You dont have javascript enabled! Please enable it!
স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গ
 
তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ প্রমুখ নেতার। | সাথে বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এর ওয়্যারলেসযােগে বাংলাদেশের | স্বাধীনতাসম্পর্কিত একটি বার্তা চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। এ বার্তাটি ছিল নিমরূপ : “This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. You fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ০১)। তবে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট পেইন, ড. মযহারুল ইসলাম (শেখ | মুজিব’, পৃ. ৮০৮-০৯) ও অনেকেই মতপােষণ করেন, ওই ওয়ারলেস বার্তাটি প্রেরণের আগে রাত ১২.২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রথম ঘােষণাটি দিয়েছিলেন, যা ছিল পূর্ব রেকর্ডকৃত : “Pak army suddenly attacked EPR base at Pilkhana, Rajarbag police line and killing citizens… I appeal and order you all in the name of almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country.” (ম্যাসাকার : রবার্ট পেইন, পৃ. ১৬)। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা, (যেটি ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছিল) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্রচারিত হয় চট্টগ্রাম থেকে।
সেখানকার আগ্রাবাদের রেডিও অফিস নিরাপদ নয় বিধায়, ২৬ মার্চ সেটি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল কালুরঘাটে। ওইদিনই কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র (পরে এর নামকরণ করা হয়েছিল বিপ্লবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র) থেকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণা বারবার পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও আবুল কাশেম। পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ, বেলাল মােহাম্মদ, এ কে খান (পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী) প্রমুখের সহায়তায় সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান ওই বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। এ সম্পর্কে গােলাম মুরশিদ তার মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বেলাল মােহাম্মদের দেওয়া এক খণ্ড কাগজে তিনি (জিয়া) ইংরেজিতে ঘােষণাটি লিখে তারপর বেতারে পড়েছিলেন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে। এটির অনুবাদ করেন বেলাল মােহাম্মদ নিজে, আর এর ভাষা ঠিক করে দেন নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমেদ। জিয়া প্রথমে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে লিখলেও, পরে অন্যদের পরামর্শে “জাতির সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা দিচ্ছেন বলে সংশােধন করেন (পৃ. ৮৮)। তবে কেউ কেউ—যেমন মিজানুর রহমান খান বলেছেন, জিয়া প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবেই উপস্থাপন করেছিলেন। মিজান লিখেছেন, ‘তাঁর স্বাধীনতার ঘােষণা বােধগম্য। কিন্তু তাঁর নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণার গ্রহণযােগ্য ব্যাখ্যা মেলে না।’ (উপসম্পাদকীয়, প্রথম আলাে, ০৪, ০৮, ‘১৩)।
জিয়ার ঘােষণাটিতে প্রকৃতপক্ষে কী কথা ছিল, এটা খােলাসা করে বলা খুবই কঠিন বিষয়। কারণ, স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের দোহাই দিয়ে জিয়ার একই ভাষণ ভিন্ন ভিন্ন লেখক ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। সিরাজ উদ্দীন আহমেদের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থের ১৪৯ পৃষ্ঠায় ভাষণটি উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে “I Major Zia, provisional commander in chief of the Bangladesh Liberation Army hereby proclaim on behalf of our great leader the supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman the independence of Bangladesh.” (তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খণ্ড)। আবার মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ও রাজনীতি’ গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় উপরিউক্ত ভাষণের শুরুর অংশটা ঠিক থাকলেও বাদ পড়েছে ‘our great leader the supreme commander of Bangladesh’ অংশটি। এর পরে আছে, I also declare, we have already framed a sovereign, legal Government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of nonalignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all Governments to mobilige public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh. The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world.
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র : তৃতীয় খণ্ডে (পৃ. ২)-এ। দেখতে পাই ভাষণের শুরুতে ‘I’ নেই, আর বাকি সবটুকু মুজিবুর রহমান। কর্তৃক উদ্ধৃতাংশের অনুরূপ। ওইসব ‘উদ্ধৃত ভাষণের প্রারম্ভে মেজর জিয়ার নাম আছে, কিন্তু একাধিক বিখ্যাত লেখকের বইয়ে দেখতে পাই ভাষণের শুরুতে জিয়ার নাম নেই (এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি, পৃ. ১৬; মুসা সাদিকের মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’, পৃ. ৩০), ভাষণটির শুরু দেখানাে হয়েছে এভাবে, “The Government of the sovereign state of Bangladesh on behalf of our Great Leader, the Sumreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, we hereby proclaim the independence of Bangladesh. And that the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of seventy five million people of Bangladesh, and the Government headed by him is the only legitimate goernment of the people of the independence Sovereign State of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed, and is worthy of being recognised by all the governments of the world. I therefore, appeal on behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the world, specially the big powers and the neighbouring countries to recognise the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the aweful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. To dub out the legaly elected representative of the majority of the people’s as sessesanist is a crude joke and contradiction to truth which should be fool none. The guiding principle of a new state will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla.
আবার ইনাম আহমদ চৌধুরীর ‘চিরঞ্জীব জিয়া’ গ্রন্থে (পৃ. ৬১) শেখ মুজিব প্রদত্ত স্বাধীনতা ঘােষণার কোনাে উল্লেখ নেই। আর স্বাধীনতা সম্পর্কিত মেজর জিয়ার ঘােষণাটিকে চাতুর্যের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি।… আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করছি। আপনারা দুশমনদের প্রতিহত করুন। দলে দলে এসে যােগ দিন স্বাধীনতা যুদ্ধে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশের উদ্দেশে আমাদের আহ্বান, আমাদের ন্যায়যুদ্ধে সমর্থন দিন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। ইনশা আল্লাহ বিজয় আমাদের অবধারিত।’  [বি. দ্র. : জনাব চৌধুরী জিয়া প্রদত্ত ভাষণের একটা বাক্য উদ্ধৃত করে অনেকটুকু জায়গা শূন্য রেখেছেন, এর কারণটা আমরা বুঝিকেননা এই অংশে শেখ মুজিবের নাম আছে, মুজিব নামটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চৌধুরীর মতাে সুশিক্ষিত, মার্জিত ব্যক্তিও ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছেন; (হায়, আমাদের বিদ্বান, জ্ঞানী-গুণী লােকজন), তবে জিয়ার ওই ভাষণে ব্রিটেন, ফ্রান্স… এ-সব দেশের প্রতি সহায়তা দানের আহ্বান প্রসঙ্গটি কোন সূত্র থেকে এনে জুড়ে দিলেন চৌধুরী? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : তৃতীয় খণ্ডের ৩ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে যে, জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানিয়ে জিয়া আলাদা একটি ভাষণ তৈরি করেছিলেন ৩০ মার্চ (যদিও জিয়ার স্বহস্তলিখিত আবেদনপত্রের অনুলিপিতে তারিখ উল্লিখিত হয়েছে ৩১ মার্চ), যেটা সাহায্যের আবেদনপত্র, স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র নয় মােটেই, অথচ সেই অংশ থেকে কিছুটা ছেটে, জিয়ার মূল ভাষণের সাথে যুক্ত করে দিলেন জনাব চৌধুরী? এটা কি তার অজ্ঞতা, নাকি চতুরতা? আমাদের আলাে-আঁধারিমাখা ইতিহাসে মাঝেমধ্যেই তথ্য-বিকৃতি দেখা যায়, লেখককুলের দৃষ্টিভঙ্গিজাত তীব্র মতান্তরও দেখা যায়। কিন্তু স্বাধীনতাসম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, একই ব্যক্তির একই ভাষণ-(যা সংগ্রহ করা খুব দুরূহ ব্যাপার নয়) আগাগােড়া ভিন্নরূপে উপস্থাপন করে প্রত্যেকটিকে ‘ইতিহাসনির্ভর’ দাবি করা—এটা বােধহয় আমাদের জাতিগত প্রতিবন্ধিত্ব ও হীনম্মন্যতাকেই স্পষ্ট করে তােলে। 
বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘােষণা’ শীর্ষক একটা বার্তা যে প্রেরণ করেছিলেন—এর প্রমাণ মেলে দেশি-বিদেশি অনেকের লেখায়। এমন কি জেনারেল টিক্কা খানের জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের লেখাতেও, When the first shot had been fired the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through an wave length close to that of official Pakistan Radio. In what must have been and sounded like a pre-recorded message. The Sheikh proclaimed East Pakistan to the People’s Republic of Bangladesh. [পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংথের) কাছাকাছি একটা তরঙ্গ থেকেও ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবের এই ঘােষণা ক্ষীণকণ্ঠে ভেসে উঠেছিল) (নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, ভাষান্তর : মাসুদুল হক, পৃ. ৮৫]। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা’ প্রসঙ্গটি আমেরিকার ডিফেন্স ইনটিলিজেন্স এজেন্সি’র ২৬ মার্চের রিপাের্টে উল্লিখিত হয়েছে এভাবে, Pakistan was thrust into Civil war today when Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the east wing of the two-part country to be the sovereign independent People’s Republic of Bangladesh.’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : সিরাজ উদ্দীন আহমেদের বই থেকে সংগৃহীত, পৃ ১১৮)। আমেরিকার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ উলপাটের লেখায় আছে, “For most of the world, however, the genocidal massacre unleashed by Pakistani force on 26 March 1971 was much louder and more memorable proclamation of the independence of Bangladesh than any proclamation to that effect that Mujib might have made on the radio. (Zulfi Bhutto of Pakistan- Staney Wolpart, page. 155). এ রকম অন্য আরেকটা তথ্য পাই পাকিস্তান সরকার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত এক শ্বেতপত্রে, “২৫ মার্চ দিনগত রাতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র’-এর অভ্যুত্থান বাস্তবায়ন করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান।” (পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে শ্বেতপত্র, ০৬ আগস্ট, ১৯৭১, পৃ. ৪০)।
 [বি. দ্র. : উপযুক্ত ভাষ্যাদি-তথ্য-উদ্ধৃতির আলােকে বলা যায় যে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু কোনাে বিষয়ে মীমাংসায় পৌছা—এটা তাে সম্ভব নয় ‘সব সম্ভবের দেশ’ বাংলাদেশে। অনেকের অভিমত, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে শেখ মুজিব স্বাধীনতাসংক্রান্ত কোনাে ঘােষণা দেননি। প্রথম ঘােষণা দিয়েছেন মেজর জিয়াউর রহমান, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে, ২৭ মার্চ তারিখে। এমন অভিমত পােষণকারীদের একজন জনাব মাসুদুল হক, তিনি তার বক্তব্যের সপক্ষে উপস্থাপন করেছেন ১১ এপ্রিল ‘৭১ তারিখে প্রদত্ত তাজউদ্দীন আহমদের বেতারভাষণ, (বাঙালি হত্যা ও পাকিস্তানের ভাঙ্গন, পৃ. ১৭৩) যা স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র তৈরি হওয়ার পর প্রচারিত হয়েছিল, ভাষণে বলা হয়েছিল, ‘…গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে, যা মেজর জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে প্রথম ঘােষিত হয়…’। একজন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক হিসেবে মাসুদুলের অবশ্যই জানা থাকার কথা যে, এই ভাষণটি যদিও প্রচারিত হয়েছিল ১১ এপ্রিলে, তবে সেটি রেকর্ড করা হয়েছিল দিল্লিতে, ৭ এপ্রিলের আগেই, রেহমান সােবহান ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সহায়তায়। ব্যাপারটা কি এমন হতে পারে না যে, ভাষণ প্রণেতারা যেহেতু জানতেন যে শেখ মুজিব ইতােমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বন্দি হয়েছেন পাকিস্তানিদের হাতে, তাই স্বাধীনতার ঘােষণার সাথে তাকে সংশ্লিষ্ট করা উচিত হবে না, এটা করলে মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগটি আরাে শক্ত ভিতের ওপর। দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এরপর নভেম্বরে আমেরিকা সফরকালীন ইন্দিরার বক্তব্য ‘স্বাধীনতার ডাক উচ্চকিত হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের পরই, তার আগে নয়। আমার জ্ঞানমতে, এমনকি এখন পর্যন্ত তিনি নিজে স্বাধীনতার কথা বলেননি। উদ্ধৃত করে মাসুদুল বলেছেন, শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘােষণা করতেনই, তাহলে তা ইন্দিরার বক্তব্যে উপস্থাপিত হতাে না? বস্তুত মাসুদুলের জানা প্রয়ােজন, যে দেশটি ইন্দিরা সফর করতে গিয়েছেন, সে দেশটি দৃঢ়ভাবে অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।

কাজেই তাদের কাছে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘােষণাকারী, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে তার অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলতাে(স্মর্তব্য যে, ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যােশফ ফারল্যান্ড শেখ মুজিবকে সরাসরি বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে কিছুতেই সমর্থন জানাবে না) সে রকমটি বললে সেটি হতাে মুজিবের জন্য খুবই ক্ষতিকর দিক। এরপর মাসুদুল বলেছেন, (পৃ. ১৭৫) যােশেফ ফারল্যান্ডকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব কোথাও বলেননি, তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। বস্তুত সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে যােশেফ ফারল্যান্ড স্বাধীনতা-ঘােষণা সংক্রান্ত কোনাে প্রশ্নই করেননি, তাহলে এ প্রসঙ্গে আগবাড়িয়ে কোনাে কথা বলা কি শােভনীয় হতাে? আমরা মনে করি, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন এ-সম্পর্কিত তথ্যাদিকে অগ্রণযােগ্য প্রমাণ করতে গিয়ে জনাব মাসুদুল যে সকল প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন, তা খুবই দুর্বল, ভিত্তিবর্জিত। তবে জিয়া ও তার স্বাধীনতা-ঘােষণা সম্পর্কে মাসুদুলের আবেগদীপ্ত কথাগুলাের সাথে আমরা একমত পােষণ করি, সময় তাকে ইতিহাসের বরপুত্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে দেয়। কেননা, তার ওই ঘােষণা তৈমুরীয় পশুশক্তি তাড়িত অসাড় প্রাণে জ্যান্ত মানুষের হৃদস্পন্দন জাগিয়ে তােলে। প্রতিরােধে ঘুরে দাঁড়ানাের দুর্দমনীয় সাহসের সঞ্চার করে। এখানে—এখানে জিয়া একদমই পৃথক সত্তায় চিরঞ্জীবী হয়ে যান ইতিহাসে।… এ ঘােষণায় ইতিহাসের সাহসী সন্তানদের তালিকায় তার নাম এসে যায় বটে, তবে ইতিহাসের সিংহ দরােজা আমাদের জন্যে খুলে যায় মুজিবেরই নামে। মুজিবের নামেই পরিচালিত হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ।’ (পৃ- ১৮০)। | ২৫ মার্চ রাত একটার পরপরই লে. কর্নেল জহির আলম খানের নেতৃত্বে বিশেষ সার্ভিস গ্রুপের এক প্লাটুন কমান্ডাে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাড়িটি ঘিরে ফেলে, প্রবেশপথের পাহারাদারদের খতম করে এবং তাদের আগমনবার্তা জানান দেয়ার জন্য মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। শেখ মুজিব একটা ছােট্ট ব্যাগ হাতে নিয়ে পাইপ টানতে টানতে নির্ভীকচিত্তে বেরিয়ে এলেন। তাকে বন্দি করে প্রথমে ক্যান্টনমেন্টে, পরে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলাে আদমজী স্কুলে।

সেনা-বেতার মারফত ঘােষণা করা হলাে, ‘বড় পাখিটিকে খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে।  তর্কপ্রবণ ও ছিদ্রান্বেষী অনেকেই প্রশ্ন তােলেন, অন্য নেতৃবৃন্দকে আত্মগােপন করার পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজে কেন আত্মগােপন করা থেকে বিরত রইলেন? তাঁর এমন সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী? এ ব্যাপারে নানা মুনি নানা মত পােষণ করেছেন, এটাকে কেউ বলছেন কৌশল, কেউ বলছেন ‘আত্মসমর্পণ (অন্যদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে ধরা দিলেন শত্রুর হাতে, যেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো নিয়ন্ত্রিত সেনাখাচা খুব নিরাপদ স্থান)। পাকবাহিনীর কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বেচ্ছাবন্দিত্ব সম্পর্কে দুটো নির্মোহ মত উল্লেখ করতে পারি, ‘মুজিব বিপ্লবী রাজনীতি করেননি, বরং চিরদিন সাংবিধানিক রাজনীতি করেছেন।… ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সত্যিকার নির্ভীক এবং আপসহীন। এর আগে বহুবার গ্রেপ্তারবরণ করেছেন।… গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি কোনােদিন আত্মগােপন করেননি।… পালানাের মতাে মনােবৃত্তি তার ছিল না’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর : গােলাম মুরশিদ, পৃ. ৭৮)। এ সম্পর্কে খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস লেখেছেন, “২৫ মার্চের কালরাত্রি। রাত সাড়ে আটটা-নয়টা নাগাদ। বৈঠকখানা ঘরে… বঙ্গবন্ধু পাশের রুমে এক-একজন নেতাকে ডেকে নিচ্ছেন এবং কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলে বিদায় দিচ্ছেন। আমার যখন ডাক পড়ল, তিনি বললেন, যদি পাকবাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণ করেই বসে, তবে আমি নির্দেশ পাঠিয়েছি স্বাধীনতা ঘােষণা করার জন্য।…আমি যদি দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যাই, তবে ঢাকা শহরসহ সমগ্র বাংলাদেশ নরপশুরা একেবারে ধ্বংস করে ছাড়বে।
আমি তা সহ্য করতে পারব না, তার চেয়ে মৃত্যুই আমার শ্রেয়’ (মুজিববাদ, পৃ. ৫৭৭)। এ ব্যাপারে শেখ মুজিবের ভাষ্যটাও শুনে নিতে পারি, যা তিনি ভুট্টোকে বলেছিলেন ২০ ডিসেম্বর, ‘৭১এ ‘আমি বাড়িতেই ছিলাম। যা ঘটছিল, তার সবই জানতে পাচ্ছিলাম কিন্তু আমি পালাইনি।… আমার সন্দেহ ছিল না যে, ইয়াহিয়া আমাকে গ্রেপ্তার করতে চাইছেন… আমার গ্রেপ্তারের পূর্বে সকল রাজনৈতিক নেতাদের আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি। আমি গ্রেপ্তারবরণ করব, কেননা এটা আমার দেশ (স্ট্যানলি উলপার্ট : জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, পৃ. ১৭১)।  (বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণা বা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ—এ-বিষয়ে আরাে ক’টি মতামত : সুবিখ্যাত ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ গ্রন্থে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, “বাঙালিদের হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য  ২৬ মার্চ বেলা প্রায় আড়াইটায় জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জনাব এম এ হান্নান পাঠ। করে শােনান।… অনুরুদ্ধ হয়ে ঐদিন বিকেলে ২৭ মার্চ তিনি (মেজর জিয়া-লেখক)… ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে উল্লেখ করলেন। সেই মুহূর্তের। মানসিক অবস্থা ও উত্তেজনায় অসাবধানতায় এই ভুল হয়ে গেল।… এরপর মেজর জিয়া এক সংশােধিত বেতার ভাষণে জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে এই ঘােষণা দেয়ার কথা উল্লেখ করলেন” (পৃ. ৮৬৯৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থে এম, ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, “চট্টগ্রামের আওয়ামী নেতা এম এ হান্নান ২৬ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা সংবলিত বাণীর বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণ প্রচার করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে এই বেতার কেন্দ্রের স্বল্পকালীন অনুষ্ঠান পুনরায় শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতার বাণীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।
সম্ভবত এটাই আমার শেষ নির্দেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।… অব্যাহত রাখতে হবে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ওই বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঘােষণায় বারবার বলা হচ্ছিল যে, মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। এর কিছুক্ষণ পর শােনা গেল, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে।’… ২৮ ও ২৯ মার্চের বিভিন্ন সময়ে বেতারে মেজর জিয়া নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দাবি করে জনগণের প্রতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে যােগ দেয়ার আহ্বান জানান।’… আবার ৩০ মার্চ সকাল ৮টার দিকে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান এবং বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা তাকে পেয়ে উফুল্ল হয়ে উঠেন। কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিড়ে ফেলেন।… প্রায় দেড় ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ (সাক্ষাৎকার : লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান)। লে. ক. (অবসরপ্রাপ্ত) অলি আহমদও বলেন, ২৭ মার্চ, বিকেল বেলা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান এ-দেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন (স্বাধীনতার ঘােষণা এবং জিয়া, দৈনিক সকালের খবর, ৩০ মে, ‘৯২)। কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আকবর হােসেনও বলেন, “ছােট্ট রেডিওটা কানে নিয়ে শুয়ে আছি, ২৭ মার্চ। হঠাৎ কানে এল—“আমি মেজর জিয়া বলছি।
মনে আশার সঞ্চার হল” (সাক্ষাৎকার, বাংলাবাজার পত্রিকা, ১১ ডিসেম্বর, ‘৯২)। অন্যদিকে সৈয়দ আবদুল আহমদ ‘কিংবদন্তীর জিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, “২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়া স্বাধীনতার ঘােষণা দেন” (দৈনিক বাংলা, ‘৯২, একই দিনে দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত অন্য একটি প্রবন্ধে একই লেখক জানিয়েছেন, ২৭ মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে জিয়া স্বাধীনতার ঘােষণা দেন’)। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায়, ১৯৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা জানান, পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন।’ প্রশ্ন হলাে, যে  জিয়াকে ঘিরে এই বিতর্কের সূচনা, তাঁর অনুসারীরাই জিয়ার নিজের কথা বিকৃত করে, সত্য-অসত্য মিশিয়ে, নিজেদের খেয়ালখুশিমতাে উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এই প্রবণতার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় সূর্যের চেয়ে। বালির উত্তাপ বেশি।’ (কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র স্থাপন, সেখানে সেনা কর্মকর্তাদের গমন এবং ওই বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কিত জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ-এর প্রেক্ষাপট ও খুঁটিনাটি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণাপূর্বক সুলেখক অমি রহমান পিয়াল, বিডিনিউজ২৪.কম-এ প্রকাশিত (প্রকাশকাল ২৭ মার্চ ‘১৪) রহস্যময় মাহমুদ হােসেন ও কালুরঘাট’ শীর্ষক নিবন্ধে জানিয়েছেন (পাঠকের সুবিধার্থে পুরাে প্রবন্ধটিই উপস্থাপন করা হলাে)] :  “কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের (ইটস জাস্ট অ্যা ট্রান্সমিটার) উদ্যোক্তা এবং জিয়াকে এতে সম্পৃক্ত করার পেছনে আছেন একজন অবাঙালি! অবিশ্বাস্য, তাই না? রহস্যময় এই চরিত্রের নাম মাহমুদ হােসেন। তিনি নায়ক না খলনায়ক তা মূল্যায়িত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন; তবে তাতে রহস্যটা মেটেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, ২৬ মার্চ রাত দশটায় ‘হ্যালাে ম্যানকাইন্ড’ বলে ভরাট কণ্ঠের উচ্চারণে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি আবারও সচল করেছিলেন মাহমুদ হােসেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার তৎপরতায় বােঝা গেছে, তিনি আসলে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন বাঙালিদের। তবে ঠিক কীভাবে সেটি রহস্যই রয়ে গেছে।
শুরু হােক মাহমুদ হােসেনের রহস্যময়তার। আরম্ভ করছি কালুরঘাটে সে সময় উপস্থিত এবং জিয়ার অন্যতম সহচর মীর শওকত আলীর স্মৃতিচারণ দিয়ে“কক্সবাজার যাওয়ার পথে কালুরঘাট ব্রিজ পেরুলেই রাস্তাটা একটা ঢালের তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। তারপর এগিয়ে গেছে সােজা পটিয়া, দুলাহাজরা এবং কক্সবাজার হয়ে মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণের প্রান্ত টেকনাফের দিকে। ঢালের শেষ মাথায়, যেখানে রাস্তাটা আবার সােজা হয়েছে, একটা পেট্রোল পাম্প আছে। পাম্পটা ইতােমধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, অন্ধকারে ডুবে ছিল। জায়গাটা। একপাশে কিছু গাছের গুড়ি পাকারে রাখা, কিছু খালি বাসও ছিলও এখানে। পলায়নপর ড্রাইভাররা ফেলে রেখে গিয়েছিল। পাম্প স্টেশনের আশেপাশে গােটাকতক গাড়ি আর পিকআপও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ছিল। ক্রমশ রাত ঘনিয়ে এলাে। | রাত তখন আটটা। একটা গুড়ির ওপর বসে কথা বলছিলাম আমি আর অলি। একটা বাসের ভেতর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জিয়া। হঠাৎ একটা লােককে এগিয়ে আসতে দেখলাম আমরা। মােটামুটি দীর্ঘকায়, চমত্তার চেহারা, মাথায় লম্বা চুল, বয়স মধ্য ত্রিশের মতাে হবে। আগন্তুক আমাদের কাছে এসে জানালেন, জিয়ার খোঁজ করছেন তিনি। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমি আর অলি। কারণ ওই অবস্থায় ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছিল।  যা হােক, আমরা তার পরিচয় জানতে চাইলাম; জিয়াকে তিনি চেনেন কীভাবে। কিন্তু পরিচয় বা উদ্দেশ্য জানাতে রাজি হলেন না দ্রলােক। জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য জোর করলেন। আমি চমৎকার আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গিতে আলাপরত আগন্তুককে নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক তখন ক্যাপ্টেন অলি গিয়ে জিয়াকে নবাগতের উপস্থিতির কথা জানালেন। একটু বাদেই অলি ফিরে এসে বললেন, দ্রলােককে বাসের ভেতর নিয়ে যেতে বলেছেন জিয়া। আগন্তুককে নিয়ে আমরা বাসে অপেক্ষারত জিয়ার কাছে এলাম।
জিয়া আমাদের দুজনকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করলেন। আগন্তুককে আগেই তল্লাশি করা হয়েছিল, জিয়ার একখানা ফটোগ্রাফ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি তার কাছে। আগন্তুকের সঙ্গে জিয়াকে একা রেখে বেরিয়ে এলাম আমরা।” (মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় প্রথম প্রতিরােধ : লে. জে. মীর শওকত আলী; গােলাম মােস্তফা সম্পাদিত অনন্য জিয়াউর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আগস্ট ২০০৪)। ২৭ মার্চের সে রাতের ঘণ্টাখানেক একান্ত আলাপচারিতার পর আগন্তুক যখন বেরিয়ে গেলেন, জিয়া তার পরিচয় দিলেন সঙ্গীদের। লােকটা আমাদের বন্ধু, আমাদের একটা উপকার করতে চায়। কী উপকার, কী তার ধরন সে আলােচনায় একটু পরেই আসছি। কিন্তু মীর শওকতের লেখায় বা আর কোথাও সেই ফটোগ্রাফের রহস্য মেলে না। কীভাবে একজন বিদেশির বুকপকেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের ছবি এলাে তা জানা হয় না আমাদের। তার আগেই অবশ্য বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার স্বাধীনতার প্রথম ঘােষণাটা পড়ে ফেলেছেন। তবে জিয়াই প্রথম নন। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরােধ লড়াইটা ঢাকার ঘণ্টাকয়েক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ক্যাপ্টেন রফিক। ২৫ মার্চ রাতে জিয়া যখন পরিস্থিতি আরও ভালাে করে বােঝার জন্য ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে পটিয়ার দিকে সরে গেছেন (চট্টগ্রাম থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ), রফিক তার সীমিত লােকবল ও সামর্থ্য নিয়েই জোর লড়াই লড়ছেন। সেদিন রাত দুটোয় রেলওয়ে হিলে রফিকের ট্যাকটিকাল হেডকোয়ার্টারে আমরা একই আগন্তুকের দেখা পাই। আগন্তুকের নাম বা পরিচয় রফিক দেননি।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে আমরা জানতে পারি, একটি বিদেশি রাষ্ট্রের তরফে তাঁকে সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব দেন ব্যক্তিটি। শর্ত তার সঙ্গে কক্সবাজার যেতে হবে। আমি যেতে পারব না, আমি ছাড়া এখানে আর কোনাে অফিসার নেই’ রফিকের প্রত্যাখ্যানের পর অপরিচিত লােকটি তাকে বিকল্প প্রস্তাব দেন রেডিওতে ভাষণ দেয়ার। আগের গ্রাউন্ডে এবারও প্রত্যাখ্যান করলেন রফিক। বরং একটি টেপরেকর্ডার এনে তাঁর ভাষণ রেকর্ড করে নেয়ার পাল্টা প্রস্তাব দিলেন। রফিক লিখেছেন :  “…এরপরেও অপরিচিত আগন্তুক তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমার ওপর এত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন যে আমি খুবই সন্দিহান হয়ে পড়লাম। পুরা বিষয়টা পাকিস্তানিদের ফাঁদ হওয়া বিচিত্র নয় আমি ভাবলাম। আমাকে রাজি করাতে না পেরে তিনি রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি নিয়ে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু দ্রলােক আর কখনও ফিরে আসেননি। পরে আমি। জানতে পেরেছিলাম যে তিনি বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অন্য একটি দলের সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং তাদেরকে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার।
জন্য প্রলুব্ধ করেছিলেন। হয়তাে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের স্থান থেকে বাঙালি সৈন্যদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত জনগণ অবশ্য তাকে সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে মেরে ফেলে। তবে তার এসব কার্যকলাপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা হয়তাে আর কখনও-ই জানা যাবে না।  এ পর্যন্ত সবাই ‘আগন্তুক’ হিসেবেই তার পরিচয় দিয়েছেন; সেটা আরও রহস্যময় করে তুলেছেন বেলাল মােহাম্মদ নিজে তার পরিচয় গােপন করে। অবশ্য মাহমুদ হােসেন নামে আমাদের আলােচিত রহস্যপুরুষটির জাতীয়তা ও পরিচিতি সম্পর্কে পরস্পরবিরােধী তথ্য রয়েছে। মীর শওকত তার চোস্ত আমেরিকান ইংরেজিতে মুগ্ধ; রফিকের মনেই হয়নি তিনি বাঙালি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সফল রূপকার বেলাল মােহাম্মদ নিশ্চিত করেছেন, তিনি। বাঙালি। কিন্তু বেগম মুশতারী শফী তাকে উল্লেখ করেছেন ভারতীয়’ বলে। বাংলাদেশে কবে থেকে আছেন এবং কী উদ্দেশ্যে এটা নিয়েও দুজনের মন্তব্য দু’ধরনের। এখানে না বললেই নয়, সে সময় এনায়েতবাজারে ডাক্তার শফীর বাসা কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লােকদের একটি আড্ডা গড়ে উঠেছিল এবং বেলাল মােহাম্মদ ছিলেন সেখানকার নিয়মিত অতিথি। এটাও বলতে হবে যে, স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে বেলাল মােহাম্মদ যে ক’টি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে তিনি মিথ্যে না বললেও সত্য গােপন করে গেছেন। কৌশলে আড়াল করেছেন মাহমুদ এপিসােড’। কখনও তার লেখায়। এসেছে ‘গাড়ি চালাচ্ছিলেন আমার এক বন্ধু।  এমনকি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে দেয়া সর্বশেষ সাক্ষাৎকারটিতেও একবারই মাহমুদের উল্লেখ ছিল তার মুখে। সেখানে তাকে ‘আগ্রাবাদ হােটেলের প্রােমােটার জাতীয় কিছু বলা হয়েছে। ভিডিওতে তার নাম বলা হলেও যিনি সেটি শুনে শুনে লিখেছেন, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেনি। মাহমুদ হােসেনকে, তাই বাদ দিয়েছেন!
আর বেলাল মােহাম্মদের ব্যাপারটা হলাে, উনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র নিয়ে একটি বই লিখেছেন। এরপর স্বাধীনতার ঘােষক বিতর্ক নিয়ে বিডিনিউজের আগে ডয়চেভেলেও তার একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই তিনি বইয়ের বক্তব্যটি ধরে রেখেছেন—কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টারটি চালু করা, সেটার প্রতিরক্ষার জন্য রফিককে না পেয়ে পটিয়া থেকে জিয়াকে নিয়ে আসা। তারপর কৌতুকছলে বলা ‘এখানে তাে সবাই মাইনর, আপনিই একমাত্র মেজর, আপনি আপনার নামে একটি ঘােষণা পড়ন না।’ কোনাে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই জিয়া তাঁর অনুরােধে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেছেন।  সুস্পষ্টভাবেই এসবের কৃতিত্ব বেলাল নিজের বলেই দাবি করছেন। এমনকি আঙুলে গুনে জিয়া স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠকারী নবম ঘােষক, সম্মানী হিসেবে ১৫ টাকার ভাতা পেতেন তখনকার ঘােষকরা এ জাতীয় রসিকতাও আছে তাঁর বয়ানে। চারদিনের ওই শব্দ-লড়াইয়ে (প্রপাগান্ডামূলক প্রচারণা অর্থে) বেলাল মােহাম্মদদের কৃতিত্ব কোনােভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটু ঘাটাঘাটি করলেই ছায়া এবং কায়াকে আলাদা করে ফেলা যাচ্ছে। রফিকের মুখেই আমরা শুনেছি, ২৫ মার্চ রাত দুটোয় তাঁর কাছে এসেছিলেন মাহমুদ, রেডিওতে ঘােষণা পাঠের আবদার নিয়ে। বেলালরা কালুরঘাটের ওই ট্রান্সমিশন সেন্টারটি মূল বেতারের বিকল্প হিসেবে চালু করার পেছনে মূলমন্ত্রণাটিও ক্ষুরধার মাহমুদ হােসেনের মাথা থেকে বেরিয়েছে ধরলে, অনেক হিসাবই দুয়ে দুয়ে চারের মতাে মিলে যায়। মিলিয়ে দেন বেলাল নিজেই।
২৬ মার্চ সন্ধ্যার পর তাঁরা ওই বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র চালু করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেন। রাতে যখন আওয়ামী লীগের মােহাম্মদ হান্নান সেখানে। গেলেন, তিনি বললেন এই ট্রান্সমিটার দিয়ে তিনি সেদিন দুপুরেই একদফা ঘােষণা পাঠ করে গেছেন (বিডিনিউজে বেলাল মােহাম্মদের সাক্ষাৎকার ২য় পর্ব)। বইয়ে মূল বেতারের কথা বলে এড়িয়ে গেলেও, সাক্ষাৎকারে আর সেটা অস্বীকার করেননি। | কথা হচ্ছে, হান্নান কীভাবে এই ট্রান্সমিশন সেন্টারটি ব্যবহার করলেন, কে তাকে দিয়ে ঘােষণা পাঠ করাতে সাহায্য করেছেন? বেলাল মােহাম্মদ এড়িয়ে গেছেন; আমার ধারণা উত্তরটা তার জানা। মুশতারী শফীই আমাদের জানিয়ে দেন যে, ২৭ মার্চ সকালে তার বাসা থেকেই গাড়ি করে বেলালকে নিয়ে পটিয়া রওনা দেন মাহমুদ। অথচ বেলাল মােহাম্মদ স্মৃতিচারণে এই যাত্রাকে এক বন্ধুর গাড়িতে বলে চালিয়ে দিয়ে নিজেকে বসিয়ে রেখেছেন ‘ড্রাইভারের পাশের আসনে।
আসা যাক বেলাল কীভাবে মাহমুদকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। মাহমুদ হােসেন নিজেকে মুখ্য চরিত্রে রেখে ‘অরিজিন অব হিপ্লিজম’ নামে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যার প্রেক্ষাপট ভারতবর্ষ। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন তার বিপ্লবী চরিত্র। লন্ডনে আইয়ুব খানের এক সভায় নাকি বােমা হামলা চালিয়েছিলেন ভাইয়ের সঙ্গে মিলে। আর মুশতারী শফীর বইয়ে ঠিক উল্টো চিত্র পাই আমরা। এখানেই আমরা জানতে পারি সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাইয়ের ভাতিজি ভাস্করপ্রভার স্বামী মাহমুদ হােসেন। ২৭ মার্চের রােজনামচায় মুশতারী শফী লিখেছেন : “…এ সময় মাহমুদ হােসেন নামে একজন লােক এল আমার বাসায় বেলাল ভাইকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে। মাহমুদ হােসেন ভারতীয় লােক। থাকে কখনও লন্ডন, কখনও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায়। তার স্ত্রী নাকি ভারতের জনতা পার্টির নেতা মােরারজি দেশাইর ভাইঝি। নাম ভাস্করপ্রভা। তিনি প্রায় মাসকয়েক হল বাংলাদেশে এসেছেন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের পল্লীগীতি ও বাউল সঙ্গীতের উপর ধারাবর্ণনা সহকারে লং প্লের রেকর্ড বের করবেন। বেলাল ভাইয়ের সাথে তার চুক্তি সংগৃহীত গানের ধারাবর্ণনা লিখে দেবার। উঠেছেন আগ্রাবাদ হােটেলে। চট্টগ্রাম রেডিওর সঙ্গীত প্রযােজক রামদুলাল দেবের সাথেও তার সখ্য গড়ে উঠেছে। উনি শিল্পীদের সংগ্রহ করে গানের রিহার্সেল করেন, রিহার্সাল হয় আগ্রাবাদ হােটেলেই। বেলাল ভাইও সেখানে যেতেন।
প্রায় ৬ ফিটেরও ওপর লম্বা কালাে লােক, মাথাভর্তি কোকড়া ঝাকড়া চুল। দেখলে ভয় লাগে। আজ এসেছেন একটা কালাে মরিস মাইনর গাড়ি নিয়ে। গাড়িতে দুজন ইপিআর জোয়ান, গাড়ির দুপাশে বন্দুকের নল বের করে। তার সাথে আরও এসেছেন আগ্রাবাদ হােটেলের সহকারী ম্যানেজার ফারুক চৌধুরী। কেন এসেছেন মাহমুদ হােসেন? কোথায় নিয়ে যেতে চান বেলাল ভাইকে? ডাক্তার শফীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বেলাল ভাই বললেন, ‘মাহমুদ হােসেন এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে চান, সীমান্তের ওপারে অস্ত্রসাহায্যের জন্য।’ আমিও কথাটা শুনলাম। শফী আঁতকে উঠে অনেকটা ধমকের সুরেই বলল, “খবরদার বেলাল, এ কাজে তুমি কিছুতেই যাবে না ওর সাথে। | বেলাল ভাই বলল, “ঠিকাছে, সীমান্তের ওপারে যাব না, তবে পটিয়া পর্যন্ত যাই। শুনেছি বাঙালি সৈন্যরা এখন নাকি ক্যান্টনমেন্ট এবং শহর ছেড়ে পটিয়ার দিকে গেছে। সেখান থেকে কিছু আর্মড গার্ড নিয়ে আসি। কারণ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনটি এখন নিরাপদ নয়।’ ও আর এই কাজে বাধা দিল না। বেলাল ভাই চলে গেল মাহমুদ হােসেনের সাথে।” (স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন, পৃ. ১০৪) বেগম মুশতারী শফীর ভাষ্যটাই সমর্থন করেছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও মুক্তিযােদ্ধা লে. কর্নেল নুরুন্নবী বীরবিক্রম। মাহমুদ হােসেন সম্পর্কে যাবতীয় খোঁজখবরের সূত্রপাতও তিনিই। তাঁর লেখা জীবনের যুদ্ধ: যুদ্ধের জীবন (কলম্বিয়া প্রকাশনী) নামে একটি বই আছে। সেখানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রামগড় জেড ফোর্স হেডকোয়ার্টারে জিয়ার সঙ্গে মদ্যপানের (রাম) ফাঁকে ফাঁকে নানা আলাপচারিতার উল্লেখেই আমি প্রথম পাই মাহমুদ হােসেনকে। মিসিং লিংকগুলাে জোড়া দেয়ার প্রয়াসও তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক অনুষ্ঠান শেষে নুরুন্নবীকে আমি ধরেছিলাম কথাগুলাের ব্যাখ্যা চেয়ে আমার সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা (সামরিক বাহিনীতে গণহত্যাখ্যাত) আনােয়ার কবীর নুরুন্নবী আমাকে রেকর্ড করতে দেননি, তবে জানিয়েছেন শিগগিরই তার একটি বই বেরােবে যাতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।
তিনি যা বলেছিলেন তা-ই স্মৃতি থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি :  “ওই লােকের পুরাে নাম মাহমুদ হাসান (নুরুন্নবী তাকে ‘মাহমুদ হাসান বলে উল্লেখ করেছেন; আর তাঁর লেখায় বলেছেন শুধু মাহমুদ; আমরা অন্য সব জায়গা থেকে জেনেছি তার নাম মাহমুদ হােসেন’)। সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই সে চট্টগ্রাম হােটেল আগ্রাবাদে স্থায়ী আবাস নেয়। লন্ডনে পড়াশােনার সুবাদে মােররাজী দেশাইর ভাতিজির সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে। বাংলাদেশের লােকসঙ্গীতের ওপর গবেষণা ও তথ্যচিত্র নির্মাণের কথা বলে সে স্থানীয় মহলে বেশ খাতির জমিয়ে তােলে। তার গুণমুগ্ধদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রখ্যাত বেলাল মােহাম্মদসহ অনেকেই। বেগম মুশতারী শফীর স্মৃতিকথায়ও উল্লেখ আছে মাহমুদের। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘােষণায় উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে অগ্রগণ্যদের একজন ছিলেন মাহমুদ। জিয়া বেশ কয়েকবারই বিভিন্ন উপলক্ষে এই গল্প করেছেন তার অধীনস্থদের কাছে।” | নুরুন্নবীর ভাষ্য অনুযায়ী—মাহমুদ জিয়াকে জানান যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সিআইএর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নাকি এরকম একটি হাস্যকর যুক্তিতে জিয়াকে কনভিন্স করেন যে, জিয়া যদি একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করেন তবে তার সাহায্যের জন্য একদিনের মধ্যে ফিলিপাইন থেকে সপ্তম নৌবহরকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। ২৭ মার্চ জিয়ার প্রথম ঘােষণাটার এটা অন্যতম রহস্য। যদিও উপস্থিতদের চাপে এরপর তিনি ঘােষণা পাল্টান। মাহমুদ জিয়ার ছাড়পত্র, আগ্রাবাদ হােটেলের পিআরও এবং ক্যাশিয়ার।
ফারুক ও গনি এবং ইস্ট বেঙ্গলের দুজন সিপাই নিয়ে কক্সবাজার রওনা দেন। জনৈক উকিলের সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে মীর শওকত ও খালেকুজ্জামানও রওনা হন। পথে দুলাহাজরায় একটি ব্যারিকেডে না থেমে এগিয়ে যায় মাহমুদের মরিস মাইনর। পরের ব্যারিকেডে উত্তেজিত জনতা চড়াও হয় তাদের ওপর। মাহমুদ বাংলা বলতে পারতেন না, তাকে বিহারি ভেবে হত্যা করে উন্মত্ত স্থানীয়রা। মাত্র একজন সিপাই প্রাণ নিয়ে কোনােমতে পালিয়ে আসে। কিন্তু জিয়ার দেখা পাননি; কারণ ২৮ মার্চ জিয়া অলি আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই কক্সবাজারে যান। বাংলা ভালাে বলতে পারেন না বলে তারও একই সমস্যা হয়, কিন্তু চট্টগ্রামের স্থানীয় লােক অলি সে যাত্রা তাকে পার করিয়ে নেন। কক্সবাজারে পৌছে সপ্তম নৌবহরের কোনাে দিশা পাননি জিয়া। খোঁজ মেলেনি শওকতেরও, যিনি রিপাের্ট করেন ৭ এপ্রিল। | খানিকটা ফাঁক রয়েছে নুরুন্নবীর বক্তব্যে। প্রথমত, জিয়া ২৭ মার্চ যে ভাষণটি দেন তাতে নিজেকে তিনি সরকারপ্রধান দাবি করেননি। করেছেন ২৮ মার্চের ভাষণে (যা লে. শমসের মুবিন চৌধুরী বেশ কয়েকবার পাঠ করেন), তৃতীয় দফা ভাষণে (মাহমুদের মৃত্যুর পর আবার পাল্টে দেন ভাষা)। আবার মীর শওকতের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ৮টার দিকেই জিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ মাহমুদের। তার অর্থ, পটিয়ায় তিনি এ বিষয়টি নিয়ে মুখােমুখি হননি জিয়ার । আর জিয়ার প্রথম ভাষণটি প্রচার হয় ৭টা ২০ মিনিটে (বেলাল মােহাম্মদের সাক্ষাৎকার)। সেক্ষেত্রে পরদিন জিয়ার ভাষণ এবং মাহমুদের কক্সবাজার যাত্রার যােগসূত্র ওই দ্বিতীয় ভাষণ।  জিয়া মাহমুদকে কেন বিশ্বাস করলেন এটা একটা রহস্যই বটে। কারণ সপ্তম নৌবহর ফুল থ্রটলে চললেও পাঁচ দিনের আগে বঙ্গোপসাগরে ঢােকার কোনাে সুযােগ ছিল না। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের অপশনও রেখেছিলেন মাহমুদ। সেক্ষেত্রে হেলিকপ্টার জোগাড়ের একটা ব্যাপার ছিল। মাহমুদ নিশ্চয়ই সেজন্য কক্সবাজার যাচ্ছিলেন না। ফেরা যাক মাহমুদের সিআইএ পরিচয় দান নিয়ে (যা জিয়া নিজের মুখে বলেছেন নুরুন্নবীকে)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মােরারজী দেশাই সিআইএ’র চর হিসেবে কাজ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে বাবার হয়ে পাচার করা তথ্যের পেমেন্ট আনার।
কাকতালীয়ভাবে জিয়ার শাসনামলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে দ্বিতীয় দফা আসীন হয়েছিলেন মােরারজী। তখন মার্কিন ছাতার তলে উপমহাদেশেও বেশ একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে এসেছিল। | তবে বেলাল মােহাম্মদ বন্ধু মাহমুদের সম্মান রেখেছেন তার মৃত্যুর ব্যাপারটি বিস্তারিত জানিয়ে। অলি আহমেদের মুখেই তিনি খবরটা পেয়েছেন। বেলাল মােহাম্মদের ভাষ্যে : “সেই ২৭ মার্চ রাতেই তারা ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে এগিয়েছিল তাদের গাড়ি। পথে পুলিশ ফাড়িগুলাের সামনে সামনে প্রহরা। একটা লম্বা বাশ রাস্তার এপাশ ওপাশ পাতা। সেখানে গাড়ি থামাতে হয়, পরিচয় বলতে হয়। তারপর ছাড়া পাওয়া যায়। বাঁশের একপ্রান্ত উপরে ঠেলে দিয়ে গাড়ি গলিয়ে নেবার পথ করে দেয়া হয়। ফাঁড়িতে ফঁাড়িতে এমনি যাত্রাবিরতিতে সময় নষ্ট হয়। | মাহমুদ হােসেনের জন্য হয়তাে এ ছিল অসহ্য। তিনি তাই জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। এপাশে ওপাশে পাতা বাঁশ ভেঙে এগিয়ে গিয়েছিল গাড়ি। পরের ফাঁড়িতে টেলিফোনে খবর চলে গিয়েছিল। মাহমুদ হােসেনের পুষ্ট শরীর ও দীর্ঘ চুল চকিতে দেখা গিয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল তিনি অবাঙালি বলে। পরের ফাড়ি হারবাংয়ে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ। গাড়ির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল অনেক টাকাকড়ি। বিদেশি মুদ্রাও। মেজর জিয়াউর রহমানের দেয়া পরিচয়পত্র হয়েছিল উপেক্ষিত। ওখানে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও উপনীত হয়েছিলেন। মাহমুদ। হােসেনকে দালাল ঘােষণা করা হয়েছিল। গুলি করা হয়েছিল তিনজনকে। মাহমুদ হােসেন, ফারুক চৌধুরী ও ওসমান গনি। সিভিল পােশাকধারী। রাইফেলধারী দুজনকে এবং ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।  তিনটি লাশ দুদিন শঙ্খ নদীতে ভাসমান ছিল। স্থানটির নাম ‘বুড়াে মৌলবীর ট্যাক’। দুদিন পর বুড়াে মৌলবী সাহেব দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে মাহমুদ হােসেনের পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামে এসেছিলেন; তাদের নিয়ে আমি গিয়েছিলাম হারবাং এলাকায়। বুড়াে। মৌলভী সাহেব তখন গত হয়েছিলেন। তার ছেলে কবরের স্থানটি দেখিয়েছিলেন। শঙ্খ নদীতে ভাঙনের ফলে স্থানটি তখন জলমগ্ন।”
শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’-এ সংযােজন হিসেবে মাহমুদ হােসেনের নাম স্বাধীন বাংলা বেতারের চ্যাপ্টারে আছে (পৃ. ৭৫)। সেখানে তাকে সদ্য লন্ডন থেকে প্রত্যাগত তরুণ ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে। এ সূত্রমতে, ২৬ মার্চ রাত ১০ টার পর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এনার উদ্যোগে একটি অতিরিক্ত অধিবেশন প্রচারিত হয়। সহযােগী ছিলেন ফারুক চৌধুরী, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ও আরও কিছু কলাকুশলী। ২৭ মার্চ রাতেই মাহমুদ ও ফারুক নিহত হন অজ্ঞাত আততায়ীদের গুলিতে।  এত কিছুর পরও রহস্যই থেকে যান মাহমুদ এবং তার অভিপ্রায়। স্রেফ অস্থিরতার কারণে ক্যাজুয়ালটি অব ওয়্যার হয়ে যান দুজন নির্দোষ মানুষকে সঙ্গী করে।
ভুট্টোর শশানদর্শন এবং রবার্ট পেইনের ‘ম্যাসাকার’, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’, সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’—এসব গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি ‘ঢাকার পােড়ামাটি ও গণহত্যা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, ২৬ মার্চ সকালে তাকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের ভয়াবহ চিহ্নগুলাে দেখানাে হয় এবং ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি হৃষ্টচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আল্লাহর অসীম দয়া, শেষপর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলাে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থগুলাের প্রায় সব কটিতে বলা হয়েছে, জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন ২৬ মার্চ সকালে। কিন্তু তাঁর কন্যা বেনজির ভুট্টোর মতে, তিনি ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন, “On March 27, 1971, he (Z A Bhutto) was actually in East Pakistan capital city of Dacca for another round of talks with Mujib when his worst fears were realised. Yahya Khan ordered in the army to quell the insurrection. Alone in his hotel room, my father watched Dacca go up in flames, sick at heart at the Generals inevitable solution of force. (Daughter of the East, page-52). বেনজিরের তথ্য অনুযায়ী ভুট্টো যদি ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেই থাকেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনাে শুভবােধ ছিল না, তিনি যে আরও নারকীয় ধ্বংসলীলা দেখার প্রতীক্ষায় ছিলেন—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
২৫ মার্চের বিভীষিকাময় কালােরাতে সারা দেশে কতজন শহীদ হয়েছিলেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান মেলা ভার। বাঙালি লেখক বা গবেষকদের মতে এর সংখ্যা লক্ষাধিক। ২৯ তারিখের সিডনি হেরাল্ডেও লেখা হয়েছিল—ওই রাতে নিহতের সংখ্যা দশ হাজার থেকে এক লাখ। বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান পত্রিকাগুলাে বলেছে ভিন্ন কথা। (এসব কথার সবটাই অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ, এই হত্যা-সংঘটনের পূর্বে সকল বিদেশি সাংবাদিককে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ‘হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল’-এ এবং কয়েক ঘণ্টা পরই তাদের সকলকে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তাই তারা সারা দেশ তাে দূরের কথা, কেবল ঢাকা শহরের ‘গণহত্যা সংক্রান্ত চিত্রটিই সরেজমিনে দেখার সুযােগ পাননি। সায়মন ড্রিং, যিনি পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আরও কদিন ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন, গণহত্যার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। কারণ, উন্মত্ত হত্যাকাণ্ডে নিহতের পরিসংখ্যান পালিয়ে পালিয়ে সংগ্রহ করা যায় না। তাছাড়া এই হত্যাকাণ্ড একই সময়ে সারা দেশে সংঘটিত হয়েছিল, ফলে কোনাে সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না এর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা)। সায়মন ড্রিংএর প্রতিবেদনে, যা ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল—তাতে বলা হয়েছিল, নিহতের সংখ্যা বাইশ হাজারেরও বেশি। ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে দশ হাজার (আবার একই পত্রিকার ১ এপ্রিলের সংখ্যায় বলা হয়েছে এই সংখ্যা পঁয়ত্রিশ হাজার)। ২৮ মার্চের ডেইলি এক্সপ্রেসের মতে চল্লিশ হাজার। আকাশবাণী বা ভারতীয় পত্রিকার মতে নিহতের সংখ্যা হাজার হাজার। আবার পাকিস্তান সরকারের ভাষ্যমতে, চল্লিশ থেকে একশাে জন মাত্র। তবে লে. জেনারেল নিয়াজির মতে, ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায়। সে রাতে বাঙালির রক্ত দিয়ে মাটি লাল করে দেয়া হয়েছিল’ (দ্যা বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান : এ এ খান নিয়াজি, ভাষান্তর—মিজানুর রহমান কল্লোল )।

আর ভুট্টো, ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “দেখুন ওই রাতে ভারতীয় সাংবাদিকদের মতে নিহতের সংখ্যা হচ্ছে ষাট থেকে সত্তর হাজারের মধ্যে। কয়েকটি খ্রিস্টীয় মিশনারির মতে সংখ্যা ত্রিশ হাজার। আমি যতদূর জানতে পেরেছি, তা হচ্ছে, সে সংখ্যা অবশ্যই পঞ্চাশ হাজারের মতাে হবে। ওই কার্যক্রম নৈতিকতার দিক থেকে অধিক ন্যায়সঙ্গতও হয়, মনে রাখবেন, তাতেও সংখ্যা অনেক বেশি’ (ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি, পৃ. ১৮৯)।  ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটনের মূল হােতা লে. জেনারেল রাও ফরমান আলির পরিকল্পনা ছিল, রবার্ট পেইনের ভাষায়, ‘২৫ মার্চের রাতে তিনি বলেছিলেন, বাঙালিদের আমি চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করে ফেলব। সেই রাতে তার সামনে ছিল ঢাকার প্রকাণ্ড একটা ম্যাপ, পাশে একগুচ্ছ টেলিফোন। তার অর্ডারগুলাে তিনি ইংরেজিতেই দিয়েছিলেন। সেই টেপ পরে পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে শােনা গেছে তার নরম অথচ দৃঢ় গলায় দেয়া আদেশগুলাে। এই আদেশের পরে সেই একই গলায় শােনা যায়, কিছুই। জিজ্ঞেস করা হবে না, মনে করবে, কিছুই হয়নি। তােমাদের কোনােকিছুরই ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আবারও বলছি, চমক্কার কাজ করছাে তােমরা। …আত্মসমর্পণের পর তার ড্রয়ায়ে পাওয়া কাগজে লেখা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সবুজকে লালরঙে রাঙিয়ে দিতে হবে। এই লাল কমিউনিজমের লাল নয়, পূর্ব পাকিস্তানের রক্তেই এই লাল তৈরি হয়েছে’ (ম্যাসাকার, ভাষান্তর-গােলাম হিলালী, পৃ. ২৮)। ২৫ মার্চের কালােরাতের অবসান হলাে একসময়। সূর্য আবারও উঠল। ঘড়ির কাটা নিয়ম মেনে চলতে থাকল। বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ শােনা গেল। সেই সাথে মেশিনগানের শব্দ, রাইফেলের শব্দ, যন্ত্রণা আর আর্তনাদের শব্দ। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে? কেউ জানে না, আগামীকাল সে নিজেই বেঁচে থাকবে কি না; মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু এই পশুশক্তির হাতে মৃত্যু—সেটা তাে অনিবার্য ছিল না। ভুট্টো পাকসেনাদের গণহত্যায় দক্ষতা দেখার জন্য ২৫ মার্চ ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন, ইতিহাস কী নিষ্ঠুর—মাত্র ক’বছর পর ওদেরই পাশবিক দক্ষতায় প্রাণ হারাতে হয়েছিল স্বয়ং ভুট্টোকেও।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!