You dont have javascript enabled! Please enable it! শরণার্থীর স্রোত : ভারত সরকারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা - সংগ্রামের নোটবুক
শরণার্থীর স্রোত : ভারত সরকারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা
 
২৫ মার্চ, ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর দলে। দলে লােকজন শহর ছাড়তে থাকে। কেউ যায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে, কেউ যায় নিভৃত পল্লীতে। মে মাসের শেষার্ধে পাকবাহিনী গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক এলাকায় গঠিত হয় শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার বাহিনী’ ‘আলবদর বাহিনী’ (শেষটি মূলত শহরকেন্দ্রিক বাহিনী) ও আলশামস বাহিনী (এটি বাঙালির ওপর নিপীড়ন চালানাের জন্য অবাঙালি, বিশেষত ‘বিহারি সম্প্রদায় নিয়ে গড়া একটা হিংস্র সংগঠন)। ওইসব কুখ্যাত বাহিনীর সক্রিয় সহায়তায় পাক হানাদাররা গ্রামে-গঞ্জেও বেপরােয়া নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। হিন্দু সম্প্রদায়—যাদেরকে পাকিস্তানিরা বিবেচনা করত ভারতীয় চর বা কাফের হিসেবে, তাদের সমূলে বিনাশ করার জন্য পাকসেনারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। তাছাড়া, যারা আওয়ামীপন্থি বা ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক, ধর্মীয় দৃষ্টিতে তারা মুসলমান হলেও পাকদের দৃষ্টিতে তারা চিহ্নিত হয়েছিল ভারতের ক্রীড়ানক হিসেবে। কাজেই সকল হিন্দু এবং স্বাধীনতাকামী মুসলিম জনগণ, বিশেষত যুবসম্প্রদায়—পাকবাহিনীর রুদ্ররােষের শিকার হতে থাকে। নির্বিচারে হত্যা যজ্ঞ চলতে থাকে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে সম্পদ লুণ্ঠন করা হতে থাকে, কিশােরীতরুণী-যুবতীদের সেনাক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ‘ভােগ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। পাকবাহিনী বা তাদের দোসরদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বা ইজ্জত বাঁচাতে স্রোতের ধারার মতাে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ সহায় সম্বলহীন অবস্থায় ছুটতে থাকে ভারতের দিকে। সীমান্ত অতিক্রমকারী শরণার্থী স্রোতের একটা পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন (২৪ মে) ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী : ১ মে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১২,৫১,৫৪৪ জন। ৭ মে ছিল ১৫,৭২,২২০ জন, ১৪ মে ছিল ২৬,৭৯,২২৬ জন, ২১ মে হলাে ৩৪,৩৫,২৪৩ জন (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৭৫)।

ছিন্নমূল শরণার্থীদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়; তাছাড়া ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, বিহার প্রভৃতি রাজ্যেও আশ্রয় নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লােক। তাদের জন্য খােলা হয়েছিল ৮২৫টি উদ্বাস্তু শিবির, যা প্রয়ােজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে অনেক শরণার্থীর ভাগ্যে মাথা গোঁজার সামান্য ঠাইটুকুও মেলেনি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে, এরমধ্যে প্রায় ৬৮ লাখ বাস করত বিভিন্ন ক্যাম্পে, আর বাকিরা আশ্রয় নিয়েছিল আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের ছায়াতলে। ১৪ জুলাই ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় লেখা হয়েছিল, ‘over 2,300,000 refugees from Bangla Desh are living out side the camps in all border states, according to Mr P N Luthra, Additional Secretary, in the ministry of Rehabilitation, now posted in Calcutta. He presumed that all these people were living with their friends and ralations.’

সে সময় পশ্চিম বাংলায় স্থানীয় অধিবাসী ছিল ৪ কোটি ৪৪ লাখ। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ৭৩ লাখ শরণার্থী। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় বাঙালি শরণার্থীদের অনুপাত দাঁড়িয়েছিল প্রতি ছয়জনে এক জন। পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম দিনাজপুর, বালুরঘাট, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, চব্বিশ পরগনা জেলাগুলােতে স্থানীয় অধিবাসী ও বাঙালি শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে নদীয়া ও পশ্চিম দিনাজপুরে স্থানীয় জনসংখ্যা যেখানে ১৫ লাখ ছিল, সেখানে বাঙালি শরণার্থীর সংখ্যা দাড়িয়েছিল সােয়া ১৪ লাখের মতাে। …উত্তর সীমান্ত মেঘালয়ে যেখানে  

refugees at Kantala Camp, 19 miles from Agartala and only 20 yards from the border. All of them came from villages just inside East Pakistan. শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা, খুন-ধর্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ২১ জুলাই, ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় লেখা হয় : A party of foreign journalists who recently toured the remote areas of Tripura and Assam said, many East Pakistan refugees told of looting and burning of Muslims villages and the rape of Muslim women, by Pakistani soldiers. …more than 150 thousand East Pakistan refugees… nearly all of them Muslim-have fled into India’s Tripura State in the past few months after a reported wave of village-burning and rape by Pakistani troops. | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই, মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখার পর ১৩ আগস্ট, দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘It is the greatest human tragedy of our time’. fofa cca 16979, The American people have read reports about the refugees with heartfelt feeling, but they cannot fully assess the magnitude of the problem unless one sees personally the plight of the refugees. ২৬ আগস্ট তিনি আরাে বলেছিলেন, “Refugees told stories of atrocities, of slaughter, of looting, burning, harassment and abuse by West Pakistan soldiers and collaborators…. We must demonstrate to the Generals of West Pakistan and the people of the world that the United States has a deep and obiding revulsion of the monumental slaughter that has ravaged East Bengal.” 
পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে বাঙালি নিধন, নারী নির্যাতন, লুঠপাট, জীবন বাঁচানাের জন্য পালিয়ে আসা লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য যােগাতে ভারতের অক্ষমতা প্রকাশ ইত্যাদি খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলােতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে, পাশ্চাত্যের গণ্যমান্যরা এসে শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন দেখে যখন ব্যথাতুর আর্তি প্রকাশ করতে থাকলেন, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অসহায় শরণার্থীদের সাহায্যদানে এগিয়ে আসতে লাগল। মােট ৭৩টি দেশ জাতিসংঘের নয়াদিল্লিস্থ অফিসের মাধ্যমে এবং সরাসরি ভারত সরকারের কাছে সর্বমােট ২৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি সাহায্য এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে—প্রায় ৯ কোটি ডলার। ব্রিটেনের সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৮২ লাখ ডলার। কানাডা দিয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৩ লাখ ডলার। সােভিয়েত ইউনিয়ন ২ কোটি ডলার; লিবিয়া, ইরান, ইরাক, মিশর, ওমান প্রভৃতি দেশ মিলে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ডলার। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য এসেছিল সাড়ে ৪৩ লাখ ডলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি পর্যায় থেকে এসেছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। বার্মা পাঠিয়েছিল ৫০০ টন চাল, তুরস্ক দিয়েছিল কম্বল, ওষুধ, শিশুখাদ্য ইত্যাদি (আমি বিজয় দেখেছি, পৃ. ১৭৫)। প্রয়ােজনের তুলনায় এ সাহায্যের পরিমাণ নিতান্তই কম, তবে এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে ভারত এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলাে যে, পাকিস্তানের বর্বরতার কারণে পূর্ব বাংলা শ্মশান হতে চলেছে এবং মানবতার শশাচনীয় বিপর্যয়কালে নীতি বােধসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে উচিত।
কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক যে, ভারতে আশ্রিত এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর (প্রায় এক কোটি) ভরণ-পােষণের জন্য ভারত সরকারের কত টাকা ব্যয় হয়েছে? এর সঠিক কোনাে পরিসংখ্যান না থাকলেও, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে লেখক ও গবেষক শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের নাগরিকদের জানা দরকার, শুধু শরণার্থীর জন্য ভারত ‘৭১ সালে ব্যয় করেছিল টাকার বর্তমান মানে ২৩১০ কোটি টাকা। লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহসহ সামরিক খাতে ব্যয় এর দ্বিগুণেরও বেশি। টাকার অঙ্কে যা হিসাব করা যাবে না, তা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের প্রায় চার হাজার অফিসার ও জওয়ান শহীদ হয়েছেন। টাকার অঙ্কে হিসাব করা যাবে না সাধারণ মানুষের ভালবাসা ও সহমর্মিতা (প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহমদ, মােনায়েম সরকার প্রমুখ সম্পাদিত, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত’ নামক প্রবন্ধ, পৃ. ৩০৮)।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র