You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের ছায়া -প্রতিচ্ছায়া - সংগ্রামের নোটবুক

প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের ছায়া ও প্রতিচ্ছায়া

মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার পরপর পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অনেক বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে স্বাধীন 

হাউজ, ব্রুস ডগলাসম্যান প্রমুখের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রসঙ্গটি বারবার প্রচারযন্ত্রে এনে এর বিপক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ২৪ এপ্রিল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতনি, সৈয়দ তৈফুরের কন্যা লুলু বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে যুক্তরাজ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয় এবং অতি অল্প সময়ের নােটিশে সম্মিলিত হওয়ার সুবিধার্ধে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ‘অ্যাকশন কমিটির স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য মনােনীত হয়েছিলেন আজিজুল হক ভূঁইয়া, কবীর চৌধুরী, মনােয়ার হােসেন, শেখ আবদুল মান্নান ও শামসুর রহমান। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর লন্ডনপ্রবাসী ছেলে রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রত্যয়দীপ্ত এক বিবৃতি দেন (এর আগে তাঁর বােন আখতার সােলায়মান ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন) এবং বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধ করেছে বা করছে, তা প্রতিহত করার জন্য বাঙালিরা অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়েছে—আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই যে, দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণকারী সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে সফল হবে।’  এরই মধ্যে আর্জেন্টিনাস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেন, ইরাকের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যােগ দেন। ২৭ আগস্ট দেশ বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক এবং বেশ কজন ব্রিটিশ এমপি-র উপস্থিতিতে লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশন কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়।
সে সময় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আরাে উপস্থিত ছিলেন আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমদ, লুফুল মতিন, আবদুর রউফ, আবদুস সামাদ প্রমুখ। ১ সেপ্টেম্বর, আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ে যান, ৭ তারিখে সুইডেনে, ১৩ তারিখ ফিনল্যান্ডে, ১৪ তারিখ যান ডেনমার্কে এবং সকল জায়গায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠন করতে সমর্থ হন। ওয়ালী আশরাফ সম্পাদিত সাপ্তাহিক জনমত’ পত্রিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। ওই সময় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য আরাে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ফণীভূষণ মজুমদার, ফকির শাহাবুদ্দিন, জ্যোতিপাল মহাথেরাে প্রমুখ।
আমেরিকায় অবস্থানরত বাঙালি, যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ক’জন হলেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি এফ আর খান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কে এস আলমগীর, মাহবুব হােসেন প্রমুখ। সেখানকার পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাহমুদ আলী, এ এম এ মুহিত, হারুন অর রশীদ ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন।  এ তাে গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘বাঙালি নিধনযজ্ঞ’ দেখেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য বাঙালি কর্মকর্তা স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ক’জনের নাম : মনজুর আহমেদ চৌধুরী (কর্মস্থল প্যারিস), এ এইচ এস আতাউল করিম (রােম), এ কে এইচ মােরশেদ (অটোয়া), রিয়াজ রহমান (দিল্লি), ফারুক সােবহান (প্যারিস), খুরশিদ হামিদ (বেইজিং), মােহাম্মদ জমির (কায়রাে), সলিমুজ্জামান (লন্ডন), হুমায়ুন খান পন্নী। (বাগদাদ), রেয়াজুল হােসেন (মস্কো) দিনপঞ্জি ‘৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যুদ্ধ দলিলপত্র, ৭ম খণ্ড]।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র