You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৪৮ এর উত্তাল মার্চ | প্রসঙ্গ ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1948-language.pdf” title=”1948 language”]
প্রকৃতপক্ষে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন ছাত্র এলাকায় ভাষার দাবিতে বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। ক্লাস বর্জন, সভা, সমাবেশ, মিছিল, বিবৃতি প্রচার, ইশতেহার বিলি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড তার প্রমাণ। এ ছাড়াও মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা সংগঠন-সম্পাদিকা এক বিবৃতিতে পাকিস্তান গণপরিষদের বাংলা ভাষা বিষয়ক ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং দেশের ছাত্রসমাজের প্রতি বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপােষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আবেদন জানান। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ মার্চ ১৯৪৮) … ৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় ইনসাফ, ফরিয়াদ পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে পুলিশি হামলার নিন্দা করা হয় এবং সেই সঙ্গে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এবং যুব ও ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান জানানাে হয় ।
১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন এবং হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি সরকারি স্থাপনার সামনে পিকেটিং এবং বিক্ষোভ মিছিল হয়। এই আন্দোলনে সচিবালয় ও হাইকোর্ট সংলগ্ন ফজলুল হক হল এবং মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা প্রধানত রাজপথের প্রত্যক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতারা প্রায় সকলেই সকাল থেকে পিকেটিংয়ে যােগ দেন। পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আন্দোলনরত ছাত্রদের পিকেটিং ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রন্থে বিবরণী রয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি না করে আহমদ রফিকের ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ গ্রন্থ থেকে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ১২ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত প্রতিবেদনটি উদ্ধৃত করছি। এখানে এমন কিছু তথ্য আছে যা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত অনান্য গ্রন্থে নেই, সেক্রেটারিয়েট ও বিভিন্ন সরকারি অফিসের সম্মুখে পুলিশের ব্যাটন চার্জের ফলে বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মি, এ. কে. ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি, মােহাম্মদ তােয়াহা ও ‘তমদুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক এ. কাশেম সহ প্রায় পঞ্চাশজন আহত হইয়াছে। …সকাল হইতেই মুসলমান ছাত্ররা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, পােস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ অফিস প্রভৃতি সরকারি অফিসগুলাের সম্মুখে পিকেটিং করিতে আরম্ভ করে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে পুলিশের ব্যাটন চার্জের ফলে পিকেটিংরত বহু ব্যক্তি আহত হয়। যে সকল সরকারি কর্মচারী সেক্রেটারিয়েটে পূর্বেই প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা লাঠিচার্জের সংবাদ শুনিয়া বাহিরে আসে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মি. নঈমুদ্দিনের সভাপতিত্বে ছাত্র ও পিকেটারদের একটি সভা হয়। সভায় পুলিশ জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ করিয়া মন্ত্রীমণ্ডলীর কার্যের নিন্দা করা হয়। গণপরিষদের (পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের) পদত্যাগের দাবি জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভার পর ধর্মঘটীরা মন্ত্রী-বিরােধী শ্লোগান দিতে দিতে পােস্টার কাধে করিয়া শােভাযাত্রা বাহির করে বাংলা ভাষা স্বীকার করিয়া লইবার দাবি তাহারা জানায়। বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ হাইকোর্টের নিকট শােভাযাত্রাকারীদিগকে বাধা দেয় । কিন্তু শােভাযাত্রাকারীদের মধ্যে একদল লােক কোনক্রমে সেক্রেটারিয়েটের উত্তর ফটকের নিকট চলিয়া আসে। সশস্ত্র পুলিশের লাঠি চালাইয়া, বন্দুকের কুঁদা মারিয়া তাহাদিগকে ‘তাড়াইয়া দেয়। প্রায় ২০ জন ছাত্র আহত হইয়াছে। ধর্মঘটের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। পুলিশেরা বিভিন্ন সরকারি অফিসগুলিতে পাহারা দেয় । অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪০ জন আহতকে ভর্তি করা হয়। মি, ফজলুল হক ও আরাে অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয়। সকালে ১০০ লােকের একটি জনতা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস, কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক অফিস ও জেলা কমিউনিস্ট পার্টির ইউনিয়নের অফিসে হানা দিয়া আসবাবপত্র ও কাগজের ফাইলে অগ্নিসংযােগ করে। ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ নামক পুস্তকের দোকানে হানা দিয়া প্রায় ৫ হাজার টাকা মূল্যের পুস্তক লুট করিয়াছে ও নগদ ২০০ টাকা লইয়া গিয়াছে বলিয়া প্রকাশ।
এইসব হামলাকারীরা ছিল প্রধানত ভারত থেকে আগত বিহারী মােহাজের এবং কিছু ঢাকার উর্দুভাষী আদিবাসী । আনন্দবাজার পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও পত্রিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসে সংঘটিত ঘটনাবলীর যে বিবরণ দিয়েছেন তা বস্তুনিষ্ঠ এ কথা প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রই স্বীকার করবেন । জিন্নাহ সাহেব ঘােষিত ভারতের দশ কোটি মুসলমানের মাতভূমি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ভাষার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ভ্যানগার্ড’ বাঙালি মুসলমান ছাত্রসমাজের এই প্রথম মােকাবেলা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। বলা চলে, যে ছাত্রসমাজের জন্য ১৯৪৫/৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলায় পাকিস্তান ইস্যুকে ভিত্তি করে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পাকিস্তান অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল সে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবি উচ্চারণের অপরাধে খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৬ মাস পরেই যে আচরণ করে তা অভিনব বটে। আশ্চর্যের কিছুই নেই যে, লাহাের প্রস্তাবের উত্থাপক এবং পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত বাঙালি মুসলমান সমাজে এক কালের কিংবদন্তীর এবং পরে অপাংক্তেয় নেতা শেরে বাংলাকেই ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ১১ মার্চের দমননীতির প্রতিবাদ জানাতে হয়েছিল, ‘এইসব ঘটনার প্রতিবাদ আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা যদি সরকার না করেন তাহা হইলে ইহার প্রতিবাদে পরিষদের সকল সদস্যের পদত্যাগ করা উচিত, আমি সর্বসাধারণ্যে ঘােষণা করিতেছি যে, ঢাকার নিরীহ ও নির্দোষ ছাত্রদের উপর পুলিশ আক্রমণের প্রতিবাদে আমিই প্রথম পদত্যাগ করিব।’ কিন্তু তখন পর্যন্ত মুসলিম লীগের বা সরকারের বিরােধিতা করার মতাে কোনাে রাজনৈতিক, যুব বা ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠেনি। মূলত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের নিয়ে পুনর্গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই ১৯৪৮ সালের ১১ থেকে ১৫ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে প্রথম সরকারবিরােধী আন্দোলন হয়েছিলাে। ১৯৪৮ সালে বাংলাভাষা আন্দোলন ১১ মার্চে ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের পরিচালনায় প্রদেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে। যদিও শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ১১ মার্চ পিকেটিংরত অবস্থায় গ্রেপ্তার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হন, তবু আন্দোলন চলতে থাকে। ১৫ মার্চ পর্যন্ত ছাত্রনেতারা একটানা ধর্মঘটের ঘােষণা দেন। ওদিকে ১৫ মার্চ পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা, তখন আইনসভা বসতাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জগন্নাথ হল মিলনায়তনে। এছাড়াও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন বিপাকে পড়ে যান। আন্দোলনকে থামানাের জন্য তিনি কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি পিছু হটেন, সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আট দফা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় ১৫ মার্চ। চুক্তির শর্তাবলী ঢাকা জেলে বন্দি ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুবের কাছ থেকে অনুমােদন করিয়ে নিয়ে আসেন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন আহমদ। পূর্ববাংলা সরকারের পক্ষে চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন আর সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন, তার আট দফা ছিলাে,
১, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলাভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে;
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন;
৩. ১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভার বেসরকারী আলােচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে;
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে । ইহাছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে;
৫, আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না;
৬. সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে;
৭. ২৯ শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে, তাহা প্রত্যাহার করা হইবে;
৮, সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
ওই চুক্তির শর্তগুলাে ১৬ মার্চ ১৯৪৮ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদও ছাপা হয় যে, ভাষা সম্পর্কিত আপােষ প্রস্তাব স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও আজ প্রায় এক হাজার লােক পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। চুক্তি অনুসারে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্দি ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেয়া হয়; কিন্তু ১৬ মার্চেও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১৬ মার্চ সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পুকুর পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সাধারণ সভার পর তারই নেতৃত্বে ছাত্ররা শােভাযাত্রা সহযােগে পরিষদ। ভবনে যায় এবং পরিষদ ঘেরাও ও সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভকারীদের ওপরও পুলিশি হামলা চলেছিল।
ওই আন্দোলনের তীব্রতা কেমন ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানের বিবরণী থেকে। তার ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রভু নয় বন্ধু’ (পৃ. ৩৮) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : তিনি মেজর পীরজাদার নেতৃত্বে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়ােগ করেন এবং স্বয়ং পরিষদে গিয়ে চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিনকে পরিষদ ভবনের (জগন্নাথ হলের পুরনাে মিলনায়তন) বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বাইরে পাচার করেন। যা-ই হােক, খাজা নাজিমউদ্দিন এবং কামরুদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের পাঠ থেকে স্বীকৃতি মেলে যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রচলিত-এই সরকারি প্রচারণা বাংলাভাষা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করা হয়েছিল। পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার মাত্র চারদিন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত মাস পর পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায় তসরিফ আনেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। জিন্নাহ সাহেব চালচলনে ছিলেন রীতিমতাে সাহেব এবং ইংরেজি ছিল তার মাতৃভাষার মতো; কিন্তু ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের বিরাট জনসভায় অপ্রতুল মাইক্রোফোন ব্যবস্থায় তিনি জিন্নাহ টুপি ও শেরওয়ানি পরে উর্দুভাষায় বক্তৃতা করেন, যা তার মাতৃভাষা ছিল না। রমনার মাঠে বিশাল জনসভায় হৈ-চৈয়ের মধ্যে উপস্থিত শ্রোতারা তার বক্তব্য কতটা অনুধাবন করতে পেরেছিল, সন্দেহ রয়েছে। আহমদ রফিক, জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ সম্পর্কে লিখেছেন, প্রায় এক ঘণ্টা (আনন্দবাজার পত্রিকার হিসাবে ৫০ মিনিট) স্থায়ী দীর্ঘ বক্তৃতায় মি. জিন্নাহ দেশবিভাগের সময়ে পাঞ্জাবে সংঘটিত হিংসাত্মক ঘটনা, শরণার্থী সমস্যা, পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য উন্নয়ন, পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা, সংখ্যালঘু সমস্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন।…তার বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রাদেশিকতা, আন্দোলন, বিচ্ছিন্নতাবােধ, দেশে ভারতীয় চর, কমিউনিস্ট ও পঞ্চম বাহিনীর উপস্থিতি, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ এবং সেই সঙ্গে মুসলমান জাতি ও জাতীয়তা এবং ইসলামি সংস্কৃতির কথা। থাকে মুসলিম লীগ দলের অপরিহার্য প্রয়ােজনের কথা এবং সর্বশক্তি দিয়ে মুসলিম লীগের খেদমত করার কথা । পরবর্তী বক্তৃতাগুলাের সুর (কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ও পূর্ব পাক বেতারে) কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও একই তারে বাঁধা ছিল। তিনটি বক্তৃতারই মূল কথা ছিল তিনটি-উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে; কমিউনিস্ট ও বিদেশী অর্থপুষ্ট চর এবং পঞ্চম বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে সতর্কতা ও ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব, সময় : বইমেলা ২০০০ যারা আশা করেছিলেন ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। অধিবাসী বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, তারা পাকিস্তানের স্থপতি কায়েদে আজমের বক্তব্য শুনে যে চরমভাবে হতাশ হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেব রমনা ময়দানের উর্দু ভাষণে যা বলেছিলেন তার বাংলা অনুবাদ, …এটা আপনাদের কাছে স্পষ্ট করে বলে দেয়া যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। হবে উর্দু, অপর কোনাে ভাষা নয়। যদি আপনাদের কেউ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন, তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রকৃত শক্র। একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনাে জাতিই দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ও টিকে থাকাতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
রমনার জনসভাতেই জিন্নাহ সাহেবের ওই ঘােষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ছাত্রকর্মীরা ‘নাে’ ‘নাে’ শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪ মার্চ ১৯৪৮ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনী ভাষণে তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে ইংরেজি ভাষায় যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম, কেবল একটি রাষ্ট্রভাষাই থাকতে পারে। যদি এই রাষ্ট্রের গঠনকারী ইউনিটসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেই ভাষা, আমার মতে কেবল উর্দুই হতে পারে। পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘােষণা সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের প্রতিবাদসূচক ‘না’ ‘না’ ধ্বনি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তবু শেষ চেষ্টা করার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা, যাদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অলি আহাদ, অরবিন্দ বসু প্রমুখ জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। জিন্নাহ সাহেব যথারীতি তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ডাকসু সহ-সভাপতি অরবিন্দ বসু প্রতিনিধি দলে থাকায় প্রথমে জিন্নাহ সাহেব এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলতে চাননি কারণ তিনি হিন্দু। কিন্তু ডাকসু ভিপি ছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি দল জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন এবং দেখা করেন। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ওই সুস্পষ্ট ঘােষণার পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে যে ৮-দফা চুক্তি করেছিল, তা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেখানে চুক্তিপত্রের ৩ ও ৪ ধারার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার, সেখানে ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভায় গৃহীত দুটি প্রস্তাবে বাংলাকে নির্ভেজাল প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ ছিল, (ক) পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থানে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে এবং বাস্তব অসুবিধাসমূহ যখন দূর করা যাবে, তখন এটা কার্যকর করা যাবে; (খ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা। ব্যবস্থাপক পরিষদের ওই প্রস্তাব ছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা। নাজিমউদ্দিনের চুক্তির বরখেলাপ। সর্বোপরি ৯ মার্চ ১৯৪৯ পূর্ববাংলা সরকার নিয়ােজিত ‘পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি’র ৭ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে পেশকৃত রিপাের্টে সুপারিশ করা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিকও উচ্চতর স্তরে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পঠিত হওয়া উচিত, যাতে আমরা পাকিস্তানের দুই অংশের ভাষাতাত্ত্বিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করতে পারি।
Reference:
স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- রফিকুল ইসলাম
সংগ্রামের নোটবুক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!