পাকিস্তানের জেনারেলগণ
পাকিস্তান—পৃথিবীর আজব একটি দেশ, যেখানে সেনাবাহিনী, অন্য যে কোনাে পেশাজীবী বা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত। ওই রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সৃষ্টিকর্তার পরেই যেন সেনাবাহিনীর স্থান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জনসংযােগ কর্মকর্তা এ আর সিদ্দিকির ‘দি মিলিটারি ইন পাকিস্তান : ইমেজ অ্যান্ড রিয়ালিটি’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন যে, অন্যদের থেকে পৃথক করার জন্য ওই দেশের সেনাবাহিনীকে বিশেষিত করে বলা হয়ে থাকে : ১, সেনাবাহিনী ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (যেন অন্যরা তা নয়)। ২. সৈনিকরা সহজ, সরল, ধর্মভীরু। (যেন অন্যরা তা নয় )। সৈনিকরা মুজাহিদ। তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষায় বিশ্বাসী। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হলে বেহেশত। (যেন অন্যরা ধর্মের রক্ষক নয়, অন্যরা কাফের বা বিধর্মীদের বিপক্ষে যুদ্ধ করলে শহীদ বলে গণ্য হবে , তাদের বেহেশত প্রাপ্তি ঘটবে না)। ৪. সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক। (যেন অন্যরা তা নয় )। ৫. সৈনিকরা সৎ। (যেন অন্যরা অসৎ)। ৬. সেনাবাহিনী কর্মদক্ষ। (যেন অন্যরা তা নয় )। এত গুণাবলি যাদের, তারাই কেবল দেশ চালাবার অধিকারী (পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৪৩)। ‘৭১-এর প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এডমিরাল আহসান। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর নির্দেশমতাে বাঙালি নিধনযজ্ঞের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করায় তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলের সামরিক অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্তি পান লে. জেনারেল ইয়াকুব খান।
কিন্তু তিনিও ইয়াহিয়া-ভুট্টো প্রণীত নীলনকশা বাস্তবায়নের কার্যক্রম না চালিয়ে পদত্যাগ করেন (৫ মার্চ)। ওই সময় জেনারেল ইয়াকুব জেনারেল পীরজাদাকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যদি সামরিক অভিযান চালানাে হয়, (তার ভাষ্যমতে সামরিক অভিযান চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসেই, ইয়াহিয়া ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের বৈঠকের সময়) তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে (পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৬২)। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর সেনা আইনের আওতায় তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শাস্তি হিসেবে তাকে বর্তমান পদের এক স্তর নিচে নামিয়ে দেয়া হয়। ৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন, বেলুচিস্তানের কসাই’খ্যাত টিক্কা খান। কিন্তু ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ বি সিদ্দিক, গভর্নর হিসেবে টিক্কাকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন, ফলে টিক্কাকে কেবল পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরবর্তীকালে এ বি চৌধুরী তাকে শপথ পড়াতে বাধ্য হন (১১ এপ্রিল), ফলে টিক্কা খান হয়ে যান গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু ১৪ আগস্ট কোনােরকম পূর্বাভাস ছাড়াই টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ডা, আবদুল মােত্তালিব মালেককে গভর্নর পদে নিয়ােগ দেয়া হয় এবং ১২ জন সিনিয়র অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদানপূর্বক আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে ঢাকায় পাঠানাে হয় সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে।
যুদ্ধাবস্থা ও পাকসেনাদের শৃঙ্খলাবর্জিত কার্যক্রম দেখে হতাশ নিয়াজি ডিভিশনাল কমান্ডারদের কাছে। গােপনীয় একটা চিঠি পাঠান, যার মূল কথা : ‘Since my arrival, I have heard numerous reports of troops indulging in loot and arson, killing people at random and without reason in areas cleared of the anti state elements, of late there have been reports of rape and even the west pakistanis are not being spared; on 12 April, two pakistani women were raped, and attempt was made on two others.’ টিক্কা খানের সমালােচনা করে নিয়াজি বলেছেন, জেনারেল টিক্কা খানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতাদের গ্রেপ্তার করতে, কিন্তু তিনি তা না করে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ করলেন, …মনে হলাে তিনি যেন শত্রুদের ওপর অভিযান চালিয়েছেন, তার সামরিক অভিযান ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন। …তার দর্শন ছিল—আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না। তার এই নির্দেশ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। টিক্কা সম্পর্কে নিয়াজির এ ধরনের মন্তব্য সত্য নাকি মিথ্যা—জানার প্রয়ােজন নেই আমাদের। তবে নিয়াজি যে অন্যান্য পাকিস্তানি জেনারেল অপেক্ষা কম মিথ্যাবাদী ছিলেন না, এর প্রমাণ পাই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তার কাল্পনিক মন্তব্য পড়লে। তিনি লিখেছেন, মার্চ মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগ সামরিক আইন উপেক্ষা করে পাশাপাশি সরকার পরিচালনার পরিকল্পনা ঘােষণা করে।
মুজিব ও আওয়ামী লীগ প্রথম চৌদ্দ দিন বর্ণনাতীত নির্যাতন চালায় অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। বগুড়ায় ১৪০০ ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ‘ও নারীদের নির্যাতন করা হয়। সিরাজগঞ্জের একটি হলে নারী ও শিশুদের তালাবদ্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ বর্বরতার লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিহারিরা। ইপিআর এ কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের হত্যা করা হয় এবং তাদের স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালানাে হয়। তাদের স্ত্রীদের নগ্ন অবস্থায় বাঙালি অফিসারদের খাদ্য পরিবেশনে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করা হয়—এ ছিল সত্যের অপলাপ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পৃ. ২১২-২১৩)। নিয়াজির এহেন মিথ্যাচার দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ তিনি যদি মিথ্যাচারে পারদর্শীই না হন, দিনকে রাত, রাতকে দিন বলতে না-ই পারেন, তা হলে কি তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হতে পারতেন? | শুধু নিয়াজি-ই বা কেন? মিথ্যাচারে পাকিস্তানি অন্য জেনারেলরাও কম। যান না। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান তার ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ’ গ্রন্থে ২৫ মার্চ রাতের বর্ণনায় বলেছেন, “ইকবাল হল থেকে অনেক ভারতীয় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং উদ্ধার করা হয়েছিল বেশ কিছু অবাঙালি মেয়েকে, যাদের পতিতা হিসেবে সেখানে রাখা হয়েছিল। এই অপারেশনে সেনাবাহিনীর পক্ষে মারা গিয়েছিল ৪ জন,… মােট মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ১৫০, অন্যান্য হিসেবে ৫০০ জন” (মুনতাসীর মামুনের ‘পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৫৩)।
জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ গ্রন্থে ১৪ ডিসেম্বরে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছে, “সম্ভবত তাদের (বুদ্ধিজীবীদের) এমন কোথাও বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যার প্রহরায় ছিল মুজাহিদরা। আত্মসমর্পণের পর ঢাকা গ্যারিসনের কমান্ডাররা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল এবং তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিবাহিনী নির্দয়ভাবে মুজাহিদদের হত্যা করছিল। পাকিস্তান আর্মিদের দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মিও বন্দি ব্যক্তিদের হত্যা করে থাকতে পারে।’ রাওয়ের অভিমত হলাে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি তাে দায়ী ননই, দায়ী নয় পাকিস্তানি বা তাদের দোসর কোনাে বাহিনীও. এর জন্য দায়ী মুক্তিবাহিনী অথবা ভারতীয় বাহিনী।”(মুনতাসীর মামুন, পৃ. ১০৪)। বস্তুত গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক থেকে অব্যাহতি—কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি টিক্কা খান। তার বিদায় সম্মানে যে নৈশভােজের আয়ােজন করা হয়েছিল, সেখানে তিনি ওই ক্ষোভের খানিকটা প্রকাশ ঘটান, পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমাকে তাড়াহুড়া করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। আমার মনে হয় অর্পিত দায়িত্ব আমি ভালােভাবেই সামলাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেন আমাকে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে বুঝতে পারছি না। প্রেসিডেন্ট যা ভালাে বােঝেছেন, তাই করবেন। যে কাজে আমি হাত দিয়েছিলাম, সেটা শেষ করে যেতে পারলেই ভালাে হতাে। আমি দুঃখিত যে, আপনাদেরকে মধ্য স্রোতে ফেলে রেখে বিদায় নিতে হচ্ছে।… আপনাদের প্রতি আমার একটাই অনুরােধ, মুঠো আলগা করা চলবে না, এই বাঙালি জাতটাকে শক্ত করে চেপে রাখবেন।
যে কোনাে উপায়ে এদের স্পর্ধাকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী থাকবেন।’ অর্থাৎ বিদায়ের প্রাক্কালেও টিক্কা খানের উপলব্ধি ছিল, বাঙালিকে ডাণ্ডা মেরেই ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আত্মম্ভরী পাক জেনারেল, যারা কেবল মদ, নারী আর শক্তিপ্রদর্শনে চিরাচরিতভাবে ব্যস্ত, তাদের মুখ থেকে মানবীয় কথা শােনার অভিপ্রায় থাকা অনুচিতই বটে। পাকিস্তানি জেনারেলরা, যারা হত্যা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, মাঝেমধ্যে তাদের কারাে মনে শুভবুদ্ধির উদয় হলেও, অন্য সঙ্গীদের কারণে তা বাস্তবায়িত করতে পারেন না। হাসান জহিরের লেখায় পাই, একাত্তরের জুলাই মাসে ইয়াহিয়া তার বিভাগীয় কমান্ডারদের সাথে আলােচনাকালীন নাকি বলেছিলেন, তিনি প্রবাসী আওয়ামী-নেতাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সাথে যােগাযােগ করতে ইচ্ছুক। তখন কেবল জেনারেল গুল হাসান এ-প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন; বাকিরা প্রস্তাবটির প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন। হাসান জহিরের ভাষায়, “There was strong opposition from the Generals at the suggestion. They said, we must finish this thing, sort of final solution. (The Separation of East Pakistan, page-346). ইয়াহিয়া খানের বাঙালি উপদেষ্টা জিডব্লিউ চৌধুরীও জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ জেনারেলদের তীব্র বিরােধিতার মুখে তিনি সে কাজটি করতে পারছিলেন না। কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব রােয়েদান খান জানিয়েছেন, তখন রাওয়ালপিন্ডির সেনাবাহিনীর জিএইচকিউ-তে নিয়মিত সভা হতাে। এক সভায় জেনারেল গুল হাসান শেখ মুজিবের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চান। ইয়াহিয়া তখন এ ব্যাপারে সকল জেনারেলের মতামত চান।
তখন দুজন বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বেশ ক’জন শেখ মুজিবকে বিচারের আওতায় নিয়ে শাস্তি দেয়ার কথা বলেন : বেশিরভাগ জেনারেল অভিমত দেন, বিচার প্রক্রিয়ার প্রয়ােজন নেই, তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হােক। অনেক জেনারেল তখন নাকি আফসােস করে বলেছেন, সেনা অভিযানের প্রথম প্রহরেই শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা উচিত ছিল। পাক জেনারেলদের শঠতা, ধূর্ততা, বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপটি বােঝা যায় নিয়াজির নিজের লেখাতেই, নভেম্বরের শুরুতে, ‘I have submitted to Gen. Hamid that I was already more or less cut off from the West. In the event of a sea and airblockade, I would be completely isolated and abandoned. He told me that I would not be either isolated not abandoned. When the Indians did impose the blockde. I spoke to Gen. Hamid about using the hump route. He said, sorry Niazi, we cannot use that route, you are on your own, carry on with whatever you have– good luck. I was abandoned in midstream. (The Betrayal of East Pakistan, page-98).’ এই হচ্ছে পাকিস্তানি জেনারেলদের চরিত্র, যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতালােভ, মিথ্যাচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, আর বিপদে পড়লে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতি। পাকিস্তানি জেনারেলদের সম্পর্কে মুনতাসীর মামুনের অভিমত, এরা নিরেট, রােবটের মতাে। দম্ভ তাদের প্রচুর এবং পাকিস্তানকেই তারা মনে করে বিশ্ব।
তারা বােধহীন, কারণ নিয়াজি বলেছিলেন তাকে, ‘হাইকমান্ড বাধা না। দিলে তিনি কলকাতা, গুজরানওয়ালা দখল করে কাশ্মির নিয়ে নিতে পারতেন।’ পাকিস্তানি জেনারেলরা এমনই গবেট যে, তারা জানেনই না, মানচিত্রের কোথায় কলকাতা, কোথায় গুজরানওয়ালা, আর কোথায়ই বা কাশির। [মিথ্যাচারিতায় পাকিস্তানি জেনারেলরাই কেবল পটু ছিলেন, তা নয়। এ ব্যাপারে গভর্নর মালেকও কম যান না; গভর্নর হওয়ার নেপথ্যকাহিনী সম্পর্কে ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি আসগর খানকে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা আষাঢ়ে গল্পকেও হার মানায় : তার ভাষ্য মতে, একদিন টিক্কা খান তাকে ডেকে পাঠালেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক প্রেরিত বার্তার সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি গভর্নর হতে রাজি আছেন কি না। মালেক তাৎক্ষণিকভাবে টিক্কা খানকে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোনাে অবস্থাতেই গভর্নরের দায়িত্ব নেবেন না। টিক্কা খানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকেন। রাত ২টার সময় ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পান; কে যেন তাকে বলছে, মালিক জাগাে, জেগে ওঠো। দেশ তােমাকে চাইছে।’ তিনি ভাবলেন, ওই কণ্ঠস্বর ‘যা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই আসতে পারে’; এরপর তিনি নামাজ পড়লেন এবং অতি প্রত্যুষে টিক্কা খানের সাথে দেখা করে বললেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণে আমি রাজি আছি। আপনি প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিতে পারেন (জেনারেল ইন পলিটিক্স : মােহাম্মদ আসগর খান, পৃ. ৩৮-৩৯)।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের পথিকৃৎ, মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ খলিলুর রহমান (‘৭১-এ মেজর) মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরাে সময়টুকুই, প্রথমে উপায়ান্তরহীন হয়ে, পরবর্তীকালে বন্দি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করেছিলেন। সেই সময়কার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করেছেন তার লেখা ‘পূর্বাপর ১৯৭১-পাকিস্তানি সেনা-গহ্বর থেকে দেখা’ গ্রন্থে। পূর্ব বাংলা সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ, আমলা বা সেনা কর্মকর্তাদের অজ্ঞতার স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে খলিল লিখেছেন, “পূর্ব। পাকিস্তানের জনগণ তখন বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা (ভােয়া) ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র না শুনে রাতে ঘুমাতে যেত না বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদি বিদেশি খবর মাধ্যমগুলাে শােনা দেশপ্রেমের অভাব বলে বিবেচনা করত। তাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সরকারের ভাষ্য ছাড়া অন্য কোনাে ভাষ্য শুনতে তারা মানসিকভাবে অভ্যস্ত ছিল না। এজন্যই যখন হঠাৎ তারা শুনতে পেল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, সবাই আমাকে প্রশ্ন করেছে, সাব ইয়ে কিয়া হাে গিয়া? পূর্ব পাকিস্তানে যা দু-চারজন বেসামরিক পাঞ্জাবি ছিলেন তারাও বাস্তব পরিস্থিতি থেকে বহু দূরে অবস্থান করতেন। সেখানে তাদের আশেপাশে কি ঘটছে তার কোনাে খবরই রাখতেন না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও বেশিরভাগ অনুরূপভাবে অজ্ঞ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্বন্ধে (পৃ. ৬৭)।” বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ওরা মনে করত ভারতীয় দুশমন দ্বারা সৃষ্ট ‘গণ্ডগােল’।
শুধু পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারাই নয়, অনেক বাঙালি অফিসার—যেমন শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাই মেজর (তৎকালীন পদবি) কাইয়ুম চৌধুরী, সুযােগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যােগ না দিয়ে পাকিস্তান সামরিকজান্তার তাবেদারি করেছেন, রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘গাদ্দার’ সম্বােধনপূর্বক বলেছেন, ‘মুজিব তুমি জানাে তােমার মতাে কুলাঙ্গার এই সােনার দেশটির কি ক্ষতি করেছে ও করছে।’ এই কাইয়ুম, পাকিস্তানি অনেক জেনারেলের মতাে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ১৪ ডিসেম্বর—তার ভাই মুনীর চৌধুরীসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হাতেই।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র