You dont have javascript enabled! Please enable it! যুক্তরাজ্য : রাজনীতির ক্ষেত্রে মতের স্নিতা আছে, তবে মানবতার প্রশ্নে সবাই অভিন্ন - সংগ্রামের নোটবুক
যুক্তরাজ্য : রাজনীতির ক্ষেত্রে মতের স্নিতা আছে, তবে মানবতার প্রশ্নে সবাই অভিন্ন
যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র—দুটি রাষ্ট্রই উন্নত গণতন্ত্রের প্রতিভূ হলেও, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রথমটি গণতন্ত্র ও মানবিকতন্ত্রের অনুসারী, আর দ্বিতীয়টি কেবল বলতন্ত্রে বিশ্বাসী। কাউকে বশে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পদক্ষেপেই থাকে অস্ত্রের ব্যবহার, আর যুক্তরাজ্য অস্ত্র হাতে নেয় সর্বশেষ পদক্ষেপে। ১৯৭১ সালে, যুক্তরাজ্য না ছিল ভারত-পাকিস্তানের বন্ধু, না ছিল শত্রু। ফলে প্রাথমিক পর্বে ওই রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ রাজনীতির আলোেআঁধারিমাখা পথকে বেছে নিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন, যার মর্মার্থ হলাে, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে চলেছে, সেটি ওদের একান্তই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ফলে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু কী সরকারি দল, কী বিরােধী দল, সবাই যখন একজোট হয়ে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা চাইল, তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ স্বীকার করে নিলেন যে, পাকিস্তানের চলমান ঘটনার প্রেক্ষিতে এই পার্লামেন্টসহ আমরা সবাই অত্যাচারিত, নির্যাতিত মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে একই সাথে আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।
লেবার পার্টির প্রভাবশালী সাংসদ ক্রস ডগলাস ম্যান ইতােমধ্যে ভারত সফরে যান, বেশ ক’টি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, মুজিবনগরের কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বলেন এবং অর্জিত অভিজ্ঞতার আলােকে ‘হাউজ অব কমন্স’ সভায় বলেন, …it is now pointless even to discuss the question of reconciliation and the possible reunification of Pakistan. – Pakistan as an unit and as an entity is dead. The only solution which will provide any possibility of relief for the people of East Bengal is for the West Pakistan Army to be forced to withdraw by economic pressures and sanctions. শ্রমিকদলীয় অন্য একজন সাংসদ, পিটার শাের, জোরালাে ভাষায় অভিমত cha, Pakistan Government’s action in East Bengal was an outrage, an act of savage and deliberate repression which it would be shameful to ignore. It is the murder at birth of the new democracy that was just emerging in that unhappy land. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্যগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থা নিয়েছিলেন। অন্যদিকে রক্ষণশীল দল উদ্ভূত সমস্যাটিকে ‘রাজনৈতিক পথে’ মীমাংসার কথা বললেও, তাঁরা পাকিস্তানি বর্বরতাকে নিন্দা জানাতে পিছ পা হননি।
সরকার ও বিরােধী পক্ষ ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধির ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নেয় সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান। না হওয়া পর্যন্ত সে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ রাখবে এবং সমাধান এমন হতে হবে যা ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে ফেরার  ব্যাপারটি নিশ্চিত হয় যেন’ (বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন : মাসুদুল হক, পৃ. ২৫৩)। একই সময়ে কানাডাও পাকিস্তানে খুচরা সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছিল।  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক সমাজের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন পত্রিকা ও বিশ্বখ্যাত ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিবিসি’—অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষত সাইমন ড্রিং, যিনি পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশ উপেক্ষা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে গণহত্যার যে সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, যা লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ মার্চ, এটি বিশ্বের সমস্ত শান্তিকামী মানুষকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। ৩ এপ্রিল ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা শিরােনাম করেছিল, ‘বন্দুকের নলের গােড়ায় অখণ্ডতা’, ১৬ এপ্রিল নিউ স্টেটম্যান পত্রিকায় বলা হয়েছিল, যদি রক্তের দাম দিয়েই স্বাধীনতা কিনতে হয়, তাহলে বাঙালি ইতােমধ্যেই অনেক বেশি দাম দিয়ে ফেলেছে। বাঙালির যৌক্তিক আন্দোলন সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় : …the Bangladesh affair is not a second Biafra or the fruits of more interminable wrangling between Delhi and Rawalpindi. It arose simply when a well-conducted, peaceful election produced a result the army could not stand. Shiekh Mujib himself has not, in certain sense, declared Bengali independence. He was not asking essentially for more than the programme he legally fought and won the election on.
জুন মাসের প্রথম দিকে করাচির ‘মর্নিং নিউজ’-এর সহকারী সম্পাদক এবং লন্ডনস্থ ‘সানডে টাইমস’-এর পাকিস্তানি সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাসকে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পূর্ব বাংলা সফরের অনুমতি দিয়েছিল। পাক সামরিক সরকার। পাকপাণ্ডাদের অভিপ্রায় ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে। স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, কোথাও কোনাে অশান্তি নেই’—এমন একটা রিপাের্ট করাবেন এন্থনিকে দিয়ে। এন্থনি পাকসেনাদের সহায়তায় উপদ্রুত এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরলেন, ওদের কাছ থেকে বাঙালির আন্দোলনদমনের গাঁজাখােরি ব্যাখ্যা শুনলেন এবং সপরিবারে পাকিস্তান ত্যাগ করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করলেন, ১৩ জুনের সানডে টাইমস পত্রিকায়। তার ভাষায়, পূর্ব বাংলার শ্যামল ভূমির ওপর ছড়িয়ে দেয়া রক্তের কলঙ্ক চিহ্নগুলাে আমার চোখে একে একে ধরা পড়েছে।… এই সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার ১০ শতাংশ জনগােষ্ঠী হিন্দুরাই শুধু নয়, বরং হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলাের সদস্যসহ সবাই এর মধ্যে রয়েছে। এমনকি ১,৭৬,০০০ জন বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ যারা ২৬ মার্চে অসময়ােপযােগী ও দুর্বল সূচনার একটা বিপ্লব সংগঠিত করতে চেয়েছিলাে, এর ভেতরে তারাও আছে।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, পৃ. ৩৫)। বস্তুত গণহত্যা সম্পর্কিত এন্থনির এই মর্মভেদী রিপাের্ট পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের যথাযথ স্বরূপ উন্মােচনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা-দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। 
‘৭১-এ, আমাদের গ্রামবাংলা ছিল পত্রিকাবর্জিত, কোথাও কোথাও সরকারি ছত্রছায়ায় প্রকাশিত দু-একটা পত্রিকার দেখা মিললেও, তাতে থাকত পাক-সামরিক জান্তার গুণগান, আর সফলতার ফিরিস্তি, পাক সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টিভির অবস্থাও তথৈবচ—সামরিক সরকারের স্তুতি, আর মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কেবল বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। অন্যদিকে আকাশবাণীর বক্তব্যও ছিল একপেশে, মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব প্রচার, নিজেদের মহত্ত্ব প্রচার। আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র—এটা যেহেতু স্বদেশচ্যুত আন্দোলনরত জনগােষ্ঠীর একটা প্রচারমাধ্যম, তা-ই এর পরিবেশিত খবরের সত্যাসত্য নিয়ে কারাে মনে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সুযোেগ ছিল না। এ সময়ে কী গ্রাম, কী শহর, সকল এলাকার সকল সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খবর জানার জন্য সর্বতােভাবে নির্ভর করত বিবিসির ওপর। প্রতিষ্ঠানটিও শ্রোতাদের আগ্রহের ব্যারােমিটার বুঝে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খবরের পাশাপাশি এ সংশ্লিষ্ট কথিকা বা সংবাদপর্যালােচনামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে যেত, যাতে স্থান পেত পাকবাহিনীর বর্বরতা প্রসঙ্গ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শরণার্থীসমস্যা, মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বগাথা ঘটনাবলি। বস্তুত একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চালচিত্র তুলে ধরে বিবিসি যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে, তাতে প্রতিটি বাঙালিচিত্তে এ প্রতিষ্ঠানটি অসামান্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র