You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিবাহিনী বনাম মুজিববাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিবাহিনী বনাম মুজিববাহিনী
আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে বাঁক ফেরানাের ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম চার নেতা—যারা একত্রে ‘চার খলিফা’ নামে খ্যাত ছিলেন, তারা হলেন—আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদুস মাখন ও শাজাহান সিরাজ। এই চারজনকে নেপথ্য থেকে উপদেশ বা নির্দেশনা দিতেন। অগ্রজ অন্য চারজন—শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদ। ২৫ মার্চ, গণহত্যা শুরু হওয়ার পর এরা কলকাতায় চলে যান এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই, মূলত শেষ চারজনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিন্ন ধারা গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়  সহায়তা লাভের আশায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছিলেন, তখন ওই ছাত্র নেতৃবৃন্দ ভারতীয় গােয়েন্দা শাখার উষ্ণ আপ্যায়ন দ্বারা তৃপ্ত হয়ে সুখদ্রিায় নিমগ্ন ছিলেন। গুজব ছিল, তারা নাকি ওই গােয়েন্দা সংস্থাটির পূর্ব-পরিচিত এবং খুবই কাছের মানুষ, তারা যে ভারতে আসছেন—সে খবর নাকি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা আগে থেকেই জানতেন। গুজব আরাে ডালপালা মেলছিল, ‘পাকিস্তানি শাসকবর্গ যদি কোনাে সময় পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসী হয়, তবে সেই আপকালে আওয়ামী লীগপন্থি যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং প্রদানের জন্য শেখ মুজিব ভারত সরকারকে অনুরােধ করেছিলেন। এই ট্রেনিং যে উপরােক্ত চার যুবনেতার অধীনে পরিচালিত হবে, সে কথা সম্ভবত মার্চ মাসে অসহযােগ আন্দোলনের কোনাে এক পর্যায়ে তিনি ভারত সরকারকে জানান। শেখ মুজিবের এই কথিত অনুরােধের সত্যাসত্য নিরূপণের কোনাে উপায় না থাকলেও, এই চার যুবনেতা সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রকাশ্যে দাবি করতে থাকেন যে, সশস্ত্রবাহিনীর ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার জন্য শেখ মুজিব কেবল তাদের চারজনের ওপরই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, অপর কারাে ওপর নয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ অবধি তাদের এই দাবি ও ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকে।’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ.৮)। এটা নিতান্তই গুজব, নাকি সত্য-ইতিহাস ঘেঁটে তা পাওয়া যায় না বটে, (অথবা পাওয়ার চেষ্টা করা হয়নি) তবে ওই ছাত্রনেতারা ভারতের মাটিতে এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মুজিবনগর সরকারের অন্য কর্তাব্যক্তিদের কারণে-অকারণে চ্যালেঞ্জ জানাতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবােধ করতেন না। ভারতের বিদেশ সংক্রান্ত গােয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing)-এর আস্থাভাজন এই ছাত্রনেতৃবৃন্দ (শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম। সিদ্দিকী-এর মধ্যে শেষ জন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই এ গ্রুপের কার্যক্রম থেকে অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে যান) প্রবাসী সরকার গঠনের আগেই, এ সরকার গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদের ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব’ প্রাপ্তির ব্যাপারে তাদের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণের পরদিন, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল—নতুন মন্ত্রিসভা এই সাত নেতাকে দেশের ভেতর থেকে ছাত্র ও যুবকর্মী সংগ্রহ করে আনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে। কিন্তু মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের বাইরে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একক সিদ্ধান্ত দেন যে, এই সাত ছাত্রনেতা মুক্তিযােদ্ধা মনােনয়ন দেয়ার পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনী গঠন, প্রশিক্ষণদান এবং তাদের পরিচালনা করার অধিকার সংরক্ষণ করবেন। (মন্ত্রিসভাকে পাশ কাটিয়ে, কী প্রেক্ষিতে, কোন বিবেচনায় সৈয়দ নজরুল এমন একক সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন—এর অন্তর্নিহিত কারণ আজো অজানাই রয়ে গেল)।
এই ছাত্রনেতৃবৃন্দ কর্তৃক বাছাইকৃত যুবাদের বিশেষ ব্যবস্থায় বিশেষ স্থানে প্রশিক্ষণ দান করতেন জেনারেল উবান, যিনি মিজো ও নাগা বিদ্রোহীদের সফলভাবে দমন করে ভারত সরকারের প্রিয়ভাজন সামরিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। উবান কর্তৃক প্রশিক্ষিত—বাহিনী, যার প্রথম নাম দেয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, পরবর্তীকালে সেটি পরিচিতি লাভ করে ‘মুজিববাহিনী’ হিসেবে। দেরাদুনের অদূরে চাকরাতা নামক স্থানে কঠোর গােপনীয়তার সাথে এদের প্রশিক্ষণ দান করা হতাে। এদের উপর না ছিল সেনাধ্যক্ষ ওসমানীর কর্তৃত্ব, না ছিল মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণ। এরা চলত আলাদা কমান্ডে, এদের অস্ত্রশস্ত্র বা প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ছিল আলাদা রকমের—অভিজাত ও উন্নত। দিল্লির ক্ষমতাবলয় থেকে সরাসরি আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই ‘মুজিববাহিনী’ অচিরেই মুজিবনগর সরকার এবং তাদের স্বীকৃত নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর সমান্তরাল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মূলত এরাই মুক্তিবাহিনীতে ‘বামপন্থীদের’ প্রবেশ ঠেকাতে অতিসক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। মুজিববাহিনী গঠনের পেছনে যুক্তি দেখানাে হয়েছিল, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ—কোনাে কারণে যদি মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দানে ব্যর্থ হন, তা হলে ওই আন্দোলন যেন ঝিমিয়ে না পড়ে, সেজন্য তরুণ নেতৃত্বকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু এটা যে অর্থবর্জিত যুক্তি, তা বােঝা যায় ওই বাহিনীর সরকার-বিরােধিতার প্রবণতা দেখে। তারা তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল, নবগঠিত মন্ত্রিসভা ভেঙে মুজিববাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠনের দাবি জানিয়েছিল।
ওই বাহিনীর শপথনামায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মনির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করা হতাে (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৩৬১)। (তবে মনির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন—এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে খােদ মুজিববাহিনীতেই প্রশ্ন দেখা দেয়, এর সূত্র ধরে নেতা-কর্মীরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, অন্য অংশের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। মুজিববাহিনী ক্রমে ক্রমে এমনই বেপরােয়া হয়ে ওঠে যে, তারা কোথাও কোথাও মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া শুরু করে, অনিয়মিত বাহিনীসহ নিয়মিত বাহিনীর অনেক যােদ্ধাকে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে, মুজিববাহিনীতে যােগ দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ওদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে সেনাধ্যক্ষ ওসমানী ঘােষণা দেন, মুজিববাহিনীকে তাঁর কমান্ডের আওতায় না আনা হলে, তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৮০)। ইতঃপূর্বে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার উপদেষ্টা মঈদুল হাসানকে দিল্লি পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান রমানাথ কাও-এর কাছে এবং তাকে অনুরােধ করেছিলেন তিনি যেন মুজিববাহিনীর অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথােপযুক্ত পদক্ষেপ নেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রমানাথ কাও সাড়া দেননি। এবার তাজউদ্দীন বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। ইন্দিরা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ডি পি ধরকে নির্দেশ দেন।
ডি পি ধরের সক্রিয় তৎপরতায় ভারত সরকারের প্রতিনিধি মেজর জেনারেল বি এন সরকার ও ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল দত্ত, মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি তাজউদ্দীন আহমদ ও সেনাধ্যক্ষ ওসমানী, মুজিববাহিনীর পক্ষে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদ এক জরুরি সভায় মিলিত হন। কিন্তু মুজিববাহিনীর সদস্যদের ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য ‘আমরাই একমাত্র অধিকার রাখি’ এমন উগ্র দাবির প্রেক্ষিতে সেই বৈঠক থেকে কার্যকর কোনাে ফল পাওয়া যায়নি। তারা আগের মতােই মুজিবনগর সরকারাধীন প্রশাসন ও মুক্তিবাহিনীকে ব্রাত্য হিসেবে গণ্য করতে থাকে।  [বি. দ্র. : মুজিববাহিনীর উত্তাপ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে কম পােড়ায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘মুজিববাহিনীর নেতাদের একাংশ’ মুজিববাদী হয়ে গেলেন সহজেই, অন্য অংশ দেখলেন সুবিধা হচ্ছে না, প্রতিযােগিতায় পারছেন না, তাই তারা আওয়াজ তুললেন শ্রেণী সংগ্রামের (সময় বহিয়া যায় : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দৈনিক সংবাদ, ২৮ নভেম্বর, ৮৯)। শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ প্রমুখ নবীন সরকারের প্রভাবশালী অংশ হিসেবে গণ্য হতে থাকলেন; আর সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ—ক্ষমতার কেন্দ্ৰবলয়ে ঢুকতে না পেরে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্ন নিয়ে দেশকে অস্থির করে তুললেন।  প্রশ্ন হলাে, মুজিবনগর সরকার গঠন, সরকারের কার্যবিধি পরিচালনা, মুক্তিবাহিনী গঠন ও তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান—সবই হয়েছে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায়; সেক্ষেত্রে ভারতেরই একটি গােয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ মদদে মুজিবনগর সরকার ও তাদের-সৃষ্ট মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে ‘মুজিববাহিনী তৈরির প্রয়ােজন পড়ল কেন? যে বাহিনী নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে অবজ্ঞা করে চলত, নিজেরাই সরকার হয়ে উঠতে চেয়েছিল, যে বাহিনীর বিরুদ্ধে পরমসহিষ্ণু তাজউদ্দীনও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, নালিশ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে, যদিও কোনাে প্রতিকার পাননি—এই বাহিনীর খুঁটির জোরটি কোথায় ছিল? মােটা দাগে বলা হয়ে থাকে, এরা ছিল ‘র’-এর আশীর্বাদপুষ্ট, কিন্তু ‘র’ ভারতীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি প্রপঞ্চবিশেষ। ওই সরকার ইচ্ছে করলেই ‘র’-এর লাগামটা টেনে ধরতে পারত, তাতে ‘মুজিববাহিনী’র লালচক্ষুতে স্বাভাবিক রং ফিরে আসত, মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন আরও নিয়মতান্ত্রিক ও সুসংহত আকার ধারণ করত। কিন্তু ‘র’, অবশ্যই ভারত সরকারের সম্মতির ভিত্তিতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে বিভক্তিরেখা টেনে রেখেছিল; কিন্তু কেন?
সেদিন কোন জাদুমন্ত্রে কিছু ছাত্রনেতা, আমাদের জাতীয় জননেতাদের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন? মুজিববাহিনীর প্রশ্নে নয়াদিল্লি তখন ‘বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল কেন? আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত প্রকৃতি জানার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের মনে হয়, মুজিববাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল ভারতের উদ্যোগে এবং ভারতের প্রয়ােজনেই। লক্ষ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধটি যেন কোনাে অবস্থাতেই কমিউনিস্ট-প্রভাবাধীন না হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারে মুজিববাহিনীকে ব্যবহার করা। লক্ষণীয় বিষয় হলাে, তখন মুজিবনগর সরকার কাজ করছিল কেবল নিজদেশের জন্য আর মুজিববাহিনীর কাজ ছিল নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যসাধনপূর্বক দেশের জন্য যুদ্ধকাজেই সেদিন যারা নয়াদিল্লির লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিয়ে পরে অন্য কাজে ব্রতী হয়েছে, তাদেরকে তাে ‘র’ জামাই আদরসহ অন্য সুবিধাদি দেবেই দেবে। 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র