You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে মে, মঙ্গলবার, ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

কাগজের বাজারে আগুন

সম্প্রতি বাজারে কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দিয়েছে যা পাওয়া যায় তার দামও বেশি। অথচ কাগজ আমাদের দেশেই তৈরি হয়। এ ব্যাপারে কর্ণফুলী কাগজ মিল কর্তৃপক্ষ বলছেন যে, দেশের চাহিদার চেয়েও বেশি কাগজ সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারের অবস্থা হল–চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এই দ্বিমুখী পরিস্থিতিতে থেকে যাচ্ছে বিরাট ফাঁক। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে–এর মানে কি?
মিল কর্তৃপক্ষ আরো বলেছেন–দেশের আভ্যন্তরীণ সরবরাহ পাকিস্তান আমলের চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বাড়ানো হয়েছে। পাকিস্তান আমলে দেশে ৮০০শ থেকে ১০০০ টন সরবরাহ হতো, এখন সেখানে তারা ১২০০শ থেকে ১৫০০শ’ টন কাগজ সরবরাহ করে। এবং মিলের উৎপাদনও আগের চেয়ে বেড়েছে। বর্তমান কাগজের মিলে প্রতিমাসে ১৮০০ টন (পাকিস্তান আমলে উৎপাদন) থেকে ২০০০ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবুও দেশের চাহিদা পূরণ হয়না। এ ব্যাপারে মিল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো–এই অব্যবস্থার জন্য ভুয়ো ব্যবসায়ী, কালোবাজারি এবং সীমান্ত পাচারকারীই দায়ী।
এরই প্রেক্ষিতে কাগজ সংকট সম্পর্কে অভিজ্ঞ মহল কতকগুলি বক্তব্যের অবতারণা করেছেন। প্রথমতঃ তারা মনে করছেন অভ্যন্তরিন চাহিদার হিসেবটা সাবেকি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্কুল-কলেজসহ বহু দেশী-বিদেশী সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। সেই অনুপাতে নিশ্চয় কাগজ সরবরাহ করা হয় না।
দ্বিতীয়তঃ উৎপাদন ও সরবরাহ যে হিসেব মিল কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন–তার নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধেও অভিজ্ঞমহল সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
তৃতীয়তঃ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে মিল কর্তৃপক্ষ প্রতিমাসে ১৮০০ শ’ থেকে ২০০০ হাজার টন কাগজের হিসেব দাখিল করেছেন সত্য। কিন্তু তার মধ্যে লেখার কাগজের চেয়ে মোটা কাগজের উৎপাদনই বেড়েছে বেশি। ফলে তাদের হিসাব ঠিক থাকলেও লেখার কাগজের উৎপাদন মোটেও পারেনি। অথচ লেখার কাগজের চাহিদা যে অনেক বেড়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য।
চতুর্থতঃ ও ব্যবসায়ীদের বেইমানি এবং মুনাফা লাভের অসৎ বাঞ্ছা কাগজের দুষ্প্রাপ্য তাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
পঞ্চমতঃ অন্যান্য নানাবিধ ব্যবসায় যারা লিপ্ত এমন লোককেও কাগজ সরবরাহ দেওয়া হয়। ফলে যথাসময়ে সরবরাহকৃত কাগজ বাজারে ছাড়া পায় না এবং শিক্ষার্থী ক্রেতাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে–সর্বত্রই এত নৈরাজ্য কেন? পাকিস্তান আমলে তো প্রচুর কাগজ পাকিস্তানেও যেত এবং সেখানকার সরবরাহের পরিমাণও নেহাৎ অল্প ছিল না। তখন তো কাগজ নিয়ে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়নি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দুশ্চিন্তায় কাল কাটাতে হয়নি।
আর সম্প্রতি সব দোষ ক্ষালনের একটা সোজা পথ বের হয়েছে। যেখানে ঘাটতি সেখানেই নৈরাজ্য, দুষ্প্রাপ্যতা, সেখানেই ঘাপলা, সেখানেই চোরাচালানি, কালোবাজারি, মুনাফাখোর এদের নাম স্মরণ করা হচ্ছে। এই ধরনের ব্যক্তিদের অস্থিত্ব দেশে বরাবর ছিল এবং এখনও আছে। কিন্তু এমন তর সংকটও আগে হতো না এবং দোষী ব্যক্তিদের গা বাঁচানোর এত সহজ উপায়ও সৃষ্টি হতো না। তাছাড়া কোন জিনিসের দাম যদি ন্যায় সঙ্গত ভাবে বাড়ে তাহলে আমাদের বলার কিছু নেই। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির হিসাব দিয়ে যখন ২১শে মার্চ ও ২৭শে এপ্রিলে পরপর দুবার যথাক্রমে শতকরা ৬৭ ভাগ ও ২২ ভাগ দাম বাড়ানো হয় তখন আমরা তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে, সরবরাহ করা হচ্ছে–ইত্যাকার কথার প্রেক্ষিতে বাজারে কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার কোন সঙ্গতি নেই।
প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়, দেশের জন-জীবন আজ প্রতিটি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অতিষ্ঠ। চাল, ডাল, তেল এর দাম রেশনেই বাড়ানো হয়েছে। খোলাবাজারে তো আগুন লেগেই আছে তার উপরে এবার কাগজেরও দাম বেড়েছে। ভাত-কাপড় যেমন আমাদের অপরিহার্য, শিক্ষার প্রশ্নে কাগজও তেমনি অপরিহার্য। পুস্তক প্রণয়ন, প্রকাশনা, পরীক্ষা পরিচালনা ইত্যাদি কাজ কাগজ ছাড়া কখনই চলতে পারে না।
তাই সংশ্লিষ্ট মহলের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের আজ সমস্যা তলিয়ে দেখতে হবে যে গলদটা কোথায়। সেইসঙ্গে কাগজের ডিলারশিপ ও সুবণ্টন ব্যবস্থা নেয়া, ভুয়ো ব্যবসায়ীদের উৎখাত করা এবং উৎপাদন ও সরবরাহকে যথার্থ হিসাব মাফিক ছকে নিয়ে আসতে হবে। কোন ধরনের কাগজপত্র প্রয়োজন, সেই অনুপাতে প্রয়োজনবোধে তার উৎপাদন বৃদ্ধিও করতে হবে। সব ব্যাপারেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এরকম গা–ঢালা ভাব থাকলে দিশেহারা জনগণ দাঁড়াবে কোথায়? শিক্ষার সম্প্রসারণই বা হবে কেমন করে?

তাঁতী সমবায়ীদের পাত্তা নেই

এত তাঁতী, এত তাঁত সমিতি অথচ বেশ ক’দিন হয় তাদের কোনো পাত্তাই নেই। বস্ত্র শিল্প সংস্থার মিলগুলোতে এখন সুতো জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে। সংস্থার সংশ্লিষ্ট বিতরনকারী সংস্থাগুলোকে বিতরনের জন্য ঘনঘন তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আগ্রহী তাঁতিদের সাক্ষাৎ মিলছে না। বস্ত্র শিল্প সংস্থা থেকে পাওয়া এপ্রিল মাসের হিসেব অনুযায়ী তার ৪৬টি মিলে ১ কোটি ১৮লাখ ৯৩ হাজার পাউন্ড সুতা মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং মজুদ সুতো ২১শে মে’র মধ্যে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশের পর মজুদ সুতোর খুব কম একটা অংশই বিতরণ করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে অতঃপর বাণিজ্যমন্ত্রণালয় তার প্রধান অঞ্চলে জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিলার নিয়োগের জন্য। এই ডিলারদের মাধ্যমে সুতোর মজুদকৃত পাহাড় কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সুতোর সাথে সাথে মিলগুলোতে কাপড় জমেছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৮৩ হাজার গজ। এটিও এপ্রিল মাসের হিসাব। বন্টন এর অভাবে তা পড়ে আছে মিলগুলোতে। অথচ সারাদেশে বস্ত্র অভাবে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কাপড়ে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ পূর্বেও ছিলাম না। এর জন্য নির্ভর করতে হতো আমাদের তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। স্বাধীনতার পর বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি করা হয়েছে। স্থানীয় মিল কারখানাগুলোতেও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় যদি সুষ্ঠু বন্টন এর অভাবে কাপড়, সুতো মিলগুলোতে মজুদ হয়ে থাকে আর তার জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে তবে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
সুতো বন্টনের ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি কারচুপির অভিযোগ পুরনো। এ নিয়ে বাংলাদেশের যত কেলেঙ্কারি হয়েছে তা আর কোন কিছু নিয়ে হয়নি। (অস্পষ্ট) ভুয়া তাঁতী এবং তাঁত সমবায় সমিতি গজিয়েছে। নানা প্রভাবশালী লোকের ছত্রছায়ায় এই ভুয়ো তাঁত সমাবায়িরা সুতো নিয়ে তা উচ্চমূল্যে সত্যিকারের তাঁতিদের কাছে বিক্রি করেছে। উৎপাদন খরচ এভাবে বেশি পড়ায় কাপড়ের দাম বেড়েছে। অথচ উৎপাদনকারী তাঁতী তার সুফল পায়নি। বর্তমানে সুতো যে মিলে জমে পাহাড় হচ্ছে তার মূল কারণ অনেকর মতে ভুয়ো তাঁত সমবায়ীদের গা ঢাকা দেয়া।
সরকারের উচ্চ দায়িত্বশীল মহল থেকে এই ভুয়া তাঁতিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশ, জাতীয় সংসদের আগামী বাজেট সেশনে প্রচলিত সমবায় আইন সংশোধন করা হবে। ইতিমধ্যে নাকি ভুয়া সমবায়ীদের খুঁজে বের করার জন্য তদন্তকারী টিম নিয়োগ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ভুয়া সমবায়ীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আমরা বিলম্বে হলেও সরকারের এই পদক্ষেপ গ্রহণকে (যদি আদৌ বাস্তবায়িত হয়) স্বাগত জানাবো। পূর্বেও বহুবার ভুয়া সমবায়ীদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল মহল থেকেই নানা প্রকার হুমকি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীমহোদয়ের ভুয়া তাঁত সমবায়ীদের অস্তিত্বের কথা বিগত বৎসরখানেক হয় স্বীকার করে আসছেন। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এখন যদি সরকার সত্যি সত্যি উপলব্ধি করে থাকেন এদের বিরুদ্ধে কিছু করা দরকার তবে তারা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সহায়তা করবে।
মিলগুলোতে মজুদ সুতো-কাপড় বন্টনের ব্যাপারেও অতিশীঘ্র কোনো উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বস্ত্র শিল্প সংস্থার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ীই মওজুদ কাপড়ের দাম ২ কোটি টাকা। এই সুতো কাপড় সত্যিকারের তাঁতি এবং ক্রেতাদের হাতে এসে পৌঁছলে বর্তমান কাপড়ের দামে অনুকূল প্রভাব পড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস। ভুয়া তাঁতী, সমবায়ী এমনকি ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সাথে সাথে সুতো-কাপড় বন্টনের সুষ্ঠু এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। নইলে নতুন করে যে আবার সমস্যা দেখা দেবে না তারই বা নিশ্চয়তা কি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!