You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের জেনারেলগণ

পাকিস্তান—পৃথিবীর আজব একটি দেশ, যেখানে সেনাবাহিনী, অন্য যে কোনাে পেশাজীবী বা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত। ওই রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সৃষ্টিকর্তার পরেই যেন সেনাবাহিনীর স্থান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জনসংযােগ কর্মকর্তা এ আর সিদ্দিকির ‘দি মিলিটারি ইন পাকিস্তান : ইমেজ অ্যান্ড রিয়ালিটি’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন যে, অন্যদের থেকে পৃথক করার জন্য ওই দেশের সেনাবাহিনীকে বিশেষিত করে বলা হয়ে থাকে : ১, সেনাবাহিনী ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (যেন অন্যরা তা নয়)। ২. সৈনিকরা সহজ, সরল, ধর্মভীরু। (যেন অন্যরা তা নয় )। সৈনিকরা মুজাহিদ। তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষায় বিশ্বাসী। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হলে বেহেশত। (যেন অন্যরা ধর্মের রক্ষক নয়, অন্যরা কাফের বা বিধর্মীদের বিপক্ষে যুদ্ধ করলে শহীদ বলে গণ্য হবে , তাদের বেহেশত প্রাপ্তি ঘটবে না)। ৪. সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক। (যেন অন্যরা তা নয় )। ৫. সৈনিকরা সৎ। (যেন অন্যরা অসৎ)। ৬. সেনাবাহিনী কর্মদক্ষ। (যেন অন্যরা তা নয় )। এত গুণাবলি যাদের, তারাই কেবল দেশ চালাবার অধিকারী (পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৪৩)। ‘৭১-এর প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এডমিরাল আহসান। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর নির্দেশমতাে বাঙালি নিধনযজ্ঞের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করায় তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলের সামরিক অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্তি পান লে. জেনারেল ইয়াকুব খান।

কিন্তু তিনিও ইয়াহিয়া-ভুট্টো প্রণীত নীলনকশা বাস্তবায়নের কার্যক্রম না চালিয়ে পদত্যাগ করেন (৫ মার্চ)। ওই সময় জেনারেল ইয়াকুব জেনারেল পীরজাদাকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যদি সামরিক অভিযান চালানাে হয়, (তার ভাষ্যমতে সামরিক অভিযান চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসেই, ইয়াহিয়া ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের বৈঠকের সময়) তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে (পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৬২)। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর সেনা আইনের আওতায় তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শাস্তি হিসেবে তাকে বর্তমান পদের এক স্তর নিচে নামিয়ে দেয়া হয়। ৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন, বেলুচিস্তানের কসাই’খ্যাত টিক্কা খান। কিন্তু ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ বি সিদ্দিক, গভর্নর হিসেবে টিক্কাকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন, ফলে টিক্কাকে কেবল পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরবর্তীকালে এ বি চৌধুরী তাকে শপথ পড়াতে বাধ্য হন (১১ এপ্রিল), ফলে টিক্কা খান হয়ে যান গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু ১৪ আগস্ট কোনােরকম পূর্বাভাস ছাড়াই টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ডা, আবদুল মােত্তালিব মালেককে গভর্নর পদে নিয়ােগ দেয়া হয় এবং ১২ জন সিনিয়র অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদানপূর্বক আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে ঢাকায় পাঠানাে হয় সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে।

যুদ্ধাবস্থা ও পাকসেনাদের শৃঙ্খলাবর্জিত কার্যক্রম দেখে হতাশ নিয়াজি ডিভিশনাল কমান্ডারদের কাছে। গােপনীয় একটা চিঠি পাঠান, যার মূল কথা : ‘Since my arrival, I have heard numerous reports of troops indulging in loot and arson, killing people at random and without reason in areas cleared of the anti state elements, of late there have been reports of rape and even the west pakistanis are not being spared; on 12 April, two pakistani women were raped, and attempt was made on two others.’ টিক্কা খানের সমালােচনা করে নিয়াজি বলেছেন, জেনারেল টিক্কা খানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতাদের গ্রেপ্তার করতে, কিন্তু তিনি তা না করে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ করলেন, …মনে হলাে তিনি যেন শত্রুদের ওপর অভিযান চালিয়েছেন, তার সামরিক অভিযান ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন। …তার দর্শন ছিল—আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না। তার এই নির্দেশ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। টিক্কা সম্পর্কে নিয়াজির এ ধরনের মন্তব্য সত্য নাকি মিথ্যা—জানার প্রয়ােজন নেই আমাদের। তবে নিয়াজি যে অন্যান্য পাকিস্তানি জেনারেল অপেক্ষা কম মিথ্যাবাদী ছিলেন না, এর প্রমাণ পাই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তার কাল্পনিক মন্তব্য পড়লে। তিনি লিখেছেন, মার্চ মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগ সামরিক আইন উপেক্ষা করে পাশাপাশি সরকার পরিচালনার পরিকল্পনা ঘােষণা করে।

মুজিব ও আওয়ামী লীগ প্রথম চৌদ্দ দিন বর্ণনাতীত নির্যাতন চালায় অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। বগুড়ায় ১৪০০ ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ‘ও নারীদের নির্যাতন করা হয়। সিরাজগঞ্জের একটি হলে নারী ও শিশুদের তালাবদ্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ বর্বরতার লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিহারিরা। ইপিআর এ কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের হত্যা করা হয় এবং তাদের স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালানাে হয়। তাদের স্ত্রীদের নগ্ন অবস্থায় বাঙালি অফিসারদের খাদ্য পরিবেশনে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করা হয়—এ ছিল সত্যের অপলাপ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পৃ. ২১২-২১৩)। নিয়াজির এহেন মিথ্যাচার দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ তিনি যদি মিথ্যাচারে পারদর্শীই না হন, দিনকে রাত, রাতকে দিন বলতে না-ই পারেন, তা হলে কি তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হতে পারতেন? | শুধু নিয়াজি-ই বা কেন? মিথ্যাচারে পাকিস্তানি অন্য জেনারেলরাও কম। যান না। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান তার ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ’ গ্রন্থে ২৫ মার্চ রাতের বর্ণনায় বলেছেন, “ইকবাল হল থেকে অনেক ভারতীয় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং উদ্ধার করা হয়েছিল বেশ কিছু অবাঙালি মেয়েকে, যাদের পতিতা হিসেবে সেখানে রাখা হয়েছিল। এই অপারেশনে সেনাবাহিনীর পক্ষে মারা গিয়েছিল ৪ জন,… মােট মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ১৫০, অন্যান্য হিসেবে ৫০০ জন” (মুনতাসীর মামুনের ‘পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ৫৩)।

জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ গ্রন্থে ১৪ ডিসেম্বরে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছে, “সম্ভবত তাদের (বুদ্ধিজীবীদের) এমন কোথাও বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যার প্রহরায় ছিল মুজাহিদরা। আত্মসমর্পণের পর ঢাকা গ্যারিসনের কমান্ডাররা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল এবং তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিবাহিনী নির্দয়ভাবে মুজাহিদদের হত্যা করছিল। পাকিস্তান আর্মিদের দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মিও বন্দি ব্যক্তিদের হত্যা করে থাকতে পারে।’ রাওয়ের অভিমত হলাে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি তাে দায়ী ননই, দায়ী নয় পাকিস্তানি বা তাদের দোসর কোনাে বাহিনীও. এর জন্য দায়ী মুক্তিবাহিনী অথবা ভারতীয় বাহিনী।”(মুনতাসীর মামুন, পৃ. ১০৪)।  বস্তুত গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক থেকে অব্যাহতি—কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি টিক্কা খান। তার বিদায় সম্মানে যে নৈশভােজের আয়ােজন করা হয়েছিল, সেখানে তিনি ওই ক্ষোভের খানিকটা প্রকাশ ঘটান, পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমাকে তাড়াহুড়া করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। আমার মনে হয় অর্পিত দায়িত্ব আমি ভালােভাবেই সামলাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেন আমাকে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে বুঝতে পারছি না। প্রেসিডেন্ট যা ভালাে বােঝেছেন, তাই করবেন। যে কাজে আমি হাত দিয়েছিলাম, সেটা শেষ করে যেতে পারলেই ভালাে হতাে। আমি দুঃখিত যে, আপনাদেরকে মধ্য স্রোতে ফেলে রেখে বিদায় নিতে হচ্ছে।… আপনাদের প্রতি আমার একটাই অনুরােধ, মুঠো আলগা করা চলবে না, এই বাঙালি জাতটাকে শক্ত করে চেপে রাখবেন।

যে কোনাে উপায়ে এদের স্পর্ধাকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী থাকবেন।’ অর্থাৎ বিদায়ের প্রাক্কালেও টিক্কা খানের উপলব্ধি ছিল, বাঙালিকে ডাণ্ডা মেরেই ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আত্মম্ভরী পাক জেনারেল, যারা কেবল মদ, নারী আর শক্তিপ্রদর্শনে চিরাচরিতভাবে ব্যস্ত, তাদের মুখ থেকে মানবীয় কথা শােনার অভিপ্রায় থাকা অনুচিতই বটে।  পাকিস্তানি জেনারেলরা, যারা হত্যা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, মাঝেমধ্যে তাদের কারাে মনে শুভবুদ্ধির উদয় হলেও, অন্য সঙ্গীদের কারণে তা বাস্তবায়িত করতে পারেন না। হাসান জহিরের লেখায় পাই, একাত্তরের জুলাই মাসে ইয়াহিয়া তার বিভাগীয় কমান্ডারদের সাথে আলােচনাকালীন নাকি বলেছিলেন, তিনি প্রবাসী আওয়ামী-নেতাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সাথে যােগাযােগ করতে ইচ্ছুক। তখন কেবল জেনারেল গুল হাসান এ-প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন; বাকিরা প্রস্তাবটির প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন। হাসান জহিরের ভাষায়, “There was strong opposition from the Generals at the suggestion. They said, we must finish this thing, sort of final solution. (The Separation of East Pakistan, page-346). ইয়াহিয়া খানের বাঙালি উপদেষ্টা জিডব্লিউ চৌধুরীও জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ জেনারেলদের তীব্র বিরােধিতার মুখে তিনি সে কাজটি করতে পারছিলেন না। কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব রােয়েদান খান জানিয়েছেন, তখন রাওয়ালপিন্ডির সেনাবাহিনীর জিএইচকিউ-তে নিয়মিত সভা হতাে। এক সভায় জেনারেল গুল হাসান শেখ মুজিবের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চান। ইয়াহিয়া তখন এ ব্যাপারে সকল জেনারেলের মতামত চান।

তখন দুজন বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বেশ ক’জন শেখ মুজিবকে বিচারের আওতায় নিয়ে শাস্তি দেয়ার কথা বলেন : বেশিরভাগ জেনারেল অভিমত দেন, বিচার প্রক্রিয়ার প্রয়ােজন নেই, তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হােক। অনেক জেনারেল তখন নাকি আফসােস করে বলেছেন, সেনা অভিযানের প্রথম প্রহরেই শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা উচিত ছিল। পাক জেনারেলদের শঠতা, ধূর্ততা, বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপটি বােঝা যায় নিয়াজির নিজের লেখাতেই, নভেম্বরের শুরুতে, ‘I have submitted to Gen. Hamid that I was already more or less cut off from the West. In the event of a sea and airblockade, I would be completely isolated and abandoned. He told me that I would not be either isolated not abandoned. When the Indians did impose the blockde. I spoke to Gen. Hamid about using the hump route. He said, sorry Niazi, we cannot use that route, you are on your own, carry on with whatever you have– good luck. I was abandoned in midstream. (The Betrayal of East Pakistan, page-98).’ এই হচ্ছে পাকিস্তানি জেনারেলদের চরিত্র, যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতালােভ, মিথ্যাচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, আর বিপদে পড়লে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতি। পাকিস্তানি জেনারেলদের সম্পর্কে মুনতাসীর মামুনের অভিমত, এরা নিরেট, রােবটের মতাে। দম্ভ তাদের প্রচুর এবং পাকিস্তানকেই তারা মনে করে বিশ্ব।

তারা বােধহীন, কারণ নিয়াজি বলেছিলেন তাকে, ‘হাইকমান্ড বাধা না। দিলে তিনি কলকাতা, গুজরানওয়ালা দখল করে কাশ্মির নিয়ে নিতে পারতেন।’ পাকিস্তানি জেনারেলরা এমনই গবেট যে, তারা জানেনই না, মানচিত্রের কোথায় কলকাতা, কোথায় গুজরানওয়ালা, আর কোথায়ই বা কাশির।  [মিথ্যাচারিতায় পাকিস্তানি জেনারেলরাই কেবল পটু ছিলেন, তা নয়। এ ব্যাপারে গভর্নর মালেকও কম যান না; গভর্নর হওয়ার নেপথ্যকাহিনী সম্পর্কে ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি আসগর খানকে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা আষাঢ়ে গল্পকেও হার মানায় : তার ভাষ্য মতে, একদিন টিক্কা খান তাকে ডেকে পাঠালেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক প্রেরিত বার্তার সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি গভর্নর হতে রাজি আছেন কি না। মালেক তাৎক্ষণিকভাবে টিক্কা খানকে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোনাে অবস্থাতেই গভর্নরের দায়িত্ব নেবেন না। টিক্কা খানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকেন। রাত ২টার সময় ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পান; কে যেন তাকে বলছে, মালিক জাগাে, জেগে ওঠো। দেশ তােমাকে চাইছে।’ তিনি ভাবলেন, ওই কণ্ঠস্বর ‘যা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই আসতে পারে’; এরপর তিনি নামাজ পড়লেন এবং অতি প্রত্যুষে টিক্কা খানের সাথে দেখা করে বললেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণে আমি রাজি আছি। আপনি প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিতে পারেন (জেনারেল ইন পলিটিক্স : মােহাম্মদ আসগর খান, পৃ. ৩৮-৩৯)। 

বেঙ্গল রেজিমেন্টের পথিকৃৎ, মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ খলিলুর রহমান (‘৭১-এ মেজর) মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরাে সময়টুকুই, প্রথমে উপায়ান্তরহীন হয়ে, পরবর্তীকালে বন্দি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করেছিলেন। সেই সময়কার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করেছেন তার লেখা ‘পূর্বাপর ১৯৭১-পাকিস্তানি সেনা-গহ্বর থেকে দেখা’ গ্রন্থে। পূর্ব বাংলা সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ, আমলা বা সেনা কর্মকর্তাদের অজ্ঞতার স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে খলিল লিখেছেন, “পূর্ব। পাকিস্তানের জনগণ তখন বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা (ভােয়া) ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র না শুনে রাতে ঘুমাতে যেত না বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদি বিদেশি খবর মাধ্যমগুলাে শােনা দেশপ্রেমের অভাব বলে বিবেচনা করত। তাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সরকারের ভাষ্য ছাড়া অন্য কোনাে ভাষ্য শুনতে তারা মানসিকভাবে অভ্যস্ত ছিল না। এজন্যই যখন হঠাৎ তারা শুনতে পেল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, সবাই আমাকে প্রশ্ন করেছে, সাব ইয়ে কিয়া হাে গিয়া?  পূর্ব পাকিস্তানে যা দু-চারজন বেসামরিক পাঞ্জাবি ছিলেন তারাও বাস্তব পরিস্থিতি থেকে বহু দূরে অবস্থান করতেন। সেখানে তাদের আশেপাশে কি ঘটছে তার কোনাে খবরই রাখতেন না। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও বেশিরভাগ অনুরূপভাবে অজ্ঞ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্বন্ধে (পৃ. ৬৭)।” বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ওরা মনে করত ভারতীয় দুশমন দ্বারা সৃষ্ট ‘গণ্ডগােল’।

শুধু পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারাই নয়, অনেক বাঙালি অফিসার—যেমন শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাই মেজর (তৎকালীন পদবি) কাইয়ুম চৌধুরী, সুযােগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যােগ না দিয়ে পাকিস্তান সামরিকজান্তার তাবেদারি করেছেন, রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘গাদ্দার’ সম্বােধনপূর্বক বলেছেন, ‘মুজিব তুমি জানাে তােমার মতাে কুলাঙ্গার এই সােনার দেশটির কি ক্ষতি করেছে ও করছে।’ এই কাইয়ুম, পাকিস্তানি অনেক জেনারেলের মতাে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ১৪ ডিসেম্বর—তার ভাই মুনীর চৌধুরীসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হাতেই।

 
প্রসঙ্গ যখন চীন
 
ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত বিরােধ দীর্ঘ দিন থেকে। সীমান্ত নিয়ে দুটি দেশ ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল ১৯৬২ সালে। সে সময় ভারতের অন্তর্ভুক্ত তিব্বতের ব্যাপক এলাকা দখল করে নিয়েছিল চীন। পরবর্তী পর্যায়ে তিব্বতসমস্যা অমীমাংসিতই থেকে যায়। চীন মাঝে মাঝে অভিযােগ করছিল, নয়াদিল্লি তিব্বতি বিদ্রোহীদের চীনের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনের অভিযােগ ছিল, এ দেশটি চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। অতীতে, ১৯৬৩ সালে রুশরা সিংকিয়াং বিদ্রোহকে সমর্থন দিয়ে গেছে। চীন তখন রুশ-ভারতের সাথে সীমান্ত সংঘর্ষ প্রতিবিধানের জন্য এবং জাতিসংঘে ‘তাইওয়ানসংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য ওয়াশিংটনের আনুকূল্য কামনা করে যাচ্ছিল। সেই সুযােগ মিলে গেল ‘৭১-এ, যখন ইয়াহিয়া চীন-মার্কিনের মধ্যে সেতুবন্ধ  হিসেবে কাজ করতে সম্মতি প্রকাশ করলেন। তাতে দুই দেশেরই সুবিধে হলাে, এক. বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যৌথভাবে সাহায্য করা যাবে; দুই. এর মধ্য দিয়ে রুশবিরােধী একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়ে গেল।  এপ্রিলের গােড়ার দিকে চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই পাকিস্তানকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বন্ধুরাষ্ট্রের বিপদের দিনে চীন তার পাশেই থাকবে। এর পরবর্তী মাসগুলােতে চীন তার পুরনাে বন্ধু পাকিস্তানকে অস্ত্রসহায়তা অব্যাহত রাখলেও মধ্য জুলাই-এ হেনরি কিসিঞ্জারের পিকিং সফরের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশীয় রাজনীতির ব্যাপারে চীনের সক্রিয় ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ১৫/১৬ জুলাই-এ পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের ভারতবিরােধী নতুন আঁতাতের কথা যখন বিশ্বব্যাপী আলােচিত খবর হিসেবে প্রচারিত হচ্ছিল, চীন তখনও রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল। তখন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করছিলেন, ৯ আগস্ট ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি চীনকে বােধহয় দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, তাই নিচুপ থেকে সে কেবল যুদ্ধপরিস্থিতির মােড় সংগােপনে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।
কিন্তু পরবর্তীকালে প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চীনের ভেতরেই ক্ষমতা-দখলের রাজনীতি এমনই প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, তা সামাল দিতে গিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়ার উপায় ছিল না তার।  “১৯৭১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধের মধ্যে চীনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উত্তরাধিকারের সংগ্রাম অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। মাও সে-তুং-এর জীবননাশ ও ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে তারই মনােনীত উত্তরাধিকারী, চীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ও দেশরক্ষা মন্ত্রী লিন পিয়াও ৮১০ সেপ্টেম্বরে এক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালান। তা ব্যর্থ হওয়ার পর ১১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি, তার স্ত্রী, পুত্র ও আরাে ছ’জন পিকিং-এর নিকটবর্তী এক বিমানঘাঁটি থেকে পলায়নের সময় মঙ্গোলিয়া প্রজাতন্ত্রের কয়েকশাে মাইল ভেতরে এক জনবিরল অঞ্চলে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।… ইতােমধ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চীন সরকার কর্তৃক সারা দেশে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়, ১ অক্টোবরের জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজ বাতিল করা হয় এবং ছুটি বাতিল করে সশস্ত্রবাহিনীর সকল সদস্যকে কাজে যােগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। সামরিক, বিমান, নৌ ও লজিস্টিকস্ বিভাগের চার প্রধানকে গ্রেপ্তার এবং কয়েক হাজার অফিসারকে গ্রেপ্তার অথবা বরখাস্ত করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ব্যাপারে অজস্র বিধি-নিষেধ ও জরুরি নির্দেশ জারি করা হয়। সেপ্টেম্বরঅক্টোবরে চীনে যে শুদ্ধি অভিযান চলে তা কালচারাল রিভােলিউশন’-এর পর চীনা ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শুদ্ধি অভিযান।
কিন্তু এবারের শুদ্ধি অভিযান মূলত চীনা সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ায় চীনের সামরিক সংগঠন সর্বাংশে আলােড়িত হয়। এই বিরাট শুদ্ধি অভিযানের পর চীনের সামরিক শক্তি ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করা কতখানি সম্ভব ছিল তা অজ্ঞাত। বাইরের পৃথিবীর জন্য চীনের এই অভ্যন্তরীণ আলােড়নের সংবাদ কয়েক মাস যাবৎ অজানা থাকে।” (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১২১ থেকে উদ্ধৃত)। উল্লিখিত সময়কালীন চীন ঘর সামলাতেই ব্যস্ত, দেশের সবগুলাে সংবাদপত্র সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন বিধায় ওদের ঘরের খবর জানার উপায় নেই কোননা, আত্মব্যস্ত চীন তখন বহির্বিশ্বের ব্যাপারে উদাসীন ও নীরব-চীনের এই অসম্ভব রকমের নীরবতা পালন—নয়াদিল্লিকে অশেষ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল, এজন্য যে, তাদের ধারণা জন্মেছিল বড় কিছু করার আগে চীন বােধহয় ‘নীরব প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছে।
সুবিশাল ও শক্তিমান দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ পাচ্ছিল না, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরােধিতার কারণেই। তাইওয়ান—যে ভূখণ্ডকে চীন নিজেরই অংশ হিসেবে দাবি করে আসছিল, সেই তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু জুলাই-এ, হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের পর পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দুটি দেশ খুব কাছাকাছি চলে আসে এবং ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, মুজিবনগর সরকারের ব্যাপারে তারা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে, পিকিং-এ চৌ এন লাই এবং কিসিঞ্জারের আরাে একটা বৈঠকের পর, প্রধানত পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণেই ৩ নভেম্বর, একটা শক্তিশালী পাক প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়। এই প্রতিনিধি দলে যােগ দিয়েছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান রহিম খান, সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান, নৌবাহিনীর প্রধান রশীদ আহমদ এবং বিস্ময়করভাবে ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ সফর থেকে পাকিস্তানের প্রাপ্তি প্রায় শূন্য হলেও, সফরশেষে ভুট্টো অতিশয়ােক্তি করে বলেন, ভারত কর্তৃক পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন ভারতকে আক্রমণ করবে বলে কথা দিয়েছে। ভুট্টোর এই অসত্য তথ্য পরবর্তীকালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের উপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। 
ভুট্টোর এই সফরকালীন চীনের অনুচ্চমনােভাব প্রদর্শন, ২৩ নভেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পদপ্রাপ্তির (যে তাইওয়ানকে যুক্তরাষ্ট্র দুই যুগ ধরে বুকে আগলে রেখেছিল, এবার সেই তাইওয়ানকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কার করে দিয়ে সে স্থলে চীনকে দেয়া হলাে সাধারণ সদস্যপদসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ) পর ইন্দিরা প্রেরিত চীনকে অভিনন্দন বার্তা, প্রত্যুত্তরে ভারত ও চীনা জনগণের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট রাখার জন্য চৌ এন লাই-এর আশাবাদ—এসব খবর পড়ে সবাই যখন চীন-ভারত সম্পর্কের ‘পরিবর্তন নিয়ে আলােচনায় ব্যস্ত, তখন অর্থাৎ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ‘আমেরিকা ও পাকিস্তানের উপর্যুপরি প্রচেষ্টার জন্যই হােক, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর ক্রমবর্ধিত চাপের মুখে পাকিস্তানের হতশা দৃষ্টেই হােক, অথবা চীনের অভ্যন্তরীণ গােলযােগ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে আসায় চীনের নেতৃত্ব পুনরায় নিজেদের সবল মনে করার জন্যই হােক—চীন পাকিস্তানের সমর্থনে সক্রিয় হয়ে ওঠে।’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৫০)। অবশ্য তখন অনেকের মনেই সন্দেহ থেকে গিয়েছিল যে, চীন শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে রুশ-ভারতের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যিই লড়বে কি না; তাদের বিশ্লেষণ ছিল এ রকম, এ যুদ্ধে ভারত জড়িয়ে গেছে তার নিজের স্বার্থেই, প্রথমত, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হলে রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক থেকে সে অনেক বেশি লাভবান হবে; দ্বিতীয়ত, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর চাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকরণ ছাড়া তার সামনে আর কোনাে বিকল্প পথ নেই। তৃতীয়ত, ভারতের বাঙালিরা এ যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে এমনই আবেগ-উন্মাদনায় ভুগছে যে, এ যুদ্ধে যদি সমর্থন দেয় সে, তাহলে গৃহবিবাদ বেঁধে যাওয়ার জোর আশঙ্কা আছে।
সােভিয়েত ইউনিয়ন এ যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে, এজন্য যে, জোট নিরপেক্ষ একটি বৃহৎ দেশকে নিজের বলয়ে টেনে নিয়ে আসতে পারলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার প্রভাব, প্রতিপত্তি আরাে বৃদ্ধি পাবে এবং চারদিকে প্রকাশ পাবে যে, পৃথিবীর সকল শােষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম এবং একমাত্র বন্ধু হচ্ছে সােভিয়েত রাশিয়া। অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পর্যদস্ত হওয়ার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরশক্তি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মনে যে রকম নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, এ কালিমা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, বিশ্ব মােড়লিপনায় নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটা ‘জয় চাই-ই, চাই। তাছাড়া সেনটো’ ‘সিয়াটো’ চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের বিপদে সহায়তা করতে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সময় চুক্তিবদ্ধ বন্ধু রাষ্ট্রটির প্রতি হাত না বাড়ালে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ অন্য দেশগুলাে তার প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়বে না? এ যুদ্ধে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পরস্পরের প্রতিপক্ষ, আর তৃতীয় পক্ষের তিনটি দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ বা ভাবমূর্তি রক্ষা করার বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে এই যুদ্ধের সাথে। এই পঞ্চশক্তির প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধের দামামায় মেতে ওঠেছে। কিন্তু এ যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে চীনের কী লাভ হবে? পাকিস্তানের অখণ্ডতা থাকুক কিংবা না থাকুক, চীনের কিছু যায় আসে না তাতে, এই অলাভজনক রক্তমাখা পথে চীনের কি হাঁটা উচিত? | চীনা নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ পত্রিকা গার্ডিয়ান’ পরামর্শ দিল পাকিস্তানকে, তােমরা বলছাে যে, চীন তােমাদের বন্ধু। কিন্তু আগামীকাল যদি তােমাদের জেনারেলরা মুক্তিযােদ্ধাদের চীনা অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে লড়তে দেখে অবাক হয়ে যায় এবং ভাবতে বসে যে, চীন বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোেদ্ধারা কিভাবে চীনের অটোমেটিক রাইফেল পেল? তবে তাদের ‘ইডিয়ট জেনারেল বলা ছাড়া আমাদের আর কোনাে গত্যন্তর থাকবে না।” 
একই রকম উপদেশ দিয়েছিল প্যারিসের একটা সংবাদপত্র, “তােমরা ভাবছাে চীন তােমাদের বন্ধু, কাজেই চীন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে তােমাদের পিছনে দাঁড়াবে। দেখা যাচ্ছে চীনের রাজনীতি তােমরা মােটেই বুঝতে পারােনি।… চীন যখন আশ্বাস দিচ্ছে, আমি তােমার পিছনে আছি, আর এ কথা যদি বিশ্বাস করাে তাহলে তােমাদের অবস্থাও অনেকটা সেই গল্পের রােগীর মতােই হবে : একজন লােক হৃদরােগে ভুগছে। চিকিৎসার জন্য সে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, কিছু চিন্তা। করবেন না, আমি আপনার যকৃত সারিয়ে দেব।… বাংলাদেশের ব্যাপারে চীন যে সকল আশ্বাস দিচ্ছে পাকিস্তানকে, তা অনেকটা ওই ডাক্তারের দেয়া আশ্বাসের মতাে।” স্টেটসম্যান পত্রিকাতেও জনৈক বিদেশি সাংবাদিক ‘চীনা হেঁয়ালি’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন; সেখানে তিনি অভিমত দিয়েছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের নানা প্রকার আশ্বাসবাণী সত্ত্বেও বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের ভূমিকাকে তিনি কোনাে মতেই মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা হিসেবে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বরং তার ধারণা, যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে হয়তাে চীনই একদিন বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসবে। কাজেই চীনের ব্যাপারে পাকিস্তানের সাবধান হওয়া উচিত’ (পত্রিকার এ ভাষ্যগুলাে দুশাে ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। পৃ. ৩০৮-৩০৯)। চীনা কূটনীতির স্বরূপ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের পত্রিকাগুলাের সন্দেহ যে অমূলক নয়, এর প্রমাণ ক’দিনের মধ্যেই পাওয়া গেল। ২৯ অক্টোবর, মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনা মনােভাবের পরিবর্তন।
খবরের ভেতরে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে চীনের মনােভাব পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ, পাক-ভারত সীমান্তে এখন যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সে সম্পর্কে পিকিং একদম নীরব। রয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যায় পরিণত করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির পক্ষপুটে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে, পিকিং তা সমর্থন করবে না, বা পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। চীন ভাবছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে তা চীনের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।’ বস্তুত চীনা কূটনীতির মর্মভেদ করতে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা যে সর্বাংশে অসফল হয়েছিল, তা বােঝা যায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনের পরবর্তী কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে। এক্ষেত্রে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পদক্ষেপ ছিল সঠিক, তারা চীনকে যথাযথভাবে চিনেছিল এবং সে অনুযায়ী রণসাজে সজ্জিত হয়েছিল।
[বি. দ্র. : মওলানা মওদুদীর ভাষ্য পাকিস্তান হলাে ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ। খােদা না করুন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পূর্ণরূপে খতম করা হবে। অতএব, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার অর্থ হচ্ছে ইসলামকে রক্ষা করা’ (দৈনিক সংগ্রাম, ০৯.১০.১৯৭১)। গােলাম আযমের ভাষ্য, ‘ইসলাম। প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মতােই পাকিস্তানের হেফাজত করা ফরজ। আল্লাহ না করুন যদি পাকিস্তান না থাকে তাহলে বাঙালি মুসলমানদের অপমানে। মৃত্যুবরণ করতে হবে’ (দৈনিক সংগ্রাম, ১৬.০৮.১৯৭১)। ভাগ্যের কী পরিহাস, সেই ইসলামের দুর্গ রক্ষা করার জন্য, ইসলামকে হেফাজত করার জন্য গােলাম আযমই ‘বিশেষ বন্ধু মানলেন নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্ট চীনকে : চীন পাকিস্তানের প্রকৃত ও একমাত্র বন্ধু, এ-কথা প্রকাশ হয়ে গেছে।’ (দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.০৮.’৭১)]
 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!