মােশতাক ও তার সহযােগীদের শেষ কামড়
৮ সেপ্টেম্বর, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ার পর, এতে বামপন্থিদের প্রবেশাধিকার প্রদান করায় আওয়ামী লীগের একটা অংশ, যার নেতা ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল, এই জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে দলের নিরঙ্কুশ অধিকারকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ার পাঁচ দিন আগে, যখন এ বিষয়ে উধ্বতন নেতৃত্ব গােপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছিলেন, এমনকি ভারতীয় পত্রপত্রিকাও দৃশ্যত যখন এ বিষয়ের কোনাে হদিস পায়নি, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে ঘােষণা করেন, শীঘ্রই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিফ্রন্ট গঠিত হতে চলেছে এবং এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন লাভ সম্ভব হতে পারে। যেদিন ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় রাশিয়ার সমর্থনের সম্ভাবনা সম্পর্কে মােশতাকের আশাবাদ প্রকাশিত হয়, ঠিক সেদিনই অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কলকাতায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তারা জানিয়ে রাখতে চান যে, ইয়াহিয়া মােশতাকের সঙ্গে গােপনে আলােচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন (কিসিঞ্জারের ‘দি হােয়াইট হাউজ ইয়ারস’ অনুসারে, মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৮৬)। এরই মধ্যে মুজিবনগর সরকার, বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, ১৯৬০ সালে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য মার্কিন সরকার জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনীর আবরণে কঙ্গোতে যে পদ্ধতিতে জনবল ও তদারকি’ যন্ত্রপাতি প্রেরণ করেছিল, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণকার্যের নামে ঠিক একই রকম ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে নিক্সন প্রশাসন। আগস্টের শেষ দিকে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নির্দেশ দেন তাজউদ্দীন এবং ৫ সেপ্টেম্বর, বেতার ভাষণে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিয়েছে, পাকিস্তানের মাধ্যমে তা দখলকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সঙ্গত মনে করেছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের সেবাদলে এখন একদল যােগাযােগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে। এতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর রণকৌশলে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায়, ত্রাণকার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘােরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চান, তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।” তাজউদ্দীনের এই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, ওয়াশিংটনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখেই তা বােঝা যায়। তাঁর ভাষণ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি জন আরউইন, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ভ্যান হােলেন এবং ইউএসএআইডি-র মরিস উইলিয়ামস যুক্তরাষ্ট্রস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝার কাছে অনুরােধ করেন যে, তিনি যেন বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হন। উত্তরে ঝা বলেন, যেহেতু সংশ্লিষ্ট এলাকার উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ নেই, কাজেই ত্রাণকার্যে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তানিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে। তখন আরউইন জানান, কলকাতায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সদস্যরা ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেছেন এবং দুই পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলােচনার পথ। খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর, ঝার এই রিপাের্টের সূত্র ধরে তাজউদ্দীনের সাথে কথা বলেন ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা এ কে রায়; তখন তাজউদ্দীন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ পরিষদ সদস্যদের একাংশের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে তাদের অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটা রাজনৈতিক সমঝােতায় পৌছানাের ব্যাপারে উৎসাহিত করে চলেছেন বলে তার কাছেও সংবাদ রয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর অস্থায়ী প্রেসিডেন্টও এ কে রায়কে জানান, তার জানা মতে দুজন জাতীয় পরিষদ সদস্য মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেছেন।’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৮৮)।
১৮ সেপ্টেম্বর, মি. রায় মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীকে জানান যে, যেহেতু অধিকৃত এলাকায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল অফিস ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় সরকারের সাথে মতবিনিময় করেছে, তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুই সরকার যেন সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে অগ্রসর হয়। কিন্তু এ কে রায়কে হতভম্ব করে দিয়ে চাষী উত্তর দেন, মার্কিন কনস্যুলেটের সাথে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কখনাে কোনাে বিষয়ে যােগাযােগ হয়নি। বস্তুত মাহবুব আলম চাষীর মিথ্যাচার ভারত সরকারের মনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি করে এবং তখন থেকে তার গতিবিধি, যােগাযােগ ইত্যাদিকে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়। কদিন পরেই জানা যায় যে, খন্দকার মােশতাক, মাহবুব আলম চাষীসহ আরাে তিন-চারজন ব্যক্তি মার্কিন প্রতিনিধিদের সাথে অতি সংগােপনে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছেন এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ছুরি মারার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর সূত্র ধরে জাতিসংঘগামী প্রতিনিধি দল, যার নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল মােশতাকের, তাকে সেই দল থেকে বাদ দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। সীমান্তবর্তী আঞ্চলিক প্রশাসন এবং সেক্টর কমান্ডারসহ অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ করা, তাদের মনােবলকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ৬ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সফর শুরু করেন। এ সময় মােশতাকের সফরসঙ্গী হন মাহবুব। আলম চাষী। এ সফরকালেও মােশতাক তাজউদ্দীন-বিরােধিতা অব্যাহত রাখেন এবং সবার কাছে এমন ধারণা দেবার চেষ্টা করেন যে, কেবল তার নেতৃত্বেই এ যুদ্ধটি স্বাধীনতার ঠিকানা খুঁজে পেতে পারে। এ সময় তিনি ভারতের অনুকম্পা লাভের জন্য নয়াদিল্লির মােসাহেব সেজে কথা বলতে থাকেন। কিন্তু ২৭ অক্টোবর, অপরাহ্বে কলকাতার ৮ থিয়েটার রােড সংলগ্ন বিএস ভবনে একান্ত জরুরি মিটিং-এ ডিপি ধর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সতর্কবার্তা দেন যে, মােশতাকের অংশগ্রহণ থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং উচ্চতর সামরিক সিদ্ধান্ত নেয়া কোনােভাবেই নিরাপদ নয়। ওই দিনই আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ মােশতাক ও চাষী প্রসঙ্গটি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে পুনরায় অবহিত করেন। কিন্তু মােশতাক সম্পর্কে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের মধ্যে দোদুল্যমানতা কাজ করায়, বেশি অপরাধী হয়েও মােশতাক স্বীয় পদে বহাল থেকে যান (তবে তার কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরােপিত হয়), শাস্তি পান কেবল মাহবুব আলম চাষী, তাকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
মুজিবনগর সরকারের ভেতর থেকে মােশতাকের নেতৃত্বাধীন অংশটি বারবার অভিযােগ তুলেছে যে, তাজউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নীতি সম্পূর্ণ ভুল পথে পরিচালিত, এখানে ভারতের ভূমিকা অস্পষ্ট, তিনি আওয়ামী লীগের দলগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে চলেছেন, বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ পরিত্যাগ করে আওয়ামী-বিরােধী শক্তির সমন্বয়ে ধূসর ও অস্পষ্ট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে কামারুজ্জামান-ইউসুফ আলীর নেতৃত্বাধীন উত্তরবঙ্গের একটা গ্রুপ দৃশ্যত অপ্রকাশ্যে তাজউদ্দীন-বিরােধিতায় বড় ভূমিকা পালন করেছে। এই গ্রুপের বক্তব্য, বর্তমান তাজউদ্দীন-সরকার ভারতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছে, কাজেই স্বাধীনতা আনয়নকল্পে তাঁর নেতৃত্বের অবসান ঘটাতে হবে এবং চীন-আমেরিকার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৯৩)। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, দৃশ্যত এসব উপদলের কোনােটির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তবে শেখ ফজলুল হক মনির কর্তৃত্বাধীন মুজিববাহিনীর প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল ঢের (বস্তুত তাঁর প্রশ্রয়ের কারণেই এ বাহিনী প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে অবজ্ঞা করে গেছে), আর মােশতাকের প্রতি তাঁর ছিল বন্ধুসুলভ-আবেগ (মােশতাক স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করছেন, এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেননি, অবশ্য এমনও হতে পারে, এই মহাক্রান্তিকালে বড় কোনাে পদক্ষেপ নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অন্তঃকলহকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চাননি)। মুজিবনগর সরকারে সৈয়দ নজরুলের ভূমিকা ছিল অভিভাবকের মতাে, অন্যায়ের প্রতিবিধান করা থেকে বিরত থেকেছেন, তবে সেটাকে সমর্থন করেননি কখনাে, ন্যায়ের পক্ষে সর্বদাই প্রত্যয়দীপ্ত থেকেছেন।
অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়, দ্বন্দ্ব-কলহ, গ্রুপিং-লবিং ইত্যাদিকে পাশ কাটিয়ে সবাই মিলেমিশে কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। | মওলানা ভাসানী, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে, বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য ও স্বীকৃতি প্রদানের জন্য চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাতিসংঘ, আরব লীগ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার নেতৃবৃন্দকে অনুরােধ জানিয়ে আলাদা আলাদা তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন, চীনের মাও সে তুং এবং চৌ এন লাই-কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Ideology of socialism is to fight against oppression . If your Government do not protest this brutal atrocities committed on oppressed masses of Bangladesh by the military junta with the help of vested interests of West Pakistan, the world may think that you are not the friend of oppressed people.’ এমন প্রত্যয়দীপ্ত ভূমিকা নেয়ার ক’দিন পরেই ভারত সরকারের ব্যবস্থাপনায় কয়েকজন দলীয় সহযােগী নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন কুচবিহারস্থ বাংলাদেশ সীমানার কাছাকাছি, সেখান থেকে তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান পালিয়ে যান পাকিস্তানে এবং ক্রমান্বয়ে ইয়াহিয়া সরকারের সমর্থকে পরিণত হয়ে যান, আর ভাসানী পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে দিল্লিতে চিকিৎসা গ্রহণ করে বিশ্রামে থাকার জন্য দিল্লির পৃষ্ঠপােষকতায় চলে যান হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়ানাে শহর দেরাদুনে, এরপর থেকে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের আলঙ্কারিক পদ গ্রহণ ছাড়া তাকে আর কোনাে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি, কিন্তু কেন? আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকালীন ভাসানী-সংক্রান্ত এই অনালােকিত ও অনালােচিত ইতিহাসটিকে সামনে নিয়ে আসা উচিত।
[বি. দ্র. : আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইতিহাস রচনায় ‘মােশতাক-চাষীর ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি সম্পর্কে সবাই কম-বেশি দৃষ্টিপাত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন, আমাদের আন্দোলনকে সমূলে বিনষ্ট করার জন্য আরাে একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য এবং প্রবাসী সরকারের অতিঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কাজী জহিরুল কাইয়ুম। কাইয়ুম কর্তৃক এই ষড়যন্ত্র’ যা কিসিঞ্জারের ‘দি হােয়াইট হাউজ ইয়ার্স’ বই-এ বেশ গুরুত্বসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থগুলােতে, কাইয়ুম-ষড়যন্ত্র’ প্রসঙ্গটি সিংহভাগ লেখকই সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কেন? কিসিঞ্জারের বর্ণনা অনুযায়ী, ৩০ জুলাই, কলকাতাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট অফিসে গিয়ে জনাব কাইয়ুম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। তখন মার্কিন কনস্যুল দু’সপ্তাহ পরে আসার জন্য তাকে অনুরােধ করে এবং বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে হােয়াইট হাউজকে অবহিত করে। দু’সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ১৪ আগস্ট কাইয়ুম আবারাে যান মার্কিন কনস্যুলেট অফিসে এবং প্রস্তাব করেন, প্রবাসী সরকার স্বাধীনতার চেয়ে কিছু কম প্রাপ্তি নিয়েই পাকিস্তানের সাথে সমঝােতায় আসতে রাজি আছে, তবে এ ব্যাপারে আলাপ-আলােচনার জন্য যে বৈঠক করা হবে, সেখানে শেখ মুজিবের উপস্থিতি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
কাইয়ুমের এই প্রস্তাব মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক কর্তৃক অনুমােদিত হয়ে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ডের মাধ্যমে কিসিঞ্জারের কাছে পৌছে, কিসিঞ্জার তা ইয়াহিয়াকে অবহিত করেন এবং ইয়াহিয়া এ প্রস্তাবের সূত্র ধরে প্রবাসী সরকারের সাথে গােপন বৈঠক করতে সম্মতি প্রকাশ করেন। ৯ সেপ্টেম্বর, মার্কিন কনস্যুল জনাব জহিরুল কাইয়ুমকে অনুরােধ করে, তিনি যেন প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে প্রস্তাবিত বৈঠকের আয়ােজন দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করেন। কিন্তু বিষয়টি ইতােমধ্যে ভারত সরকারের কানে চলে গেছে, এটা বুঝতে পেরে জনাব কাইয়ুম তার পূর্ববতী অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং প্রবাসী সরকারের আস্থা পুনরার্জনে তৎপর হয়ে ওঠেন। পরবর্তী পর্যায়ে ষড়যন্ত্রী কাইয়ুমকে কোনাে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছিল কি না, সে তথ্য আমাদের জানা নেই।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র