You dont have javascript enabled! Please enable it! শরণার্থী- রাজনীতি আন্তর্জাতিক সমাজ - সংগ্রামের নোটবুক
শরণার্থী, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সমাজ
১২ আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর রবার্ট কেনেডি কলকাতার আশপাশের বেশ ক’টি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এসব উন্মুল মানুষের দুর্বিষহ জীবনযাত্রা দেখে তিনি বেদনায় কাতর হয়ে যান এবং হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখতে বাধ্য হন। ১৩ আগস্ট, কলকাতা থেকে দিল্লি এসে, পালাম বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমেরিকাবাসীগণ শরণার্থী সম্বন্ধীয় খবরাখবর সংবাদপত্রে পড়ছেন, কিন্তু শরণার্থীদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত তারা সমস্যার বিশালতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারবে না।’ কেনেডি কর্তৃক পরিদর্শনকৃত শরণার্থী-শিবিরের শােচনীয় ছবি এবং তাঁর প্রতিক্রিয়া নিউজ উইকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক সমাজে প্রবল আলােড়নের সৃষ্টি হয়। ২৭ আগস্ট, হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকা লেখে, ‘শরণার্থীদের জন্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার ইতােমধ্যেই ১২০ কোটি রুপি খরচ করেছে। শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ১১০ কোটি রুপি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৮.৩৭ কোটি রুপি এখন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে।’ সন্দেহ নেই, প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী-প্রবাহ ভারতীয় অর্থনীতিতে কঠিন চাপ সৃষ্টি করেছিল, বাড়তি এক কোটি মানুষের আশ্রয় ও খাদ্য যােগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল নয়াদিল্লি। ভারত বারবার বলে আসছিল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে সংঘাত চলছে, তা নিয়ে নয়াদিল্লির মাথাব্যথা নেই, তারা উদ্বিগ্ন কেবল নিজ দেশে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ব্যাপারে। ওই শরণার্থীদের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, আশ্রয় কেন্দ্রের আশপাশে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে।
উদ্বাস্তুরা ভারতের জন্য কেবল বিপুল অর্থনৈতিক বোঝা নয়, একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক শঙ্কাও তারা বহন করছে—ভারতের অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পূর্বাঞ্চল, কয়েক বছর আগেই যে অঞ্চলের উপর দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটেছে, সেখানে চেপে বসেছে লাখ লাখ গৃহহীন, কর্মহীন মানুষ’ (সিডনি শনবার্গ-এর লেখা থেকে, গ্রন্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের। ভূমিকা, সােহরাব হাসান সম্পাদিত, পৃ-১৯১), যাদের মাধ্যমে ওখানকার অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলার আরাে অবনতি ঘটার আশঙ্কা আছে, কাজেই তাদের ব্যাপারে পূর্ণ মীমাংসায় না পৌছা পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপারে সে নিচুপ হয়ে থাকতে পারে না। শরণার্থীদের নিয়ে পাকিস্তানই প্রথম হীন, নীতিবর্জিত রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছিল। মে-এর মধ্যভাগ পর্যন্ত তারা স্বীকারই করতে চায়নি যে, পাকিস্তানের কোনাে অধিবাসী শরণার্থী হিসেবে ভারতে প্রবেশ করেছে বা করছে। মে মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান অনুভব করতে পারল যে, তারা একটা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে, এটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিস্তর অর্থের প্রয়ােজন। সেই অর্থের জন্য পাকিস্তান বিশ্ব ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়; অর্থসহায়তার শর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংক কথিত গণহত্যা ও শরণার্থী প্রসঙ্গটি যাচাই করে দেখতে চায়, কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলদের দুর্ভাগ্য যে, অনেক ফন্দি ফিকির করেও তারা শরণার্থীবিষয়ক আসল চিত্রটি গােপন করতে ব্যর্থ হয়; বিশ্বব্যাংকের তিন কর্মকর্তা পিটার কারগিল, ভ্যানডার হিজডেন, ডেভিড গর্ডন যশােরসহ পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল পরিদর্শন করে রিপাের্ট পেশ করেন, ‘অবস্থা অবশ্যই স্বাভাবিক থেকে বহু দূরে সরে গেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার কোনাে লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না এবং ঘটনার গতিও সেদিকে নয়।…
বিমান থেকে পরিষ্কার চোখে পড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম। একটি বাড়িতে তখনাে আগুন জ্বলছিল এবং বিমান অবতরণের রানওয়ের পূর্বদিকের অনেক বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে।… কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী যশাের শহরের লােকসংখ্যা ৮০ হাজার থেকে কমে ১৫/২০ হাজারে নেমে এসেছে। দোকানে কেনাবেচা বন্ধ। দোকানপাটের অর্ধেকেরও বেশি ধ্বংস করা হয়েছে।… পরিস্থিতি স্বাভাবিককরণের ন্যূনতম শর্ত হিসেবে কঠোরভাবে দৃশ্যমান পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি হ্রাস করতে হবে; পাকিস্তানে অন্ততপক্ষে পরবর্তী বছরের জন্য নতুন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা বন্ধ রাখতে হবে’ (দৈনিক পূর্বদেশ, ২১ জুলাই, ‘৭১)। বস্তুত শরণার্থী-রাজনীতির কূপে পড়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা পাকিস্তানের জন্য আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। পিটার কারগিল ও তার টিমের রিপাের্ট সম্পর্কে পরদিন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করা হয়, …কারগিল রিপাের্টের যেসব অংশ নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ভারতীয় প্রচারণারই প্রতিচ্ছবি আমরা পাই। এ থেকে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে পাকিস্তান সফরকারী পিটার কারগিল ও সহযােগীরা হিন্দুস্থানি স্বার্থের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন।… বিশ্বব্যাংককে নিরপেক্ষ করে তুলতে হলে ষড়যন্ত্রকারী ও স্বার্থদুষ্ট ব্যক্তিদের এ সংস্থা থেকে বহিষ্কার করা উচিত বলে আমরা মনে করি।… এ ছাড়া পাকিস্তানকে সাহায্যদাতা কনসাের্টিয়ামের সদস্য রাষ্ট্রগুলাে কারগিল রিপাের্টের ওপর নির্ভর করে গৃহীত তাদের অসঙ্গত সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে।’ কিন্তু হায়, দৈনিক সংগ্রামের সংগ্রামী কণ্ঠ বিশ্বব্যাংককে একটুও প্রভাবিত করতে পারল না।

একটা বিষয়ে ভারত মােটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং সীমান্তে ‘অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য শরণার্থীদের যতই মিষ্টি সুরে আহ্বান করুক না কেন, চূড়ান্ত মীমাংসা-দৃশ্যত দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ-ই পাক অধিকৃত বধ্যভূমিতে ফিরে যাবে না। সিডনি শনবার্গের ভাষায়, বর্তমান লেখক ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক শরণার্থী শিবিরগুলাে ব্যাপকভাবে ঘুরে আলাপ-আলােচনা করে অনুভব করতে পেরেছেন যে, বেশিরভাগ শরণার্থীই ফিরে যাবেন না। কেননা, একদিকে তাদের বাড়িঘর, বিষয়-সম্পত্তি দালালদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে শরণার্থীদের বৃহদংশ… পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চাইতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতকেই বেশি নিরাপদ বােধ করে (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, সিডনি শনবার্গ, পৃ-২০০)। শরণার্থী শিবিরে ভাতের অভাব আছে, মাথা গােজার জায়গার অভাব আছে, কিন্তু গুলি-বােমা-বেয়নেটে প্রাণ যাওয়ার ভয় তাে নেই। মা-বােনের ইজ্জত হারানাের ভয়ও তাে নেই। দেশ শত্রুমুক্ত হতে লাগুক না বছরের পর বছর, আধপেটা খেয়ে বা না খেয়েও কষ্ট করতে সবাই রাজি, কেবল প্রাণ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা থাকলেই হলাে। শরণার্থীদের এমন দৃঢ় মনােভাবকে পুঁজি করে নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক সমাজে প্রচার করতে লাগল, চাপিয়ে দেয়া শরণার্থীর বােঝা বইতে গিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিপর্যস্ত প্রায়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ বা অন্য কেউ যদি সমাধানযােগ্য পদক্ষেপ নেয় তাে ভালাে, নইলে নিজের কল্যাণের জন্য যা যা করা দরকার, নয়াদিল্লি তা-ই করতে বাধ্য হবে।

বস্তুত শরণার্থী প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজের সিংহ ভাগই ছিল ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল, এই প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে ইন্দিরা প্রশাসন পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করার পথ খুঁজে যাচ্ছিল।  ২২ অক্টোবর, আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক ‘দি ওয়াশিংটন পােস্ট’-এর সম্পাদকীয় কলামে লেখা হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। আর এই যুদ্ধাশঙ্কার জন্য পাকিস্তান বিশেষভাবে দায়ী।… পাকিস্তান তার নিজের দেশের সমস্যাকে শরণার্থীরূপে ভারতে চালান করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।… বাংলাদেশ থেকে ভারতে এক কোটি শরণার্থী গেছে যাদের ত্রাণকার্যের জন্য একশাে কোটি ডলার প্রয়ােজন।… এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নিয়েছে। সে পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে।… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা বিশেষভাবে কলঙ্কজনক।’ এর ক’দিন পর, ২৫ অক্টোবর বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন মন্তব্য করে, ভারতে সরকারিভাবে ৯০ লাখ শরণার্থী এসেছে। যে হারে শরণার্থীর আগমন ঘটছে, তাতে ১৯৭১ সাল শেষ হওয়ার আগেই শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি কুড়ি লাখের মতাে।… এমন একটা সময় ছিল, যখন ভাবা হতাে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ। সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই। এই সমাধান সম্ভব হবে। কিন্তু অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমনই এক পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে যে, বাঙালিরা পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে সমাধান মেনে নেবে এমন আশা কূটনীতিকরা আর করছেন না। বাংলাদেশের আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে, কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায়, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর অন্য কোনাে সমাধানই বাঙালিরা মেনে নিতে রাজি নয়।

শরণার্থী’-র ওপর ভারতীয় প্রশাসনের সমধিক গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভারত-যুগােস্লাভ যুক্ত ইশতেহারের মধ্যে। যুগােস্লাভের প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ৪ দিনের সরকারি সফরে ২৪ অক্টোবর নয়াদিল্লি আসেন এবং সফর শেষে দুই দেশ মিলে যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করে, এর মূল কথা ছিল, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর আগমনের ফলে ভারতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ও ভারতের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। এই সমস্যার সমাধানকল্পে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে এবং ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের অবিলম্বে স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক প্রভৃতি পেশার পাশাপাশি আপাদমস্তক ঈশ্বরে সমর্পিত একজন যাজিকা, মাদার তেরেসা যখন শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট-হাহাকারের বর্ণনা দিয়ে বিশ্বসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যান, তখন এর মধ্যে কেউ ‘রাজনীতি খোঁজেন না, খুঁজে পান আর্তমানবতার দলিত রূপের নিষ্ঠুর-করুণ চিত্র। শরণার্থীদের অপরিসীম দুঃখ-যন্ত্রণার করুণ চিত্র দেখে এই মহীয়সী নারী বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন,-“ভারতের সমস্যাকে আমরা বিশ্বসমস্যা হিসেবে গণ্য করতে চাই। লাখ লাখ পাকিস্তানি (পূর্ব বাংলা থেকে আগত) শরণার্থীকে ভারত ভালােভাবে আশ্রয় দিয়েছে, দেখাশােনা করছে।… এই সমস্যাটি শুধু ভারতের নয়, বিশ্বেরও সমস্যা। এই সমস্যার দায়ভার বিশ্বকে নিতে হবে।
এই সমস্যার প্রতিকারও বিশ্বকে করতে হবে।—আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের ভাবতে হবে যে লাখ লাখ শিশু অপুষ্টি ও ক্ষুধা এবং অন্যান্য সমস্যায় ভুগছে। তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলে বাঁচানাে কঠিন হবে। এখানে আমি আবারও বলতে চাই যে, বিশ্ব যদি খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে এবং শিশুদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়, তাদের মৃত্যুর জন্য বিশ্বকেই জবাবদিহি করতে হবে। শরণার্থীদের মধ্যে আমি পাঁচ বা ছয় মাস কাজ করেছি। আমি বয়স্ক ও শিশুদের ধুকে ধুকে মরতে দেখেছি। এ কারণেই আমি পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও তার প্রতিকার কত জরুরি সে সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করতে চাই। বিশ্বকে আমার আবেদন জানিয়েছি, অবশ্যই তাদের জবাব দিতে হবে।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, পৃ.১২২)।
শরণার্থী-সমস্যা, যা মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক সমাজকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, এই সমস্যা মােকাবিলা করতে গিয়ে নয়াদিল্লিকে প্রচণ্ড বেগ পােহাতে হয়েছে, এর পেছনে ভারত-রাষ্ট্রের মানবিক বােধ যথেষ্ট পরিমাণে সংশ্লিষ্ট ছিল, তবে তাকে কেন্দ্র করে ভারত যে কূটনৈতিক মারপ্যাচের আদৌ আশ্রয় নেয়নি—এমনটি বলার অবকাশ কম। শরণার্থীদের ভারত খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে, সেই সাথে এদের সামনে রেখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপশাসন ও বর্বরতার চিত্রটি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে উত্থাপন করে গেছে এবং শরণার্থী-প্রশ্নে নিজ দেশের স্বার্থহানি ঘটছে—এমন প্রচারের মাধ্যমে বহির্বিশ্বকে জানান দিয়ে রেখেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এ সমস্যার সমাধান যদি না করা হয়, তবে নয়াদিল্লি নিজেই এ বিষয়ের সমাধান টানতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ এসব প্রচারণার মাধ্যমে ভারত ওই যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার যৌক্তিক কারণ সৃষ্টি করে নিয়েছিল।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র