You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় জনমানসে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি
শুরুতে ভারত মহা-উৎসাহ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে স্বীয় ভূখণ্ডে কর্মতৎপরতা চালাবার অবাধ সুযােগদান, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্র সরবরাহ, শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্তকরণ, সাধ্যমতাে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও খাদ্য ব্যবস্থাকরণ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি তুলে ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা—প্রথম দুই তিন মাস এসব কাজ নিরলসভাবে সম্পন্ন করেছে নয়াদিল্লি সরকার। ইয়াহিয়া-ভুট্টো পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের দায় মাঝেমধ্যেই চাপাতে চেয়েছে দিল্লির কাঁধে; কিন্তু দিল্লি এ নিয়ে খুব গা করেনি, তারা তাদের কাজ অব্যাহত গতিতে চালিয়ে গেছে কিন্তু জুনের শেষার্ধে খােদ দেশের অভ্যন্তর থেকেই নয়াদিল্লির বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও সমালােচনার ঝড় উঠতে থাকে। এক, ভারতের মুসলমান জনগােষ্ঠী—যাদের বিরাট একটা অংশ উর্দুভাষী, তারা বােম্বে-পাটনা থেকে উর্দুভাষী মুসলমান মালিকদের তত্ত্বাবধানে ওই ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলাের মনগড়া অপপ্রচারে এমন ধারণায় উপনীত হন। যে, ভারত উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে দিয়ে এ অঞ্চলের মুসলমানদের দুর্বল করার চেষ্টা করছে। ২১ জুন, পাটনা থেকে প্রকাশিত উর্দু। পত্রিকা ‘ঘমখর’-এর এক প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে শ্রেষ্ঠ নরহত্যাকারী’ ‘দেশ ধ্বংসকারী অমুসলমান’ বলে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আরাে উল্লেখ করা হয়, “মুজিবের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বিহারিদের বিরুদ্ধে ‘নরহত্যা’ ‘ধর্ষণ’ ‘লুণ্ঠন’ চালিয়েছিল।” পত্রিকাটি অভিমত দিয়েছিল, বাংলাদেশ মানে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিমদের খতম কর।’ অন্য আর একটি পত্রিকা ‘সদা-এ-হিন্দ’-এ বলা হয়েছিল, করাচি থেকে জানা গিয়েছে, মিলেটারি অপারেশনের পূর্বে বাঙালিরা বিহারিদের নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল।’
মুশকিল হলাে, উর্দু পত্রিকায় প্রকাশিত এই মিথ্যে সংবাদগুলাে কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকছিল না, এসব খবরের ওপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্যের নামিদামি পত্রিকাগুলােও অনুরূপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছিল। এসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলিম মানেই ভারতের কংগ্রেস সরকারের দালাল’ ও ‘হাতের পুতুল। ভারতীয় মুসলমানদের মনে গ্রথিত হয়ে যাওয়া এসব ভ্রান্ত ধারণা অপনােদনের জন্য নয়াদিল্লি শেষ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের সহায়তা কামনা করে এবং এই সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়ার পর ‘উর্দুভাষী ভারতীয় মুসলমাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। দুই. দেশবিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কখনােই সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। কাশীর প্রশ্নে দুটো দেশের পরস্পরবিরােধী অবস্থান দিনকে দিন। বেড়েই চলছিল। এ সময় ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান ভেঙে ‘স্বাধীন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রাথমিক পর্যায়ে, বহির্বিশ্ব বিবেচনা করেছিল—ভারতের প্রতিশােধস্পৃহা হিসেবে। বিশেষত মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ-এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক তত্ত্বের সন্ধান করেছিলেন। অনেকেই মনে করতেন, ভারত নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিছু অনুগত নেতৃবৃন্দ ও শরণার্থী এনে ‘নাটকীয় পদ্ধতিতে পুতুল সরকার গঠন করিয়েছে।
এবং এর মাধ্যমে দিল্লি পাকিস্তানকে বিভক্ত করে দিয়ে রাষ্ট্রটির শক্তি বিনষ্টের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যদিও উদ্বিগ্নবােধ করতেন, তবে এটিকে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবেই বিবেচনা করতেন। তাঁরা, বিশেষ করে মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ—কেউ-ই চাইতেন না যে, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হােক। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন—যে দেশগুলাে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত, তারাও ‘অখণ্ড পাকিস্তান নীতিতে অটল ছিল, বিধায় ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ওই দুটি দেশ ভারতীয় ভূমিকার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত এ যুদ্ধ যদি বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, পাকিস্তানের পক্ষে চীন-মার্কিনশক্তি এগিয়ে আসে—তাহলে পরিণতি কী হবে, এ প্রশ্নটি ভারতীয় জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই নিজেদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, ভারতীয় জনগণের একাংশ ওই যুদ্ধে ভারত যেন জড়িয়ে না যায়, সে ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠেছিল।
তিন, ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার পর, যতই দিন যাচ্ছিল—ভারতগামী শরণার্থীদের সংখ্যা ততই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এসব শরণার্থীর বেশিরভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লােক। ওইসব হতভাগার মুখে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের (যাদের সবাই মুসলমান) অত্যাচারের কথা শুনে সেখানকার গােড়া হিন্দুরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে; তারা ভারত সরকারকে চাপ দিতে থাকে, এ ব্যাপারে সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য। অন্যদিকে নকশালপন্থিদের মিইয়ে যাওয়া আন্দোলনের মধ্যে গতি সঞ্চার করার জন্য তারা (নকশালিস্টরা) সুকৌশলে প্রচার করতে থাকে যে, মুজিবনগর সরকার এবং তার অধীন সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী—প্রায় সবাই মুসলমান, কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থী, এরা সবাই। হিন্দু—তাদের বাড়িঘর সহায়সম্পত্তি সবকিছুই মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তা আর ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এ প্রেক্ষিতে এই আন্দোলন চালিয়ে না লাভ হবে ভারতের, না হবে ওপার বাংলার হিন্দুদের।
চার, নয়াদিল্লির মনে আশঙ্কা জন্মায়, বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলে, এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিম বাংলায় একই রকম আন্দোলন শুরু হবে না তাে? কিংবা অহিন্দিভাষী অন্যান্য প্রদেশ, যেখানে মাড়ােয়ারি ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেই সকল দরিদ্র জাতিগােষ্ঠী হঠাৎ করে মাড়ােয়ারি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না তাে? ভারত যখন বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে গৃহদাহে ভুগছে, তখন বিশেষ একটা মহল প্রচার করতে থাকে যে, দিল্লির সহায়তায় পূর্ব বাংলা যদি পাকিস্তান থেকে বেরিয়েই আসে, তাহলে নতুন দেশটির ভাগ্য হবে সিকিমের অনুরূপ, বা বড়জোর ভুটানের মতাে স্বাধীন তবে আজ্ঞাবাহী’ । ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানগণ, বরাবরই সন্দিগ্ধ ছিলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণ কর্তৃক স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলনটি চলছে, এর প্ররােচনাদাতা ভারত, কারণ ভারত চায় দুর্বল ও খণ্ডিত পাকিস্তান। শুধু কি তাই, নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঘুরে ঘুরে ত্রিপুরা, মিজোরাম যেতে হবে না—বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সহজেই যাওয়া যাবে। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সেনাবাহিনীর বেশ বড় একটা অংশ নিয়ােজিত রাখতে হয়, সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি স্বাধীন হয়ে গেলে সে ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। বস্তুত বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিজের দেশ থেকেই নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায়—নয়াদিল্লিকে বেশ ব্রিতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে, প্রচুর সমালােচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ সময়ে ভারতের ত্রিশঙ্কু অবস্থা সম্পর্কে কলকাতার ‘যুগান্তর পত্রিকা ‘নয়াদিল্লির সামনে শুধু অন্ধকার’ শিরােনামযুক্ত রিপাের্টে মন্তব্য করেছিল পাকিস্তানে সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করতে ব্রিটিশ সরকার নারাজ। আমেরিকাও বােধহয় ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসারী।
তার উপর সংযম রক্ষার জন্য ভারতকে অযাচিত উপদেশ দিয়েছেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ। সােভিয়েত রাশিয়ার সুর নরম। আরব রাষ্ট্রগুলাে জেগে জেগে ঘুমুচ্ছে। যুদ্ধের জন্য ইসলামাবাদ খরচ করছে দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকা।এদিকে শরণার্থীদের ভরণ-পােষণে ভারতের দৈনিক ব্যয়ও দেড় কোটি টাকায় পৌছে গেছে।ইয়াহিয়া খান দ্বিগুণ বিক্রমে বাঙালি তাড়াছেন। আবার তাদের ফেরত নেয়ার জন্য লােক-দেখানাে ক্যাম্প খােলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আশ্রয় নিতে বাঙালি মাত্রই নারাজ; ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার এখন কী করবেন? তাদের সকল হিসেব-নিকেশ ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে।’ এত সমালােচনা, গৃহের কিংবা বহির্বিশ্বের বিরােধিতা সত্ত্বেও নয়াদিল্লি তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি, মাঝেমধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ের ধারা পরিবর্তন করেছে মাত্র।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!