You dont have javascript enabled! Please enable it!
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র
২৫ মার্চের কালােরাত থেকে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদস্থ নিয়মিত বেতারকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওখানকার বেতারকর্মী বেলাল মােহাম্মদের নেতৃত্বে সৈয়দ আবদুস শাকের, মােস্তফা আনােয়ার, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, সুব্রত বড়ুয়াসহ এগারাে জন বেতারকর্মী কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে চলে যান এবং ওখানকার ট্রান্সমিটারটি ব্যবহার করে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র গড়ে তােলেন। ২৬ মার্চ দুপুর থেকে চালু হওয়া এই বেতারকেন্দ্র থেকেই মেজর জিয়াউর রহমান, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। পরদিন, পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আগেই কালুরঘাটের বেতার কর্মীরা আগরতলার দিকে চলে যান এবং সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ নাম দিয়ে একটি প্রচারকেন্দ্র গড়ে তােলেন। সেখানে কালুরঘাটস্থ কর্মীদের সাথে আরাে যুক্ত হয়েছিলেন এইচ টি ইমাম, অধ্যাপক মােহাম্মদ খালেদ, ডাক্তার এম শফী, বেগম মুশতারী শফী প্রমুখ। কিছুদিন পর, ২৫ মে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতাস্থ বালিগঞ্জের সার্কুলার রােডে পঞ্চাশ কিলােওয়াট ট্রান্সমিটারের একটি পূর্ণাঙ্গ বেতারকেন্দ্র চালু করা হয়। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে প্রতি সেকেন্ডে ৮৩০ কিলাে সাইকেলে প্রতিধ্বনিত এ বেতারকেন্দ্রটি পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণাসঞ্চারী ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের দখলকৃত ছ’টি বেতারকেন্দ্র থেকে পাক হানাদারবাহিনী। তখন একযােগে প্রচার করছিল, পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে যা হচ্ছে, সেটা ভারতের মদদপুষ্ট কতিপয় লােকের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, যে আন্দোলনের নাটেরগুরু শেখ মুজিব। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেরিতে হলেও শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগের দেশদ্রোহী ও ইসলাম বিরােধী—ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের স্বরূপ বুঝতে পেরেছে, তাই তারা এখন ‘তথাকথিত স্বাধীনতা’র দুঃস্বপ্ন থেকে সরে এসে ‘পবিত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছায়াতলে আবারাে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতায় আঘাত হানার জন্য হিন্দুস্থানের কর্তারা যত অপচেষ্টাই করুক, তাদের উদ্দেশ্য কিছুতেই সিদ্ধ হবে না এবং তাদের দালাল হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শেখ মুজিবের বিচার হবেই হবে এবং তার সহযােগীদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হবে। বস্তুত পূর্ব বাংলার ছ’টি বেতারকেন্দ্রের মধ্যে কেবল ঢাকা কেন্দ্র থেকেই প্রতিদিন আঠারােটা প্রপাগান্ডামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হতাে।
এর বিপরীতে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ছিল একটি মাত্র বেতারকেন্দ্র, তা থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে আমরণ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হতাে, দেশপ্রেমের উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত, কথিকা, নাটক প্রচার করা হতাে, কাল্পনিক প্রপাগান্ডাও চালানাে হতাে, তবে কখনােই পাকিস্তানি প্রপাগান্ডার জবাব দেয়া হতাে না।  প্রথম দিকে ইস্টার্ন কমান্ডের পিআরও কর্নেল রিখে-এর কাছ থেকে প্রতিদিনের যুদ্ধ-পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার করা হতাে। কিছুদিন পর ওয়াশিংটনে অবস্থানরত এনায়েত করিম, এ এম এ মুহিত, এস এম কিবরিয়া, এস আর করিম, এ মাহমুদ আলী, লন্ডনের মহিউদ্দীন চৌধুরী, হংকংয়ের মহিউদ্দীন আহমদ, টোকিওর মাসুদ আহমদ প্রমুখের সহযােগিতা থেকে সংবাদ আহরণ শুরু হয়। এক সময় রণাঙ্গন থেকে সরাসরি খবর পাঠাননার জন্য সেক্টরসমূহে বিশেষ সংবাদদাতা প্রেরণ করা হয়। এঁদের মধ্যে অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আবুল মঞ্জুর যুদ্ধকালীন সংবাদ সংগ্রহে বিশেষ সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখেন। তাদের প্রেরিত খবরের সাথে আলাে-আঁধারি, কথ্য-গ্রাম্য ভাষার রং ও রস লাগিয়ে, মােহনীয় কণ্ঠ ও ভঙ্গিতে এম আর আখতার মুকুল পাঠ করতেন ‘চরমপত্র’ নামের একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, মুক্তিবাহিনীর বিক্ষুগুলার। আঙ্কা, গাবুর, কো আর গাজুরিয়া মাইর একটুক কইর্যা কড়া হইয়া উঠতাছে, আর খেইলটা জমছে। এর মইদ্দে টিক্কা-নিয়াজির হেই জিনিস। খারাপ হইয়া গেছেগা। তাগাে তিনটা ডিভিশনের বেস্ট সােলজাররা বাংলাদেশের কেদোর মইদ্দে ঘুমাইয়া পড়ছে। এই দিকে নর্দার্ন রেনজারস, গিলগিট স্কাউট, লাহাের রেন্জারস, পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মড পুলিশ যাগােই ময়দানে নামাইতেছে, তারাই আছাড় খাইতেছে। 
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় হানাদার সােলজাররা ট্রেনে চাপলে ডিনামাইট, রাস্তায় গেলে মাইন, টাউনে ঘুরলে হ্যান্ড গ্রেনেড আর দরিয়াতে নামলেই খালি চুবানী খাইতে হয়।’ বস্তুত এ ধরনের অনুষ্ঠান পথেপ্রান্তরে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের মনে যেমন প্রেরণা যােগাত, তেমনি রসঘন প্রফুল্লতায় ভরিয়ে দিত তাদের অন্তর। একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বেতারকেন্দ্র থেকে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যা কিছু উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা সম্ভব, বিদেশ-বিভূঁই কলকাতা থেকেও, অনেক বাধা-বিপত্তি জয় করে—মুক্তিপিয়াসী অদম্য বাঙালিকুল সেসব অনুষ্ঠান সুচারুভাবে উপস্থাপন করে গেছেন। সেদিন ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে ভেদ ছিল না, ভাবনা ও স্বপ্নের মধ্যে ফারাক ছিল না, কারাে মনেই লােভ এবং স্বার্থের প্রভাব ছিল না—সবার চেতনায় জ্বলজ্বল করে ভাসত এক এবং অখণ্ড চিত্র—স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। সিকান্দার আবু জাফরের ভাষায়, “রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন, বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক’—আজ এতদিনে শ্রেণী-বর্ণ-গােত্র-ধর্ম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালি নর-নারীর রক্তধৌত বাংলার মাটি পুণ্যস্নাত হয়েছে—মহাপুণ্য স্নাত হয়েছে।… বাঙালির ঘরে যত ভাইবােন, আজ অগণিত আত্মপরিজনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশের সামনে দাঁড়িয়ে এক বেদনায় একাত্ম হয়েছে, এক প্রতিজ্ঞায় বাহুবদ্ধ হয়েছে, মৃত্যুর বিনিময়-মূল্যেই তারা মৃত্যুকে রােধ করবে। বাংলার মাটির পুণ্য পীযুষ-ধারায় সঞ্জীবিত-প্রাণ একটি বাঙালি বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রাম শেষ হবে না’ (২৬ জুলাই, ‘৭১-এ ‘অভিযােগইশতেহার’ শিরােনামে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত)। 
গান, কবিতা, নাটক, কথিকা, সংবাদ পরিবেশন ও সংবাদ বিশ্লেষণ—নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে প্রচার করা হতাে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে নামক ধারাবাহিক কথিকা। সে সময় ঢাকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে অধ্যাপক হাসান জামান নামের একজন প্রতিদিনই গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে প্রচার করতেন, পাকিস্তান ও ইসলাম সমার্থক শব্দ, আর আওয়ামী লীগ কর্তৃক বর্তমানের আন্দোলন—মূলত ইসলামের বিরুদ্ধেই আন্দোলন। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ যে মােটেও ইসলামবিরােধী তৎপরতা নয় এবং গণতন্ত্র, মানবতা, নরহত্যা, জেহাদ, ধর্মের নামে ধোঁকাবাজি, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি—প্রভৃতি বিষয়কে ইসলাম কোন দৃষ্টিতে দেখে—এসব বিষয়েরই তথ্য ও বিশ্লেষণমূলক জ্ঞানগর্ভ আলােচনা উপস্থাপন করা হতাে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে নামক অনুষ্ঠানে। বিজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। কর্তৃক উপস্থাপিত এই অনুষ্ঠান-ভারত-বাংলাদেশের অনেক সাধারণ মানুষ, যারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে হিন্দু অধ্যুষিত ভারত ও মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে ধারণা করত—তাদের ভুলের বৃত্ত থেকে বের করে আনতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। 
তবে হ্যা, প্রবাসী সরকারের মধ্যেই ঘাপটি মেরে থাকা কিছু পাকিস্তানি। অনুচর, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেছিল—এদেরই একাংশ ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটানাের জন্য কম অপচেষ্টা করেনি। আগস্ট মাসে, শর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভূতের প্ররােচনায় বেতারকর্মীদের একটা বড় অংশ ‘বেতন বৃদ্ধিসহ কতিপয় দাবির প্রেক্ষিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘটে গেলেন। তারা সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত ওই বেতারকেন্দ্র থেকে সংবাদ পরিবেশন ব্যতীত অন্য কোনাে অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেয়া হবে না। লাখ লাখ মুক্তিযােদ্ধা এবং শরণার্থী, ‘স্বদেশে নির্বাসিত কোটি কোটি বাঙালির প্রত্যয়-স্বপ্ন ও মনােবল বৃদ্ধিকারী প্রতিষ্ঠানটির ‘হঠাৎ ধর্মঘট আহ্বানে মুজিবনগর সরকার খুব বিব্রত বােধ করলেন এবং ধর্মঘট চলার তিন দিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট দাবিগুলাে মেনে নিয়ে বেতারকেন্দ্রটি পুনরায় চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন (আমি বিজয় দেখেছি, পৃ. ১১২)।  [বেলাল মােহাম্মদের লেখায় পাই, চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুলও নাকি পারিতােষিক বৃদ্ধির দাবিতে তাঁর উপস্থাপিত অনুষ্ঠানটির প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তবে বেলালের এমন দাবির সত্যতা মুকুল অবশ্য জোরগলায় নাকচ করে দিয়েছেন।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!