মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে কিছু কথা
৮ থিয়েটার রােড, কলকাতা, মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে ১১ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত কর্নেল ওসমানী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর (এ প্রস্তাবের সূত্র ধরে তিনি পদত্যাগও করেছিলেন) এবং ভারত থেকে প্রত্যাশিত সামরিক সহায়তা না পাওয়ার প্রেক্ষিতে সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে ‘গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গটি ক্রমাগত সামনে চলে আসে। ফলে গেরিলা তৎপরতা বাড়ানাের জন্য যখন অনিয়মিত বাহিনীর মধ্য থেকে ‘গেরিলা’ সন্ধানের অতি উৎসাহী পদক্ষেপ নেয়া হলাে, তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে অহেতুক সন্দেহ জন্মে যে, বাংলাদেশ কেবল নিজের শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধিতেই মনােনিবেশ করে যাচ্ছে, শত্রুর বিরুদ্ধে মুখােমুখি যুদ্ধ করতে তারা তেমন উৎসাহী নয়। এসব অনভিপ্রেত খবরের পাশাপাশি কিছু খবর আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর মনােবলকে চাঙ্গা করে দেয়। চারদিকে খবর রটে যায়, ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে আমাদের নৌ-কমান্ডােরা ৫০,৮০০ টন পাকিস্তানি জাহাজ সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত করে দিয়েছে, ৬৬,০৪০ টন জাহাজকে ক্ষস্তি করেছে, বেশ কটি পাকিস্তানি নৌযান দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এসব খবরের সাথে সাথে বিষাদের ছায়া নামে, যখন মুজিববাহিনী কোথাও কোথাও সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিতে লাগল, সরকারি বাহিনীর অনেক সদস্যের ওপর বর্তমান পরিচয় ত্যাগ করে ‘মুজিববাহিনীতে যােগ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়ােগ করা হতে লাগল। সেই সময়ে মুজিববাহিনীর কিছু কর্মকাণ্ড আমাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈনিক—উভয় অংশকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
পাশাপাশি অস্ত্র-গােলাবারুদ প্রভৃতি দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রশাসনের অনুদার মনােভাব, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে দোদুল্যমানতা—ইত্যাদি বিষয় ভারতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যের মনে সন্দেহ। ও অবিশ্বাসের জন্ম দিতে লাগল। “দীর্ঘদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীন থাকায় ভারত সম্পর্কে যে মতবাদ বদ্ধমূল করে তােলা হয়েছিল, অনেকের মধ্যে তা-ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, ভারতীয় ফরমেশনের অপেক্ষাকৃত পদস্থ অফিসারদের মধ্যে কারাে কারাে পদমর্যাদা-সচেতন পেশাদারী আচরণ, বিদ্রোহী তরুণ অফিসারদের আবেগপূর্ণ মানসিকতা উপলব্ধিতে অক্ষমতা, উর্দু ভাষার ওপর বীতশ্রদ্ধ বাংলাদেশ সৈন্যদের সঙ্গে হিন্দি ভাষা ব্যবহার ইত্যাকার আচরণ দুই পক্ষের সম্পর্কের আবহাওয়াকে আরাে খারাপ করে তােলে। এরূপ আবহাওয়ার মাঝে এবং বিডিএফ (বাংলাদেশ ফোর্স) সদর দপ্তরের সুস্পষ্ট নির্দেশের অনুপস্থিতিতে সেক্টরনেতৃত্ব ভারতীয় ফরমেশনের সঙ্গে যথােপযুক্ত আলােচনা না করেই কিছু কিছু। আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। ফলে সেপ্টেম্বরে বিশেষত, পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিয়মিত বাহিনী যেখানে সক্রিয় ছিল, সেখান থেকে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে সাফল্য অপেক্ষা ক্ষয়ক্ষতি বিপর্যয়ের সংবাদই বেশি আসতে থাকে।” (মূলধারা ‘৭১, পৃ-১১২)। এ ঘটনার সত্যতা প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য সচিব ড. টি হােসেন প্রদত্ত ২১ সেপ্টেম্বরের facefco : I ventured to enquire from the Indian side. They said our boys entered without planning and information to their counterpart, so they were not ready for the offensive. Any way, these problems are to be shorted out at local levels to make them consistant with higher level agreement before any optimism is indulged in our reliance on our host. | দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যােগাযােগ সংক্রান্ত দূরত্ব কমানাের জন্য এবং পরিচালনাগত অভিন্নতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশ ও ভারত মিলে যুগ্ম-কমান্ড ব্যবস্থা গঠন করে।
এর ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানের মূল দায়িত্ব ভারতীয় কমান্ডের কাছে হস্তান্তরিত হয়, তখন বাংলাদেশ বাহিনীর অফিসার ও অন্য সৈন্যরা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সব ধরনের গােপনীয় তথ্য ভারতের হাতে তুলে দেয়। বস্তুত যৌথ কমান্ড গঠনের এই উদ্যোগ কর্নেল ওসমানীর মনঃপূত হয়নি, এ প্রেক্ষিতে তিনি বরাবরের মতােই পদত্যাগের হুমকি দেন; কিন্তু তাজউদ্দীন এবার ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তিনি জানালেন, ওসমানী যদি পদত্যাগ করার অভিপ্রায় লিখিতভাবে ব্যক্ত করেন, তবে তা গ্রহণ করা হবে। বস্তুত এরপর ওসমানী যুগ্ম কমান্ড সম্পর্কে আর কথা বলেননি, পদত্যাগও করেননি। তবে সেনাপ্রধানের পদটি আঁকড়ে থেকেই নিজেকে সরিয়ে রাখেন যুদ্ধের মাঠ বা পরিকল্পনা প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে। এর ফলে চূড়ান্ত অভিযানের প্রাক্কালে ভারতীয় কমান্ডকে নানাবিধ কৌশলগত সমস্যায় পড়তে হয়, যা পূরণের জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেন দুজন—তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুজিবনগর সরকারের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার। যুগ্ম কমান্ড’ সংক্রান্ত জনাব ওসমানীর অভিমানহত মনােভাব মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল এবং সম্ভবত এ কারণেই তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক অনুরােদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, ১৬ ডিসেম্বর, পাকবাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণমূলক অনুষ্ঠানে তিনি অনুপস্থিত থাকেন, যা তাঁর মহৎ কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যে কলঙ্কের তিলক হয়ে আছে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র