বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৩১শে আগস্ট, শনিবার, ১৪ই ভাদ্র, ১৩৮১
নদীগুলোতে আবার পানি বেড়েছে
দেশের নদীগুলোতে আবার পানি বাড়ছে! বিশেষ করে বড় বড় নদী গুলোর অবস্থা আশঙ্কাজনক। জানা গেছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়িয়া এলাকায় ঢল নামার দরুন আমাদের দেশের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বাড়ছে। গতকালের সংবাদে প্রকাশ, চাঁদপুরের কাছে মেঘনা নদীতে দেড় ফুট পানি বেড়েছে, ফলে বর্তমানে মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার দুই ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুষ্টিয়ার কাছে গড়াই ব্রিজ ও জি,কে, প্রজেক্টের নিকট দিয়ে পদ্মার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুটি নদীর পানি বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় এক ফুট। গত পাঁচ দিন ধরে সিলেটে প্রবেশপথগুলো নদীতেই পানি বেড়েছে। ফলে জেলায় আবার বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে রাজশাহী জেলার পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীর পানি প্রথম বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পদ্মা এখন এই জেলায় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। বস্তুতঃ গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন দেশের প্রায় উল্লেখযোগ্য প্রত্যেকটি নদীরই পানি বেড়েছে। ফলে বন্যার পানি যে দ্রুত নেমে যাচ্ছিল তা আবার বেড়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা প্রকার রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। মহামারী আকারে তা ছড়িয়ে পড়েছে । উদরাময় এবং পেটের অসুখ জনিত রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই মানুষ মারা যাওয়ার খবর আসছে। এমতাবস্থায় আবার নদীতে পানি বাড়ার সংবাদে দেশের ছিন্নমূল মানুষের উদ্বেগাকুল হয়ে উঠেছে। মূলতঃ আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচবার শেষ চেষ্টা ও নিদারুণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রকৃতির খেয়াল এর কাছে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় এর মত আত্মহুতি দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাবার পথ আমাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। চীনের দুঃখ ছিল হোয়াংহো নদী, আজ সেই হোয়াংহো তাদের আশীর্বাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আমাদের চিরকালের দুঃখ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই দুর্যোগের মোকাবিলা করার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা নিতেই হবে। নইলে দেশের আর্থিক কাঠামো যেমন কোনদিনও মজবুত হওয়ার নিশ্চয়তা পাবে না তেমনি জনজীবন বিনষ্ট হবার মতো দুঃখজনক ঘটনারও পরিসমাপ্তি ঘটবে না। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির প্রতিরোধের জন্য বৈজ্ঞানিক কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। এবারের ভয়াবহ বন্যার পরিসমাপ্তি ঘটতে না ঘটতেই আবার পানি বেড়েছে প্রবল ঢলের দরুন। সবে যখন পানি সরে যাচ্ছিল, যখন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আবার বাঁচবার জন্য চিন্তা করছিল ঠিক তখনই পুনরায় বড় বড় নদীতে পানি বেড়েছে। অসহায়, দুঃখ-কষ্টে ক্লান্ত মানুষের কাছে এই পানি বৃদ্ধির ঘটনা যে কত বড় মারাত্মক ব্যাপার তা অনুমান সাপেক্ষ। বলা হয়েছে কলেরা নয় উদরাময়ে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। আমরা এ রোগের বিস্তারিত জানার প্রয়োজনের চাইতে যেকোনো মহামারীর হাত থেকে ছিন্নমূল মানুষের বাঁচবার নিশ্চয়তা আশা করি। কর্তৃপক্ষ পানি বাড়ার ফলে উদ্ভূত সমস্যাদি আন্তরিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মহামারী নিরোধ অভিযান
বন্যার সহচর মহামারী ও নানাবিধ ব্যাধী যথাসময়ে সবখানেই উপস্থিত হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে সরকারি উদ্যোগের সারাদেশে ব্যাপক হারে মহামারী প্রতিরোধ অভিযান চালানো হচ্ছে। এবং তথ্য বিভাগের এক অসমাপ্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নেত্রকোনা, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া-রাজশাহী, ফরিদপুর, বগুড়ায় বন্যা দুর্গত অঞ্চলে কলেরা রোগ বিস্তার করেনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত দপ্তরের প্রতিবেদনে বন্যা দুর্গত অঞ্চলে আমাশয় ও উদরাময় রোগের প্রাদুর্ভাব এর কথা প্রকাশ করা হয়। তাদের হিসেব মতে, ১লা জুলাই থেকে ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত নেত্রকোনায় আমাশয়ে ৬ জন, মোহনগঞ্জে উদারাময় একজন মারা গেছে। কক্সবাজারে উদরাময়ে ১৪ জন, চকোরিয়ায় ১৪জন, রামুতে ১৩ জন, টেকনাফে ১জন মারা গেছে। কুষ্টিয়ায় ৪জন মারা গেছে উদরাময়ে, ফরিদপুরে উদরাময়ে ১০ জন এবং কলেরার ৮ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে।
তথ্য দপ্তরের হিসেবে কলেরার সংক্রমণ স্বীকার না করলেও উদরাময় ও আমাশয় এর প্রাদুর্ভাব এর কথা রেখে ঢেকে বলা হয়েছে। বসন্ত রোগের উল্লেখ কোথাও নেই। এছাড়া রংপুর, চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, তেতুলিয়ার ইত্যাদি অঞ্চলে মহামারীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সংবাদপত্রের পাতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল কলেরা, বসন্ত, মহামারী সহ উদরাময়ের প্রাদুর্ভাবের কথা প্রকাশিত হচ্ছে না যে এমন নয়। এর সাথে রয়েছে জ্বর, চর্মরোগ এবং নানাবিধ রোগের কথা। ক’দিন আগেই পত্রিকান্তরের পৃষ্ঠায় ফরিদপুরের বন্যাদুর্গত জলিলপার ক্যাম্পে প্রায় ২০০০ আশ্রয় প্রার্থীর জ্বর, কলেরা ও অন্যান্য রোগের বর্ণনা ছাপা হয়েছিল। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার রাজাগঞ্জ ইউনিয়ন ও স্যালাইনের অভাবে কলেরা ৩০ থেকে ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর আমরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় দেখেছি। এবং এমনি ধরনের তথ্যভিত্তিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সহ চিঠিপত্র ও সংবাদপত্রের পাতায় বেরোচ্ছে।
একদিকে সরকারি ভাষ্য কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারীর কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে, অপরদিকে বন্যা প্লাবিত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বাস্তব ভিত্তিক প্রতিবেদন আসছে। ফলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে জনমনে। বন্যা দুর্গত অঞ্চলের সত্য চিত্র কি-তা আমরা যথাযথ ভাবে বুঝতে পারছি না।
আমাদের বক্তব্য হলো দেশে ব্যাপকহারে মহামারী প্রতিরোধ অভিযান চলছে-এ অত্যন্ত আনন্দের কথা। আশার কথা। কিন্তু তাই বলে প্রতিবেদনের খবরগুলোর বাস্তবতা যাচাই করতে দোষ কি? যদি মহামারীতে কোন এলাকা আক্রান্ত হয়েই থাকে এবং প্রাণহানির খবর সত্যি হয়, তাহলে তাকে চেপে যাওয়ার সেই সাবেকী প্রচেষ্টার তো কোনো অর্থ হয় না। আর এর ফলে শুধু বিভ্রান্তি নয়-সমস্যা চেপে রাখতে গিয়ে তা বাড়ছেও। ক্ষতিগ্রস্ত জনজীবণের ভোগান্তিও সেইসঙ্গে বেড়ে চলেছে।
আমরা এখন স্বাধীন জাতি। এদেশ আমাদের। এর দোষ-গুণ, এদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও কৃতিত্ব সবই আমাদের। তাই সহজ স্বীকারোক্তি সহকারে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করেই দ্বিগুণ উদ্যমের রোগ প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এতে সাময়িক ব্যর্থতা প্রকাশ পেলেও ভবিষ্যতের সাফল্য আসবে এগিয়ে। তাই লুকোচুরি, কথা কাটাকাটি বা হিসেব-নিকেশের তালিকা প্রণয়ন না করে বন্যা দুর্গত অঞ্চল সহ সারাদেশে রোগ প্রতিরোধ আন্দোলন আরো জোরদার করলে আমরা যথার্থই উপকৃত হব।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক