You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.07 | কবি রচিলেন তাঁর অমর কবিতাখানি  - সংগ্রামের নোটবুক
কবি রচিলেন তাঁর অমর কবিতাখানি  
[৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে ইয়াহিয়া খান অনুরােধ করেছিলেন, পরদিনের জনসভায় তিনি যেন কঠোর কোনাে কর্মসূচি না দেন। আবার ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বলেন, কোনাে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মার্কিন সরকার সমর্থন করে না, তাই এরকম আন্দোলনের সৃষ্টি হলে মার্কিন তরফ থেকে সহায়তা পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। (যুক্ত পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি : জি ডব্লিউ চৌধুরী, পৃ. ১২০)]।  ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দান। লাখ লাখ লােকের সমাবেশ। সবার কষ্ঠে আকাশ-কাঁপানাে শ্লোগান। হৃদয়ে আকুল প্রতীক্ষা। কখন আসবেন তিনি? কখন আসবেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের কবি? কী শােনাবেন তাঁর কবিতায়? একদিকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করার জন্য ছাত্রসমাজের চাপ, অন্যদিকে সবকিছু ঠাণ্ডামাথায় মােকাবিলা করার ঋদ্ধ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা—কোন পথে হাঁটবেন তিনি? কোনটি হবে সঠিক সিদ্ধান্ত? শত্রুকে মােকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতিমূলক সময় নেবেন কিছুদিন? জনতার উন্মাতাল। তরঙ্গকে আবেগমথিত ঝড়াে-শব্দাবলি দিয়ে আরাে বিক্ষুব্ধ করে তুলবেন? নাকি বলার সবটুকু ছন্দ-অলঙ্কারে না সাজিয়ে সরাসরি বলে ফেলবেন? একসময় কবি এলেন, নিরুত্তাপ, নির্বিকার ভঙ্গিতে। ধীরপায়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নির্বাক থাকলেন কিছুক্ষণ। লাখ লাখ জনতার চোখের দিকে তাকালেন; ওদের মনের কথা পড়ে নিলেন। হঠাৎ তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। আগুনের শিখায় দ্যুতিত হলাে তার আপাদমস্তক। কোনাে ভূমিকা, উপক্রমণিকা না করে, যেন মধ্যখান থেকে কবিতা পাঠ শুরু করলেন : “আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।… কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস’ করুণ রসের কবিতাংশ আর্দ্র কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন। এবার অবতারণা করলেন রুদ্র রসের, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে।… গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য রিকশা, ঘােড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে।… এরপর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয়—তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল, তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে…।’ রুদ্র রসের পর নিখাদ বীররসের পরিবেশনা, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােল এবং তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। মাত্র কয়েক লাইনের একটা কবিতা—আবৃত্তি করতে সময় লেগেছে মাত্র ২০ মিনিট, এর মধ্যে করুণ-রুদ্র-বীররস সঞ্চার করে কী অপূর্ব দক্ষতায় কবি এটাকে ‘মহাকাব্যিকতায় ভরিয়ে তুললেন। পূর্ব-লিখিত নয়, মুখস্থ করেও নয়, তাৎক্ষণিকভাবে রচিত একটা কবিতায় কী অনিন্দ্যসুন্দর শব্দ-সমবায়ে, কী সব মােহনীয় পঙক্তি বলে গেলেন, কত অব্যক্ত কথার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, ভাবে-শিল্পসৌকর্যে, ছন্দে-মাধুর্যে, রসে  রূপে এমন অমলধবল সার্থক মহাকাব্য ইতিহাসে বা সাহিত্যে কে, কবে লিখতে পেরেছেন? যে কবি বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর আকৃতি ও গভীরতা আঁকতে পারেন, না বলার মধ্য দিয়েও ভাবের সবটুকু প্রকাশ ঘটাতে পারেন, কোটি মানুষের কণ্ঠস্বরকে মাত্র কয়েক ছত্রে বিন্যস্ত করতে পারেন, তিনি যদি মহাকবি না হন তাে, এ দুনিয়ায় মহাকবি কে? | এ কবিতায় তিনি কী বলেছেন, এরচেয়েও বড় প্রশ্ন তিনি কী বলেননি?
নিজের এবং জাতির বেদনার কথা বলেছেন, প্রতিপক্ষের ওয়াদা ভঙ্গের প্রসঙ্গ বলেছেন, পূর্বাপর ঘটনা বিবৃত করে জাতিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন, ‘যদি আর একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয়’–এরপর প্রসঙ্গান্তর, চূড়ান্ত উচ্চারণ নেই, কেন নেই? ‘আকেলমা-কে লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায় (জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য সামান্য ইশারাই যথেষ্ট)’; তাছাড়া তিনি তাে জানেন, এই মুহূর্তে চূড়ান্ত কথা বললে ‘স্বাধীনতা ঘােষণা করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সৈন্যরা যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সভাস্থল তাক করে গােলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলাে বসানাে হয়েছিল। কামানের গােলাবর্ষণের নির্দেশ দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষক হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে থাকে। ইয়াহিয়া খান একটি মাত্র অজুহাত খুঁজছিলেন, একটু উস্কানি পেলেই তিনি আঘাত হানবেন।’ ( লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে : মেজর রফিকুল ইসলাম, পৃ. ৪২)। নিজের জনগণকে কামানের গােলার সামনে রেখে হুট করে অপরিণামদর্শী কথা বললে এর দায় ইতিহাস কি তার কাঁধেই দেবে না? তবে কি তিনি গণমানুষের চোখের ভাষা, আকাক্ষার কথা এড়িয়ে গেছেন? কোননা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন? বলার কথাটুকু, পুরােটা বলেননি? মনে রাখা প্রয়ােজন সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কবিরা কি কোনাে কথা সরাসরি বলেন? খােলাসা করে সবটুকু বলেন? কথার মালা সাজিয়ে, অলঙ্কার পরিয়ে, সিন্ধুকে বিন্দুতে প্রতিস্থাপিত করে, আভাসে-ইঙ্গিতে, বলে-না বলে বিশাল ভাবাকাশকে ক’টি মাত্র পর্ভূক্তিতে ধারণ করার নামই তাে কবিতা। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়েছে, যা কিছু আছে, তা-ই দিয়ে শত্রুকে মােকাবিলা করার আহ্বান আছে, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমাসহ সকল প্রতিষ্ঠানের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, সর্বোপরি আছে রক্ত দিয়ে দেশ মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় এবং ব্যঙ্গার্থধর্মী অলঙ্কৃত আহ্বান, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বস্তুত শেখ মুজিব এমন একজন রাজনীতিক, যথাসময়ে যথার্থ কাজটি করায় তার জুড়ি মেলা ভার। কল্পনা করে নেই, ওইদিন শেখ মুজিব যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করতেন, তাহলে কী হতাে? জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ঘটে যেত। লাখ লাখ মানুষের দিকে তাক করা কামানগুলাে একসাথে গর্জে উঠলে, আকাশ থেকে বােমা পড়লে, রমনার রেসকোর্স ময়দান রক্তে লাল হয়ে গেলে, তখন কি বলা হতাে না, এটা ছিল শেখ মুজিবের অবিমৃশ্যকারিতা? হুট করে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে তিনি অগণিত মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন?’ বড় কথা, ইয়াহিয়া চাচ্ছিলেন। যেনতেন একটা অজুহাত। শেখ মুজিবের কাছ থেকে হঠকারী একটা বক্তব্য, যাতে বিশ্ববাসীকে বােঝানাে যায়, শেখ মুজিব আন্দোলনের নিয়মতান্ত্রিক পথ পরিহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব চাচ্ছিলেন, আক্রমণটা আসুক ইয়াহিয়া-ভুট্টোর তরফ থেকে। তাহলে বিশ্ববাসীকে বােঝানাে সহজ হবে যে, আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ওরা স্তব্ধ করে দিতে যাচ্ছে। বস্তুত কৌশলের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন শেখ মুজিবই, ৭ মার্চ স্বাধীনতা-আন্দোলনের ডাক দিয়েও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ অপবাদ মাথায় নিতে হলাে না। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে নিলেন, যার যা আছে, তাই নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বানও জানালেন, স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাকও দিলেন—আবার আলােচনার পথও খােলা রাখলেন-এরচেয়ে ভালাে ও ফলদায়ক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত আর কী-বা হতে পারত। নেতা তার মানুষের ভাষা বুঝলেন, মানুষ বুঝল নেতার ইঙ্গিত, বলা এবং না-বলা সমস্ত কথার গূঢ়ার্থ-এই যে পারস্পরিক নিবিড় মিথস্ক্রিয়া—এখানেই নেতৃত্বের সার্থকতা, ‘রাজনীতির কবি’ অভিধার যথার্থতা এবং জনতা বা কাব্যপায়ীর সফলতা। ৭ মার্চের ওই ঐতিহাসিক ভাষণটি পূর্ব বাংলার সকল বেতার কেন্দ্র থেকে একযােগে প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষমুহূর্তে সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।
সরকারি ওয়াদাভঙ্গের প্রেক্ষিতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলী-কর্মচারীরা ওই দিনের সকল সম্প্রচার বন্ধ করে দেন এবং শ্লোগান দিতে দিতে মিশে যান রেসকোর্সের জনসমুদ্রে অনুরূপ ঘটনা ঘটে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রেও। সম্প্রচারকর্মীরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ৭ মার্চের ভাষণ সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজে ফিরে যাবেন না। গভীর রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের সাথে সামরিক কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয় যে, পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ কোনাে পরিবর্তন ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি প্রচার করা হবে। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের কথা রেখেছিল, বস্তুত শেখ মুজিব এমন একজন রাজনীতিক, যথাসময়ে যথার্থ কাজটি করায় তার জুড়ি মেলা ভার। কল্পনা করে নেই, ওইদিন শেখ মুজিব যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করতেন, তাহলে কী হতাে? জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ঘটে যেত। লাখ লাখ মানুষের দিকে তাক করা কামানগুলাে একসাথে গর্জে উঠলে, আকাশ থেকে বােমা পড়লে, রমনার রেসকোর্স ময়দান রক্তে লাল হয়ে গেলে, তখন কি বলা হতাে না, এটা ছিল শেখ মুজিবের অবিমৃশ্যকারিতা? হুট করে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে তিনি অগণিত মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন?’ বড় কথা, ইয়াহিয়া চাচ্ছিলেন। যেনতেন একটা অজুহাত। শেখ মুজিবের কাছ থেকে হঠকারী একটা বক্তব্য, যাতে বিশ্ববাসীকে বােঝানাে যায়, শেখ মুজিব আন্দোলনের নিয়মতান্ত্রিক পথ পরিহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব চাচ্ছিলেন, আক্রমণটা আসুক ইয়াহিয়া-ভুট্টোর তরফ থেকে। তাহলে বিশ্ববাসীকে বােঝানাে সহজ হবে যে, আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ওরা স্তব্ধ করে দিতে যাচ্ছে।
বস্তুত কৌশলের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন শেখ মুজিবই, ৭ মার্চ স্বাধীনতা-আন্দোলনের ডাক দিয়েও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ অপবাদ মাথায় নিতে হলাে না। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে নিলেন, যার যা আছে, তাই নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বানও জানালেন, স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাকও দিলেন—আবার আলােচনার পথও খােলা রাখলেন-এরচেয়ে ভালাে ও ফলদায়ক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত আর কী-বা হতে পারত। নেতা তার মানুষের ভাষা বুঝলেন, মানুষ বুঝল নেতার ইঙ্গিত, বলা এবং না-বলা সমস্ত কথার গূঢ়ার্থ-এই যে পারস্পরিক নিবিড় মিথস্ক্রিয়া—এখানেই নেতৃত্বের সার্থকতা, ‘রাজনীতির কবি’ অভিধার যথার্থতা এবং জনতা বা কাব্যপায়ীর সফলতা। ৭ মার্চের ওই ঐতিহাসিক ভাষণটি পূর্ব বাংলার সকল বেতার কেন্দ্র থেকে একযােগে প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষমুহূর্তে সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। সরকারি ওয়াদাভঙ্গের প্রেক্ষিতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলী-কর্মচারীরা ওইদিনের সকল সম্প্রচার বন্ধ করে দেন এবং শ্লোগান দিতে দিতে মিশে যান রেসকোর্সের জনসমুদ্রে অনুরূপ ঘটনা ঘটে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রেও। সম্প্রচারকর্মীরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ৭ মার্চের ভাষণ সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজে ফিরে যাবেন না। গভীর রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের সাথে সামরিক কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয় যে, পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ কোনাে পরিবর্তন ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি প্রচার করা হবে। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের কথা রেখেছিল, ৮ মার্চ বেতারকেন্দ্রের কল্যাণে ওই মহাকাব্যিক ভাষণ পৌঁছে গিয়েছিল সকল বাঙালির কানে এবং হৃদয়ে।
বস্তুত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অনড় থেকেই, যুক্ত পাকিস্তান ভাঙার দায়—সুকৌশলী শেখ মুজিব ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কাঁধে চাপাতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, পাকিস্তানে বাঙালিরা মেজরিটি; মেজরিটি কখনাে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলন করে? এ কাজ করে মাইনােরিটি—যেমন করছে পশ্চিম পাকিস্তান। এ সম্পর্কে ‘নিউজ উইক’ পত্রিকা লিখেছিল, A month ago, at a time when he was still publicly refraining from proclaiming independence, Mujib privately told News Week Loren Jenkins that there no hope of salvaging the situation the country as we know it is finished. But he waited for president Aga Mohammad Yahia Khan to make the break. We are the majority so cannot secede. They, the westerns are the minority and it is up to them to secede. (5 April ’71). C মুজিবের এহেন বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল পরবর্তী পর্যায়ে খুবই ফলদায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।  তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ মন্তব্য করেছিল, “On Sunday (7 March), Sheikh Mujib came as near to declaring this (Independence) as he could without inviting harsh reaction from the Army. (The end of old Pakistan, David Loshak, 10 March, 1971). পূর্ব বাংলার কিছু রাজনীতিক বা কর্মী, যারা অতি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘােষণার পক্ষে ছিলেন এবং এ-ব্যাপারে শেখ মুজিবকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেছেন। তারা অবশ্য ৭ মার্চের ভাষণ শুনে তুষ্ট হতে পারেননি। আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় থেকেও আমরা এদিন রেসকোর্সের জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম।
সারা শহরে রটে গিয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজ স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন এবং বড় ধরনের একটা ঘটনা ঘটবে আজ। কিন্তু আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসি।’ (রাশেদ খান মেনন, সাক্ষাৎকার)। ওইদিন কেউ কেউ নাকি এমন প্রত্যাশাও করেছিলেন, শেখ মুজিব কেবল ‘স্বাধীন দেশ’-এর ঘােষণাই দেবেন না, তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ঘােষণাও দেবেন। ভাগ্যিস শেখ মুজিব অতিবিপ্লবী হয়ে কোনাে হঠকারী ঘােষণা দেননি, দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে গিয়েছেন। তবে মুজিবকে যারা চিনতেন, যারা তার কাছের মানুষ, কিংবা রাজনীতির ব্যাপারে যথেষ্ট দূরদর্শীতারা ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিবের ওই ভাষণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেছে ‘স্বাধীনতা-সংগ্রাম’। এ বিষয়ে তকালীন মেজর, পরে মেজর জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি লেখার কিয়দংশ স্মরণ করতে পারি : ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হলাে। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনাে ব্যক্তিকে তা জানালাম । বাঙালী ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল। (একটি জাতির জন্ম, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৬ ডিসেম্বর ‘৭২)। বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণের পর, ২৫ মার্চ-পরবর্তী ‘স্বাধীনতা-ঘােষণা’—এগুলাে ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।  [বি. দ্র. ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত কালজয়ী ভাষণ, যা সংগ্রহ করা খুবই সুলভ-কাণ্ডজ্ঞানের অভাবহেতু সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্নভাবে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১-এর দশমাস’ ও সিরাজ উদ্দীন আহমেদের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’—এই তিনটি বইয়ের দিকে আলােকপাত করা হলাে—আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে’—তিনটি বইয়ে শুরুটা একরকম হলেও পরবর্তী অংশে মুকুল ও ত্রিবেদীর বইয়ে আছে, আপনারা সকলে জানেন এবং বােঝেন কিন্তু সিরাজের বইয়ে আছে, ‘আপনারা সবই বােঝেন;…ত্রিবেদীতে আছে, এ দেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবাে।’
মুকুলে ‘আমরা’ শব্দটি নেই, সিরাজে আছে এ দেশকে আমরা গড়ে তুলবাে।’ পরের বাক্যটি তিন বইয়ে তিন রকম : ত্রিবেদী—‘বাংলাদেশের ইতিহাস করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস-মুমূর্ষ মানুষের রক্তের আর্তনাদ-এ দেশের করুণ ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস’; মুকুল—’বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ—এ দেশের ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস; সিরাজ‘২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষ নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। …মুকুল—’আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই’; ত্রিবেদী—“আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের অধিকার চাই। সিরাজ- ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই’; মুকুল—এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে—বাঙালিরা বুঝে সুঝে কাজ করবে; ত্রিবেদী-বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন; সিরাজ— ‘কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়; মুকুল ও ত্রিবেদী—এবং আমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবাে।’ সিরাজ …তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি…।’ একই ভাষণ, যা রেকর্ডকৃত অবস্থায় সহজেই পাওয়া যায়, এর ‘গ্রন্থরূপ’-এ যদি এত অসঙ্গতি থাকে, তাহলে ইতিহাসচর্চায় আমরা যে খর্ব, দায়সারা, উদ্দেশ্যবাদী বা অপরিপকৃ—এ সত্যটিই সামনে চলে আসে। এমন একটি ঐতিহাসিক ভাষণ, যেটিকে তুলনা করা হয় আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত ‘গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে, এর ‘বিকৃতি রােধ করা উচিত নয়?
আমরা যে খুব বিতর্কপ্রবণ জাতি, অন্ধকার নিয়ে মেতে থাকতে ভালােবাসি, কারাে অর্জিত সফলতার আলােকিত দিকগুলাে না দেখে কেবল তার ত্রুটি খুঁজে বেড়াই, এর একটি লজ্জাকর উদাহরণ হলাে, অনেক নিন্দুক বলে বেড়ায়—৭ মার্চের ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু নাকি ‘জয় বাংলার সাথে সাথে ‘জিয়াে পাকিস্তান’ উচ্চারণ করেছিলেন। এ ধরনের উদ্ভট কথা প্রসঙ্গে গােলাম মুরশিদ খুবই স্পষ্ট অভিমত রেখেছেন, কিন্তু টেলিভিশন কেন্দ্রে তার বক্তৃতার যে ভিডিও রেকর্ড ছিল, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এই অপবাদের কোনাে সমর্থন পাওয়া যায়নি’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, পৃ. ৭২)। কত মানুষ কত কথাই বলে, কিন্তু সবার কথা ধর্তব্যযােগ্য নয়, কিন্তু এমন অবান্তর কথাটি (বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধুর ‘জিয়াে পাকিস্তান’ বলা) যদি বলেন বিচারপতি ও প্রাজ্ঞ লেখক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, তাহলে হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।] 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র