You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের অনালােকিত প্রস্তুতিপর্ব - সংগ্রামের নোটবুক
প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের অনালােকিত প্রস্তুতিপর্ব
দেশবিভাগের কিছুদিন আগে, ৭ আগস্টে লেখা, তৎকালীন ছাত্রনেতা (পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় নেতা) তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে ‘পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা’ সম্পর্কে কিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা লেখা আছে, লেখক ও গবেষক ড. আতিউর রহমান এটিকে বলেছেন, পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে থেকে এটাই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার চিন্তা’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৪৩); পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে, এ উদ্যোগ বা পরিকল্পনার সূত্র ধরে হাঁটা হয়নি। এরপর শেরে বাংলা, ভাসানী বা দেবেন সিকদার স্বাধিকার বা স্বাধীনতাবিষয়ক ইঙ্গিতধর্মী কথা অনেকবার বলেছেন বটে, তবে এসব ছিল ‘কথার কথা’, কারণ ওই কথার সূত্র ধরে তাঁরা কেউ কোনাে কার্যকর বা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন—এমন তথ্য ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। মেজর মুখলেছুর রহমান তাঁর বাঙালির স্বাধীন কমান্ডার নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক নিঃগৃহীত সেনাকর্মকর্তা লে. কর্নেল এম এ জি ওসমানী শেখ মুজিবের কাছে এলেন এবং বললেন, লিডার, আপনি আমাকে দশ ব্যাটালিয়ন সৈন্য দেন, আমি আপনাকে স্বাধীন বাংলা উপহার দেব। তখন। শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, দশ ব্যাটালিয়ন নয়, আমি পাঁচ কোটি বঙ্গসেনা আপনাকে দেব। আমার মুক্ত বাংলা চাই। এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে, বাঙালি রাজনীতিক এবং সেনাকর্মকর্তারা গােপনে গােপনে বৈঠক করেছেন, নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা বিষয়ে কোনাে পরিকল্পিত উদ্যোগের খবর নেই। দ্যা সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থে হাসান জহির জানিয়েছেন, ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ ৬ দফার বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য দুটো সেল গঠন করে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সেলের প্রধান ছিলেন ড. নূরুল ইসলাম এবং সামরিক সেলের প্রধান ছিলেন কর্নেল ওসমানী।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন শেখ মুজিব, তবে তার সন্দেহ ছিল ৬ দফার ভিত্তিতে সামরিক সরকার তার দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এমন পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য তিনি তিনি প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওসমানীকে। তিনি সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য ইউনিফর্ম পরিহিত সংস্থার বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন এবং যখন তাদের সঙ্কেত দেয়া হবে তখন সাথে সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বে। এ প্রেক্ষিতে ওসমানী ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে জয়দেবপুরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসে ২০ জন সামরিক কর্মকর্তা নিয়ে একটা সভা করেন। সভায় তিনটি পরিকল্পনা পেশ করা হয়, এক, প্রতিরক্ষা চাকরি সম্পর্কীয়, দুই. স্বাধীনতা ঘােষণার পর সশস্ত্র প্রতিরােধ, তিন, মুক্তিযযাদ্ধারা ব্যর্থ হলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সহায়তায় শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া (ভাষান্তর : সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ১৩৫)।  স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে ড. কামাল হােসেন লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির গােড়ার দিকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা দেয়ার সম্ভাব্যতা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে বিলম্ব আওয়ামী লীগকে তার নিজস্ব বিকল্পগুলাে বিবেচনায় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রণােদিত করে। স্বাধীনতার একটি ঘােষণা প্রস্তুত করে হাতে রাখার সিদ্ধান্ত হলাে। এ ঘােষণা দেয়া হলে তার বিরুদ্ধে সামরিক আঘাত কতটা জোরালােভাবে আসতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ওই আক্রমণ মােকাবিলা করে জয়লাভ করার জন্য জনগণের শক্তি কতটুকু—সবকিছুই সতর্কভাবে বিবেচনার প্রয়ােজন ছিল। বিদ্যমান সামরিক শক্তি সম্পর্কে কিছু হিসেব করে দেখা হলাে।
ভারতের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এর ফলে সৈন্য ও খাদ্য সরবরাহে সৃষ্ট অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হলাে। আমাকে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হলাে। এই খসড়া তৈরিতে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হলাে মার্কিন স্বাধীনতার ঘঘাষণাপত্রের ভাষ্য, যেখানে এ ঘােষণাকে যুক্তিসঙ্গত করতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে। খসড়াটি প্রস্তুত হলে ১০ ফেব্রুয়ারি আমি সেটি শেখ মুজিবের হাতে দিলাম এবং তিনি সেটি নিজের কাছে রাখলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ওই খসড়াটি প্রণয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন। যদি স্বাধীনতা ঘােষণার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, সেক্ষেত্রে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়ােজনীয় কর্মপরিকল্পনার রূপরেখাও তিনি প্রস্তুত করেন। ওই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলাে ছিল—রাজপথে লাখ লাখ মানুষ নামিয়ে দিয়ে প্রধান শহরগুলােতে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু, সামরিক বাহিনীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলে বেতারকেন্দ্র, সচিবালয় ও গভর্নর হাউজ দখল এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গভর্নরের কাছ থেকে ঘােষণা আদায় ইত্যাদি।’ (সাক্ষাঙ্কার, কামাল হােসেন)।  বস্তুত ২৫ মার্চ কালােরাতের গণহত্যা আকস্মিক এবং বর্বরােচিত বটে, তবে ছয় দফাকেন্দ্রিক দাবি—যা প্রকারান্তরে ‘স্বাধীনতার কড়চা, এতে অনড় থাকলে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা আওয়ামী নেতাদের মাঝে সততই কাজ করেছিল। তাই স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ানাে, স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এমন উদাত্ত আহ্বান—বিষয়গুলাে হঠাৎ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ঘটে যায়নি, পূর্ব পরিকল্পনামাফিক ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে। শেখ মুজিব এবং তার সঙ্গীরা বারবার বৈঠকে বসেছেন, ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, বিশ্বজনমতকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য পাকিস্তান কর্তৃক সেনা আঘাতের প্রতীক্ষা করেছেন। আওয়ামী-নেতৃবৃন্দের নিপুণ কূটনীতি ফলদায়ক হলাে একসময়। তাঁদের গায়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা আঁটা গেল না, বরং বাঙালির প্রতিরােধকে ‘আত্মরক্ষার লড়াই’ হিসেবে প্রচার করার সুযােগ সৃষ্টি হয়ে গেল। বিশ্বদরবারে ধারণা দেয়া গেল—পাকবাহিনীর বর্বর আক্রমণে রক্তাক্ত হওয়ার পরই কেবল স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হয়েছে।
যে কথাটি বলতে মানা
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছিলেন, তােমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে।’ ১৪ মার্চ তিনি সামরিক বাহিনীকে প্রতিরােধ গড়ে তােলার কথা বলেছিলেন। ১৮ মার্চ সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহ্বান বা নির্দেশে সাধারণ জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছিল, সশস্ত্রবাহিনীর অফিসারগণ সেভাবে সাড়া দেননি। সােয়াত থেকে অস্ত্র খালাসের সময় সাধারণ জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু চট্টগ্রামে কর্মরত লে. কর্নেল এম এ চৌধুরী, দ্বিতীয় বেঙ্গলের কমান্ডার লে. কর্নেল সামছুল হাসান, কর্নেল কাজী রফিকউদ্দীন, যশােরের লে. কর্নেল এম এ হাই, ক্যাপ্টেন আবুল কালাম, ক্যাপ্টেন হাসমত উল্লাহ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মেজর মওলা, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন—তাঁরা কেউই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আলােড়িত হননি। রাজারবাগের ইপিআর বাহিনী যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরী তাদেরকে নীরব থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথম পর্যায়ে নিস্ক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন, এঁদের মধ্যে অনেকেই পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যােগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, আবার কেউ কেউ পাকিদের বশ্যতা স্বীকার করার পরও ওদের দ্বারা নিহত হয়েছেন, কেউ-বা ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সেবাদাস হিসেবে স্বজাতি নিধনে শােচনীয় ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ৪০ হাজার বাঙালি পুলিশ, ২০ হাজার ইপিআর, ১০ হাজার ইবিআর যদি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সময়ােপযােগী কার্যকর নির্দেশ পেত, তাহলে ২৫ মার্চের রাতেই পাকবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরােধের সম্মুখীন হতাে এবং তাতে একরাতে এমন অভাবনীয় গণহত্যা কিছুটা হলেও কম হতাে। (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, পৃ. ১৫৭-১৫৮)। 
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রতিরােধ গড়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য “১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাব’ লুট করা হয়েছিল। ২ মার্চ বায়তুল মােকাররম ও নিউমার্কেটের বন্দুকের দোকান থেকে অস্ত্র ছিনতাই হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর অস্ত্র দোকান লুট হয়। ৬ মার্চ বিজ্ঞান গবেষণাগারের বিস্ফোরক, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের ট্রেনিং ক্লাবের রাইফেল, রাজশাহীর সকল অস্ত্রের দোকান, ১৬ মার্চ নাটোরের মহারাজ হাইস্কুলের রাসায়নিক দ্রব্য। লুট করে স্বাধীনতাকামীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছিল (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, ৭ম খণ্ড পৃ. ৪১৮)। জয়দেবপুরেও দেখতে পাই সাধারণ সৈনিক এবং জনতার সাহসী প্রতিরােধচিত্র। ২৫ মার্চের কালােরাতে, পাকবাহিনী কর্তৃক বর্বরােচিত আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত, আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে কেউ-বা ইট টানছেন, কেউ-বা বিরাট বিরাট গাছ কেটে আনছেন—কেউ-বা পাশের মােটর মেরামত কারখানার সামনে ফেলে রাখা পুরনাে ভাঙা গাড়িগুলাে এনে রাস্তায় জড়াে করছেন—সবারই মুখে এক কথা-ব্যারিকেড তৈরি করাে, ওদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করাে।… হায়েনাদের একটি কনভয় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে দৈনিক পাকিস্তান (বর্তমানে দৈনিক বাংলা) অফিসের সামনে, কনভয়ের সামনে বিরাট ব্যারিকেড। ওরা ডিঙ্গাতে পারছিল না তখন—তাই গুলি খাওয়া শুয়ােরের মতাে ঘোঁৎ ঘোৎ করছে কনভয়ের বিরাট গাড়িগুলাে (নাজিমুদ্দীন মানিকের লেখা থেকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩২৪)। বস্তুত তখন ‘স্বাধীনতা বিষয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-অনুভূতি কাজ করছিল, এর ছিটেফোঁটাও ছিল না অধিকাংশ বাঙালি সেনাকর্মকর্তার মনে।
এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সেনানায়ক শাফায়াত জামিলের বিশ্লেষণী ভাষ্য এরকম, মুক্তিযুদ্ধের প্রথমপর্বে (২৫ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত) সেনাবাহিনীতে চাকরিরত মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন অফিসার সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে যােগদান করেন। পুরাে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানে কমিশনপ্রাপ্ত বাঙালী অফিসার বলতে ছিলেন এরাই। তখন বেশিরভাগ বাঙালী অফিসারেরই পােস্টিং ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলাদেশে কর্মরত এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটি বা বিভিন্ন উপলক্ষে এদেশে এসেছে, আবার চলে গেছেন এমন অফিসারের মােট সংখ্যা দেড়শ’র মতাে ছিল। অর্থাৎ দেড় শ’ অফিসারেরই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সুযােগ ছিল। অথচ যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন উল্লিখিত ২৫/৩০ জন। এদিক দিয়ে অফিসারদের তুলনায় সাধারণ সৈন্যদের ভিতরেই সংগ্রামী চেতনা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এ চেতনা ও দূরদৃষ্টির অভাবেই বহু বাঙালী অফিসার অসহায়ভাবে বন্দী ও পরবর্তীকালে নিহত হন’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পৃ. ২০)।
এ এস এম সামছুল আরেফিনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান গ্রন্থের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সেনা ইউনিটে কর্মরত ছিলেন বা ছুটি ভােগ করছিলেন দেড় শতাধিক সামরিক কর্মকর্তা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মেজর’ পদবিধারী এবং ইচ্ছে করলেই তারা যােগ দিতে পারতেন ‘মুক্তি সংগ্রামে। বেশ ক’জন বাঙালি অফিসার পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যােগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, অথচ শীর্ষভাগ বাঙালি অফিসার স্বদেশে বসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ না দিয়ে স্বজাতির নিধনযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন, বা স্বজাতি বিনাশের চিত্র দেখার পরও চাকরির মায়ায় ফিরে গেছেন পাকিস্তানে, কেউ-বা স্বজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্রচালনাও করেছেন (প্রখ্যাত শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ভাই মেজর কাইয়ুম চৌধুরী—মুক্তিযুদ্ধকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সুযােগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই যুদ্ধে যােগ না দিয়ে স্বজাতি নিধনে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন)।  যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির আনুপাতিক হার বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে, যে কোনাে পেশাজীবীর তুলনায় সেনাকর্মকর্তারাই বেশি পরিমাণে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে, যখন পাকসেনাদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন বেশ ক’জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তান-পক্ষ ত্যাগ করে যােগ দিয়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে। এ অংশের বেশিরভাগ কর্মকর্তা, চাকরি ছেড়ে নিছক দেশের টানে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এসব অফিসারের স্বাধীনতা-উত্তর সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রিয় পাকিস্তান ছেড়ে তারা এখানে এসেছিলেন—যুদ্ধ করতে নয়, এসেছিলেন। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও আইএসআই কর্তৃক প্রদত্ত অন্য এজেন্ডা বাস্তবায়নের নিমিত্তে।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র