You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধ ইন্দিরার আশা-নিরাশা - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধ এবং ইন্দিরার আশা-নিরাশা
মধ্য জুলাই পর্যন্ত, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের ভবিষ্যৎ ভূমিকম্ব মাথায় রেখেও ভারত মুজিবনগর সরকারকে দ্বিধাবর্জিত চিত্তে সহায়তা করে গেছে। ভারতের এই মনােসমীক্ষণে প্রথম বিঘ্ন ঘটে হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের পর। চীন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি ভারতকে অতলান্ত শঙ্কা-সমুদ্রে ফেলে দেয়। কারণ ভারতের যা রণসম্ভার ও কূটনীতিক বলয়, তা পাকিস্তানকে ঠেকানাের জন্য যথেষ্ট হলেও, পাকিস্তানের পাশে যদি চীন-মার্কিন ঐক্যশক্তি দাঁড়িয়ে যায়, সেটা মােকাবিলা করার সামর্থ্য নয়াদিল্লির নেই বললেই চলে। বিচলিত দিল্লি প্রশাসনের কাছে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ অপেক্ষা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় স্বীয় ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই তারা ত্বড়িতগতিতে মস্কোর শরণাপন্ন হয়ে বিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে নেয়। তারপরও পাকিস্তান + চীন + মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র = ভারত + সােভিয়েত ইউনিয়ন (+ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী) এ সাধারণ সমীকরণটির ওপরও আস্থা রাখতে পারেনি ভারতীয় প্রশাসন। তারা, বিশেষত শ্রীমতি গান্ধী আরাে মিত্র বা বৈশ্বিক জনসমর্থন আদায়ের জন্য পশ্চিমা দুনিয়া ভ্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতঃপূর্বে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং ৫ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত মস্কো, প্যারিস, অটোয়া, ওয়াশিংটন এবং নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের কার্যালয় ঘুরে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্রটি উপস্থাপন করে এসেছিলেন।
এবার ইন্দিরা নিজেই যান মস্কো সফরে, সেপ্টেম্বর ২৮ ও ২৯, এ দুদিনে তিনি তিন সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ, পােদগনি ও কোসিগিনের সাথে ছ’ঘণ্টাব্যাপী আলােচনা করেন এবং দুই দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এ বৈঠক সম্পর্কে ইন্দিরার সফরসঙ্গী ডি পি ধর পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, Finally the Soviet leaders wanted to know what India expected to them to do. Flexible attitude was adopted by the both sides for both political solution based on Mujib’s release and building up Indian’s armed preparedness, should she be embroiled in a military conflagaration. Soviet arms assistance was assured to be quickened, but not more than normal supplies except for some weapons for freedom fighters, should the struggle prolong. রুশ-ভারতের যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের পর পর সােভিয়েত পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানি বর্বরতার প্রসঙ্গটি গুরুত্বসহ উপস্থাপিত হতে থাকে এবং মস্কো, লেনিনগ্রাড, মিনস্ক প্রভৃতি বড় বড় শহরে পাকিস্তানবিরােধী প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়।
২৪ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী। বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি প্রভৃতি দেশ সফর করেন; ২৫ অক্টোবর তিনি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে ভাষণ দিলেন, ‘প্রচলিত অর্থে এটা গৃহযুদ্ধ নয়। এ হচ্ছে বেসামরিক জনগণকে হত্যা-গণহত্যা। কেননা তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভােট দিয়েছিল। এ হচ্ছে প্রতিবেশী জাতির। বিরুদ্ধে অসহায় মানুষকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিকারগ্রস্ততা।’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৩)। অখণ্ড পাকিস্তান প্রশ্নে ইন্দিরাঅনুসৃত নীতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্র-প্রশাসন এমনই ক্ষুব্ধ ছিল যে, ইন্দিরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কোনাে মন্ত্রীও নয়, বিমানবন্দরে পাঠানাে হয়েছিল। ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত কিটিংসকে। মার্কিন প্রশাসনের এমন অপমান গায়ে মাখলেন না ইন্দিরা, বৈঠক করলেন নিক্সনের সাথে, ফলাফল সেই একই—শূন্য। প্রেসিডেন্টের দেয়া ভােজসভায় ইন্দিরা খােলাখুলি মত প্রকাশ করলেন, ‘আপনারা কি ভাবতে পারেন মিশিগান রাজ্যের সমস্ত অধিবাসী এসে। | জড়াে হয়েছে নিউইয়র্ক রাজ্যে। তাদের আশ্রয় দান, প্রশাসন, সেবামূলক যেমন স্বাস্থ্য যােগাযােগ ও খাদ্য প্রভৃতি যােগান দেয়ার জন্য অর্থ সম্পদের প্রয়ােজন নেই? যে দেশ দারিদ্র্য ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতাে সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ। করে চলেছে, তার অবস্থা কী দাঁড়ায়?—আমাদের প্রশাসন এই ক্রমবর্ধমান। বিশাল জনতার চাহিদা মেটাতে ইতােমধ্যে চাপের মুখে পড়েছে। খরার জন্য মজুদ খাদ্যশস্য নিঃশেষ হয়ে গেছে। উন্নয়নমূলক কাজের জন্য রাখা সীমিত।
সম্পদও ফুরিয়ে গেছে।’ (বা. ডকু, পৃ. ২৫৭)। | এ সময় ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এনবিসি)-এর টেলিভিশন। নেটওয়ার্ককে তিনি বলেন, “আমরা খােলাখুলিভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।… তারা সততার সাথে ভােট দিয়েছিল, কিন্তু এখন তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। গেরিলা আন্দোলন গড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত আমরা। তাদের ব্যাপারে নাক গলাইনি।’ ৮ নভেম্বর প্যারিসে রাষ্ট্রীয় ভােজসভায় তিনি। বললেন, “আমরা অতিমাত্রায় আত্মসংযম দেখিয়েছি। কিন্তু কোনাে সন্দেহ। নেই যে আমাদের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন।… এই সঙ্কটের। মূল কারণের অপনােদন ঘটাতে হবে। একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের। করতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। তবে তা অবশ্যই বাংলাদেশের। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সমর্থনযােগ্য হতে হবে।’ কিন্তু না, ইন্দিরার এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, এমনকি গণহত্যা প্রসঙ্গেও পাশ্চাত্য। রাষ্ট্রনায়কদের কাছ থেকে তেমন সাড়া মিলল না। তারা শরণার্থীদের দুঃখকষ্টের ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা দেখিয়েছে, কিন্তু যে জন্য এই সমস্যার উদ্ভব, তা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে পুরােপুরি। বস্তুত পক্ষকালব্যাপী ইউরােপআমেরিকা সফর থেকে রাষ্ট্রিক ও কূটনৈতিক-বিবেচনায় ইন্দিরার প্রাপ্তি শূন্য প্রায়, তবে সেখানকার গণমানুষের সমর্থন আদায়ে তিনি সফল হয়েছিলেন।
Gta petzt, ‘I was not going to ask for anything but only to inform the world leaders of the real situation in the Indian subcontinent and to acquaint the host countries with the Indian point of view.’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পৃ. ৩৬৮)। | ইন্দিরা গান্ধী যদিও বলেছেন যে, তিনি বহির্বিশ্বের কাছে কিছু চাইতে যাননি, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে ভারত উপমহাদেশের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরাই লক্ষ্য ছিল তার এবং সেটা তিনি সফলভাবেই করতে পেরেছেন, তবে ইন্দিরার এ কথা কূটনীতিসুলভ বচন মাত্র, আসল ঘটনা ছিল অন্যরকম—বাংলাদেশ বিষয়ে বহির্বিশ্বের নির্লিপ্ত ও নির্বিকার আচরণে তিনি খুব মর্মাহত হয়েছিলেন; বিশেষত নিক্সন-কিসিঞ্জারের অবজ্ঞাসূচক আচরণ তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছিল খুব এবং এরই প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ডিসেম্বরের প্রথম দিনে, আগরতলার জনসভায়। কারাে নাম উচ্চারণ না করে, কাউকে সমালােচনা না করে ওইদিন তিনি প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, এখন থেকে আমরা এই অঞ্চলে আমাদের স্বার্থে যা যা করা প্রয়ােজন, ঠিক তা-ই করব। তথাকথিত বৃহৎ শক্তিসমূহের কথামতাে আমরা কোনাে কাজ করব না। তবে হ্যাঁ, ইন্দিরার এই দৃঢ় ও কঠোর বক্তব্য প্রদানের মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিল সােভিয়েত নেতৃত্ব এবং বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ। কারণ, কোনাে কোনাে দেশের ক্ষমতাসীন মহল ভারত-বাংলাদেশের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিলেও, কোনাে কোনাে দেশ ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, ওই সব দেশের জনগণ (মুসলিম দেশগুলাে বাদে) যেন স্বীয় রাষ্ট্রনায়কদের প্রতিপক্ষ হয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন এবং এ প্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি কর্তৃক গৃহীত নীতির সমর্থনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, শরণার্থীদের সহায়তাকল্পে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, ব্যক্তিক চিত্তে এই মানবিক বােধের উদ্বোধন—যা সুচারুভাবে করতে পেরেছিলেন মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধী, এটা কূটনৈতিক বিজয়ের চেয়ে গৌণ নয় কোনােমতেই।
ময়দানে তিনি নেই, তবে আছেন অন্তরে ও আলােচনায়
একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলােতে, বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু কেবল রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের অস্তিত্বের অংশ, চেতনার মশাল, সমকালীন ইতিহাসের মিথ, বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের মুকুটহীন সম্রাট। পঁচিশ মার্চের কালােরাতে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গােপন স্থানে, তখন থেকে তিনি আমাদের কাছে। অপ্রত্যক্ষ, কিন্তু চিন্তা-আবেগে-চেতনায়, সবখানেই তিনি মূর্তিমান, দীপ্ত প্রেরণার উৎস। যে বৈপ্লবিক আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির বােধ ও চেতনায়, তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই আগুনের উত্তাপ একটুও কমেনি, তাঁর যােগ্য সহকর্মীরা, তাঁর প্রিয় ভাইয়েরা অর্থাৎ বাংলার জনগণ আগুনের শিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছেন রক্ত আর চেতনার সম্মিলন ঘটিয়ে। সবাই ভেবেছেন, তিনি। নেই—তাতে কী, তাঁর হুকুম তাে দেয়াই আছে; তিনি তাে আগেই বলেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’…বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল, তােমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক,… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রাণের নেতা, হৃদয়ের নেতা উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হুকুম তাে দিয়েই গেছেন, শত্রুকে মােকাবিলা করার হুকুম, দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেয়ার হুকুম, সেই হুকুমের অনুবর্তী হয়ে তিনি নিজেই তাে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও স্বতঃস্ফূর্তচিত্তে। গ্রেপ্তারবরণ করেছেন, পালিয়ে যাননি মৃত্যুর ভয়ে, নেতা হিসেবে সবটুকু গরল’ সামনে থেকে নিজেই পান করে নিয়েছেন, আর অন্যদেরকে পালিয়ে গিয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলার হুকুম দান করেছেন—এরপর নতুন কিছু বলার প্রয়ােজন কী, যদিও গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আবারাে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন এবং অন্যদের দ্বারা বলিয়েছেন, এটা যেন আসরে গাওয়া গানের পর একই শিল্পীর রেকর্ডকৃত গান শােনা, বা ওই শিল্পীরই গাওয়া গান অন্যের কষ্ঠে শােনা, কিন্তু শিল্পীর সামনে বসে গান শােনা আর রেকর্ড করা গান শােনা কিংবা একই গান অন্য কারাে কষ্ঠে শােনা কি এক জিনিস? কাজেই যে গান আমরা প্রত্যক্ষভাবে শুনেছিলাম, শুনে শিহরিত হয়েছিলাম, শপথবদ্ধ হয়ে এসেছিলাম, এরপর রেকর্ডকৃত গান না শুনলেও আমাদের আগুন-জ্বালানাে চেতনার খুব যে। রকমফের হতাে, তা মনে হয় না। 
বস্তুত, মার্চের উত্তাল দিনগুলাে থেকে শেখ মুজিব আর স্বাধীনতা দুটো যেন সমার্থক শব্দে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আঙুলের ইশারায় জনতা দুলত, রাস্তায় নামত, স্লোগান দিত, নতুন নির্দেশনা পাবার জন্য অধীর আগ্রহ। নিয়ে প্রতীক্ষা করত। ইয়াহিয়া এবং তার সহযােগীদের ধারণা ছিল মুজিবসহ কয়েক জন আওয়ামী নেতাকে জেলে ঢােকালে, কয়েক হাজার মানুষের রক্তে রাজপথ লাল করে দিলে, হুজুগে বাঙালির উতলে ওঠা আবেগাপ্লুত-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে। এ চক্রটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে, রাজনীতির কবি’ শেখ মুজিব বাণী-ছন্দ ও অলঙ্কারসমৃদ্ধ যে কবিতায় বাঙালির চিত্তকে সম্মােহিত করে রেখেছেন, এর আবেদন বুলেট-বােমা-ট্যাঙ্কের নিষ্ঠুরতা দিয়ে। নিঃশেষিত করা যাবে না। শেখ মুজিবীয় সম্মােহনে কেবল দেশীয় জনতাই যে আবিষ্ট হয়েছে, এমন নয়, এ সম্মােহনী শক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ-দেশান্তরে। তাই, ১০ এপ্রিল, নবগঠিত সরকারে, অনিশ্চয়তাধীন শেখ মুজিবকেই নির্বাহী ক্ষমতার শীর্ষ স্থানটিতে বসাতে হয়েছে, নতুন সরকারের শপথ নেয়ার স্থানটির পুরনাে নাম বাদ দিয়ে মুজিবনগর’ রাখা হয়েছে এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দ নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে আইনবিহীন প্রক্রিয়ায় যে একটা বাহিনী গড়ে তুলেছেন, এটিকে গ্রহণযােগ্য করার জন্য ‘মুজিববাহিনী’ নামকরণ করা হয়েছে। ২৫ মার্চের কালােরাতে তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব সমাজের মুখে যে দুটো বিষয় বারবার উচ্চারিত হয়েছে, এর একটি বর্বরােচিত গণহত্যা, অন্যটি শেখ মুজিবের নিরাপত্তা। পাকিস্তানের গােপন কারাগারে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে—এমন খবরের ভিত্তিতে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে প্রভাব খাটানাের জন্য ২০ জুলাই, জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ভারত, চীন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সরকারপ্রধানকে অনুরােধ জানিয়েছিলেন।
১৩ আগস্ট, বাংলাদেশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রায় ৫০০০ জন বুদ্ধিজীবী কলকাতাস্থ রুশমার্কিন কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সে সময় তাদের হাতে fer Save Mujib, Free Mujib from Yahya’s jail, Foil plot to kill Mujib, Joy Bangla, No farce in the name of traii, Release Mujib প্রভৃতি শ্লোগান সংবলিত ব্যানার।  ১৯ আগস্ট, বৃহস্পতিবার, মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল, Senator Edward Kennedy, future Presidential candidate of America, has promised to secure the release of Sheikh Mujibur Rahman, President of the People’s Republic of Bangladesh. He gave the assurance while talking to Bangladesh intellectuals during his just concluded visit to Mujib Nagar.’ এর আগে, ৩ আগস্ট, ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তান কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২২ অক্টোবর, সােভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লি সফরে এসে, পরদিন মার্কিন সরকারকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সাধন ছাড়া কেবল সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা রােধ করা সম্ভব নয় (মূলধারা ‘৭১, পৃ.১২৬)। তৎকালীন রাজনীতি প্রবাহে কারাবন্দি শেখ মুজিবের প্রভাবের স্বরূপ বােঝা যায়, ২ আগস্ট নিউজউইকে প্রকাশিত লােরেন জেনকিনসের রিপাের্টটির শেষাংশ পড়লে : “…গত সপ্তাহে ইসলামাবাদে এক কূটনীতিক বিষন্নকণ্ঠে আমাকে বলেন, পাকিস্তানের ট্রাজেডি হচ্ছে যা ইয়াহিয়া করেছেন সেটা তিনি বিস্মৃত হচ্ছেন—বিস্মৃত হচ্ছেন নিজস্ব কার্যক্রমের মূল্যের বিনিময়ে। এখন একজনই মাত্র বেঁচে আছেন, যিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারেন। আর তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিব। ইয়াহিয়া শপথ নিয়েছেন যে, মুজিবকে মরতেই হবে। কিন্তু যে দিন তিনি তাঁকে ফাঁসিতে ঝােলাবেন—সেইদিন নিজেকে যেমন, তেমনি পাকিস্তানকেও ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে দাঁড় করাবেন।” (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩১)।
ওই সময় ‘মুজিব’ নামটির সম্মােহনশক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তার অনুসারীরা তাে বটেই, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধপক্ষও তাঁরই নামকে পুঁজি করে, বা তার প্রতি কৃত্রিম অনুরাগ দেখিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিত। যেমন, সেপ্টেম্বর মাসে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভণ্ডুল করার নিমিত্তে মােশতাকচক্র প্রচারণা শুরু করেছিল, দুটোর মধ্যে আমাদেরকে যে কোনাে একটা বেছে নিতে হবে, হয় স্বাধীনতা, নয় তাে শেখ মুজিবের মুক্তি, দুটোকে একসাথে অর্জন করা সম্ভব হবে না কিছুতেই। অর্থাৎ মুজিবের প্রাণরক্ষার দোহাই দিয়ে মােশতাক গং স্বাধীনতার লড়াইকে সমাধিস্থ করতে চেয়েছিল। আবার একই রকম ষড়যন্ত্র দেখি বিজয় অর্জনের মাত্র দুদিন আগে, ১৩ ডিসেম্বরে। আমাদের জয় যখন নিশ্চিত প্রায়, তখন প্রবাসী সরকারের বরখাস্তকৃত পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী মুজিবের মেকি ভক্ত সেজে, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একটা বিবৃতপত্রে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করেন, যাতে লেখা ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়, তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করবেন। লক্ষণীয় যে, মােশতাক বা চাষী, উভয়ই একটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছেন মাত্র একজন ব্যক্তিকে—শেখ মুজিবকে। মুজিবনগর সরকারের ধীমান শীর্ষ নেতৃত্ব ওই সংকটকালীন অবস্থায় না স্বাধীনতা, মুজিবের মুক্তি—দুটোর মধ্যে কোনাে একটাকে বেছে নেননি, দুটোকেই একসাথে অর্জনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা করেছেনও।
তা না করে কী-ই-বা উপায় ছিল তাদের, যে কোনাে একটা অর্জন করলে ব্যবচ্ছেদকৃত অপূর্ণ দেহ পাওয়া যেত, কারণ—সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর স্বাধীনতা, এ দুটো সত্তাকে আলাদা করে দেখার। কোনােই উপায় ছিল না। মুজিব প্রসঙ্গে ১৩ আগস্ট, বিখ্যাত মার্কিনি পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’ তার সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করেছিল, Pakistan may have made a serious error in bringing to trial before a Military Court the leader of the Awami League.- The authenticity of Sheikh Mujib,s leadership is not open to question.–there is no alternative to Sheikh Mujib reconciliation is to be achieved.

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র