বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩১শে মার্চ, রোববার, ১৯৭৪, ১৭ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সমাজবিরোধী অপরাধের শাস্তি প্রসঙ্গে
যে মুহূর্তে দেশে নানা রকমের অন্যায়, অনাচার আর দুর্নীতির অন্ত নেই; অসৎ ব্যবসায়ী, মওজুতদার, অতিমুনাফাখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানী ও অন্যান্য সমাজবিরোধী অশুভ শক্তির দুঃসহ দৌরাত্ম্যে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস, আর যে মুহূর্তে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের বলগাহীন ঘোড়ার লাগাম টেনে রাখতে সরকার ও জনসাধারণ বলতে গেলে একেবারে হতাশ ও দিশেহারা, সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান জাতিকে একটি মূল্যবান কথা শুনিয়েছেন। তিনি আবেগ বিজড়িত কন্ঠে বলেন যে, যে ক্ষেত্রে একটি লোককে হত্যা করার দরুণ আইন অপরাধীর জন্য মৃত্যুদন্ডেরও অনুমোদন আছে, সে ক্ষেত্রে, যে সব অসাধু ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর, মওজুতদার ও অন্যান্য সমাজবিরোধীরা দেশের কোটি কোটি মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যাচ্চে তাদের জন্যেও আইনে মৃত্যুদন্ডের মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির একান্ত বিধান থাকা উচিত। উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় উপলক্ষে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি গত পরশু ভাষণ দিতে গিয়েই এ কথা বলেন।
আমরাও বহুদিন ‘বাংলার বাণী’র সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে বার বার ঠিক একই সুরে বলে এসেছি যে যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের দৃষষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আর এ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কি তা’ দেশের মানুষ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই বিচার করবেন। এজন্যে প্রয়োজন পড়লে দেশের পুরনো আইনকে রহিত বা বদল করে নতুনভাবে ঢালাও করতেও আমরা প্রস্তাব দিয়েছি অবশ্য। আমাদের এতো চিৎকার এতো লেখালেখি কতটুকু কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়েছে বা বাস্তবে কতটুকু কার্যকরী ব্যবস্থা আনতে সক্ষম হয়েছে, তা’ এখনো আমরা নিশ্চয় করে বলতে পারিনা। তবে খুব একটা সুফল যে পাওয়া যায়নি সেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে একটু বিচার করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
মাঝে মাঝে অপরাধী ধরার খবর আমরা পাচ্ছি ঠিকই তবে ধরার পর তাকে কিভাবে শাস্তি দেয়া হলো কিম্বা তাকে ধরার ফলে বাজারে কি শুভ প্রতিক্রিয়াই বা পরিলক্ষিত হলো, তা’ কিছুতেই বোঝার উপায় নেই। কারণ, দুঃসহ বাজারের করুণাবস্থা দিন দিন শুধু করুণতম হয়েই ঘণীভূত হচ্ছে। সুতরাং, অপরাধীকে ধরেই বাকি আসল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হচ্ছে, তা কেউই বলতে পারবেন না। দোষের বোঝা কারো নেই। অপরাধী ধরলেও অজুহাতের বা যুক্তি দিয়ে বেরিয়ে যাবার কম সুযোগ নেই। ধরলেও বিপদম না ধরলেও বিপদ। সব মিলিয়ে এক উভয়-সংকটের মাথা খারাপ করা অবস্থা।
জিনিসপত্রের আগুন দামে মানুষ আজ হতাশ, দিশেহারা। ভবিষ্যতের ভাবনায় ব্যাকুল। আজ সে কিছু করতে যাবার সাহসও হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি কর্তৃপক্ষের আশার বাণীটুকুও তার কাণে বিষের মতো ঠেকছে। দেদার দাম বাড়ছে, বাড়লে কমার কথা নেই। দেদার ঘুষ চলছে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। দেদার ধর-পাকড় হচ্ছে। কিন্তু ধরেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এ সব বিষয় থেকে শুধু একটা কথাই সুস্পষ্ট যে, আমরা মুখে যতই দাবী করি না কেন, নিশ্চয়ই সরকারী ব্যবস্থায়, আইনে, উদ্যোগে ও কঠোরতায় গলদ আছে। নিশ্চয়ই জনসাধারণের মধ্যে একযোগে মিলিত হয়ে সমস্যা প্রতিরোধের উপযুক্ত সংগঠনের অভাব আছে, নিশ্চয়ই দেশ ও সমাজবিরোধীদের পেছনে প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ আছে এবং অজস্র গোপন পালাবার পথ আছে, তা’ না হলে এমনটি কখনোই হতোনা। সুতরাং ব্যাপকভাবে নতুন বিশেষ বিশেষ আইনের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে। তা-না হলে সবই শুধু অরণ্যেই কাঁদাকাটি হবে।
প্রসঙ্গতঃ গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত গম চুরির ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সংবাদ প্রকাশ, গত ফেব্রুয়ারী মাসের ২৭-২৮ তারিখে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে খুলনা থেকে মোট ১১টি ওয়াগনে খাদ্য বিভাগ ৬১৯৮ মণ গম পাঠান। কিন্তু মালগুলো সিরাজগঞ্জে পৌঁছালে প্রায় ৬৮০ মণ ১৫ সের গম কম পাওয়া যায়। কে নিলো কেউ জানেনা।
আলোচ্য সিরাজগঞ্জ ঘটনা সম্পর্কেও বলা যায় যে, এটা কোনো গায়েবী আলামত নয়, রীতিমতো সুপরিচিত ব্যক্তিদের সুপরিকল্পিত উপায়ে গম চুরি। আর সম্ভবতঃ এজন্যে একদিনের পথে ২২ দিন লেগেছে। কারণ, বিভিন্ন সাবধানতা ও উপযুক্ত মওকা নিয়েই এই কুকাজ করা হয়েছে। আর এদের পেছনে রেল ও খাদ্য বিভাগের অসাধু কর্মচারী ও শ্রমিকরা কন্ট্রাক্টর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। ব্যাপক তদন্ত চালালে সব মাছই ধরা পড়বে। বিশেষ করে খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত মাল বুক করা বা পৌঁছুনো পর্যন্ত ওয়াগনগুলোতে মাললোডিং বা আনলোডিং-এর সময়ে রেল বা খাদ্য বিভাগের কোন্ কোন্ শ্রমিক বা কর্মচারী কে কোথায় কতক্ষণ কিভাবে ছিল, পথে ওয়াগনগুলো কোথায় কতদিন কতক্ষণ কিভাবে কার তত্ত্বাবধানে ছিল, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সত্যিকারের চোর ধরার উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে তদন্ত চালালে সব চোরই ধরা পড়েব বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু কোল টেনে চোর ধরলে, আর দশটা তদন্তের মতো এটাও ভেস্তে যাবে।
সুতরাং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহেবের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই যে, দেশের বিভিন্ন কালোবাজারী, মওজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানী ও অন্যান্য বিষধর সমাজবিরোধী অশুভ শক্তিকে নির্মূল করতে অপরাধীকে নিশ্চিতভাবেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এবং এক্ষেত্রে আমরা কতটুকু যোগ্যতা দেখাতে পারলাম কি না পারলাম তার উপরই নির্ভর করছে আমাদের আগামী ভালো-মন্দ বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিম্বা অভিশপ্ত জীবন।
কাগজ নিয়ে কালোবাজারী
চাল-ডাল তেল নুন এবং শিশু খাদ্যের মতো অবশেষে কাগজের বাজারও গরম হয়ে উঠেছে। সরকারীভাবে কাগজের দাম শতকরা ৬৫ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। একদিকে কাগজের দাম বাড়ানো হয়েছে, অপরদিকে বাজার থেকে কাগজ উধাও হয়ে যাচ্ছে। কাগজের বাজারে দেখা দিয়েছে চরম আকাল।
নানান অনিবার্য কারণে সরকার না হয় কাগজের দাম বাড়িয়েই দিলেন। কিন্তু বাজার থেকে রাতারাতি কাগজের কারবার গুটিয়ে ফেলা হবে, এটা কি কেউ কল্পনা করতে পারেন? অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাগজ বিকিকিনির হাটেও দেখা দিয়েছে মারাত্মক সংকট। কাগজ সংকট বর্তমানে এমনই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, বাজারে এখন কাগজের টিকিটিও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজ একেবারে ভেল্কিবাজীর মতো লাপাত্তা।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, সভ্য জগতে কাগজের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাগজ জ্ঞান বিকাশের মাধ্যমগুলোর অন্যতম বাহন। কাগজ ছাড়া বই ছাপানো যায় না। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্যেও কাগজ একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। এ ছাড়া অফিস আদালতও কাগজ ছাড়া অচল। দাউদ কর্পোরেশন ইসলামপুরে একটি ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়ের জন্য কাগজের দোকান খুলেছে। স্কুল কলেজে ব্যবহারের জন্য কাগজের কোনো রকম সংকট যাতে দেখা না দেয় সেজন্যেই এই ন্যায্যমূল্যের কাগজের দোকানটি চালু করার প্রধানতম উদ্দেশ্য। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, অন্যান্য ন্যায্যমূল্যের দোকানের মতো কাগজের ন্যায্যমূল্যের দোকানটিতেও দুর্নীতি ও কারচুপি জাঁকিয়ে বসেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অভিযোগানুযায়ী জানা যাচ্ছে যে, ন্যায্যমূল্যে কাগজ বিক্রি প্রথা চালু করাতে কোনো ক্ষেত্রে সুফল ফললেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীত ফল পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ ন্যায্যমূল্যের কাগজের এই দোকানটি থেকে নাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠান এবং ভুয়া স্কুল-কলেজের নামে বিপুল পরিমাণ কাগজ তুলে নেয়া হচ্ছে। এবং তা যথারীতি কালোবাজারে বিক্রি করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ‘টুপাইস’ কামিয়ে নিচ্ছে। স্কুল-কলেজের নাম ভাঙিয়ে ভুয়া লাইসেন্স শিকারীরা এখন কাগজের বাজারে হানা দিয়েছে। ফলে, স্বাভাবিক কারণেই, বাজারে কাগজের ‘শ্রামুখ’ দেখা যাচ্ছে না। বরং কাগজের বাজারে সৃষ্টি হয়েছে এক ব্যাপক সংকট। অভিযোগে প্রকাশ, প্রকৃত কাগজের দোকানদাররা কর্ণফুলী কাগজের মিল থেকে কাগজ সংগ্রহের কোটা পায়নি। কোটা যারা পেয়েছে তারা প্রকৃত কাগজ ব্যবসায়ী নয়। অর্থাৎ অন্যান্য ব্যবসায়ের ব্যাপারে যে সীমাহীন দুর্নীতির ছড়াছড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। কাগজ ব্যবসায় ক্ষেত্রেও সেই একই ভানুমতির খেল দিন দিন প্রকটতর হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় বাজারে কাগজ সংকট দেখা দেয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ভুয়া ব্যবসায়ীরা এইভাবে আর কতদিন লাইসেন্স শিকারে মত্ত থাকবেন আমরা জানি না। তবে কাগজের বাজারে সুস্থ আবহাওয়া গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কালবিলম্ব না করে যথাযোগ্য ব্যবস্থাবলম্বন করা অবশ্য কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। পাকশী কাগজের কল বন্ধ হয়ে গেছে। অচিরেই আবার কোন্ দিন কোন্ কাগজের কল বন্ধ হয়ে যায় তাও আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। কাগজের মূল্য যে হারে বেড়েছে, তাতেও আমরা আশংকিত হয়ে উঠছি। কিন্তু কাগজের দামের চেয়ে এখন আমাদের আশংকা কাগজ না পাওয়া নিয়ে। বাংলা নববর্ষ সমাগত প্রায়। হাল খাতার জন্য কাগজ প্রয়োজন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন থেকেই কাগজের অন্বেষণ করতে শুরু করেছে। কিন্তু ঢাকার বাজারে জাবদা খাতা তৈরীর কাগজ আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীরাও কাগজ সংকটের ফলে অনিবার্যভাবে বিরাট সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এই অবস্থায় কাগজের ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করাটাই যথেষ্ট হবে না। কাগজ যাতে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা সম্ভব হয়, সেদিকেও তীক্ষ্ম নজর রাখা দরকার।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক