You dont have javascript enabled! Please enable it! 1970.12.10 | ভুট্টো-ইয়াহিয়ার নতুন ষড়যন্ত্র - সংগ্রামের নোটবুক
ভুট্টো-ইয়াহিয়ার নতুন ষড়যন্ত্র
যে কোনাে সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী দলই পরবর্তী সরকার গঠন করে। কিন্তু অপরাষ্ট্র পাকিস্তান ছিল এ নিয়মের শশাচনীয় ব্যতিক্রম। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠনের নিঃসংশয় দাবিদার হয়ে উঠল, তখন গণতন্ত্রের সকল নিয়ম-কানুনকে অগ্রাহ্য করে ইয়াহিয়া-ভুট্টো মিলে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল। নির্বাচনের রায় এবং এ রায়ের প্রভাব সম্পর্কে প্রথম বিতর্কটি অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসেনি, এর সূত্রপাত ঘটান মওলানা ভাসানী-নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণার ঠিক পরের দিনই। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানিদের রায় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি গণভােট গ্রহণ করা প্রয়ােজন। দুদিন আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ যে রায় দিয়েছে, তা কোনাে ব্যক্তি বা পার্টি বা দফার জয় নয়। এ নির্বাচনের রায় ৬ দফা, ১১ দফা, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্যে জনগণের রায় বলে শেখ মুজিব যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা ঠিক নয়। (দৈনিক পাকিস্তান, ১০ ডিসেম্বর ‘৭০)। আবার স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে গণভােট চাওয়ার ক’দিন পরেই, ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাসানী বলেন, ‘পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব খর্ব হলে কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না। ভাসানীর এ বক্তব্য প্রকাশের পর পিডিপি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান অভিযােগ করেন, নির্বাচনে জনগণ ভুল রায় দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামের নেতা গােলাম আযম বলেন, এ নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা ছাত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ ভাসানীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠনের আহ্বান জানান।
১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ৬ দফাভিত্তিক প্রণয়ন-প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সহায়তা কামনা করেন। একই দিনে জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মােট ৮৮টি আসনে বিজয়ী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য ৭ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করে সবাইকে তাজ্জব বানিয়ে দেন। ২০ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তার দলের সহযােগিতা ছাড়া এককভাবে কেউ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা কেন্দ্রে সরকার গঠনের কাজ করতে পারবে না। অর্থাৎ ভুট্টো দেশ পরিচালনায় তার দলের অংশীদারিত্ব দাবি করে বসেন। এর জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন বা সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ একাই যােগ্য। কেউ সাহায্য করলে ভালাে, না করলে আওয়ামী লীগ এককভাবেই। তা করবে। (৩ জানুয়ারি ‘৭১ নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল সদস্যের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানটি করা হয় রমনার রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে তােমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতধর্মী কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জয়লাভ করলেই দাবি আদায় হয় না, এর জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হবে।… ষড়যন্ত্রের কারণে যদি আমার মৃত্যু ঘটে, তবু আপনারা নিরস্ত হবেন।
শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানের গণপ্রতিনিধিদের সহযােগিতা গ্রহণে রাজি আছি, কিন্তু নীতির প্রশ্নে কোনাে আপস করা হবে। শাসনতন্ত্র ছয় দফার ভিত্তিতেই হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জানুয়ারি, ‘৭১)।  নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনকল্পে ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনা করার পর সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেন। পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদকে নিয়ে ইয়াহিয়া যান লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে যান। সেখানে বেশ কয়েকবার রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে ইয়াহিয়ার মনােভাবে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়, শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী আখ্যায়িত করে যে বক্তব্য রেখেছিলেন ঢাকায়, তা তিনি বেমালুম অস্বীকার করেন। লারকানায় বসে ইয়াহিয়া (১৭ জানুয়ারি) নতুন একটি তত্ত্ব দেন জাতিকে, The people have given their dicision in favour of two majority parties. ইয়াহিয়ার সাথে বােঝাপড়া শেষ করে ভুট্টো এলেন ঢাকায় (২৭ জানুয়ারি)। বারবার বৈঠকে বসলেন শেখ মুজিবের সাথে, কিন্তু কোনােরূপ অগ্রগতি সাধিত হয়নি; শেখ মুজিব তার ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অনড় থাকেন আর ভুট্টো তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফিরে যান পাকিস্তানে। ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘােষণায় জানানাে হয়, আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে ‘জাতীয় পরিষদ’-এর প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
এর প্রেক্ষিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা (বা পাকিস্তানের অঘােষিত প্রধানমন্ত্রী) নির্বাচন করা হয়। সহকারী নেতা নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারি দলের নেতা (বা মুখ্যমন্ত্রী) নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, চিফ হুইপ নির্বাচিত হন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। সাংবাদিকদের কাছে নেতা নির্বাচন সংক্রান্ত এসব তথ্য পরিবেশন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশােয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগ দিতে ঢাকায় যাব না।’ তিনি আরাে বলেন, এ মুহূর্তে ঢাকায় গেলে তিনি এবং তার দলের অন্য সদস্যদের প্রাণ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। ভুট্টো কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান তাঁর বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন এবং পরদিন প্রাদেশিক গভর্নরদের বৈঠকে ‘অস্ত্রের ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানকে বশে আনবেন বলে দম্ভোক্তি প্রকাশ করেন। এ পর্যায়ে ১ মার্চ তিনি জানিয়ে দেন যে, জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন, যা ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল, অনিবার্য কারণবশত তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হলাে। জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত করার কারণ হিসেবে ইয়াহিয়া খান বলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ প্রয়ােজন’ কিন্তু এ ব্যাপারে দুই অংশের মধ্যে সমঝােতার লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় তিনি এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং এই অনাকাক্ষিত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত।
তবে ওই দিনই নেয়া তার সিদ্ধান্তগুলাে পর্যালােচনা করলে বােঝা যায়—এই পদক্ষেপটি ছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। ওই তারিখেই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান, যিনি বাঙালির প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল বলে বাজারে গুজব ছিল—তাকে সরিয়ে দিয়ে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সে পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। নিয়ােগ পাওয়ার পরপরই ইয়াকুব খান পাকিস্তানের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হতে পারে—এমন সংবাদ, মতামত বা আলােকচিত্র প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরােপ করেন এবং এ আদেশ ভঙ্গ করা হলে সামরিক বিধির ২৫ ধারা বলে সর্বাধিক ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে বলে সবাইকে হুশিয়ার করে দেন। একই সাথে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও নতুন গভর্নর নিয়ােগ দেয়া হলাে। পাঞ্জাবে লে. জেনারেল আতিকুর রহমান, বেলুচিস্তানে লে, জেনারেল রিয়াজ হােসেন, সীমান্ত প্রদেশে লে. জেনারেল কে এম আজাহার হােসেন, সিন্ধুতে লে. জেনারেল রাখমান গুলকে নিয়ােগ দানের মাধ্যমে সামরিক প্রশাসনকে ঢেলে সাজানাে হলাে।  জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সংবাদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় যেন বারুদ ছড়িয়ে দিল। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়, মিলকারখানা সবকিছু নিমিষে বন্ধ হয়ে গেল। সবাই নেমে এলাে রাস্তায়, সমস্বরে শ্লোগান ধরল আমজনতা—‘জয় বাংলা’; ‘পাকিস্তানের পতাকা, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ৬ দফা, ১১ দফা বাদ দিয়ে জনতা তখন এক দফায় আন্দোলিত, উদ্বেল—পূর্ণ স্বাধীনতা চাই।
হােটেল পূর্বাণীর সামনে লাখ লাখ জনতাকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ষড়যন্ত্র যদি আরাে চলে, তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নেবে। যে কোনাে ত্যাগ স্বীকার করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার কথা বলে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায়, পরের দিন সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘােষণা করবেন বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। ওই দিনই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে গঠিত হলাে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং ওই রাতেই ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, স্বাধীনতার প্রস্তাব পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন—ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখন। ২ মার্চ ঢাকাতেই কেবল হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল, কিন্তু কার্যত এ দিন সমগ্র প্রদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সামনে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ওই সভায় স্বাধীনতার প্রস্তাব পাঠ করেন। ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক এম এ রশীদ। (ওইদিন আ স ম আবদুর রব কর্তৃক স্বাধীনত বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল—এরকম একটি তথ্য পরবর্তীকালে প্রচার পেলেও, ওই সমাবেশ অনুষ্ঠানের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রনেতা আবদুল কুদুস মাখন, শামসুজ্জামান চৌধুরী, কাজী আরেফ আহমেদ প্রমুখ এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে ভিন্নমত পােষণ করেন। তাদের মতে, ওই দিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনসংক্রান্ত কোনাে কর্মসূচি ছিল না।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক স্মরণে রেজিমেন্টাল পতাকা ঘাড়ে করে যখন একটি জঙ্গি মিছিল আসে, তখন ওই পতাকাটিই হাত বদল হতে হতে রবের হাতে আসে, তখন তিনিসহ আরাে তিনজন ছাত্রনেতা ওই পতাকাটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন মাত্র। কাজী আরেফের স্পষ্ট অভিমত, শিবনারায়ণ দাশ কর্তৃক ওই পতাকা সৃজনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাই ছিল প্রধান এবং ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পতাকা উত্তোলন করা হয়নি, হয়েছে পতাকা প্রদর্শন।) একই দিনে পুরানা পল্টন ময়দানে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এক বিশাল গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, মতিয়া চৌধুরী, সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক প্রমুখ বর্তমান আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করার আহ্বান জানান। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা সিরাজ সিকদার মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা ও ধরন তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকে এর নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। ওই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চলমান হরতালকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন।
৩ মার্চ সারা বাংলায় অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়। জনগণ রাস্তায় নেমে জঙ্গিরূপ ধারণ করে, সেনাবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার জন্য স্থানে স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখে। ক্ষুব্ধ জনতার সাথে কোথাও কোথাও সংঘর্ষ বাধে সেনাবাহিনীর। এর প্রেক্ষিতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়। হরতাল শেষে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আহূত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা মরিবার জন্য প্রস্তুত; ভয় দেখাইয়া লাভ নাই।… আমি মরে গেলেও সাত কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হইয়াছে।’ ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভাের ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক গৃহীত কয়েকটি প্রস্তাব ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে শােনানাে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রস্তাব হলাে—
১. স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং
২. দলমত নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি নরনারীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের
নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। ইশতেহারে বলা হয়—১. ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগােলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। ২. বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রতিটি অঞ্চলে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে; মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। ৩. বর্তমান সরকারকে বিদেশি সরকার গণ্য করে এর সকল আইনকে বেআইনি বিবেচনা করতে হবে। অবাঙালি সেনাবাহিনীকে শত্রু হিসেবে গণ্য এবং এদের খতম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬৬-৬৬৭)।
এ দিনই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইকবাল হল’-এর নাম পরিবর্তিত করে নতুন নাম রাখা হয় ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি, যাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান-বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।) ৩ মার্চ নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে গােলটেবিল বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। ১০ মার্চ ঢাকায় সে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানাে হলাে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সে আহ্বানকে ‘বন্দুকের নলের মাথায় নিষ্ঠুর তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে দেন। বস্তুত তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতাবিষয়ক আলােচনার পরিসর ক্রমেই ছােট্ট হয়ে আসছে। বাঙালি জনগােষ্ঠী এমনভাবে জেগে উঠেছে যে, তারা এখন পশ্চিমের কাছ থেকে কোনাে সুবিধাদি চায় না, তাদের কাম্য বস্তু এখন একটাই—স্বাধীনতা। কী নির্ভয়ে তারা সামরিক বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে রাস্তায় নেমে গগনবিদারী স্লোগান দিচ্ছে, বড় বড় গাছ বা ইট ফেলে জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড রচনা করছে, ‘জয় বাংলা’ বলে বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে, কী অমিত বিক্রম আর দেশপ্রেম নিয়ে সশস্ত্র পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বেতার-টেলিভিশনের শিল্পী-কুশলী, লেখক-বুদ্ধিজীবী—সবাই এখন এক দফা এক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন, এই প্রবল জনস্রোত, বিদ্রোহী চেতনাকে রুখতে পারে। এমন সাধ্য কার?’ কোথাও কোনাে সরকারি কর্তৃত্ব নেই, জংলি আইনের প্রতি ন্যূনতম ভীতি নেই, সমস্ত দেশ যেন একাত্ম হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাঁর কাছ থেকে স্বপ্নময় দিকনির্দেশনা কামনা করছে। উদ্বেল। আলােড়িত শেখ মুজিব ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে মনোেযােগী হয়ে উঠলেন।
৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী গােপন বৈঠক করেন এবং বেলুচিস্তানের কসাই’ হিসেবে কুখ্যাত ও ধিকৃত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ দান করেন (কিন্তু ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী নরঘাতক টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করায়—টিক্কা খানের গভর্নর হওয়ার সাধ আপাতত পূরণ হলাে না, তাকে বেশ ক’মাস। কাটাতে হয়েছে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে) এবং এর পরদিন, ৬ মার্চ বেতার ভাষণে আগামী ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ঘােষণা প্রদান করেন। এ ভাষণে পাকিস্তানের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য প্রকারান্তরে তিনি শেখ মুজিবকে দায়ী করেন এবং হুমকি দেন, যে কোনাে মূল্যে তিনি পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করবেন। এবং তা করার জন্য দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যে প্রস্তুত হয়েই আছে, তা দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন। ইয়াহিয়া একদিকে আলােচনার দ্বার উন্মুক্ত করে। রাখলেন, অন্যদিকে ‘শতাব্দীর ভয়াবহতম নৃশংসতা’ ঘটানাের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। [বি. দ্র.: কোটি কোটি মানুষের নির্বাচনী রায় বানচাল করা এবং সেই সাথে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণহত্যা ঘটানাের ধিকৃত সিদ্ধান্ত নেয়া—স্বৈরশাসক হিসেবে তকমা-আঁটা থাকলেও—এ কাজে হাত দেয়া যে কোনাে স্বৈরশাসকের পক্ষে সম্ভব নয়। এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পেরেছে চেঙ্গিস খান, হিটলার-মুসােলিনি—তারা পেরেছে, এজন্য যে, জন্ম ও কর্মসূত্রে তারা সর্বদা  ক্ষমতালিপ্সা, ভােগ-প্রতিহিংসা-মিথ্যাচার-ভণ্ডামির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে; ভুট্টো ও ইয়াহিয়া জন্ম ও কর্মসূত্রে কীভাবে, কোন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, একটু পর্যালােচনা করে দেখা যাক : জুলফিকার আলী ভুট্টো : লারকানার প্রভাবশালী ভূস্বামী শাহনেওয়াজ ভুট্টোর সন্তান জুলফিকার আলী ভুট্টো বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ডের ছাত্র। আমেরিকাতেও লেখাপড়া করেছেন।
ব্যারিস্টার হয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন সিন্ধু হাইকোর্টে। পেশায় সুনাম অর্জিত হওয়ার পর দৃষ্টি কাড়েন। আইয়ুব খানের। আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে যােগ দেন। ১৯৬১ সালে ঢাকার আইনজীবী আবদুল আহাদের পত্নী হুসনা শেখের সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং পরিচয় থেকে পরিণয়ের সূত্রপাত। কর্মব্যস্ত ভুট্টো ঢাকায় আসার সুযােগ পান না, তাই হুসনাই করাচি যান ঘনঘন। ব্যাপারটা জানতে পেরে ভুট্টোর স্ত্রী বেগম নুসরাত এই অবৈধ কাজ থেকে স্বামীকে ফেরানাের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে ভুট্টোর বিরুদ্ধে নালিশ জানান প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কাছে। আইয়ুব তাকে ডেকে পাঠান এবং নুসরাতের সামনেই কড়া ভাষায় ধমকান। শেষে বলেন, হুসনার সাথে সম্পর্ক রাখলে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হবে আর মন্ত্রিত্ব রাখতে চাইলে হুসনাকে ছাড়তে হবে। ভুট্টো হুসনাকেই ছাড়লেন এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, এই অপমানের প্রতিশােধ তিনি নেবেনই। সেনাবাহিনীর সাথে যােগাযােগ করতে লাগলেন। পীরজাদা, ইয়াহিয়া, হামিদ, গুল হাসান প্রমুখ বড় বড় অফিসারের সাথে সখ্য গড়ে তুললেন। ১৯৬৫ সাল, ভুট্টো তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আইয়ুবের হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তাদের লাহোের শহরটি ভারতের দখলে যায় যায় অবস্থা। বিপদ বুঝতে পেরে রুশ নেতা কোসিগিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মানতে সম্মত হন আইয়ুব। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ৪ জানুয়ারি ‘৬৬ ‘তাসখন্দ’-এ বিস্তারিত আলােচনার প্রেক্ষিতে দুই প্রতিপক্ষ এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। ভারতের দাবি অনুযায়ী ওই আলােচ্যসূচিতে ‘কাশ্মীর’ প্রসঙ্গ রাখা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধ-ক্ষস্তি আইয়ুব, নিজের জনগণকে বুঝ দেয়ার জন্য আলােচ্যসূচিতে যাতে ‘কাশ্মীরকে রাখা হয়, এ-ব্যাপারে সােভিয়েত নেতৃত্বকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোকে মস্কো প্রেরণ করেন।
আইয়ুবের ওপর প্রতিশােধ নেয়ার অপেক্ষায় থাকা ভুট্টো মস্কোতে গেলেন, কিন্তু কাশ্মীর’ প্রসঙ্গে কোনাে কথা না বলেই ফিরে গেলেন ইসলামাবাদে এবং প্রেসিডেন্টকে মিথ্যে বললেন, ‘আলােচনা চমৎকার হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি তাসখন্দে গিয়ে আইয়ুব বুঝতে পারেন যে, ভুট্টো তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। কিন্তু তখন কিছু করার উপায় নেই, যেন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন—এমন একটা দলিলে সই করতে বাধ্য হন আইয়ুব। পাকিস্তানের জন্য লজ্জাকর এই চুক্তির খবর জানাজানি হতে দেরি হলাে । দেশে ফিরে আইয়ুব দেখতে পেলেন ওই তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে হাজার হাজার ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে এসেছে। এর ক’দিন পর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যেন বােমা ফাটালেন ভুট্টো। তাসখন্দ চুক্তির সমালােচনায় উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠলেন। পাকিস্তানি জনগণ ভুট্টোর কথায় চমকে যায়। দেশের স্বার্থরক্ষার বিষয় নিয়ে একজন প্রতাপশালী প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে সরব হয়েছেন একজন মন্ত্রী; তার সাহস আছে বটে, সেইসাথে দেশপ্রেমও। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মােহবিস্তারী জ্যোতিষ্কে পরিণত হন ভুট্টো। মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন, দল গড়লেন, আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন হলেন। এরপর অনেক ঘটনা-উপঘটনার মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া-হামিদ-পীরজাদার সহায়তায় ভুট্টো তার মনের আশা পূরণ করতে সক্ষম হন, ২৪ মার্চ ‘৬৯ আইয়ুবের পতনের মধ্য দিয়ে। ভুট্টো কেবল আইয়ুবের সাথেই বেঈমানি করেননি, তিনি বেঈমানি করেছেন বাংলার জনগণের সাথে, শেখ মুজিবের সাথে, এমনকি ইয়াহিয়ার সাথেও।
তিনিই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে ইয়াহিয়াকে নানাভাবে প্ররােচিত করেছেন; বুদ্ধি দিয়েছেন, মাত্র কয়েক হাজার বাঙালি নিধন করলেই ‘আন্দোলন-ফান্দোলন’ সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তার বুদ্ধিমতাে ইয়াহিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পুরাে দায়ভার নিজের ঘাড়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন, তবু শেষরক্ষা হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখা গেল না, নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত হতে হলাে এবং এই পরাজয়ের সূত্র ধরেই ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভুট্টো গেলেন কারাবন্দি শেখ মুজিবের কাছে, মুজিবকে ভয় দেখিয়ে, লােভ দেখিয়ে ওয়াদা করানাের চেষ্টা করেছেন, তিনি। যেন অখণ্ড পাকিস্তান, নিদেনপক্ষে কনফেডারেশন গঠনে রাজি হন। কিন্তু তাতে লাভ হলাে না কোনাে, মুজিব সদ্য অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে একচুলও সরে এলেন না। এরপর ভুট্টো মহাবিপাকে পড়েন, ইন্দিরার সাথে ‘বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত প্রস্তাবিত সিমলা বৈঠক নিয়ে। এপ্রিল ‘৭২ ইতালির বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বলেছিলেন, “ইন্দিরা আমার কাছে একজন সাধারণ মানের মহিলা, সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্না।… একটি ভাবনা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, সেটা হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন গার্ড সৈনিকের প্রহরায় আমাকে ওই মহিলার শারীরিক সংস্পর্শে আসতে হবে। সেটা আমার জন্য গাত্র দাহকর।
‘৭২ সালের জুন মাসে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ইন্দিরা-ভুট্টোর বৈঠক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ইতালীয় পত্রিকায় ভুট্টোর শিষ্টতাবর্জিত সাক্ষাৎকারটি পড়ে ইন্দিরা খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং ভুট্টোর সাথে সিমলা বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে ভুট্টো পড়েন বিপাকে, কারণ ওই বৈঠকে বসার দায় তারই বেশি। তিনি রােমে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে বার্তা পাঠান, তিনি যেন ফালাসিকে খুজে বের করেন এবং বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সনির্বন্ধ অনুরােধ, ফালাসি যেন ওই সাক্ষাৎকারের কথাগুলাে ভুট্টোর কথা নয়, এগুলাে তারই বানানাে কথা—এটা স্বীকার করে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। রাষ্ট্রদূত ফালাসির সাথে দেখা করলেন, তার প্রেসিডেন্টের আকুতির কথাটি বললেন, ফালাসি তখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, রাষ্ট্রদূত মহাশয়, আপনার মতাে আপনার প্রেসিডেন্টেরও মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে নিশ্চয়ই।’ এর পর থেকে ফালাসি যখনই যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই ভুট্টোর পক্ষ থেকে এক বা একাধিক কর্মকর্তা গিয়ে তাকে অনুরােধ করেছেন, প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু তাতে ফালাসির মন গলেনি। শেষপর্যন্ত মানবিক দিক বিবেচনা করে ইন্দিরা নিজেই বাঁচিয়ে দেন উন্নাসিক ভুট্টোকে, তিনি বৈঠকে বসতে সম্মত হন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভুট্টোর অভিমত, ‘তিনি অযােগ্য, অতিশয় আত্মম্ভরী, অসংস্কৃত, কাণ্ডজ্ঞানরহিত—সবকিছুই।… কীভাবে চিৎকার করতে হয়, সেটাই তিনি জানেন মাত্র।’ ভুট্টো সম্পর্কে ওরিয়ানা ফালাসির অভিমত, “…তিনি ক্ষমতা ভালােবাসেন।
তার কথা শুনে, আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, তার উদ্দেশ্য মহৎ। তিনি নির্ভেজাল সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে চান। কিন্তু এর পরপরই আপনি যদি করাচিতে তার লাইব্রেরিতে ঢােকেন, দেখতে পাবেন মুসােলিনি ও হিটলারের মহার্ঘ্য গ্রন্থগুলাে যত্ন সহকারে রাখা আছে এবং সেগুলাে সােনালি মােড়কে বাঁধাই করা।’ এই ক্ষমতাপাগল, ধুরন্ধর, বিশ্বাসঘাতক, ঠাণ্ডা মাথার খুনি’ ভুট্টো নিজেও শেষপর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। ছয়জন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে, বিশ্বাসভাজন বলে তিনি যাকে সেনাপ্রধান করেছিলেন, সেই জিয়াউল হকই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন (জুলাই ‘৭৭) এবং ৪ এপ্রিল ‘৭৯ ফাঁসির দড়িতে ঝােলান। জেনারেল জিয়া ধারণা করতেন, ভুট্টোর জন্মদাত্রী যেহেতু ধর্মান্তরিত হিন্দু রমণী লক্ষ্মী বাঈ, তাই তার খতনা করা না-ও হতে পারে। এই সন্দেহ থেকে জিয়ার আদেশ মােতাবেক মৃত ভুট্টোর নির্মাঙ্গের ছবি তুলে পরীক্ষা করা হয়েছিল, খতনার মাধ্যমে তিনি প্রকৃত মুসলমান হয়েছিলেন কি না। আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান : আইয়ুব খানের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া তার প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রতি কারণেঅকারণে ভক্তি দেখাতেন এই বলে যে, ‘আইয়ুব আমার পিতার মতাে।’ পিতা তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি সেনানায়করা ক্ষমতালাভের জন্য কতটুকু ভয়ঙ্কর ও বিশ্বাসঘাতক হতে পারেন। সেই বােধ থেকে বেশ ক’জন সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে তিনি পুত্রকে করলেন সেনাপ্রধান—এই ভেবে যে, বিপদের দিনে পুত্র অবশ্যই রক্ষা করবেন পিতাকে।
পিতা আইয়ুব খান নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন, পাঠানমােগল আমলে সিংহাসনের লােভে কত আসল পিতা আসল পুত্ৰকর্তৃক হত হয়েছেন, আর ইয়াহিয়া তাে স্ব-স্বীকৃত পুত্র, তার ওপর বিশ্বাস রাখা ঠিক হবে কি না। | ২৯ জানুয়ারি ‘৬৮ আইয়ুব খান হৃদরােগে আক্রান্ত হন। খবরটি পাওয়া মাত্রই সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। প্রেসিডেন্টকে সুস্থ করে তােলার নাম করে ইয়াহিয়া তখন কোনাে মন্ত্রী বা অন্য কোনাে কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্টের ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিতেন। না। ছ’ সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সুস্থ হয়ে উঠলেন, কিন্তু ততদিনে ইয়াহিয়া ক্ষমতার স্বাদটুকু বুঝে গেছেন, ফলে ক্ষমতার সবটুকু নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলেন না আইয়ুবের কাছে। ইতােমধ্যে ক্ষমতালােভী বেশ কজন জেনারেল হামিদ, গুল হাসান, পীরজাদা, ওমর এবং হঠাৎ আইয়ুববিদ্বেষী বনে যাওয়া রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ এসে ভিড় করলেন ইয়াহিয়ার পাশে। আইয়ুব জানতেই পারলেন না, কখন তার সন্তানতুল্য ইয়াহিয়া ক্ষমতালিপ্সায় আক্রান্ত হয়ে পিতার বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছেন। পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে ইয়াহিয়ার বােধহয় চক্ষুলজ্জা একটু বেশিই ছিল, তা-ই হুট করে তিনি আইয়ুবকে ক্ষমতার চেয়ার থেকে ফেলে দিলেন না, সবই করেছেন ধীরে ধীরে, পরিকল্পনামতাে, আর এর চূড়ান্তরূপ প্রকাশ পায় ২৪ মার্চ ‘৬৯; ওইদিন পাকিস্তানের নতুন সামরিক শাসক হয়ে আবির্ভূত হন ইয়াহিয়া খান।
(তথ্যসূত্র : বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙন : মাসুদুল হক। ইয়াহিয়া খানের চারিত্রিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবার্ট পেইন লিখেছেন,  ‘নারীতে আসক্তি ছিল ইয়াহিয়া খানের। প্রায়ই নাইট ক্লাবে তার সাথে দেখা যেত জনচারেক মেয়েকে। সরকারি তহবিল থেকে টাকা-পয়সা নেয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না। শুধু নারী আসক্তি নয়, প্রচণ্ড মদখােরও ছিলেন ইয়াহিয়া খান। ব্যবহারে ভদ্রতা শব্দটি সম্ভবত তার অভিধানে ছিল না।  রেডিও-টিভিতে তার ভাষণগুলাে বেরিয়ে আসত ভাবলেশহীন কাটা কাটা শব্দ হিসেবেই। আবরণ দিয়ে ভান করেও ইয়াহিয়া খান তার বর্বরতাকে ঢাকতে পারেননি।… কথাবার্তা মেধা মননে ইয়াহিয়া খানের সাধারণ যােগ্যতাও ছিল। দেশের সার্বিক সামাজিক-রাজনীতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে তার অজ্ঞতা ছিল পাহাড়প্রমাণ। নিছক সৈনিক হিসেবেই বেড়ে ওঠে ইয়াহিয়া খানের জীবন। ক্ষমতা, সম্পদ, নারীসঙ্গ খুব চমৎকার উপভােগ করতেন ইয়াহিয়া খান। নিজে মদ খেতে পছন্দ তাে করতেনই, আনন্দ পেতেন মদ খাইয়েও। বর্তমান যুগে এ ধরনের শাসক কীভাবে টিকে আছে সেটা ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার।’ (রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, গােলাম হিলালী অনূদিত, বাংলাদেশ-গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ঙ্কর অধ্যায়, পৃ. ২৬)।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র