You dont have javascript enabled! Please enable it!
১৯৭০-এর নির্বাচন এবং বাঙালির একক নেতার আবির্ভাব
[বি. দ্র. : রাজনীতির ক্ষেত্রে সােহরাওয়ার্দীকে গুরু মানতেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানপন্থি, ক্ষমতালােভী সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক গৃহীত অনেক পদক্ষেপ শেখ মুজিবের মনঃপুত হয়নি, তবু তিনি নীরবে মেনে নিয়েছেন, গুরুর বিরুদ্ধে যাননি। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল ধারাটি ভাসানীর নেতৃত্বে ‘৫৭ সালে ন্যাপ গঠন করল, চিন্তায় মননে প্রগতিবাদী হয়েও বঙ্গবন্ধু এ অংশের সাথে যাননি, তিনি থেকেছেন গুরু সােহরাওয়ার্দীর সাথেই। পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুবের আবির্ভাবের পর, সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে শেখ মুজিবের গােপন-নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে, মূলত ১৯৬১ সালের পর থেকে; তখন থেকে শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনৈতিক প্রগতিচেতনার মধ্যে জোর প্রভাব ফেলে রাজনীতির বামদর্শন’ এবং এ দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু (৫ ডিসেম্বর ‘৬৩) পরবর্তী শেখ মুজিবের রাজনীতিতে।]  ইয়াহিয়া কর্তৃক ‘আইনগত কাঠামাে আদেশ জারির পর এর বিভিন্ন ধারা উপধারা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি দুদিনব্যাপী (১ ও ২ এপ্রিল ‘৭০) বৈঠক করে ওই ‘আদেশ কাঠামাের বিভিন্ন অংশ সংশােধন করার দাবি জানায়। মওলানা ভাসানী, ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, প্রগতি লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান ওই আদেশের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন।
কিন্তু ওই আদেশ বলবৎ রাখার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অনমনীয় মনােভাব প্রকাশ করায় (২৮ জুলাই বেতার ভাষণ) কিছু নেতা—যেমন মওলানা ভাসানী, মুসলিম লীগের আবদুল কাইয়ুম খান প্রমুখ পূর্ব বাংলায় বন্যার প্রকোপের কথা বলে নির্বাচনের তারিখ পেছানাের জন্য জোর দাবি জানাতে থাকেন। তাঁদের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘােষণা করা হয়, জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হবে ৭ ডিসেম্বর, আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে ১৭ ডিসেম্বর। বস্তুত নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার কাছে গােয়েন্দা রিপাের্ট এরকম ছিল যে, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পেতে পারে, কেন্দ্রে সরকার গঠন করার মতাে আসন কোনােভাবেই পাবে না। রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন ১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপকূল অঞ্চলে শতাব্দীর ভয়াবহতম সাইক্লোন এসে আঘাত হানে। পটুয়াখালী, বরগুনা, ভােলা, পিরােজপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নােয়াখালী, বরিশাল অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। বেসরকারি হিসাবমতে, ওই সাইক্লোনে দশ লক্ষাধিক মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দুর্গত অঞ্চলে গিয়ে সাধ্যমতাে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান ছাড়া অন্য কোনাে নেতা বিপর্যস্ত এলাকায় যাওয়ার প্রয়ােজন বােধ করেননি। পশ্চিমের এমন অমানবিক, পাষণ্ড আচরণ পূর্ব বাংলার জনগণকে মর্মাহত করে, তাদের চোখে আবারাে ভাসতে থাকে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার ছবি।

নির্বাচনে অংশ নেয়া, না-নেয়ার ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ আগে থেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিল। এবার ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলার কথা বলে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। তবে সিদ্দিক সালিক অভিমত পােষণ করেছেন, ওই নির্বাচনে শাসকগােষ্ঠী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও RUCE) : The Government ran special trains to Tangail and arranged power supply at the site to make rally a success. Some political owls in the Government House wanted the N AP (B) of stay and develop as a political counter-weight to the Awami League. (Witness to Surrender, page 06). অনুরূপভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন কৃষক-শ্রমিক দলের এস, এম. সােলায়মানও, নির্বাচনের মাত্র তিন দিন আগে ঘূর্ণিঝড়ের অজুহাত তুলে তিনি নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কোমর বেঁধে নির্বাচনী

আওয়ামী লীগের এই ভূমিধস বিজয় সম্পর্কে চমকার বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক, বাম-তাত্ত্বিক যতীন সরকার : “এসব নির্বাচনে ভােটারদের কাছে বিশেষ প্রার্থীটির ব্যক্তিগত পরিচয় মােটেই বড় হয়ে দেখা দেয় না, বড় হচ্ছে তার দলীয় পরিচয়। আর দলীয় পরিচয়ের প্রতীক হয়ে আসে তার বড় নেতা, সেই নেতাকে লক্ষ্য করেই তারা ভােট দেয়।… নেতারা ভােটারদের বলেছেন, ‘আমরা যাকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছি, সে যদি কলাগাছও হয়, তবু তাকেই আপনারা ভােটটা দেবেন : কলাগাছ হলেও আমাদের কথাতেই সে চলবে-ফিরবে, তাকে ভােট দিলেই আমরা আপনাদের প্রাপ্য আদায় করে দিতে পারব। সত্তরের নির্বাচনেও তারা তাদের নেতা শেখ মুজিবের কলাগাছেই ভােট দিয়েছে। নৌকা প্রতীকটিকেই তারা চিনেছে, অন্য কোনাে দিকেই তাকানাের প্রয়ােজন মনে করেনি। এ রকম করে যে তারা ভুল করেনি, ইতিহাসই তার সাক্ষী।” (পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, পৃ. ৩৩৯)। বস্তুত এ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের কোনাে আসন পায়নি আওয়ামী লীগ। তবে পূর্ব বাংলায় অবিস্মরণীয় বিজয়ের প্রেক্ষিতে, এ অংশে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!