ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি
ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর, অক্টোবর মাসে স্বাক্ষরিত হয় ‘বাংলাদেশ (প্রবাসী সরকার)-ভারত মৈত্রী চুক্তি। ৭ দফাভিত্তিক এই চুক্তির বেশ ক’টি দফা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকার সেগুলাে মেনে নিয়েছিল ভারতীয় সহায়তা বেশি করে পাওয়ার প্রত্যাশায়। চুক্তির দফাগুলাে ছিল :
১, যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকতে পারবে। বাকিদের চাকরিচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্যপদ পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে, তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুনর্নিরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের কোনাে নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না। ৪. অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে। ৫. সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে। ৬. দু’দেশের বাণিজ্য হবে খােলা বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ হিসাব হবে বছরওয়ারী এবং যার যা পাওনা, সেটা স্টার্লিং-এ পরিশােধ করা হবে। ৭. বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলবে এবং ভারত যতদূর পারে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ওই গােপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং স্বাক্ষরদানের পরপরই তিনি মূৰ্ছা। গিয়েছিলেন (দুশাে ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, পৃ. ৩২৫)।
[বি. দ্র. ১. আমাদের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সমস্যা এই যে, এখানে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটিই যেন মুখ্য, তিনি নিজের দর্শন অনুসারে ইতিহাস লেখেন, সেজন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূল নয়—এমন কিছু সত্যকে এড়িয়ে যান, আবার কিছু অসত্য বা অর্ধসত্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা পাঠ করে প্রকৃত সত্য কোনটি—এ নিয়ে পাঠককে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি প্রসঙ্গটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখকগণের প্রায় সবাই এড়িয়ে গেছেন। দুশাে ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ নামক গ্রন্থে মুহাম্মদ নূরুল কাদির সেই চুক্তির প্রত্যেকটি ধারা উল্লেখ করেছেন এবং অন্য একজন লেখক মাসুদুল হক তার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ’ গ্রন্থে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই চুক্তির ধারাসমূহ কী কী প্রভাব ফেলেছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গ্রন্থ ‘মূলধারা ৭১’-এ মঈদুল হাসান বলেছেন, সে সময় ভারতবাংলাদেশের মধ্যে লিখিত কোনাে চুক্তিই হয়নি, ১৬ নভেম্বর, নয়াদিল্লিতে ইন্দিরার সাথে বৈঠকের সময় লেখকের ভাষায়, ‘তাজউদ্দীনকে জানানাে হয়। গত দু’মাস যাবৎ তার ও ডি পি ধরের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয় নিয়ে যে আলােচনা চলে আসছিল তা ভারত সরকার স্থগিত রাখার পক্ষপাতি; কেননা তাদের মতে, ভারতে অবস্থানকালে এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর ভারতের চাপের মুখেই সম্পন্ন হয়েছে বলে চিত্রিত হওয়া স্বাভাবিক।—তাজউদ্দীনও চুক্তির ব্যাপারে ভারতের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবেই গ্রহণ করেন।
কেননা পাকিস্তানের দখল অবসানের জন্য যে ভূমিকায় ভারতকে সম্মত করানাের উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন এক সময় এই চুক্তির কথা ভেবেছিলেন, তার সকল আয়ােজনই এখন সম্পন্ন প্রায়।’ (পৃ. ১৬২)। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? জনাব নূরুল কাদির ও মাসুদুল হক। উল্লিখিত চুক্তির ধারাসমূহ এবং এর প্রণয়নকাল পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, আর জনাব মঈদুল বলছেন, চুক্তি-বিষয়ে আলােচনা চলছিল, শেষ পর্যন্ত তা স্বাক্ষরিত হয়নি। এ দু’ধরনের অভিমতের মধ্যে আমরা কোনটাকে সত্য বলে ধরে নেব? নূরুল কাদির বলেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং স্বাক্ষর দানের পরপরই তিনি মূৰ্ছা গিয়েছিলেন; কিন্তু মঈদুলের লেখায় ওই চুক্তিবিষয়ে। সৈয়দ নজরুলের নামটিই আসেনি, বারবার এসেছে তাজউদ্দীনের নাম; নূরুল কাদির, মঈদুল ও মাসুদুল—তিনজনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এই অবিস্মরণীয় ইতিহাসের প্রত্যেকটি অংশকেই খুব কাছে থেকে দেখেছেন? তাঁদের এই দেখার মধ্যে এত ফারাক কীভাবে হলাে? হায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, হায় এ বিষয়ের লেখকবৃন্দ!
[বি. দ্র. : ২. “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘র’ এবং ‘সিআইএ” গ্রন্থে মাসুদুল হক মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলেছিল—এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন : চুক্তির ১নং ধারা অনুসারে স্বাধীনতা লাভের পর বেশ ক’জন ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ওই কর্মকর্তাদের নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেন। চুক্তির ২নং ধারা অনুসারে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা অনির্দিষ্টকালব্যাপী বাংলাদেশে অবস্থান করার অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে কোনাে অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই খুব দ্রুত ব্যাপারটি মীমাংসিত হয়ে যায়। চুক্তির ৩ ও ৪নং ধারা মােতাবেক বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনীর পরিবর্তে প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের কথা বলা হয়েছিল এবং এ প্রেক্ষিতেই বােধহয় বিকাশ ঘটেছিল রক্ষীবাহিনীর। ৫নং ধারায় বলা হয়েছিল, ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে চলতে হবে, এ ধারাটি যুদ্ধের সময় যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল; সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে জেনারেল ওসমানী ১৬ ডিসেম্বর, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে যােগ দিতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন। ৬নং ধারায় উভয় দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্যের কথা বলা হয়েছিল; এ প্রেক্ষিতে দু’দেশের সীমান্তের তিন মাইল খুলেও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে সে উন্মুক্ত সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়।
চুক্তির ৭নং ধারা অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র—এ দুটি বিভাগের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ ধারাকে পুরােপুরি অগ্রাহ্য করে নিজের মতানুসারে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি ঢেলে সাজিয়েছেন এবং ওই সাত দফা চুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে গিয়ে তাকে তেমন কোনাে বাধা বা আপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি। বস্তুত এটা সম্ভব। হয়েছিল তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কল্যাণেই। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, যে দেশটির সক্রিয় সহায়তায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জন্ম নিল, সেই দেশের সাথে একটা লিখিত চুক্তি’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা দিয়েই বাতিল করে দিতে পারলেন? কোনাে লিখিত চুক্তি উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া বাতিল করা যায়? এর জন্য কি আলােচনায় বসতে হয় না? আসলে চুক্তি হয়েছে, কি হয়নি—এটা যেমন আমাদের ইতিহাসে ‘রহস্যময় করে রাখা হয়েছে, তেমনি একদল উপস্থাপিত ‘বাতিলতত্ত্ব’টি আষাঢ়ে গল্পের চেয়েও হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইতিহাস—ইতিহাসই, তাতে কালাে-সাদা যা-ই থাকুক, পাঠককে তা অবহিত করা-ইতিহাসকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।]
‘সবকিছু স্বাভাবিক, কোথাও কোনাে সমস্যা নেই’
জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমগুলাে অনবরত রেকর্ড বাজাচ্ছিল, পূর্ব। পাকিস্তানে কার্যত কোনােই সমস্যা নেই, ভারতের মদদপুষ্ট কতিপয় দুষ্কৃতিকারী, যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশের অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য দেশপ্রেমিক পাকসেনারা বাধ্য হয়ে সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, এতে অল্প সংখ্যক বেসামরিক লােক স্থানচ্যুত হয়ে অকারণ ভয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল বটে, তবে দেশের বর্তমান স্বাভাবিক অবস্থার কথা জানতে পেরে ওই স্থানচ্যুতরা নিজভূমে প্রত্যাবর্তন করতে চাচ্ছে। এবং তাদেরকে স্বাগত জানাবার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সীমান্তগুলােতে অভ্যর্থনা কেন্দ্রও খােলা হয়েছে, কিন্তু ভারতের বাধার মুখে স্থানচ্যুতরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজ দেশে ফিরে আসতে পারছে না। ভারত ওইসব লােকের গায়ে তথাকথিত শরণার্থী নামের তকমা লাগিয়ে, নিজ দেশের উদ্বাস্তুদের তাদের সাথে একত্র করে শরণার্থীকেন্দ্রিক যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তা সর্বৈব মিথ্যা, বানােয়াট—পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য এটা। তারা পরিকল্পিতভাবে করে যাচ্ছে।
মুশকিল হলাে, দেশের অবস্থা স্বাভাবিক আছে এমন মৌখিক কথায় না । শরণার্থী, না বিশ্বসম্প্রদায়—কারাে যখন আস্থা অর্জন করা গেল না, তখন মাথামােটা পাক কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্যের সপক্ষে তথাকথিত প্রমাণাদি, ডকুমেন্টস ইত্যাদি যােগাড় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশে অবরুদ্ধ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জোর করে রেডিও, টিভি কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সেনাপক্ষের বক্তব্যের সমর্থনে কথা বলানাে হলাে। দেশে অবস্থানরত খ্যাতিমানদের মধ্য থেকে, অনেকের সম্মতি না নিয়েই তাদের নাম জড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক’—এ ধরনের মিথ্যে বিবৃতি পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করা হলাে। কিন্তু তাতেও যখন প্রত্যাশিত ফল মিলল না, তখন ঢাকা শহরে অবস্থানত চাকরিজীবী যারা, তাদের সন্তানদের শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্যসহ (কে শিক্ষাঙ্গনে যায় বা যায় না ইত্যাদি) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনিক ছাত্র হাজিরার প্রতিবেদন চেয়ে পাঠানাে হলাে (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৭ম। খণ্ড, পৃ. ৮১৩-১৪)। ১ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে, ওই প্রতিষ্ঠানের ৬ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের চেয়ারম্যান ড. এনামূল হক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এ বি এম হাবিবুল্লাহ—এ দুজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলাে। বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে চাকরি থেকে বহিষ্কারসহ ৬ মাসের ডিটেনশন দেয়া হলাে। একই বিভাগের।
শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও ড. নীলিমা ইব্রাহীম এবং ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়া হলাে। পরদিন অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর, টিক্কা খান ৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ৬নং সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দুজন শিক্ষক, যথাক্রমে মােজাফফর আহমদ চৌধুরী ও আবদুর রাজ্জাক, বাংলা বিভাগের মাজহারুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের খান। সারওয়ার মুর্শেদ আদালতে অনুপস্থিত, বিধায় ৯ নভেম্বরের রায়ে প্রত্যেককে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলাে এবং তাদের সম্পত্তির ৫০ শতাংশ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ প্রদান করা হলাে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৭ম । খণ্ড, পৃ. ৫৩৬-৩৯ এবং দৈনিক পাকিস্তান, ১০ নভেম্বর, ‘৭১)। ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র পাঠিয়ে সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে। নিয়মিতভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে বলা হলাে এবং শিক্ষার্থীদের তাদের। পরিচয়পত্র সাথে রাখতে আহ্বান জানানাে হলাে।
এ তাে গেল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রসঙ্গ; সামরিক বা সিভিল প্রশাসনেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হলাে, ১৩ মে টিক্কা খান সমন জারি করে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে ২০ মে’র মধ্যে সামরিক আইন আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন; সেইসাথে উল্লেখ করেন, ওসমানী যদি নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির না হন, তবে তার অনুপস্থিতিতে ৪০ নম্বর সামরিক বিধি অনুযায়ী তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হবেন। ২ সেপ্টেম্বর ১৩ জন সিএসপি অফিসার, এর মধ্যে তিনজন জেলা প্রশাসক, যথাক্রমে এইচটি ইমাম (পার্বত্য চট্টগ্রাম), আবদুস ছামাদ (সিলেট), এম এন কিউ খান (পাবনা) এবং ৬ জন মহুকুমা প্রশাসক, যথাক্রমে মােহাম্মদ খুরশেদুজ্জামান চৌধুরী (কিশােরগঞ্জ), কাজী। রুকুনউদ্দীন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), ওয়ালিউল ইসলাম (মাগুরা), আকবর আলী খান (হবিগঞ্জ), কামালউদ্দীন সিদ্দিকী (নড়াইল), তৌফিক এলাহী চৌধুরী। (মেহেরপুর) এবং খােন্দকার আসাদুজ্জামান (যুগ্ম সচিব), কুদরত এলাহী চৌধুরী (এডিসি, রাজশাহী), সাদত হােসাইন (এসি, যশাের)সহ আরও ৪৫ জন ইপিসিএস অফিসার, ২২ জন পুলিশ অফিসারকে সামরিক আদালতে। হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলাে। কিন্তু তাদের কেউই আদালতে হাজির। হননি, তাঁদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছেন, যারা দেননি—তারাও। পাকিস্তানি জঙ্গি আদালতের আদেশকে উপেক্ষা করে গেছেন। (দৈনিক পাকিস্তান, ৩ সেপ্টেম্বর, ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫তম খণ্ড)।
মিষ্টিকথায় চিড়ে ভিজিয়ে ভারত থেকে যখন একজন শরণার্থীকেও দেশে। আনা গেল না, কিংবা বিভিন্ন রকম হুমকি-ধমকি দিয়েও কর্মকর্তা, শিক্ষক বা। শিক্ষার্থী—কাউকেই প্রতিষ্ঠানগামী করা গেল না, তখন পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ। নতুন নাটকের অবতারণা করে। তারা ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী ও আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলােতে জড়াে করে, টিভি। ক্যামেরায় তা ধারণ করে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে বলতে শুরু করল, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং শিক্ষার্থীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নিয়মিতভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ করছে। কিন্তু না, এই অস্বাভাবিক কার্যক্রম বেশিদিন চালানাে গেল না, কারণ। লাঠিসােটাধারী অছাত্ররা, যারা লুটপাট-ডাকাতি করে ইতােমধ্যেই অনেক। সম্পদের মালিক হয়ে গেছে বা ক্ষমতাবলয়ে থেকে থেকে নাদুসনুদুস। চেহারাধারী হয়ে পড়েছে, তারা বইখাতা নিয়ে খুব বেশিদিন শ্রেণিকক্ষগামী। থাকতে চাইল না। ফলে ‘সবকিছু স্বাভাবিক প্রমাণের অপচেষ্টা শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্লাসে না এলে নিজেরই ক্ষতি হবে’ (২৬ সেপ্টেম্বর, পূর্বপাকিস্তানের গভর্নরের ভাষণ), ছাত্রদের অপকর্মের জন্য দায়ী হচ্ছে বিপথগামী নেতৃত্ব ও ভুল শিক্ষানীতি’ (২১ অক্টোবর, শিক্ষামন্ত্রীর বেতার ভাষণ) এমন সুভাষিত কথামালাতেও যখন কাজ হলাে না, তখন কর্তৃপক্ষ ‘সবকিছু স্বাভাবিক প্রদর্শনের প্রচেষ্টা থেকে সরে আসে এবং একটা লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে স্থিত হয়, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, চাই কেবল মাটি। ‘পাকিস্তানে সবকিছু স্বাভাবিক আছে’ এ মিথ্যাচারের বিপরীতে আসল চিত্রটা দেখতে পাই লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত মারি সেইলের প্রতিবেদনে : ‘ পূর্ব পাকিস্তানে দুটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। একটি বেসামরিক প্রশাসন, অন্য প্রশাসনটি ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে সৃষ্ট গােপন সংবাদদাতা ধর্মান্ধ ও খুনে ডাকাতদের নিয়ে তৈরি। কারাে কাছেই জবাবদিহি করার প্রয়ােজন পড়ে না এদের এবং স্পষ্টতই পূর্ব পাকিস্তানে বলবৎ সকল আইনের ঊর্ধ্বে এরা। অনেক বছর আগে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে কজায় আনতে ব্রিটিশরা গ্রামের পর গ্রাম দেয় জ্বালিয়ে এবং সেখানকার অধিবাসীদের গুলি করে হত্যা করে। পূর্ব পাকিস্তানের মতাে জনবহুল শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে এই পদ্ধতির প্রয়ােগ অতিশয় নিন্দনীয়। হিটলার ও মুসােলিনির প্রয়ােগ পদ্ধতিও এর তুলনায় সমর্থনযােগ্য।’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৭৯)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র