You dont have javascript enabled! Please enable it!
মঞ্চের পরিবর্তন  নায়কের পরিবর্তন
২৫ মার্চ কালােরাতে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মােতাবেক আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ সুবিধেমতাে আত্মগােপনে গেলেন, পাকবাহিনীর তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর একের সাথে অন্যের সর্বপ্রকার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রাতের আঁধারে বা পরদিন, অথবা আরও ক’দিন আত্মগােপনে থেকে সবাই পা বাড়ালেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, প্রধানত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে। তাজউদ্দীন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করলেন তাঁর প্রীতিভাজন সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সাথে নিয়ে। ২৮ মার্চ, ঝিনাইদহ পৌছার পর সেখানকার এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের সহায়তায় তাদের যােগাযােগ স্থাপিত হয় মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সাথে। তৌফিকের সহায়তায় তারা সীমান্ত পাড়ি দেন ২৮ মার্চ রাতে, সেখানে। ভারতীয় সীমান্তবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান গােলক মজুমদার তাদেরকে সংবর্ধনা জানান। মজুমদার তাদেরকে নিয়ে যান ভারতীয় সীমান্তরক্ষীপ্রধান রুস্তমজীর কাছে। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সহায়তাদান এবং মুক্তিফৌজ গঠন, তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দান ও অস্ত্র সরবরাহ—ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলােচনার সূত্রপাত করা হলে রুস্তমজী স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, ‘মুক্তিফৌজের ট্রেনিং বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই ট্রেনিং সমাপ্ত হবার পরেই কেবল তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এই ট্রেনিং বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের দেয়া হবে কি না, সেই সিদ্ধান্তের সংবাদ এখনও তার জানা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং তাজউদ্দীন চাইলে তাকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মাত্র।’ (তাজউদ্দীন আহমদ, একান্ত সাক্ষাত্তার, ৮ মে, ১৯৭৩)। 

ইতঃপূর্বে ৫ অথবা ৬ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে তাজউদ্দীন গােপনে দেখা করেছিলেন ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সাথে, কথাও বলেছিলেন বেশ সময় নিয়ে। আলােচ্য বিষয় ছিল, পূর্ব বাংলা যদি স্বাধীনতার রক্তভেজা সংগ্রামে লিপ্ত হয়, যদি পাক হানাদার বাহিনী। বাঙালির স্বাধীনতা-সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেবার নিমিত্তে পৈশাচিকতার পথ বেছে নেয়, সেক্ষেত্রে ভারতীয় সরকারের সহায়তার স্বরূপ কেমন হতে পারে। তাজউদ্দীনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সেনগুপ্ত চলে যান দিল্লিতে, তখন সর্বভারতব্যাপী নির্বাচনী জোয়ার থাকায় ওই উত্তর নিয়ে ফেরৎ আসতে তাঁর বেশ ক’দিন দেরি হয়ে যায়। ১৭ মার্চ, কে সি সেনগুপ্ত গা-ছাড়া ভাব নিয়ে তাজউদ্দীনকে অবহিত করেন যে, ইসলামাবাদস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার এমনটি ঘটবে বলে আদৌ মনে করেন না, তবু অপ্রত্যাশিত আঘাত যদি আসেই, ভারত সম্ভাব্য সকল সহযােগিতা প্রদান করবে।’ ওইদিন তারা। একমত হন যে, বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরও আলােচনা করা দরকার এবং এ প্রেক্ষিতে আগামী ২৪ মার্চ দুজন আবারও মতবিনিময় করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আন্দোলন ও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সাথে আলােচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কে সি সেনগুপ্তের সাথে প্রত্যাশিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়নি, বিধায় যুদ্ধ বাধলে ভারতীয় সহায়তার 

গতিপ্রকৃতি নিয়ে কোনাে স্থির সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই সিদ্ধান্তহীনতার নাজুক চিত্র দেখতে পান তাজউদ্দীন, ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর প্রধান কর্মকর্তার সাথে কথা বলে। 
রুস্তমজী এবং গােলক মজুমদারের একান্ত চেষ্টায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পান তাজউদ্দীন আহমদ। ১ এপ্রিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সাথে নিয়ে তিনি দিল্লি গমন করেন। ইন্দিরার সাথে সাক্ষাতের আগের দিন, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ভারতের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতােমধ্যে সরকার গঠন করেছে কি না। এই জিজ্ঞাসা থেকে তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে, কি হয়নি সে সম্পর্কে কোন প্রকৃত সংবাদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং হঠাৎ করে তাদেরকে সরকার গঠনের কল্পিত সংবাদ অবহিত করলে তারা বিস্মিত বা সন্দিগ্ধ হওয়ারও কোনাে আশঙ্কা নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট ইতােপূর্বে, ৩১ মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, (প্রস্তাবে ভারতীয় লােকসভা ‘পূর্ব বাংলায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে। পূর্ব বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা এবং গভীর সহানুভূতি জানায় এবং তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে যে, পূর্ব বাংলায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে জয়ী হবে।) তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা জন্মায়” (মূলধারা ‘৭১ : মঈদুল হাসান, পৃ-১২] । তাজউদ্দীন তখন দ্বিধান্বিত বােধ করেন, সরকার গঠন বিষয়ে আগামীকালও যদি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তাহলে ইন্দিরা গান্ধীকে কী বলবেন তিনি? তাজউদ্দীনের মাথায় হাজারাে জটিল চিন্তা ঘােরপাক খেতে থাকে। তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তার উপরের সারির নেতৃবৃন্দ—বঙ্গবন্ধু ইতােমধ্যে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়েছেন, কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মােশতাক আহমদ—তারা কে, কোথায় আছেন কিংবা আদৌ জীবিত আছেন কি না, কিছুই তার জানা নেই। তিনি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারেন, সরকার গঠনের উপর নির্ভর করবে ভারতীয় সাহায্যের গতিধারা। কিন্তু প্রকৃত সত্য তাে সরকার ঘােষিত হয়নি, এ অবস্থায় তিনি যদি কেবল দলীয় পরিচয় নিয়ে হাজির হন ইন্দিরার কাছে, তাহলে তার সহানুভূতি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রত্যাশিত সাহায্য লাভের সম্ভাবনা থাকবে না। তাহলে? ‘প্রয়ােজন কোনাে আইন মানে না’ এ রকম আপ্তবাক্য চিন্তা করে, অনিচ্ছুক চিত্তে তাজউদ্দীন এবার কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেন, যা আইনগত দিক থেকে অগ্রহণযােগ্য, তবে আপদকালীন পরিবেশ বিচারে খুবই ইতিবাচক, কল্যাণকর এবং ফলদায়ক। পরদিন সরকার গঠন বিষয়ে ইন্দিরা কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলেন, পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট, আমি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সকল সদস্য ওই সরকারের মন্ত্রিসভার সম্মানিত সদস্য। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আজন্ম বৈরী ভারত তাজউদ্দীনের সরকার গঠনবিষয়ক তথ্য’কে স্বাগত জানান এবং ৪ ও ৫ এপ্রিলের দু’দফা বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ১. নবগঠিত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান এবং কর্মপরিচালনার জন্য অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হবে; ২. বাংলাদেশ থেকে আগত সকল শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার জন্য ভারত সাধ্যমতাে সহায়তা দেবে; ৩. মুক্তিযযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণদান এবং অস্ত্র সহায়তা দেয়া হবে; ৪. মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রচারণার জন্য একটি বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত করা হবে; ৫. যােগাযােগের সুবিধার্থে প্রবাসী সরকারকে একটা বিমান দেয়া হবে ইত্যাদি। দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন আহমদ তার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহানের সহায়তা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলনীতি সংবলিত একটি বেতার ভাষণ তৈরি ও রেকর্ড করেন, যা ১১ এপ্রিল শিলিগুড়ির একটি অনিয়মিত বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথম প্রচার করা হয়, পরে সেটি আকাশবাণীর অন্যান্য নিয়মিত কেন্দ্র থেকে পুনঃপ্রচার করা হয়।
ইন্দিরা-তাজউদ্দীনের আলােচনা সফল হলাে বটে, কিন্তু উভয়কেই সতীর্থ নেতৃবৃন্দের প্রবল সমালােচনার মুখে পড়তে হয়। সীমান্ত উন্মুক্তকরণ, প্রবাসী সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি—ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভারতীয় রাজনীতির ডানপন্থি অংশ প্রবল আপত্তি তােলে এবং এসব সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শালীনতায় সমর্থনযোেগ্য কি না, তাতে ভারতের জাতীয় স্বার্থের কোনাে প্রতিফলন আছে কি না—ইত্যাদি প্রশ্নবাণে ইন্দিরাকে জর্জরিত করা হতে থাকে। এসব প্রশ্নের সূত্র ধরে দিল্লির রাজনীতিতে বিভাজন সৃষ্টি হওয়ার আগেই দৃঢ়চেতা ইন্দিরা গান্ধী মূলত তার একক সিদ্ধান্তের জোর খাটিয়ে সকল মতবিরােধের অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ এত সহজে পার পেলেন না। দিল্লি থেকে ফিরে এসে, ৮ এপ্রিল কলকাতার রাজেন্দ্র রােডের এক বাড়িতে তিনি কামারুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কতিপয় নেতার সাথে দেখা করেন এবং কোন প্রেক্ষিত ও উদ্দেশ্যে তিনি ইন্দিরার কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন—এর কার্যকারণ বর্ণনা দেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা কামারুজ্জামান, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, বরিশাল থেকে নির্বাচিত পরিষদ-সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারপ্রত্যেকেই তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন, বিশেষত শেখ ফজলুল হক মণি মন্ত্রিসভা গঠনেরই তীব্র সমালােচনায় মেতে ওঠেন। (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : ড. মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ৩৪৫); [বি.দ্র. : কামারুজ্জামান কর্তৃক তাজউদ্দীন বিরােধিতার কথা মূলধারা ‘৭১-এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে (পৃ. ৫২); আবার সেই সময়ে কামারুজ্জামানের ভূমিকা নিয়ে বিপরীতধর্মী কথা বলেছেন লেখক কাজী সামসুজ্জামান, তাঁর ‘আমরা স্বাধীন হলাম’ নামক গ্রন্থে। তিনি লেখেছেন, ‘মে মাসের এক বিকেলে উক্ত লেখকের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা দেখা করতে আসেন। কেন্দ্রীয় প্রবীণ নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে, তারই দপ্তরে। তাদেরই একজন, নেতাকে বলেন, আপনি অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আপনাকে বাদ দিয়ে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হলেন কীভাবে?
এ প্রশ্নে ক্রুদ্ধ কামারুজ্জামান উত্তরে বলেন, “দেশ, বাড়িঘর, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন সহায় সম্পত্তি সব ফেলে রেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন, কিন্তু চরিত্রটা ফেলে আসতে পারেননি। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এসেছি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে, কলহ করতে নয়। দেশ স্বাধীন করুন, তারপর দেশে ফিরে গিয়ে যত পারেন দলাদলি করবেন। এখন প্রশ্ন হলাে, তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্ব পদে আসীন হওয়ার পর, কামারুজ্জামানের অবস্থান প্রসঙ্গে এই বিপরীতধর্মী দুটি তথ্যের কোনটিকে সঠিক বলে বিবেচনা করব আমরা? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এ রকম পরস্পরবিরােধী অসংখ্য তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু কেন?]। মণি এবং চিত্তরঞ্জন সুতার, সেখানে উপস্থিত ৪২ জন নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটা আবেদনপত্র পাঠান, যার মূল বিষয় ছিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের যে ভাষণটি রেকর্ড করা হয়েছে, সেটি যেন কোনাে ইলেকট্রনিক মাধ্যম থেকে প্রচার করা না হয়। দলীয় নেতৃবৃন্দের প্রবল বিরােধিতা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল রইলেন, কারণ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে-এই নেতৃত্বের কোন্দল স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরাে আয়ােজনটাকেই ভূলুণ্ঠিত করে দিতে পারে। ৯ এপ্রিল, হতাশ তাজউদ্দীন আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে পুরনাে ডাকোটা প্লেনে চড়ে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে খোঁজ করতে বেরিয়ে যান।
মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা, শিলচর হয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুল মান্নান প্রমুখ সিনিয়র নেতাকে সাথে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলা পৌছান ১১ এপ্রিল খন্দকার মােশতাক আহমদ, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী আগে থেকেই আগরতলায় অপেক্ষা করছিলেন। দুদিনব্যাপী প্রবল বিতর্ক ও আলােচনার পর ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘােষণা সংক্রান্ত একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তাজউদ্দীনপ্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার গঠন ও আয়তনকে বহাল রাখা হয়। তবে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিসরকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা হয়। নতুন ‘শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ােগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির অথবা তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ করা হয় এবং এই আদেশটি ২৬ শে মার্চ থেকে কার্যকারিতা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ-১৭)। বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণের ফলে ওই পদলাভের প্রতি অন্যদের আকাক্ষা অনেকটা কমে যায় এবং সংশ্লিষ্ট পদের যথাযথ ক্ষমতা নির্দ্বিধায় ত্যাগ করে তাজউদ্দীন আহমদ প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করার মধ্যে তাঁর ক্ষমতালিপ্সা কাজ করেনি, তিনি এটা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রয়ােজনীয়তার প্রেক্ষিতেই।

ইতােমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ডকৃত ভাষণ শিলিগুড়ির অনিয়মিত বেতারকেন্দ্রসহ আকাশবাণীর অনেক কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়ে গেছে। কাজেই ১১ এপ্রিলে প্রচারিত ওই ভাষণকে ‘বৈধ সরকার গঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য স্বাধীনতা আদেশ ঘােষণার তারিখ ১০ এপ্রিল বলে ঘােষণা করা হয়।’ [বি. দ্র. : ১১ এপ্রিলে প্রচারিত ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আজ প্রতিরােধ আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছেন। সাগরপারের বাঙালি ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন। এরপর বিভিন্ন অঞ্চলে সদ্য নিয়ােগকৃত সেনা কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে তাজউদ্দীন বলেন, ‘আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারি কাজ পরিচালনার জন্য সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ইতােমধ্যে সােভিয়েত রাশিয়া ও ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস, কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে।’ (বাংলাদেশের। স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮-১৫)]।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!