You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৮ই নভেম্বর, রবিবার, ১৯৭৩, ২রা অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অর্থনৈতিক উন্নয়নই শুমারীর লক্ষ্য

সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কাঠামো ছাড়া কোনো দেশেরই সত্যিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষতঃ আমাদের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক কাঠামোটি সুদৃঢ় থাকা একান্ত দরকার। সুপরিকল্পিত অর্থনীতির জন্যে চাই সঠিক ও নির্ভুল পরিসংখ্যান। পরিকল্পিত অর্থনীতির যুগে তাই জাতীয় আদম শুমারীর সর্বাঙ্গীণ সার্থক রূপায়ণ কাম্য।
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় শুমারী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার এবং টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, শুমারীর অর্থ শুধু মাথা গুনতি নয়—দেশের জনশক্তি, বস্তু, সম্পদ, কর্ম এবং জীবন পদ্ধতির নির্ভুল খতিয়ান নেওয়াই জাতীয় শুমারীর প্রকৃত লক্ষ্য। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে প্রত্যেক পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি মানুষের বিত্ত, বৃত্তি শিক্ষা, দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল তথ্যাবলী সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি শুমারীর কাজে নিযুক্ত সোয়া লাখ কর্মীকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পূর্ণোদ্যমে কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং শুমারীর গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
অতীতের কথা যদি উল্লেখ করি, তাহলে দেখা যাবে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে দেশে যে আদমশুমারী অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে সঠিক তথ্যের যথার্থ পরিসংখ্যান নেওয়া হয়নি—কোনো রকমে দায়সারা গোছের আদমশুমারীর ফলে তাই দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। জনজীবনে দেখা দিয়েছে শোচনীয় অবস্থা। স্বাধীনতার পর তাই জনগণের সরকার জনজীবনের আর্থিক মান উন্নয়নের জন্যে শুমারীর মতো একটি অতি জরুরী কাজে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছেন। সরকার জনসংখ্যা এবং সেই সঙ্গে দেশে বসবাসকারী জনসাধারণের জীবনযাত্রা প্রণালীর পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ান নিতে উদ্যোগী হয়েছেন এ জন্যে যে, এগুলোর সঠিক হিসেব না পেলে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ ব্যাপারে জনগণের সহযোগিতাও একটি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে বাধ্য। এই শুমারী কার্যক্রমের ফলে জাতীয় জীবনের একটা সার্বিক প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হবে এবং এরই আলোকে দেশের অর্থনীতি কাঠামোকে একটি সুষ্ঠু পর্যায়ে উপনীত করা সম্ভব হবে। আমরা আশা করি, শুমারীর কল্যাণকর উদ্দেশ্য যেন দেশের প্রতিটি নাগরিকই সম্যক উপলব্ধি করেন। নইলে ক্রুটিপূর্ণ ও অসত্য তথ্য থেকে জাতীয় উন্নতির লক্ষ্য অর্জন কষ্টকর ব্যাপারে পরিণত হবে।

আবার পাটের গুদামে আগুন

উপযুক্ত সতর্কতার অভাবে এবং স্পষ্টতঃই দেশের স্বাধীনতার শত্রু ও দুষ্কৃতিকারীদের কুটিল চক্রান্তে আবারও লক্ষ লক্ষ টাকার পাট পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলো।
ঘটনাটি ঘটেছে গত পরশু শুক্রবার নারায়ণগঞ্জস্থ র‌্যালি ব্রাদার্স ও জে.পি.এস.সি’র পাটের গুদামে। আগুন লাগার কারণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জল্পনা-কল্পনা সহ নানান মতবিরোধ ও ব্যক্তিগত বিরোধও সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিনষ্ট পাটের মূল্য প্রায় ২৭ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আবার অনেকে বলছেন, এ পরিমাণ ৫০ লাখেও উপনীত হবার খুবই সম্ভাবনা আছে।
যাহোক, ঘটনা বা মতামত যাই হোক না কেন, আগুন লেগে বহু লক্ষ টাকার পাট পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে এবং আমাদের বিধ্বস্ত ও গঠনোন্মুখ অর্থনীতির উপর তা এক বিরাট ও বিরূপ প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করবে এটাই হচ্ছে আসল কথা ও প্রধান উপজীব্য বিষয়। তাই এ সম্পর্কে কয়েকটি দিক গভীরভাবে বিবেচনা করা নিতান্ত সময়ের প্রয়োজনেই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে পাটের গুদামে আগুন লাগার কাহিনী আজকের নতুন নয়। বহুবারই বা বলতে গেলে প্রায় ক’দিন পর পরই আমাদের দেশে পাটের গুদামে আগুন লাগা প্রায় একটা ফ্যাশন বা মামুলি খেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি যে, পাটই হচ্ছে আমাদরে ক্ষীণ অর্থনীতির একমাত্র মূল মেরুদন্ড। একে আমরা আদর করে ‘সোনালী আঁশ’ বলেও আখ্যায়িত করে থাকি। কারণ, এই হচ্ছে একমাত্র পণ্য যা’ বিদেশ থেকে স্বর্ণ (বৈদেশিক মুদ্রা) অর্জনে সহায়তা করে।
অথচ, একে নিয়েই আমাদের যতো রকমের বাংলিং আর টালবাহানা এবং এর প্রতিই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অনীহা।
অবশ্য, এমন মন্তব্য করতে আমরাও কম মনঃকষ্ট পাচ্ছি না। তবে পাটরাজ্যের প্রতি সামান্য একটু দৃষ্টি দিলেও আমাদের এ কথারই সত্যতা প্রতীয়মান হবে।
অসাবধানতাজনিত বা হঠাৎ আগুন লেগে কোনো গুদামের পাট পুড়ে গেছে—এ একটা নিতান্তই ঠুনকো অজুহাত যা’ দুষ্কৃতিকারীরা চিরকালই কর্তৃপক্ষ বা জনসাধারণকে বুঝিয়ে এসেছে।
অবশ্য, অসাবধানতাজনিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না বা ঘটতে পারেনা এমন কথাও আমরা মনে করিনা। তবে সব আগুনেরই পেছনে যদি এই অসাবধানতার ঠুনকো অজুহাত দেখানো হয়, তবে প্রশ্ন জাগে—এ অসাবধানতা কেন? নিশ্চয়ই প্রহরারত বা কর্মরত অফিসার বা কর্মচারীদের অসাবধানতাই সব অগ্নিকান্ডের মূল কারণ? তাই যদি হয় তবে বার বার এ অসাবধানতা কেন? কেন এ অসাবধানতা না ঘটার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? তবে কি ধরে নিতে হবে যে, এ রীতিমতো ইচ্ছাকৃত অসাবধানতা?
আমাদের কেন জানিনা মনে হচ্ছে শেষোক্ত কথাটিই সম্ভবতঃ সত্যি। কারণ, বীমা ইত্যাদি সংস্থার কর্মচারীদের সাথে একটা নিবিড় হৃদয়ের যোগাযোগ রেখেই সম্ভবতঃ এমন নিয়মিত অসাবধানতা অবাধে প্রতিপালিত হচ্ছে।
আবার, যদি ধরে নেওয়া হয় যে, প্রকৃতই এমন ঘটনা একটি অনিচ্ছাকৃত অসাবধানতা মাত্র, তাহলেও কি অসাবধানতাকে একটি অযোগ্যতা বলে ধরে নিয়ে এমন অসাবধানীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া চলেনা?
এ সম্পর্কে বহু রকমের গোপন কথা, কোড কথা, ফ্যাকড়া ও ঘাপলা আছে যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানার কথা নয় বা যা একটু আন্তরিকভাবে তদন্ত করলেই বেরিয়ে পড়তে পারে বলে আমাদের ধারণা।
তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন যাতে নিরপেক্ষভাবে এসব ঘটনার সরেজমিনে তদন্ত করে এবং দুষ্কৃতিকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করতে হবে।

বন্য জীবজন্তু সংরক্ষণের ব্যবস্থা

বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্তপ্রায় বন্য জীবজন্তু ও পশুপক্ষী সংরক্ষণের জন্যে সরকার কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ সম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপ করে ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির ২৩ নং আদেশ জারী করা হয়েছে। এই আদেশ অনুসারে বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তু যার বর্ণনা ৩ নং তফসিলে বর্ণিত হয়েছে তা কোনো প্রকারেই হত্যা, হত্যার চেষ্টা বা অন্য কোনো প্রকারে ধরা এবং রপ্তানী করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য বৈধ অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ১ নং তফসিলে বর্ণিত বন্য জীবজন্তু শিকার বা ধরার সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। এমনকি এই সব জীবজন্তু বা তার অংশবিশেষ বৈধ অনুমতিপত্রের মাধ্যমে রপ্তানীও করা যাবে।
বাংলাদেশে বন্যজন্তু প্রধান জাতীয় সম্পদগুলোর মধ্যে একটি। পৃথিবী বিখ্যাত রয়্যাল বেঙল টাইগার বন্য জীবজগতে অদ্বিতীয় এবং এর প্রাপ্তিস্থান শুধুমাত্র বাংলাদেশেই রয়েছে। তাছাড়া সুন্দরবনের হরিণ, ময়ূর এবং অন্যান্য জীবজন্তু এবং পশুপাখীরও যথেষ্ট নাম রয়েছে এবং এসবের প্রতি বিদেশীদের যথেষ্ট আকর্ষণ রয়েছে। এই সম্পদের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। যে সব দ্রব্য রপ্তানী করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, বন্যজন্তু, পশুপাখী এবং এসবের অংশ বিশেষ তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দ্রব্য। সুতরাং অর্থনৈতিক দিক থেকে বন্যজন্তু, পশুপক্ষী সংরক্ষণের গুরুত্বের কথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখেনা। তাছাড়া পর্যটন শিল্পের দিকটা চিন্তা করলেও এর উপযোগিতা আরো বৃদ্ধি পায়। বনের সঙ্গে বনের জীবজন্তু, পশুপক্ষী ইত্যাদির কথা এসে যায়। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা ‍জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বনাঞ্চল। এই সুন্দরবনে যেমন নানাবিধ জীবজন্তু পশুপাখী রয়েছে তেমনি রয়েছে শিকারের সুযোগ-সুবিধা। তাই বিশেষ করে বিদেশী শিকারীদেরকে এই সুন্দরবন ও সেই বনের জীবজন্তু শিকারে আকৃষ্ট করে। তাছাড়া বন বিভাগ এমন গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সংরক্ষিত এলাকা রূপে গড়ে তুলে অবসর বিনোদন ও পর্যটন শিল্পের আকর্ষণীয় স্থানরূপে গড়ে তুলতে পারেন। এর ফলে বিদেশী পর্যটকেরা অধিক আকৃষ্ট হবে এবং তাতে করে বৈদেশিক বিলুপ্তপ্রায় বন্য জীবজন্তু ও পশুপক্ষী সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তাকে একটি শুভ উদ্যোগ বলা যায়। তবে এই শুভ উদ্যোগটি কেবল কাগজে কলমে বা ফাইলে চাপা পড়ে থাকলেই চলবে না, সে বিধি নিষেধ যথাযথ কার্যকর হচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা মনে করি, দেশের অন্যতম জাতীয় সম্পদ বন্য জীবজন্তু এবং সঙ্গে সঙ্গে বনাঞ্চল সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকার সর্বদা সচেতন দৃষ্টি রাখবেন এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!