছবি’ জাপানি পত্রিকা ‘মাইনিচি শিমুন’এ প্রকাশিত হওয়ার পর পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে জাপানিদের মনে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপান যেহেতুে মার্কিন কর্তৃত্বাধীন দেশ, তাই জাপানের শাসকদল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নির্যাতিত বাঙালির পাশে এসে দাঁড়াতে পারেনি, তবে সে দেশের জনগণ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই মানবিক কাজটি করে গেছেন নিরলসভাবে, জাপানে বাংলাদেশ সলিডারিটি কমিটির মাধ্যমে। জাপান কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হিদেও তাকানাে, ওসাকার কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তসুরুশিমা, সংস্কৃতিকর্মী কেন আরিমিৎসু, সমাজকর্মী তাদামাসা ফুকিউরা, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার নাগিসা ওশিমা প্রমুখের নেতৃত্বে জাপানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে।
এবং শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। তাকামাসা সুজুকি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণার জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে মাইক নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন এবং জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ’ গানটির রেকর্ড বাজিয়ে জাপানের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। লে. জেনারেল ফুজিয়ারা, যিনি ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযােগী, তিনি বাংলাদেশ বিষয়টিকে মানবিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে জাপান সরকারের সমর্থন আদায়ে সনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
 
আলােচনার আড়ালে যুদ্ধ প্রস্তুতি  
 
৭ অক্টোবর, ইয়াহিয়া খান জরুরি এক বার্তা পাঠান কিসিঞ্জারের কাছে, যাতে উপমহাদেশের অবনতিশীল অবস্থা রােধকল্পে নিক্সনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ কামনা করা হয়। ওইদিনই কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপসংস্থা ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ’-এর জরুরি সভা আহ্বান করেন এবং মূলত পাকিস্তানের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানাের জন্যই পাক-ভারত সীমান্ত থেকে বিবদমান দুই পক্ষেরই সৈন্য প্রত্যাহার এবং ভারত যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধা প্রেরণ না করে—সেজন্য সােভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতকে চাপ প্রয়ােগ করানাে বা দুই দেশের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল নিয়ােগ-ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। ১২ অক্টোবর নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, ভারত যদি মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য প্রদান করা থেকে বিরত না হয়, তাহলে পাকিস্তান পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণ করার আশঙ্কা আছে (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১২৩)। সােভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশীয় পাক-মার্কিন কূটচালের ব্যাপারে অনবহিত ছিল না, সে অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, ১২ অক্টোবর, ইয়াহিয়ার ভাষণে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসনে নির্বাচনের ঘােষণা (এসব আসনের নির্বাচিত সদস্যগণ মুজিবনগর সরকারের সাথে যােগ দিয়েছিলেন বিধায় এগুলােকে শূন্য আসন হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছিল), মূলত তার হত্যা, নির্যাতন, নৃশংসতার ওপর ‘গণতান্ত্রিক আবরণ দেয়ার দুশ্চেষ্টা মাত্র এবং এটিকে নিষ্কণ্টক করার জন্য পাক-ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য ধূম্রজালপূর্ণ মার্কিন-প্রস্তাবের অবতারণা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত  নতুন প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে অক্টোবরের শেষদিকে সােভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল কুটাকভকে নয়াদিল্লি সফরে পাঠানাে হয় এবং ১ নভেম্বর থেকে আকাশপথে ভারতের জন্য সােভিয়েত সামরিক সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
নভেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, পূর্ব বাংলায় তাদের যে সামরিক শক্তি মজুদ আছে, তা দিয়ে ভারতবাংলাদেশের যৌথশক্তিকে মােকাবিলা করা সম্ভব নয়; এ পরিস্থিতিতে তারা চীন-মার্কিনসহ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘যুদ্ধবিরতির কার্যকর উদ্যোগ কামনা করে যাচ্ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল, চীনকে প্রভাবিত করে যদি তাকে সিকিম সংলগ্ন চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর সীমান্ত বরাবর ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করানাে যায় এবং সে নিজে যদি সপ্তম নৌবহরের জাহাজবাহিত বিমানের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর বিমান। আচ্ছাদন বিস্তার করে নৌসেনা অবতরণের (মূলধারা ‘৭১, পৃ-১৪৫) বন্দোবস্ত করতে পারে, তাহলে উপমহাদেশীয় পুরাে সামরিক পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অনুকূলে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। ৩ নভেম্বর, বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট–পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ওই চুক্তির শর্তানুসারে, পাকিস্তান যদি বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের অস্ত্র ও সৈন্যদল সহযােগে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। ওয়েলার্ট ইচ্ছে করেই ওই চুক্তিটির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, দৃশ্যত ভারতের মনে ভীতি সঞ্চার করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য, যাতে দেশটি পাকিস্তান সংক্রান্ত সমস্যা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া শুরু করে।
ওই চুক্তির একটা ধারায় বলা হয়েছিল, পাকিস্তান যদি কোনাে কমিউনিস্ট দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সার্বিক সহায়তাকল্পে এগিয়ে আসবে’, যেহেতু ভারত কোনাে কমিউনিস্ট দেশ নয়, কাজেই ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত পাক-মার্কিন চুক্তি ভারতের জন্য প্রযােজ্য হওয়ার কথা নয়। তারপরও নয়াদিল্লিকে সতর্কতামূলক ভূমিকায় যেতে হয়েছিল, কারণ তার আশঙ্কা ছিল, ওই চুক্তির ফাঁক-ফোকড় ধরে যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েই নেয়—যার পূর্ব প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে ওয়েলার্টের সাম্প্রতিক বক্তব্য, তাহলে তা প্রতিরােধ করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায় আগে থেকেই স্থির করে রাখলে পরবর্তী পর্যায়ে কাজে লাগবে খুব। ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে নিক্সন প্রশাসনের অভাবনীয় শীতলতা প্রদর্শন, একই সময়ে ভারতকে ওয়েলার্টের হুমকি প্রদান, চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার পাক-মার্কিন জোটের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, এসব বৈরী পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও, ফ্রান্স সফরকালীন অনুকূল সাংবাদিক সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছিল দীপ্ত প্রত্যয়, পূর্ব বাংলার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, শীঘ্রই হােক আর দেরিতেই হােক, এ স্বাধীনতা আসবেই (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ৯ নভেম্বর, ৭১)। একই সময়ে বিশ্বের সচেতন রাজনৈতিক মহল (কেবল ভুট্টো-ইয়াহিয়া ও তাদের ইয়ার বন্ধুরা ছাড়া) এবং প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোেও সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়। ৬ নভেম্বর, ‘স্যাটারডে রিভিউ ম্যাগাজিন’-এ চেস্টার বাওয়েলস দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘Without massive economic and military assistance from United States, it is unlikely that West Pakistan can reassert its authority over East Pakistan. For better, or for worse, the die has been cast; East Pakistan will eventually win its independence.’
বিশ্বখ্যাত পত্রিকা গার্ডিয়ান ৯ নভেম্বরের সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখেছিল, The West Pakistani Generals, in sort, have come to the end of their path of bungling violence. They can battle and lose or talk and quit. They cannot hang on.’ শরণার্থী-সমস্যা দূরীকরণার্থে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান নামক অপশক্তিকে পরাভূত করা ছাড়া অন্য কোনাে পথ নেই—এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সে প্রেক্ষিতে যথাযথ সৈন্য সমাবেশের কাজ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নয়াদিল্লি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল এজন্য যে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য হিসেবে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করে দুর্নাম কুড়ােতে চাইছিল না সে, তাছাড়া এর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নিয়েও তার শঙ্কা ছিল ঢের। নয়াদিল্লি খুব করে প্রত্যাশা করছিল প্রথম আক্রমণটা যেন ইয়াহিয়ার দিক থেকে আসে, যাতে সে বলতে পারে আক্রান্ত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি।’ (এ ধরনের কৌশলের অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর পশ্চিম বাংলার বয়রা এলাকা থেকে ট্যাঙ্কসহ দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে যশাের জেলায় অবস্থান নিয়েছিল। ১৯ ও ২১ নভেম্বর, দুবার পাকিস্তান বাহিনী শত্রুসেনার ওপর আঘাত হেনেছিল। কিন্তু দুবারই শত্রু বিতাড়নে ব্যর্থ হয়ে নীরবে ফিরে এসেছিল তারা; নয়াদিল্লির ধারণা ছিল, এই অনুপ্রবেশের ফলে পাকিস্তান নিশ্চয়ই তেতে উঠবে, ক্রুদ্ধ হয়ে বড় কিছু করে বসবে, আর তখনই…)। নয়াদিল্লির সেই প্রতীক্ষানীতি’ কাজ দিল অবশেষে, ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন এবং ওই দিনই তক্ষশীলায় এক অনুষ্ঠানে, চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে জানান দেন, আগামী দশদিনের মধ্যে তিনি হয়তাে রাওয়ালপিন্ডিতে থাকবেন , যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবেন। 

ঠিক একই দিন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে জাতির উদ্দেশে বলেন, মুক্তিবাহিনী এখন যে কোনাে সময়ে, যে কোনাে জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমন কি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে।… অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতম হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরাে আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়ােজন আছে।… ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি এক বিশ্বশক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দমন করা যায় না। …বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিকচক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া। তা করার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি…।’

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!