মুক্তিযােদ্ধা নির্বাচনে বর্ণবৈষম্য
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে প্রথম বিরােধ দেখা দিয়েছিল ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে। সেটা কোনােমতে ধামাচাপা দেয়ার পর নতুন সমস্যা সৃষ্টি হলাে মুক্তিযােদ্ধা-রিক্রুটিংয়ের ক্ষেত্রে। প্রথমদিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল। কেবল আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে। পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যবস্থা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীরও মনঃপূত।… ট্রেনিংয়ের আগ পর্যন্ত তরুণদের একত্রিত রাখা এবং তাদের মনােবল ও দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ‘যুবশিবির’ ও ‘অভ্যর্থনা শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব শিবিরে ভর্তি করার যে স্কিনিং পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তদনুযায়ী বহির্দেশীয় আনুগত্য থেকে যারা মুক্ত, কেবল সেই সব তরুণই আওয়ামী পরিষদ সদস্যদের দ্বারা শনাক্তকৃত হওয়ার পর ভর্তির অনুমতি পেত (মূলধারা ‘৭১, মঈদুল হাসান, পৃ. ২২)। ফলে আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য সংগঠন—যারা প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতাকামী এবং যুদ্ধে যােগ দিতে বদ্ধপরিকর-মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে নিয়ােগ পেতে তাদেরকে হাজারাে বাধার সম্মুখীন হতে হলাে। অবশ্য বৃহৎ সংগঠন হিসেবে, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে—মুক্তিবাহিনীতে আওয়ামী কর্মীদের নিরঙ্কুশ প্রভাব থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক ব্যাপার হলাে, অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের বৃহত্তর ও সর্বজনীন সংগ্রামে ভিন্ন মতাবলম্বীদের যুক্ত হতে না দেয়া বা যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করা। মুক্তিযােদ্ধা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অস্বাভাবিক পক্ষপাত ও দলীয় সংকীর্ণ আচরণ সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন, মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটিংয়ের ব্যাপারে পরিষদ সদস্যদের সুপারিশ করার যে বিধান ছিল, অনেক ক্ষেত্রে সেই সুপারিশের অপব্যবহার ঘটতে দেখা গেছে।
এঁদের অনেকে স্থানীয় রাজনীতির সুবিধার্থে অধিক সংখ্যায় কেবল নিজ নিজ এলাকার তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে ঢােকানাের প্রবণতা দেখাতেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীর দৈহিক যােগ্যতা, সংগ্রামী স্পৃহা এবং চারিত্রিক গুণাগুণ শিথিলভাবে বিচার করা হয়েছে। অংশত, এর ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের বৃহত্তর অংশ পরবর্তীকালে লড়াই থেকে দূরে সরে থাকে, এমনকি কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অপেক্ষা গ্রামীণ বিবাদ ও ব্যক্তিগত রেষারেষির নিষ্পত্তিতে, এমনকি সরাসরি লুটতরাজে অংশগ্রহণ করে’ (১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী কর্তৃক তৈরি ওপিএস প্ল্যান থেকে অনূদিত, মূলধারা ‘৭১, পৃ. ২৩)। মঈদুল আরাে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগদানেচ্ছু অপর নানা দল ও মতের ছাত্র-যুবকদের জন্য রিক্রুটিংয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিপত্য ছিল প্রবল ক্ষোভ ও হতাশার কারণ। দেশের ভিতরে পাকিস্তানি নির্যাতন যতই গ্রাম-গ্রামান্তরে বিশেষভাবে তরুণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, ততই প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্র-যুবক ট্রেনিং লাভের আশায় ভারতে এসে ভিড় করেছে, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে সাধারণ শরণার্থী শিবিরে অথবা সরকার অননুমােদিত ক্যাম্পের অবর্ণনীয় দুর্দশার পরিবেশে। মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের মুখে বিভিন্ন দল, মত ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার সপক্ষে এক স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযােদ্ধা মনােনয়ন ও ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে প্রদর্শিত বৈষম্য তরুণদের সেই একতাবােধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। সেপ্টেম্বরে রিক্রুটিং-এর ক্ষেত্রে দলীয় বৈষম্যের নীতি অনেকখানি হ্রাস পেলেও মুক্তিযােদ্ধাদের পর্যায়ে অবিশ্বাস, রেষারেষি ও দ্বন্দ্বের জের মূলত চলতেই থাকে।’
(মূলধারা ‘৭১, পৃ.২৪)। অবশ্য মুক্তিযােদ্ধা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বামপন্থিদের দূরে রাখা—আওয়ামী লীগের এই মতের সাথে নয়াদিল্লিও অভিন্ন মত পােষণ করত। আওয়ামী রাজনীতির ভয় ছিল, বিচার-বিবেচনা না করে যুদ্ধগমনেচ্ছু সকল বামপন্থিকে যদি মাঠে নামাননা হয়, তাহলে সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মনিষ্ঠা ও দৃঢ়তা দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানে ওরা ভাগ বসাতে পারে। অন্যদিকে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থিদের তখন চরম দাপট। নয়াদিল্লির এমন আশঙ্কা অমূলক ছিল না যে, পূর্ব বাংলার বামপন্থিরা যদি মুক্তিবাহিনীতে অবাধে ঢুকে যায়, তাহলে আদর্শিক প্রশ্নে তারা হয়তাে নকশালিস্টদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে পারে। ওদেরকে দেয়া অস্ত্র নাগা, মিজো, নকশালবাদীদের হাতে চলে যেতে পারে, তাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চরম হুমকির সামনে পড়তে পারে।
বস্তুত মুজিবনগর সরকার, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরামের প্রাদেশিক সরকার—সবাই তখন একটা বিষয়ে দৃঢ়মত ছিলেন যে, চরম বামপন্থি দর্শন বিশ্বাসী কেউ যেন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে না পারে, কোনাে ট্রেনিং না পায়; যােদ্ধা-নির্বাচনে মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের অভেদ ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি—তকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিতর্কিত বিষয় হিসেবে গণ্য হলেও, অগােছালাে প্রশাসনাধীন ব্যাপকবিস্তৃত যুদ্ধটিকে এক ও অভিন্ন প্রবাহে আবদ্ধ রাখার জন্য এ রকম সিদ্ধান্তের গুরুত্বকে অস্বীকারও করা যায় না। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, প্রধানত বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ থেকে আগত ছাত্র-যুবাদেরকে প্রশিক্ষণ দানের কাজ শুরু করা হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এ কাজের ভার নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১২৭টি কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে ৫০০ থেকে ২০০০ লােককে একসাথে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং, মেজর সুব্রানিয়াম, ক্যাপ্টেন এস কে শর্মা প্রমুখ। প্রথম পর্যায়ে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল চার সপ্তাহ, পরে তা বাড়িয়ে ৪৫ দিন করা হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই অনিয়মিত বাহিনীর প্রথম নামকরণ করা হয়েছিল ‘গণবাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের কাছে তারা পরিচিত হলাে ‘মুক্তিবাহিনী’ বা ‘মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকেও মুক্তিবাহিনী’ শব্দটিই ব্যবহার করা হতাে। বস্তুত ‘গণবাহিনী অপেক্ষা ‘মুক্তিবাহিনী’ বা ‘মুক্তিযােদ্ধা’ শব্দদ্বয়ের ভাষিক ব্যঞ্জনা ও ভারিত্ব বেশি ছিল বিধায় জন-সমাদৃত শব্দগুলােই স্থান করে নেয় মানুষের মুখে মুখে, এমনকি ইতিহাসের পাতাতেও।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র