আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত জড়িয়ে যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের যে অবদান, তা ইতিহাসের চিরস্মরণীয় অংশ হয়ে থাকবে। দেশটি যুদ্ধোন্মুল শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, সাধ্যমতাে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিয়েছে, যুদ্ধেছু বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থাসহ ওদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অবাধ সুযােগ দান করেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করার জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে, নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও চীন-মার্কিন হুমকিকে উপেক্ষা করেছে, সর্বশেষে বাংলাদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যে যুদ্ধে তাকে হারাতে হয়েছে কয়েক হাজার সৈন্য, ৭৪টি যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, সামরিক সরঞ্জামাদিসহ আরাে কত কী? আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের এই যে অমল, অসামান্য অবদান—এর পুরােটাই কি মানবিকবােধ থেকে জাগ্রত? বিপদগ্রস্তকে উদার সহায়তা দান? নাকি এর মধ্যে রাজনীতি-কূটনীতি, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের কোনাে ঘাের মারপ্যাচও কাজ করেছে?
শরণার্থীদের আশ্রয়দান, খাদ্য কিংবা অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির জোগান দান—সেটা মানবিকতাবােধ বা জাতিসংঘের বিশেষ আইন দ্বারা সমর্থিত বিধায়, ভারতের এই কাজকে ‘মহত্ত্বের প্রকাশ’ বলা যায়। এক কোটি শরণার্থীকে ভরণপােষণের যথাযথ ক্ষমতা নেই বিধায় এ সমস্যার প্রতিকার চেয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অধিকারও তার আছে। যে। দেশের জন্য এই মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি, সেই রাষ্ট্রের নিন্দা করা বা এর কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করা—এসব কাজও তার অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যায় না। স্বাধীনতাযুদ্ধে লিপ্ত কোনাে ভূখণ্ডের প্রবাসী সরকারকে ভিন্ন দেশে আশ্রয়দানের নজির তেমন বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু বিবদমান প্রতিপক্ষের একটা অংশকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান করা, তাদের হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালানাে, সর্বশেষে তাদের পক্ষে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া, এসব কাজ ভারত কি কেবল বাংলাদেশের স্বার্থেই করেছে? এর মধ্যে তার নিজের স্বার্থ, সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য একেবারেই কি ছিল না? ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র দুটোর জন্মই। হয়েছে শত্রুতার মধ্য দিয়ে। এরই প্রতিফলন দেখতে পাই জাতিভিত্তিক ‘মাইগ্রেশন কার্যক্রমে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষণিক পরই হিন্দু আর শিখের রক্তে পাকিস্তান এবং মুসলমানের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল ভারতের মাটি। এক বছরের মধ্যেই কাশ্মির নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় দুটি দেশ। সেই যুদ্ধ থামে একসময়, কিন্তু শেষ হয় না ভূস্বর্গ নিয়ে বিবাদ, বিসংবাদ।
১৯৬৫ সালে সেই কাশ্মির নিয়ে আবারাে বাধে মহারণ। সােভিয়েত সহায়তায় অঙ্ক্ষিত বন্ধ হয় যুদ্ধ, কিন্তু মানসিক যুদ্ধ, সীমান্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে অবিরাম। ১৯৬২-তে তিব্বত সীমান্ত যুদ্ধে ভারতকে নাস্তানাবুদ করেছিল চীন। পাকিস্তান তাই শত্রুর শত্রু অর্থাৎ চীনকে বেছে নেয় মিত্র হিসেবে। আর আমেরিকার সাথে সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির মাধ্যমে যে উষ্ণতা গড়ে উঠেছিল, সেটা দিন দিন আরাে উষ্ণতার দিকে যাচ্ছিল। জোট নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী ভারত দু’পাশের দুই প্রতিবেশী চীন-পাকিস্তানকে শান্ত ও উদ্বিগ্ন রাখার জন্য হৃদ্যতা গড়ে তুলেছিল সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। পরাশক্তির সাথে উষ্ণতা বিচারে পাকিস্তানের পাল্লা ভারী হওয়ায়, নিজে কম শক্তিধর হয়েও সেনাশাসনাধীন পাকিস্তান মাঝেমধ্যেই ‘হালুম’ করে উঠত। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক আবরণে আবৃত ভারতীয় শাসকশ্রেণি পাক জেনারেলদের মতাে মাথা গরম না করে কোনাে একটা মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলেন। কথায় আছে, কলহপ্রিয় মানুষের কলহ বাধানাের জন্য প্রতিপক্ষ থাকতে হয় না, সে নিজে নিজেই যেনতেনভাবে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে নেয়। বাইরে না পেলে, নিজের ঘরের ভেতরই প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এমনই কলহপ্রবণ যে, বাইরের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে দ্বন্দ্বে নামে নিজের ঘরেই, বাঙালিকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে। ভারত যেন সে অপেক্ষাতেই ছিল। শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে নেয়, নতুন বন্ধুকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্রসহায়তা দিয়ে পুরনাে শত্রুকে ‘শিক্ষা দিতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়। তবে মাথামােটা পাকিস্তানি জেনারেলদের মতাে সে কখনাে হুঙ্কার দিয়ে কথা বলে, এতদসংশ্লিষ্ট প্রচারণা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে, শত্রু বিনাশের প্রাথমিক পর্বের কাজ করে যায় অতি নীরবে।
তবে হ্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি ভারত যে পরিমাণ সহানুভূতিশীল ছিল, মাঝখানে তা কিছুটা হ্রাস পেয়ে যায়, সে তখন গ্রহণ করেছিল ‘অপেক্ষা করে দেখি কী হয়’ নীতি, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনহেতু সে এমন অবস্থায় চলে যায়, মুজিবনগর সরকারের চেয়েও পাকিস্তানের বড় শত্রু হয়ে ওঠে ভারত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে খুবই যৌক্তিক ও তাৎপর্যপূর্ণ আলােচনা করেছেন বিশিষ্ট লেখক যতীন সরকার, তার ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থে। তাঁর মতে, ভারতীয়দের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুকূল মনােভাব পােষণকারী মানুষেরাই ছিল সংখ্যায় ভারী। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিল একটা আবেগাপ্লুত সহমর্মিতা। সে সহমর্মিতার মূল উৎস ছিল বাঙালিত্ব। বাঙালিদের একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সব কাজ কর্ম চলবে বাংলায়, আবহমান বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহক হবে সেই রাষ্ট্রটি—এ রকম একটি সম্ভাবনা সকল বাঙালির বুকে শিহরণ জাগাতাে।… বহুজাতিক রাষ্ট্র ভারতের অন্য অন্য জাতির লােকেরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল বটে, কিন্তু তাদের সে সমর্থনের পেছনে ছিল বৌদ্ধিক যৌক্তিক রাজনৈতিক ও মানবিক বিবেচনা। তাদের হৃদয়ে বাঙালি জাতির মানুষদের মতাে এমন উথালপাথাল করা আবেগ ছিল।’ (পৃ. ৪৩৪)।
ভারতীয় শাসকশ্রেণি, যাদের সিংহভাগই অবাঙালি, তারা বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিল কেন? যতীন সরকার খােলাসা করেছেন সেই প্রশ্নেরও, ‘এদের সমর্থনের পেছনে যা সক্রিয় ছিল তা জাতীয় আবেগ নয়, তা হচ্ছে তাদের শ্রেণি ও শ্রেণিরাষ্ট্রের স্বার্থ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেয়া মানে পাকিস্তানের মাজা ভেঙে দেয়া। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের। মাজা ভেঙে যাওয়া অবশ্যই ভারতের সামগ্রিক স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থনটা তাে দেয়া হচ্ছে একটা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের তথা আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতি। অথচ সেই বাঙালি জাতিরই একটি বড় অংশ আছে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে। পাকিস্তানের শাসনাধীন বাঙালিদের স্বাধীনতা লাভের অধিকার যদি ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত হয়, তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য তা হবে না কেন? ভারতীয় বাঙালিরা যদিও স্বাধীনতার দাবি তােলেনি, তবু যে দুর্দমনীয় আবেগ নিয়ে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে, সেই আবেগ যে সেখানেই আটকে থাকবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? সে এক জটিল প্রশ্ন বটে; আর যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের দেশ ভারতের একটা রাজ্য যদি স্বাধীনতা-প্রতিষ্ঠার আবেগে উতলে ওঠে, তাহলে ভাষা ও জাতীয়তার সূত্র ধরে এর বিস্তৃতি ঘটার আশঙ্কা মােটেই অমূলক নয়। এ প্রসঙ্গে যতীনবাবুর বিশ্লেষণ, এ বিষয়টি নিয়েও ভারতের শাসকশ্রেণী গভীরভাবে ভেবেছে, এর বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। তবে ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখেও সে সময়কার বর্তমানটিকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে, অনেক যােগ বিয়ােগের অঙ্ক কষে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল হতে দেয়াটাকেই তাদের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূল বলে বুঝে নিয়েছে।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের আবেগ যে উত্তুঙ্গ পর্যায়ে পৌছেছিল, তার বিরুদ্ধ স্রোতে গেলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সম্পূর্ণ বিপদ দেখা দিত। এমনকি বাঙালি জন-উত্থানে ভারতের অখণ্ডতাই বিপর্যস্ত হয়ে যেত, সে সময়কার সরকারি নীতি নির্ধারণে এ বিবেচনাটিও বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। শাসকগােষ্ঠীর বাইরে যাদের অবস্থান তাদেরও ছিল নিজ নিজ বিবেচনা। কেউ কেউ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি বর্বর ও অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত একটি গােষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী শক্তিগুলাে যে কোনােভাবে মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ডিত ও বিপর্যস্ত দেখতে পারলেই খুশি। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাদেরও সমর্থন পেয়েছে। ভারতের বণিকরা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের অনুকূল বলেই ভেবেছে। বামপন্থিদের মধ্যে নানান ধারা থাকলেও, এই বুর্জোয়া নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারে না বলে কেউ কেউ তাত্ত্বিক মন্তব্য দিলেও, বামপন্থি কোনাে গােষ্ঠীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরােধিতা করেনি। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই) তাে আন্তর্জাতিক দায়িত্ববােধের দৃষ্টিতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে, এবং একে সফল করে তােলার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’ (পৃ. ৪৩৫)। | ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছেন, এটাকে বলেছেন ভারতীয় চক্রান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’, তারা এসব আবেগতাড়িত কথা এজন্য বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে মুসলিম রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের শোচনীয় ভাঙন তারা হৃদয় থেকেই চাননি। তবে তাদের এই ক্ষোভ বা অসন্তুষ্টি—রাজপথে এসে প্রকাশিত হয়নি, বিধায় ভারত সরকার এটিকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে।
অন্যদিকে সে দেশের সিংহভাগ মানুষ, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রায় সবাই ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে, এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। এরই ফলে ভারতের সাধারণ মানুষও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনেক স্বার্থত্যাগ ও আত্মত্যাগ করেছে; ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর সৈনিকদের রক্ত বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে, পনেরাে ষােল হাজার ভারতীয় সেনা আমাদেরই মুক্তির সােপানতলে আত্মবলিদান করেছে। ভারতের সরকার তথা শাসকগােষ্ঠী তাদের শ্রেণি ও শ্রেণিরাষ্ট্রের স্বার্থেই আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়েছিল নিশ্চিত, তবে এ কথাও সত্য যে, আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে তাদের স্বার্থ সেদিন একবিন্দুতে মিলে গিয়েছিল বলেই আমরা তাদের এ রকম সহযােগিতা পেয়েছিলাম ও নিয়েছিলাম।’ যতীনবাবুর এই বিশ্লেষণ সত্য বটে, তবে স্বার্থ ছাড়াই যে কারণে সিনেটর রবার্ট কেনেডি, ব্রিটিশ এমপি পিটার শশার বা লেখক রােমা রােলা যুদ্ধকালীন দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালির পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, শরণার্থী শিবিরে এসে কেউ চোখের জলে ভেসেছেন, সেই মানবিকতাবােধের স্বীকৃতি না দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে কেবল যদি ভারতীয় শাসকগােষ্ঠীর ‘শ্রেণিস্বার্থ বা রাজনৈতিক স্বার্থ খুঁজে বেড়াই, তাহলে মানবতাবাদী অগণিত ভারতীয়, যারা কেবল ন্যায় ও নীতির বােধবিচারে আমাদের পক্ষে জোরালাে অবস্থান নিয়েছিলেন সেদিন, তাদের অমল ধবল। অবদানকে খাটো করা হবে।
এখানে আরাে একটি দিক বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, তৎকালীন দিল্লি। সরকারের অতিঘনিষ্ঠ মিত্র-মস্কোপন্থি দল সিপিআই, যারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ‘বিশ্ববিপ্লব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করত, সেই বিবেচনা থেকে তারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সনিষ্ঠ হওয়ার জন্য ইন্দিরা প্রশাসনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, এতে সােভিয়েত ইউনিয়নকে সংশ্লিষ্ট করার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বামপন্থি বুদ্ধিজীবী তরুণ সান্যাল এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সংগ্রাম যে, সাম্রাজ্যবাদবিরােধী মুক্তিসংগ্রাম, এই সত্যটি সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষিণ-এশীয় টেবিলের প্রধান পনােমারিয়েভ এবং সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিউনিদ ব্রেজনেভকে ভ্রাতৃসুলভ পার্টির নেতা হিসেবে ভবানী সেন, এন কে কৃষ্ণাণ, এস এ ডাঙ্গে ও বিশ্বশান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্র বিশেষভাবে অবগত করান ও বােঝান। এমনি বুঝিয়েছিলেন তারা জার্মান নেতাদেরও। অন্যদিকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সুস্পষ্ট ভূমিকা নেবার জন্য নানাভাবে প্রভাবিত করেন। রাজ্যসভায় কমিউনিস্ট সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত, প্রাক্তন সিপিআই নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্য মােহন কুমার মঙ্গলম ও ডি পি ধর। এই উভয় ভূমিকার অন্যতম তাৎপর্য ছিল ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত ভারত-সােভিয়েত শান্তি মৈত্রীর সহযােগিতা চুক্তিটি। বস্তুত ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে চীন-মার্কিন, এ দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে নয়াদিল্লি পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতাে কি-না, এমন সন্দেহ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি।
[বি. দ্র. : মােহাম্মদ আইয়ুব ও কে সুব্রামানিয়াম (সুব্রামানিয়াম ছিলেন ভারতের ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসেস, যা পরবর্তীকালে (১৯৬৮) রিসার্স অ্যান্ড অ্যানালিসেস উইং বা ‘র’ নামে পরিচিত হয়—এর পরিচালক)—দুজনের যৌথভাবে লেখা গ্রন্থ ‘দ্য লিবারেশন ওয়্যার এর মুখবন্ধে পাই খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত একটা কথা, ২৬ মার্চ ‘৭১ পরবর্তী পাকিস্তানকে কব্জা করার যে সুযোেগ এসেছে, ভারতের জন্য এমন একটি ঘটনা, যা এর আগে কয়েক শতাব্দীতেও ঘটেনি।’ মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনা দপ্তরে মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং রচিত গ্রন্থ ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সমুদ্রপথে ভারী অস্ত্র ও গােলাবারুদ আনার আগেই পূর্বাঞ্চলকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কৃরিত সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে বলতে থাকেন। তারা বলেন, পাকিস্তানকে ভারত যত সময় দেবে, সামরিক দিক দিয়ে তত বেশি মাশুল দিতে হবে অভিযানে। এখনই ব্যবস্থা নেয়ার সময়—সমস্বরে বলেন তারা। তাদের কেউ কেউ চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ সম্পর্কে এই অভিযােগ করেন যে, তিনি শীতল মনােভাব দেখাচ্ছেন। এই রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পেছন থেকে অর্থমন্ত্রী ওয়াই ভি চ্যাবনের সমর্থন নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি অবিলম্বে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানান এবং বলেন এ ব্যাপারে মানেকশর কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে তাকে অপসারণ করা হােক।
বলা হয় তারা এই যুক্তি দেখান, কোননা। অবস্থাতেই ভারতকে ঈশ্বর প্রদত্ত এই সুযােগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। পরবর্তীকালে, ১৯৯০ সালের জুলাই মাসে পাক্ষিক ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব। ইন্ডিয়া’-র সাথে এক সাক্ষাৎকারে ‘র’-এর অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা আর। স্বামীরাথন স্বীকার করেছেন যে, ‘৭১ এর এপ্রিল মাসে চ্যাবন ও জগজীবন রাম দুজন মিলে ইন্দিরার সামনেই মানেকশকে চাপ দিচ্ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে যুদ্ধে নামলে পরাস্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ, মানেকশ এ-কথা ইন্দিরাকে বুঝিয়ে বলার পর, এ-রকম উদ্যোগ নেয়া থেকে বিরত থাকে নয়াদিল্লি।
ওয়াশিংটনের অবস্থান উন্মােচিত এবং চীনের প্রতিবন্ধী পুরনাে সুর সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা অর্পণ বিষয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং যখন তালবাহানা করে যাচ্ছিল, সামরিকপন্থায় নির্বাচনী রায়কে নস্যাৎ করার জন্য গােপনে গােপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল—এ সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রের অবিদিত ছিল না মােটেই, বরং এ ব্যাপারে কোনােরূপ আপত্তি না জানিয়ে বন্ধুরাষ্ট্রের সামরিক জান্তাকে নীরব সম্মতি দিয়ে যাচ্ছিল। ভ্যান হােলেন, যিনি ওই সময় মার্কিন সরকারের ডেপুটি অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর রচিত গ্রন্থে স্বীকার করা হয়, ‘At the first SRG (Senior Review Group) meeting on South Asia, (on march 6, 1971) Under Secretary of State for Political Affairs Alexis Johnson expressed the State Department view… all considered that their interests were served by continuation of a united Pakistan, Johnson suggested that one option for the US was to try to discourge President Yahya khan from using force in East Pakistan against Mujib and Awami League followers. But he did not press the point after Kissinger cautioned SRG members to keep in mind President Nixon’s ‘special relationship’ with Yahya’s relationship that surprised and perplexed the participants. The President, he said, would be relactant to suggest that Yahya exercise restraint in East Pakistan – Following this cautionary note and further discussion at various alternatives, the SRG members concluded that ‘massive inaction’ was the best policy for the US. (“Tilt Policy Revisited : Nixon-Kissinger Geopolitics and South Asia,’ Asian Survey, page 340-41), পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে, মার্চ মাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কয়েক দফা বৈঠক করেছিলেন শেখ মুজিবের সাথে।
যদিও সেসব বৈঠক থেকে কোনাে ইতিবাচক ফল আসেনি, তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওইসব বৈঠকে বসার অভিপ্রায় থেকে অনুমিত হয়, ওয়াশিংটন পাকিস্তান কর্তৃক সামরিকপন্থা গ্রহণের প্রতি নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করলেও, তা এড়ানোের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথমভাগে পাকিস্তান প্রশ্নে মার্কিন নীতি কঠোর সমালােচনার মুখে পড়ে, তাতে আরাে নতুন মাত্রা যােগ হয় ঢাকাস্থ কন্সাল জেনারেল আর্থার কে ব্লাড, যিনি বাঙালির আন্দোলনকে যৌক্তিকদৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন হােয়াইট হাউজে, তাকে অতি ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়ার পর। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে মার্কিন নীতির কদর্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠলেও, দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং-এর ১৪ এপ্রিলের বক্তব্য সবাইকে আবার দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। ওইদিন এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে সব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সারা পৃথিবীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে, এবং ওইগুলােকে মার্কিন সরকার এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে না। এর কিছুদিন পর, জুন মাসে—তাদের অবস্থান আবারাে ধোয়াশার সৃষ্টি করে, যখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য ‘যুদ্ধাস্ত্রের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে থাকে। পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতকে নিবৃত্ত রাখার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ২৮ মে একটি চিঠি লেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে।
তাতে তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া সরকারকে এক রাজনৈতিক সমঝােতায় রাজি করানাের জন্য নীরবে কাজ করে চলেছে’ (মূলধারা ৭১, পৃ. ৪০)। নিক্সনের এ কথা যে ভাওতাবাজি ছিল, তা জানা যায় ২১ ও ২২ জুনে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার কল্যাণে। পত্রিকাটি লেখে যে, মার্কিন সরকারের অনুমতিক্রমে পাকিস্তানের দুটি জাহাজ ‘সুন্দরবন ও ‘পদ্মা’ সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে যথাক্রমে ৮ মে ও ২১ জুন পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করেছে (অর্থাৎ ৮ মে বাঙালি নিধনযজ্ঞের জন্য অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ পাঠানাের অনুমতি দিয়ে নিক্সন ২৮ মে ইন্দিরাকে আশ্বস্ত করছেন, তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝােতার চেষ্টা করে যাচ্ছেন)। এই সময় বিশ্বব্যাংকের ১১-জাতি এইড টু পাকিস্তান ক্লাব’ এক বছরের জন্য পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য স্থগিত রাখার সুপারিশ করে, কিন্তু এই ক্লাবেরই শক্তিমান সদস্য মার্কিন সরকার ঘােষণা দেয়, অন্যরা সাহায্য প্রদান বন্ধ করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা অব্যাহত রাখবে। ২৯ জুন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস অফিসার চার্লস ব্রে ঘােষণা করেন, আগামী দুই মাসের মধ্যেই মার্কিনি সমরাস্ত্র নিয়ে আরাে চার থেকে পাঁচটি জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করবে (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৪১)। ৬ জুলাই, হেনরি কিসিঞ্জার নয়াদিল্লিতে এলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য। তিনি মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা না করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরােধ করেন। প্রত্যুত্তরে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে বসবাসরত শরণার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে, এ-ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেন, সেইসাথে পাকিস্তানে। কারাবন্দি শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝােতার লক্ষ্যে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবি জানান।
কিসিঞ্জার উভয়ক্ষেত্রে অক্ষমতা জানানাের পর, ইন্দিরা দৃঢ়কণ্ঠে জানান, তাঁর উত্থাপিত দাবি না মানলে ভারতের পক্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সাহায্য বৃদ্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই (ডি পি ধরের একান্ত সাক্ষাৎকার, ১৮ এপ্রিল ‘৭৩)। উত্তরে কিসিঞ্জার বলেন, ভারত যদি মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখে, তাহলে সে পাকিস্তান কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে চীনেরও যুদ্ধে নামার সম্ভাবনা আছে। কিসিঞ্জার অবশ্য ইন্দিরাকে আশ্বাস দেন, ভারত ও পাকিস্তানের বিরােধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিরপেক্ষ থাকবে, তবে ভারত যদি চীন কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তবে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাবে। তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি এমনই ছিল যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন আর চীন-সীমানা সংঘর্ষ ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে দুই বিপরীত মেরুতে চলে গিয়েছিল। তারা এক অপরের চরম বৈরী হয়ে উঠেছিল। তবে এই দুই রাষ্ট্রের একটি জায়গায় মিল ছিল যথেষ্ট, উভয়ই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শত্রু বিবেচনা করত যুক্তরাষ্ট্রকে। চীন-রাশিয়ার ঘােরতর দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে ইয়াহিয়া খান বড় ধরনের চাতুর্যের আশ্রয় নেন। তিনি নিক্সনকে প্রস্তাব দেন, চীন-মার্কিন শীতল সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবেন, যদি পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আরাে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মস্কোকে চাপে রাখার জন্য নিক্সন ইয়াহিয়ার প্রস্তাবটি লুফে নেন এবং এরই অংশ হিসেবে ভারত সফর করার পর কিসিঞ্জার পাকিস্তান থেকে অতিগােপনে পিকিং সফরে যান।
সেখান থেকে ওয়াশিংটনে ফিরে তিনি পূর্ব প্রতিশ্রুতি (ভারত যদি চীন কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সর্বাত্মক সহায়তা দেবে) থেকে সরে এসে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা-কে অভাবনীয়ভাবে অবহিত করেন, চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে (গার্ডিয়ান, ২৮ জুলাই ‘৭১)। রাজনীতির কী অপার মহিমা, দীর্ঘদিন ধরে চীন-ভারত প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি অবলম্বন করে হাঁটছিল, স্বল্পদিনের ব্যবধানে নিজের স্বার্থ খুঁজতে গিয়ে প্রতিশ্রুত অবস্থান থেকে সে সরে গেল। কিসিঞ্জারের এই ঘােষণা তথা পাকিস্তান-চীন ও মার্কিনিদের নতুন আতাত ভারতকে এই শঙ্কায় ফেলে দিল যে, বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদান অব্যাহত না রাখলে পাক-ভারত যুদ্ধ এড়ানাে সম্ভব হবে বটে, তবে পূর্ব বাংলায় যতদিন পাকবাহিনী রক্তপাত চালাবে, ততদিন লাখ লাখ শরণার্থীর চাপ অবধারিতভাবে ভারতকেই বয়ে যেতে হবে। | চীনকে পাশে পেয়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আরাে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাে। মুক্তিযােদ্ধাদের সীমান্ত পারাপার, দেশের ভেতরে তাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার জন্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তােলার উদ্যোগ নিল সে। ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে গেরিলাবিরােধী তৎপরতায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তা রবার্ট জ্যাকসনকে ঢাকায় পাঠানাের সিদ্ধান্ত নিল। মুজিবনগর সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা অপশক্তিকে মূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হলাে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাশাধিক সহায়তা পেয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নতুন কিছু পদক্ষেপ নেয়। বাংলাদেশকে দুই থেকে তিনটি প্রদেশে বিভক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে; হিন্দু সংখ্যালঘুদের ভােটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৭৯ ও ১৯৪ জন নির্বাচিত সদস্যের আসন ‘শূন্য’ ঘােষণা করে এবং শূন্য আসনগুলােতে নতুন করে নির্বাচন দেয়ার পদক্ষেপ নেয়। বাঙালি জাতীয়তাবােধের ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক বােধের ঐক্য, শিক্ষাসংস্কৃতি-অর্থনীতি প্রভৃতির ধারাকে বিনষ্ট করার জন্য যা কিছু করা প্রয়ােজন, সবই দ্রুতগতিতে করতে থাকে যাতে বাঙালি সম্প্রদায় আর কোনােদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতকে পর্যুদস্তকারী দেশ। চীনের উষ্ণ আশ্বাস পেয়ে খুশিতে ডগমগ ইয়াহিয়া আবেগ সংবরণ করে রাখতে পারলেন না, তিনি ভারতকে হুমকি দিয়ে বলেন, বৃহত্তর যুদ্ধ বাধলে ‘পাকিস্তান একা থাকবে না।
বাস্তবিক অর্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহে চীনের ভূমিকা ছিল। খুবই রহস্যাবৃত কথিত সমাজতান্ত্রিক একটি দেশ, যারা শােষিত শ্রেণীর অধিকার অর্জন’-এর গান গেয়ে বেড়ায়, ভারত-বিরােধিতা প্রশ্নে তার অবস্থানকে যৌক্তিক ধরে নিয়েও, প্রশ্নের অবকাশ থাকে—একটি শােষিত জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে চীন কোন যুক্তিতে গণহত্যাকারী, চরিত্রহীন এক স্বৈরশাসকের সক্রিয় সহযােগী হয়ে উঠল? কাউকে সাহায্য, সহায়তার ব্যাপারে আমেরিকা বরাবরই নীতিবর্জিত, স্বীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সে ‘সর্প হইয়া দংশন করাে ওঝা হইয়া ঝাড়াে’—এমন অপপ্রবণতায় বিশ্বাসী, শত্রু বা মিত্র বদলাতে তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘স্বার্থ ভিন্ন আদর্শের স্থান নেই, কিন্তু চীন—সে না মহান মাও সে তুং-এর আদর্শে গড়া দেশ, তাহলে দেশটি এমন ভ্ৰষ্টনীতি গ্রহণ করল কেন? মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ক’দিন পর, যুক্তরাষ্ট্রও যখন তার অবস্থান নিরূপণে দোলাচলবৃত্তিতে আচ্ছন্ন, ভারত তার ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তহীন, তখন কেবল চীনই বাংলাদেশ প্রশ্নে’ তার দ্বিধাবর্জিত অবস্থান ঠিক করে ফেলে, ১৩ এপ্রিল ‘৭১ চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বার্তা পাঠিয়ে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দেন, ‘Should India dare launch aggression, the Government and People of China would firmly support the Government and people of Pakistan in their just struggle to safeguard their sovereignty and national independence’ (যেন ভেতরের ঘটনা যা-ই হােক, ভারত যদি তােমার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, চীন তােমার পাশেই থাকবে; আদর্শবর্জিত, কেবল বিরােধিতার খাতিরে বিরােধিতা করে যাওয়া, শুভ বােধসম্পন্নতার পরিচয় বহন করে না; হায়, নীতিবর্জিত সমাজতান্ত্রিক চীন, কেবল ভারত বিরােধিতার অন্ধ আবেগে স্থির, তবে শেষ পর্যন্ত অকল্পনীয় হঠকারিতায় পৃষ্ঠ প্রদর্শন)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র