You dont have javascript enabled! Please enable it! সেনাকর্মকর্তাদের বৈঠক সেক্টর পুনর্গঠন নতুন কৌশল প্রণয়ন - সংগ্রামের নোটবুক
সেনাকর্মকর্তাদের পুনরায় বৈঠক সেক্টর পুনর্গঠন নতুন কৌশল প্রণয়ন
এপ্রিলের শেষার্ধ থেকে জুন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে সফল হয়েছে বটে, তবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ, প্রয়ােজনীয় লােকবলের অভাব, প্রত্যাশিত অস্ত্রের অভাব, পরিকল্পনা ও সমম্বয়ের অভাব; ফলে সদ্য স্বাধীন-ঘােষিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রায় পুরাে ভূখণ্ড পাকিস্তানের কজায় চলে যায়। যুদ্ধ-ময়দানের এ রকম শােচনীয় অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিরােধযুদ্ধের কৌশল প্রণয়নের জন্য, ১১ থেকে ১৭ জুলাই (মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থে বলা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ জুলাই, পৃ. ৪৯) প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৪ এপ্রিল, সিলেটের তেলিয়াপাড়ার বৈঠকে যেসব সেনাকর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন, তারা ছাড়াও এ বৈঠকে নতুন করে যােগ দেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খােন্দকার (তাকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন লে. কর্নেল এ এ রব), মেজর সি আর দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, উইং কমান্ডার এম কে বাশার, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর নাজমূল হক, মেজর এম এ জলিল, মেজর এ আর চৌধুরী প্রমুখ। তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা ও বেসামরিক শাসন পরিচালনার জন্য ১১টি আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। ওই বৈঠকে “মুক্তিযুদ্ধের অধােগতি রােধ এবং কমান্ড ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে এক ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
সেক্টর অধিনায়কদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে এবং তাদের সমবায়ে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠনের এই উদ্যোগের পিছনে জিয়াউর রহমান মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রধান সেনাপতি ওসমানীকে দেশরক্ষা মন্ত্রী পদে উন্নীত করে সাতজন তরুণ অধিনায়কের সমবায়ে গঠিতব্য এক কাউন্সিলের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণই ছিল আলােচ্য প্রস্তাবের সারকথা। কিন্তু প্রস্তাবের মূলমর্ম ওসমানীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থাব্যঞ্জক হওয়ায় কর্নেল ওসমানী সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। …তাজউদ্দীনের চেষ্টায় ওসমানীর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হতে কেটে যায় একদিনেরও বেশি সময়। …তারপর কয়েকদিনের আলােচনায় বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, মুক্তিবাহিনীর শ্রেণীকরণ ও দায়িত্ব অর্পণ, সশস্ত্র তৎপরতার লক্ষ্য ও পরিসীমা নির্ধারণ, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি নির্মাণ, প্রতিপক্ষের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, যােগাযােগ ইত্যাদি বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। …সীমান্ত এলাকায় কিছু ‘মুক্তাঞ্চল’ গঠনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে নিয়মিত বাহিনীকে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।” (মূলধারা ‘৭১, পৃ.৫০-৫১)। এই যুদ্ধ কাউন্সিল গঠন-প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে একাত্তরের স্মৃতিচারণ গ্রন্থে (পৃ. ১৪৯) আহমেদ রেজা লিখেছেন, “মেজর জিয়ার উদ্যোগে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলাে। এই প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল কর্নেল ওসমানীর সামরিক নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ। এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন মেজর মীর শওকত, উইং কমান্ডার বাশার, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর জলিল, মেজর মঞ্জুর প্রমুখ সেক্টর অধিনায়ক। মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর দত্তের ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ।
কিন্তু মেজর খালেদ মােশারফ যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের কঠোর বিরােধিতা করেন।’ একই ব্যাপার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে (পৃ. ৯৪) ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ‘একজন সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করায় বহু সামরিক অফিসারের মধ্যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির অধিনায়ক হওয়া উচিত নয়।… সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযােগিতা তখন থেকেই শুরু হয়। সফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বলে আমার ধারণা। ৭ জুলাই, মেঘালয়ের তুরা অঞ্চলে ১-ইবি, ৩-ইবি ও ৮-ইবি, এই তিনটি ব্যাটালিয়নকে একত্রিত করে যে স্বতন্ত্র ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল, যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান (জেড ফোর্স নামে পরিচিত), অনুরূপভাবে আরাে দুটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড গঠন করার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এ বৈঠকে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে ত্রিপুরা রাজ্যের ২-ইবির দায়িত্বে মেজর সফিউল্লাহ এবং ৪-ইবির দায়িত্বে মেজর খালেদ মােশাররফকে প্রদান করে ‘এস ফোর্স’ ও ‘কে ফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু আলাদা ব্রিগেড পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন কর্মকর্তা—তাঁদের কারােরই একক দায়িত্বে ব্যাটালিয়ন পরিচালনার পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। তাছাড়া প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নে সৈন্যসংখ্যা ছিল খুবই কম, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রয়ােজনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আবার একটি ব্যাটালিয়ন পরিচালনা করতে সাধারণত ১৫/১৬ জন অফিসার লাগে, কিন্তু এক্ষেত্রে আছে অর্ধেকেরও কম করে। তুরা ব্রিগেড (জেড ফোর্স) গঠনের পর, চাপের মুখে ত্রিপুরায় অনুরূপ দুটি ব্রিগেড কে ফোর্স’ ও ‘এস ফোর্স’ গঠন করতে গিয়ে সৈন্য ও অফিসারের স্বল্পতা বেশি করে অনুভূত হয়। তখন সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হয়।
কিন্তু এ পদক্ষেপটি ফলদায়ক হয়নি, কারণ, নতুন রিকুটেড হয়ে যারা এলাে, তাদের বেশিরভাগই ছিল আনাড়ি এবং অদক্ষ। ফলে তড়িৎ শক্তিবৃদ্ধির প্রক্রিয়া কার্যত সফলতা আনতে ব্যর্থ হয়, বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার বা অন্যান্য অফিসারদের লড়াই করার ক্ষমতা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে, পরবর্তী পর্যায়ে ওসমানী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যে কাজের জন্য ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল, তা অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবৎ ব্রিগেডকে ব্যবহার করা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না। তাই ‘বর্তমানে যেহেতু ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়নের উপযােগিতা অতি নগণ্য, সেহেতু নিয়মিত বাহিনীকে বরং কোম্পানি/প্লাটুন গ্রুপে বিভক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতার জন্য নিয়ােগ করা উচিত।’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ.। ৫৮)।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র