মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১ মে ১৯৭২
ঢাকা
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,
স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলার মেহনতি মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করেছে। এ জন্য দেশ ও জাতি আজ গর্বিত। মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক। বাংলার মেহনতি মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করেছে। এইজন্য দেশ ও জাতী আর গর্বিত। মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জ্বলন্ত প্রতীক। সারা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য আজকের এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। .. আমি ব্যবস্থার নিগড়ে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠি জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক আজ জনগণ। তাই কোনও শ্রেণি বিশেষের ভোগ লালসার জন্য, এ লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্ত এই সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই ব্যবস্থায় দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক, শ্রমিক ও সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করা হবে। যদিও বাধা অনেক তবু লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। আমার প্রিয় দেশবাসী, আপনারা জানেন আমাদের বর্তমান জাতীয় উৎপাদন সাড়ে ৭ কোটি দারিদ্র পীড়িত মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটাবার জন্য পর্যাপ্ত নয়। শত শত বছর ধরে আমরা একটা নিকৃষ্ট উপনিবেশ ও বিদেশিদের বাজার হিসেবে লুণ্ঠিত হয়েছি। বিদেশিরা দেশের অর্থনীতিকে জনগণের প্রয়োজন উপযোগী গড়ে তোলেননি। এর পর এহিয়ার বর্বর সৈন্যরা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছে। আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তন করেছি। পাশাপাশি দুঃখী জনগণের অভাব মোচন, দুর্দশা লাঘবের জন্য আমাদের সাধ্যমত আশু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা, পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ করা হয়েছে। লবণ উৎপাদককে আর আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। নির্যাতনমূলক ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। সরকার প্রায় ষোল কোটি টাকার টেস্ট রিলিফ জনগণের মধ্যে বিতরণ করেছে। দরিদ্র চাষিদের দশ কোটি টাকার তাগাবি ঋণ, এক লাখ নব্বই হাজার টন সার, দুই লাখ মণ বীজ ধান দেয়া হয়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে চার কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্কুল ঘর পুনর্নির্মাণ, ছাত্র-শিক্ষকদের সাহায্যের জন্য প্রায় দশ কোটি টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুক্তি সংগ্রামের সময় ক্ষতিগ্রস্ত দুই শ’ সাতাশিটি রেল সেতুর মধ্যে দুইশত বাষট্টটি এবং ২৭৪টি সড়ক সেতুর মধ্যে ১৭০টির মেরামত কাজ ইতিমধ্যে শেষ করা হয়েছে। বাকি গুলোর কাজ বর্ষার আগে শেষ করার জন্য আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্যাংক-বীমা ও শিল্প ব্যবসায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছিল। কল-কারখানায়। উৎপাদন প্রায় থেমে গিয়েছিল। দক্ষ পরিচালকের অভাব, খুচরা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের টানাটানি শিল্প জীবনে অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। শূন্য হাতে সরকার ব্যাংক-বীমা ও পুঁজি বিনিয়োগ সংস্থা, শিল্প-কারখানা গুলোকে সক্রিয় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতীতে কতিপয় সুবিধাভোগী দেশের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগ ভাগ্য করত। বর্তমান ব্যবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে। কৃষক-শ্রমিক দরিদ্র বঞ্চিত লোকেরা উপকৃত হবেনই। এই জন্য সরকারের ওপর গুরুভার সত্ত্বেও আমরা চলতি বছরের ২৪ শে মার্চ আমাদের অর্থনীতির কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন ব্যাংক-বীমা, পাট, বস্ত্র, চিনি শিল্প, আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ শিল্প-কারখানা একটি বিরাট অংশ জাতীয়করণ করেছি। পুরাতন পুঁজিবাদী পদ্ধতির স্থলে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির কায়েমের পথে এটা একটা সুস্পষ্ট দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে গড়ে তোলার কাজ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে। এখানেই শ্রমজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম শ্রমিকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হলে তাদের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। আমরা এখন আর পুঁজিপতি প্রভুদের জন্য ভোগের জন্য সম্পদের উৎপাদন করতে যাচ্ছি না। এখন যা উৎপাদন হবে তা শ্রমিক, কৃষক এবং বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণে লাগবে। সমাজতন্ত্রের শত্রুরাই লক্ষ্য অর্জনের বাধা এবং জাতীয়করণ কর্মসূচির সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চায়। শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু এটা করতে হলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকরা যে ভূমিকা পালন করেছেন এই দৃষ্টিভঙ্গির ও আচরণের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অবশ্যই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে শিল্প উৎপাদনের সুফল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষি ভাইদের ভাগ্য করতে দিতে হবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল দাবি-দাওয়া পেশের মনোভাব ত্যাগ করা দরকার। এক কথায় সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করা সম্ভব নয়। বন্ধুগণ, শ্রমিকরা যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন সে জন্যই আমি ইতিমধ্যেই শ্রমিক নেতাদের সাথে শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের একটা স্কিম প্রণয়নের প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেছি। নতুন ভূমিকা পালনের জন্য শ্রমিকদের যেমন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হচ্ছে তেমনি সরকারি প্রশাসনতন্ত্রকেও নতুন করে ঢেলে সাজোনো দরকার। সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য সরকারি কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি উচ্চ-নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের বেতনের ক্ষেত্রে যে বিরাট ব্যবধান ছিল তা কমিয়ে আনার জন্য বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করার উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় বেতন কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। সরকারি চাকরির এ নয়া কাঠামোতে কর্মচারীরা জাতীয় পুনর্গঠনে শক্তি হিসাবে অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে জনসাধারণ যে সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন সে জন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। বেকারত্ব, অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দুর্মূল্য আমাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে আমার জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছি। পরিকল্পিত উপায়ে সমস্যার মোকাবেলার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। জনগণের জানা আছে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের অভাব হয়েছে। যুদ্ধে বন্দর, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিছু সংখ্যক এজেন্ট, অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারিরা পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে বেশ খানিকটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সামগ্রিক চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে খাদ্যশস্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এপ্রিল মাসে প্রায় দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। মে মাস নাগাদ আরো তিন লক্ষ পঁচাশি হাজার টন খাদ্য শস্য আসছে। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত সাড়ে সাত লক্ষ টন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য ও বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ আমাদের প্রায় সাত লক্ষ টন খাদ্য শস্য দেবার আশ্বাস দিয়েছেন। এর ফলে খাদ্যশস্যের দাম ক্রমান্বয়ে কমে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। খাবার তেল, কেরোসিন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই জিনিসপত্রের দাম আরো কমে যাবে।
আমার ভাই ও বোনেরা, আমাদের সমস্ত পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে রয়েছে বণ্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা। ইতিমধ্যেই বেসরকারি ডিলার, এজেন্ট ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে যদি তারা অসাধু ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করে তাহলে তাদের সকল লাইসেন্স পারমিট বাতিল করে দেয়া হবে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রতি ইউনিয়নে এবং সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমবায় ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে বেসরকারি ব্যক্তিদের বণ্টনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সাময়িক স্বল্পতার সুযোগে যুক্তিহীন মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ পাবে। এই পরিকল্পনা কার্যকর করার সাথে সাথে কম বেতনের লোকেদের জন্য আমরা কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করেছি। আপনারা জানেন জিনিসপত্রের দাম না কমিয়ে কেবল বেতন বাড়িয়ে দিলেই জনসাধারণের অসুবিধা দূর হয় না। কাজেই মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই বর্ণিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছি। সেই সাথে আমরা মনে করি এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত নিম্নআয়ের মানুষদের কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া দরকার। আপনাদের সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশের গরিব সরকারি কর্মচারীদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। স্বায়ত্তশাসিত, অর্ধ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, দেশ রক্ষা বাহিনী, রাষ্ট্রায়ত্ত সরকার পরিচালিত শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও শ্রমিকরা এ বাড়তি সাহায্য পাবেন। আজ থেকে এটা কার্যকরী হবে। আগামী ১লা জুনের বেতনের সাথে আপনারা এ বাড়তি টাকা পেয়ে যাবেন। যে সকল সরকারি কর্মচারী প্রতি মাসে ৩৩৫ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান, তাদের সাময়িক ভিত্তিতে সরকার এই হারে সাহায্য দান মঞ্জুর করেছেন। মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক পঁচিশ টাকা, মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা, এই শ্রেণীভুক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক একশত পঞ্চাশ টাকা পাবেন। মাসিক বেতন ২২৬ টাকা হতে ৩২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা। এই শ্রেণীভুক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন। যে সকল কর্মচারীরা মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত বেতন পান তাদের জন্য মার্জিনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হবে। যে সকল বেসামরিক কর্মচারী প্রতিরক্ষা বরাদ্দ হতে বেতন পান, যারা (অস্পষ্ট) এবং কন্টিজেন্টাল কর্মচারী তাদের বেলায়ও এই আদেশ প্রযোজ্য হবে। এই সাময়িক সুবিধার কোনও অংশই বেতন হিসেবে গণ্য হবে না। যে সকল শ্রমিক সরকারি মালিকানাধীন কর্পোরেশন, সংস্থা, কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি তত্ত্বাবধানের অধীনে ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত আছেন ও মাসিক ৩৩৫ টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন তাদের সাময়িক ভিত্তিতে এই হারে সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে। মাসিক মজুরি ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২৫ টাকা, মাসিক মজুরি ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা। এই শ্রেণিভুক্ত শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মাসিক ১৫০ টাকা পাবেন। মাসিক মজুরি ২২৬ টাকা থেকে ৩২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা, এই শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন। যেসকল ব্যক্তি মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তাদের জন্য মার্জিনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হবে। এই সুবিধা স্থায়ী ও অস্থায়ী, বদলি, … শ্রমিকরাও পাবেন। সরকারের মালিকানাধীন, তত্ত্বাবধীন চা বাগানের শ্রমিকরা এ হারে সবসময়েই সুবিধা ভাগ্য করবেন। দুই সদস্য বিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত বিশ টাকা পাবেন। এক সদস্য বিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত ১০ টাকা পাবেন। আমার দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আমি বিশ্বাস করি এই পদক্ষেপগুলি আপনাদের বর্তমান দুর্দশা কিছুটা লাঘব করবে। অবশ্য জনগণের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রকৃত মানোন্নয়ন এই বেতন বৃদ্ধির ওপর কোনক্রমে নির্ভরশীল নয়। তখনি সম্ভব হয়ে উঠবে, যখন পুরো মাত্রায় আমাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত এবং কল-কারখানাগুলি চালু হবে। আমরা এখন পর্যন্ত নতুন কর, খাজনা ধার্য করি নাই। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, আপনাদের এই বেতন বাড়াবার জন্য সরকারের প্রতিবছর অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কৃষকসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে সুবিধা দেবার জন্য ইতিপূর্বে প্রায় সত্তর কোটি টাকার বকেয়া সুদ খাজনা ও কর মাফ করে দেয়া হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি করে। আমরা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারি। আমার গরিব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উপযোগী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করুন। আমাদের, আপনাদের পরিশ্রম করতে হবে। উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করতে সক্ষম হব। আজকের এই মে দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাবো। এই দেশের চাষি, তাঁতি, কুমার, কামার, শ্রমিক ও মজলুম জনতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করবো। আমার পার্টির সহকর্মীগণ এবং সরকার এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ যে, দুঃখের মধ্য দিয়ে আপনাদের দিন কাটছে। ঘরে খাবার নাই, পরনে কাপড় নেই, মাথা গোজবার জন্য নেই এতটুকু ঠাই। এহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলা আপনাদের সব কিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তবে আপনারা সম্পূর্ণরূপে আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে, এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য জনগণের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করিব। ইতিমধ্যে কিছু সংখ্যক বিদেশি এজেন্ট ও দুষ্কৃতিকারী স্বার্থান্বেষী মহল মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সুযোগ নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। এদের অতীতের কার্যকলাপ আপনারা জানেন। আমার অনুরোধ আপনারা এই সাম্রাজ্যবাদী দালালদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন। কিছু কিছু দুষ্কৃতিকারী জায়গায় জায়গায় শান্তি -শৃঙ্খলা নষ্ট করবার জন্য চেষ্টা করছে। আপনারা তাদের ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখবেন। সরকার তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ভাইয়েরা আমার, আমি আপনাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবনা। আপনারা জানেন, আমি একবার কোনও অঙ্গীকার করলে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও তা পালন করবার চেষ্টা করি। আমি বিগত দিনে যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেগুলি পালনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি আলাউদ্দিনে আশ্চর্য প্রদীপ নিয়ে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করিনি, যে রাতারাতি সবকিছু ঠিকঠাক করে দিবো। সমৃদ্ধির পথে কোনও সংক্ষিপ্ত রাস্তা নাই। শতাব্দীর শোষণের পুঞ্জীভূত সমস্যা আমাদের সামনে জড়ো হয়ে রয়েছে। এগুলির সমাধানে উদ্দেশ্যে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ভিত্তি গড়ে যেতে পারবো। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে এখানে বসবাস করতে পারবে। খোদা আমাদের সহায় আছেন।
জয় বাংলা।
Reference:
পিপলস ভয়েস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান