You dont have javascript enabled! Please enable it!
জনগণ নয় নেতা ভুল করেছেন বারবার
পৃথিবীতে যখন যেখানে স্বৈরাচার বা নষ্ট শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের চাটুকারিতা করার জন্য উর্বর, অনুর্বর, নষ্ট-ভ্রষ্ট মাথাওয়ালা লােকের অভাব হয়নি। ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষ শাসন করেছে, তারা কেবল নিজস্ব শক্তির জোরে রাজদণ্ড পরিচালনা করেনি। ভারতীয়দের বিরাট একটা অংশ, শিক্ষিতমেধাবী-বিত্তবান লােকজন রাজশক্তিকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছে—নানাবিধ সুবিধালাভের আশায়। বস্তুত ওই সুবিধাবাদী ধনিক, শিক্ষিতদের নিরলস সহযােগিতার বলে মাত্র কয়েক লক্ষ ইংরেজ কোটি কোটি ভারতবাসীকে প্রায় দুশাে বছর পদানত করে রাখতে পেরেছে। পাকিস্তানি জমানাতেও নষ্ট, ভ্রষ্ট, ভণ্ড শাসকদের চারপাশে স্বজাতিবিদ্বেষী বাঙালি বিশ্বাসঘাতকদের আনাগােনা কম ছিল না। বঙ্গসন্তান নূরুল আমীন, ফজলুর রহমান, মােনায়েম খানের বিশ্বাসঘাতকতা আমরা মানতে পারি সহজেই, কারণ বিশ্বাসঘাতকতা করা তাদের চরিত্রেরই অংশ—আমরা বিস্ময়াবিষ্ট হই তখনই, যখন আমাদেরই বন্ধু বলে কথিত কোনাে কোনাে নেতা নিজের স্বার্থ বা ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে অপশক্তির সাথে হাত মিলিয়েছেন এবং বিজাতি কর্তৃক বাঙালি দলন-পীড়নে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সহায়তা দান করেছেন।  ১৯৫৪ সালে, নির্বাচনের আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, তৎকালীন ছাত্র নেতৃবৃন্দের চাপের মুখে যুক্তফ্রন্টে সামিল হয়েছিলেন; কিন্তু কদিন পর হঠাৎ করে তিনি ইসলামপন্থি নেজামে ইসলামকে ‘যুক্তফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গোঁ ধরেন। বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে শরিক দলগুলাে ফজলুল হকের এ প্রস্তাব মেনে নেয়।
তখন নেজামে ইসলাম স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে, জনাব হকের সম্মতির ভিত্তিতে ফ্রন্টের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তােলে। শেষপর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি বিশাল ঔদার্যের পরিচয় রেখে ফ্রন্ট থেকে সরে দাঁড়ায়। ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চব্যাপী অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভােটে বিজয়ী হয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। শুরুতেই নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে গােল বেঁধে যায়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় নিতে অস্বীকৃতি জানান ফজলুল হক। শেষ পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হলেও যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলাের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস অতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ‘৫৪-এর নির্বাচনে, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা সম্পর্কে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া লিখেছেন, ‘নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় আঁচ করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী জনাব ফজলুল হকের সাথে আঁতাত গঠনের গােপন চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বিরােধিতা এবং এই ষড়যন্ত্ৰতথ্য অকালে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়—তা ফলপ্রসূ হয়নি। (পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর, পৃ. ৪৯)।  মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর, ৩০ এপ্রিল ফজলুল হক যান কলকাতায়। সেখানকার এক সংবর্ধনাসভায় তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে অপ্রত্যাশিত কিছু কথা বলেন, রাজনৈতিক কারণে বাংলাকে বিভক্ত করা যাইতে পারে, কিন্তু বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বাঙ্গালিত্বকে কোনাে শক্তিই কোনাে দিন ভাগ করিতে পারিবে না। দুই বাংলার বাঙ্গালী চিরকাল বাঙ্গালীই থাকিবে।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : ড. মােহাম্মদ হাননান, পৃ-৮৮)। এবং বাঙালি এক অখণ্ড জাতি।
আশা করি ভারত কথাটির ব্যবহার করায় আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উহার দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে বুঝাইয়াছি। আমি এই বিভাগকে কৃত্রিম বিভাগ বলিয়া মনে করিব। আমি ভারতের সেবা করিব। দুই বাংলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে তাহা একটি স্বপ্ন ও ধোকা মাত্র। করুণাময় খােদাতায়ালার দরবারে আমার একটি প্রার্থনা, তিনি যেন এই ব্যবধান দূর করেন। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক কালাহানের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় চারদিকে রটে যায় যে, ওই সাংবাদিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ফজলুল হক নাকি বলেছেন, প্রয়ােজনবােধে পূর্ববঙ্গ স্বাধীনতা ঘােষণা করিবে।’ এ বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, পাকিস্তানি শাসকচক্র খবরটিকে দাবার চাল হিসেবে ব্যবহার করে, এবং নতুন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনে ৩০ মে শপথ নেয়ার মাত্র এক মাস সাতাশ দিন পর—৯২(ক) ধারাবলে (এটি ১৯৩৫ সালে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ ধারা, যার বলে সুনির্দিষ্ট অভিযােগের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিলপূর্বক সেখানে গভর্নরের শাসন বলবৎ করতে পারেন) ওই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। ৩০ মে রাতে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী—দীর্ঘ ঊনত্রিশ মিনিটের বেতার ভাষণে বলেন, ‘যুক্তফ্রন্টের নেতা ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক হচ্ছেন এমন এক রাজনীতিবিদ যিনি নীতিগতভাবেই পাকিস্তানবিরােধী।
এসব বিবেচনা করেই হক মন্ত্রিসভা বাতিল করা ব্যতীত কেন্দ্রের আর কোনাে পথ ছিল না।’ (পাকিস্তান অবজারভার, ৩১ মে ‘৫৪)। এরপর মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জাকে নিযুক্তি দিয়ে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন চালু করা হয়। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি রাজনীতিতে, বিশেষত বাঙালি-বিষয়ে মার্কিনি হস্তক্ষেপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিলড্ৰেথ কূটনৈতিক পর্যায়ের সকল শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা আশিটি আসন পাবে মুসলিম লীগ। কিন্তু ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগের গো-হারা দেখে হিলড্রেন্থ নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচন দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকারের কোন রদবদল হইবে না বা কেন্দ্রীয় সরকার প্রভাবিত হইবে না’ (তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) : পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর, পৃ. ৫৯]। হিলড্রেথের অযাচিত রাজনৈতিক মন্তব্য নিয়ে পূর্ব বাংলা যখন উত্তাল, ঠিক তখন (১৯ মে, ‘৫৪) পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণের নামে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বস্তুত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করার পর পূর্ব বাংলার জনমানসে এই সন্দেহ প্রবল হয়ে ওঠে যে, নতুন মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পেছনে মার্কিন সরকারের কালাে হাত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ইতঃপূর্বে ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে সােহরাওয়ার্দীর অবস্থান এবং যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে শেরে বাংলার নেতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে। আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতাদ্বয়ের আরাে কিছু অপ্রিয় কাজ দুর্ভাগ্যবশত দেখতে পাই যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত হওয়ার পর। বরখাস্তকৃত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ঘােষণা দিয়েছিলেন (২৩ জুলাই, ‘৫৪), তিনি আর রাজনীতি করবেন না।
কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এ ওয়াদা থেকে সরে এসে, ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যােগদান করেন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই উক্ত পদ থেকে ইস্কান্দর মীর্জা কর্তৃক অপসারিত হন। অপসারণের অপমান গায়ে না মেখে জনাব হক তখন মীর্জার তােষামােদি করে বলেন, “ইস্কান্দর মীর্জা একজন বাঙালি এবং তার দেহে রয়েল ব্লাড বা রাজরক্ত রহিয়াছে” [পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর : তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) পৃ. ৭২] এ-রকম চরম তােষামােদিতে খুবই প্রীত হন ইস্কান্দর মীর্জা এবং পুরস্কার হিসেবে তার স্তাবক ফজলুল হককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বানিয়ে দেন। গভর্নর হয়েই ফজলুল হক আওয়ামী সমর্থিত মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে বরখাস্তকরণের মধ্য দিয়ে তার কর্মচর্চা শুরু করেন। | ডিসেম্বর ‘৫৪, সােহরাওয়ার্দী তখন সুইজারল্যান্ডে। হঠাৎ মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে করাচি চলে আসেন তিনি এবং বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর অধীনে আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন (২০ ডিসেম্বর)। তিনি একবারও ভাবেননি, ১৯৪৬ সালে তিনি যখন যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তখন তাঁরই অধীন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন এই মােহাম্মদ আলী। একজন কনিষ্ঠ নেতার অধীন সােহরাওয়ার্দীর মতাে ডাকসাইটে বয়ােজ্যষ্ঠ নেতার মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া শােভন হয়েছে কি না, তা এক জটিল প্রশ্ন। যা হােক, আইনমন্ত্রী হয়েই সােহরাওয়ার্দী এমন সব উদ্যোগ নিতে থাকেন, যা তাঁর দলের জন্য তাে বটেই, এমনকি পূর্ব বাংলার আপামর জনতার জন্যও ছিল চরম হানিকর।
তার ইউনিট প্রথা (পূর্ব বাংলা এক ইউনিট আর পশ্চিমের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশকে একটি প্রদেশে পরিণত করে অন্য একটা ইউনিট), সংখ্যা সাম্যনীতি (জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মােটের উপর পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবেন আইনসভার ৪০ জন প্রতিনিধি, (মুসলমান। ৩১ জন, অমুসলমান ৯ জন) আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবেন ৪০ জন প্রতিনিধি। পরিকল্পনার সূত্র ধরে তিনি সবাইকে, বিশেষত বাঙালি জনগােষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, ‘যদি দেশবাসী এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে প্রয়ােজনবােধে সামরিক আইনের মাধ্যমেই তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে।’ (অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি, পৃ. ২৩০)। বস্তুত ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে বাঙালি যাকে সম্মান দেখায়, তিনিই কি না পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক শাসনের বাতাবরণ তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বােঝাই যায়, সােহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত সুবিধা বাতিল করে বাঙালির পায়ে কুড়াল মারতে চেয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দীর আরেকটি দর্শনের নাম শূন্যতত্ত্ব। তিনি মনে করতেন, তৎকালীন জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাের মিলন মানে শূন্যের (শক্তিহীন, দুর্বল অর্থে) সাথে শূন্যের মিলন—যার যােগফল হবে শূন্য। কিন্তু যদি ব্রিটেন অথবা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী হয় এবং তাদের শক্তির বহর যদি ৫ হয়, তাহলে শূন্যের সঙ্গে যােগ করলে তা অর্থাৎ পাকিস্তান পাঁচ হবে, ০+৫= ৫।’ (সাক্ষাৎকার : সিরাজুল আলম খান, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ১৯৬৩-৬৫)। তাঁর এই শূন্যতত্ত্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাবকে বাড়িয়ে দেয় এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়াতলে নিয়ে যেতে থাকে। তার দোলাচলবৃত্তি, কখনাে-বা পশ্চিমের স্বার্থ রক্ষার নীতি বঙ্গীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বস্তুত সােহরাওয়ার্দীর রাজনীতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরস্পরবিরােধী তথ্যের সমাবেশ দেখতে পাই; কারাে বর্ণনার তুলিতে তিনি মানবিকতা-ঋদ্ধ দীপ্তিতে চিত্রিত হয়েছেন, আবার কারাে বর্ণনায় তিনি উপস্থাপিত হয়েছেন ‘ক্ষমতালােভী’, ‘পাষণ্ড’ হিসেবে। সিরাজ উদ্দীন আহমেদের লেখায় পাই, দেশ বিভাগের পর ‘হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে না এসে পশ্চিম বাংলা, বিশেষ করে ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য ভারতে অবস্থান করে মহাত্মা গান্ধীর সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়ােগ করেন। গান্ধী ও সােহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় ১৯৪৭-৪৯ সালে কোনাে দাঙ্গা। হয়নি। …তোরা] কলকাতায় অবস্থান করে হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য কাজ করেছেন’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃ. ২২)। আবার ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ গ্রন্থে সােহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বলা করা হয়েছে, এই নীচ, লােভী, অর্থবশ এবং হীনচরিত্রের মানুষটার একটাই রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, যেনতেন প্রকারে নির্বাচনে জেতা এবং ক্ষমতা দখল করা। কারণ এদেশে একবার ক্ষমতা হাতে এলে চট করে তা হাতছাড়া হয় না। সুতরাং সর্বক্ষণ গদিতে থাকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গুণ্ডা বদমাশ পুষে সরকারি তহবিল থেকেই সে অর্থ ব্যয় করেছে,…। ১৯৪২ সালে বাংলাদেশে যখন দুর্ভিক্ষ মহামারী শুরু হলাে, তখন অন্নহীন মানুষের জন্য পাঠানাে হাজার হাজার মণ চাল কালােবাজারে বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা কামিয়ে নেয় লােকটা।…কলকাতার এমন কোন সুন্দরী বারবিলাসিনী ছিল না, যার সঙ্গে সে যৌনাচার করেনি।… লােকটা খেত ঝাল মসলায় গরগরে মাংস আর মদ। কিন্তু সবচেয়ে বীভৎস ছিল। লােকটার খুনের নেশা। মানুষের রক্তে লাল হয়ে যায় লােকটার দুটো হাত।’ (পৃ-২৫৯)।
পাকিস্তান জুড়ে আইয়ুববিরােধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন করাচি থেকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর ‘৬২ সােহরাওয়ার্দী মুক্তি পাওয়ার আগেই চারদিকে রটে যায়, পূর্ব বাংলার ছাত্র অসন্তোষ ও বিরাজমান অস্থিতিশীলতা প্রশমনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের জন্যই তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কথাটা যে অসত্য নয়, এর প্রমাণ

পাই নিমােক্ত উদ্ধৃতিতে, ঢাকায় এসে ‘সােহরাওয়ার্দী ছাত্রলীগের নেতাদের এটা ব্যাপারে বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি ক্রমাগত এভাবে চললে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের হাতে চলে যাবে এবং পরিশেষে এ থেকে লাভবান হবে কমিউনিস্টরাই।’ (সাক্ষাৎকার : পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সিরাজুল আলম খান)। বস্তুত সােহরাওয়ার্দীর এই পরামর্শের কারণেই ছাত্রলীগ উত্তাল আন্দোলন থেকে পিছটান দিয়েছিল। আরাে একটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ১৯৫৭ সালে সােহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন, তখন সবাই ধারণা করেছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তিনি নিশ্চয়ই কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু সমগ্র বাঙালি জনগােষ্ঠীকে হতভম্ব করে দিয়ে সােহরাওয়ার্দী তখন বলেছিলেন, তার প্রধানমন্ত্রী হওয়াতেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবির ৯৮ ভাগ অর্জিত হয়ে গেছে।’ (দ্য লিবারেশন ওয়ার : মােহাম্মদ আইয়ুব ও কে সুব্রামানিয়াম, পৃ. ১৯)। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী—যাঁকে বাঙালিরা শ্রদ্ধা করে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে, অবাঙালি এই নেতা ভারত বিভক্তি, বিশেষত বাংলা। বিভাজনের ঘাের বিরােধী ছিলেন বটে, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম কর্তৃক বাঙালি জাতিগােষ্ঠীর ওপর ভয়ানক দমন-পীড়ন সত্ত্বেও তিনি শেষ। পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানেই বিশ্বাস বজায় রেখেছেন।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে ঢাকার রাজপথ যখন রঞ্জিত হলাে, তখনও সােহরাওয়ার্দী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুরই সাফাই গেয়েছেন। ২০ ডিসেম্বর ‘৫৪ আইনমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পর তার ইউনিট প্রথা’ ও ‘সংখ্যা সাম্যনীতি’ দুটোই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হিসেবে তিনি অনুগামীদের ওপর পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি চাপিয়ে দিতেন এবং আইয়ুববিরােধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত ‘স্বাধীন দেশের দাবি’কে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পাকিস্তানবিরােধী কোনাে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি, তিনি পেছন থেকে সুতাে টেনে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর পরই আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী চেতনায় দ্যুতিত হয় এবং আপসহীন নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের উত্থানের বাধাহীন ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক যতীন সরকার ঠিকই বলেছেন, “সােহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকলে মুজিবের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হতাে।… ছয় দফার মতাে কোনাে রাজনৈতিক কর্মসূচি যদি তিনি হাজির করতেন, তবে একে তিনি বড়জোর রাজনৈতিক দর কষাকষির  হাতিয়ার করে তুলতেন—বাঙালি গণমানুষের হাতে মুক্তিসংগ্রামের অস্ত্ররূপে। ব্যবহৃত হতে দিতেন না।’ (পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, পৃ. ২৯৮)।  [বি. দ্র. : মুখ্যমন্ত্রী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর (মে ‘৫৪) ফজলুল হক ঘােষণা করেছিলেন, তিনি আর রাজনীতি করবেন না। কিন্তু পরের বছরেই তিনি প্রথমে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন। গভর্নর হয়েই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী সমর্থিত মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে বরখাস্ত করে নিজ দলীয় আবু হােসেন সরকারকে ওই পদে নিয়ােগ দেন।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনকে প্রভাবিত করে ফজলুল হককে পূর্ব বাংলার গভর্নরের পদ থেকে বরখাস্ত করান সােহরাওয়ার্দী, সেই সাথে আবু হােসেন সরকারকেও মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজ দলের আতাউর রহমান খানকে ওই পদের দায়িত্ব দেন। বস্তুত এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তকালে পাকিস্তানি নেতারাই কেবল ক্ষমতালিন্দু ছিলেন না, আমাদের নেতারাও ক্ষমতার স্বাদ নেয়া বা ধরে রাখার জন্য ওদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না)। অন্যদিকে কাগমারী সম্মেলনে (৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ জানানাের হুশিয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে গণ্য করা হলেও পরবর্তীকালে পাকিস্তানবিরােধী আন্দোলনে ভাসানীর ভূমিকা দেখে মনে হওয়া অসঙ্গত হবে না যে, তার ওই ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ ছিল কথার কথা মাত্র। কাগমারী সম্মেলনের কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দেয় (২৪ জুলাই), ভাসানী তাঁর অনুগামীদের নিয়ে গঠন করেন ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, এরপর অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ‘৬৬ সালে, ‘ন্যাপ’ আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়, একটি অংশ পরিচিত হয় ন্যাপভাসানী, অন্যটি ন্যাপ-মােজাফফর) এবং এর পর থেকে পাকবিরােধী আন্দোলনে তাকে খুব সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর ছ’টি ফৌজদারি মামলা কাঁধে নিয়ে শেখ মুজিব যখন নিক্ষিপ্ত হন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, তখন মওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল বনানীর এক বিলাসবহুল বাড়িতে।
এর কিছু দিন পর, ১৯৬৩ সালে ছাত্র আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের যখন টালমাটাল অবস্থা, ভাসানী তখন আইয়ুব কর্তৃক মনােনীত হয়ে সরকারি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন।’ (পলিটিক্যাল অ্যালাইটস ইন বাংলাদেশ, রঙ্গলাল সেন, পৃ. ২১৮)। সেখানে চীনা নেতা মাও সে তুং নাকি আইয়ুব খানের বিরােধিতা না করার জন্য ভাসানীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “You are our friends and if at the present moment you continue your struggle against the Ayub government it will only strength on the hand of Russia, America and India. It is against our principles to interfear with your work, but we would advice you to proceed slowly and carefully. Give us a chance to decpen our friendship with your government. (Pakistan: Military Role of or Peoples Power – Tariq Ali, page 140).
বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার তার স্মৃতিকথামূলক ‘আমার দেশ আমার জীবন’ নামক গ্রন্থে মওলানা ভাসানীকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, “আইয়ুবের প্রতি সমর্থন ও ছয়দফা আন্দোলনের বিরােধিতার মাধ্যমে ভাসানীর গৌরবময় জীবনের অধঃপতনের সূচনা হয়। অবশেষে ‘৭০-এর নভেম্বরে, সমুদ্র উপকূলবর্তী মহাদুর্যোগকে কেন্দ্র করে ভাসানী, আতাউর রহমান ও পীর মােহসেন উদ্দীন দুদু মিঞার আকস্মিক স্বাধীনতা ঘােষণা, অতিবিপ্লবী পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করার এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল। …প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা এবং অবশেষে ঐ আন্দোলনের বৃহত্তম ক্ষতিকারক মওলানা ভাসানী সত্যিই এক দুর্বোধ্য চরিত্র।” (পৃ. ১৫২)। জনাব সাত্তারের পর্যবেক্ষণ যে মিথ্যে নয়, এর প্রমাণ পাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খ্যাতিমান লেখক মাসুদুল হকের গ্রন্থেও, যেখানে মাসুদুল জনাব ভাসানীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি প্রয়ােগ করে দেখিয়েছেন, ‘৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিতে ভাসানী কেন অনিচ্ছুক ছিলেন, ইয়াহিয়াকে বলুন নির্বাচন বন্ধ করতে। নির্বাচন হলেই পাকিস্তান ভেঙে যাবে।’ (বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন, পৃ. ৯৬)। পাকিস্তানের ভাঙন রােধকল্পে ভাসানী যে প্রতি মুহূর্তেই সচেষ্ট ছিলেন, এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় ৯ মার্চ ভাসানীপ্রদত্ত পল্টনের বক্তৃতায়। ওইদিন তিনি বলেন, ২৫ মার্চের মধ্যে স্বাধীনতার দাবি মানা না হলে তিনি শেখ মুজিবের সাথে মিলে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন। তাঁর এ কথার সূত্র ধরে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির ওপর হামলা হচ্ছে, এ কথা কি ভাসানী পূর্ব থেকেই জানতেন?
জনাব মাসুদুল হকের সংশয়হীন উত্তর ও ব্যাখ্যা, জানতেন। জানতেন বলেই বাঙালিকে স্বাধীনতা দানের আহ্বানের নামে শ্রুতিমূলে আবদার নামক শব্দটির ব্যঞ্জনা তুলে এবং মুজিবের সাথে মিলে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম—যুদ্ধ নয়, শুরু করার হুমকির আড়ালে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শেখ মুজিবের সঙ্গে আপােষ করতে বললেন।’ (বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন, পৃ. ১৪৯)।  ১৯৬৩ সালে মওলানা ভাসানী এবং আইয়ুব খানের মধ্যে একটা গােপন | বৈঠক হয়েছিল। এর পর থেকেই পিকিং প্রদেয় ‘একতা…সংগ্রাম অথবা এমনকি বিভক্তি…নতুন ভিত্তিতে নতুন একতা’ ফর্মুলা গ্রহণ করে কমিউনিস্ট ও ন্যাপ আলাদা হয়ে যায় এবং ভাসানী সরকারবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে তীব্র অনীহা প্রকাশ করতে লাগলেন।… কালক্রমে এই প্রবণতাতেই ন্যাপ (ভাসানী) আইয়ুব খানের গদি রক্ষার সহায়কশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।’ (জাতীয় রাজনীতি : অলি আহাদ, পৃ-৩৬৬)। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সময় থেকে মজলুম জননেতা পুরােপুরি ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ নীতি বেছে নেন। অনেকেই অভিযােগ করেন, শেখ মুজিব উপস্থাপিত ৬ দফার আন্দোলনকে দুর্বল ও হালকা করে দেবার জন্যই নাকি একই সময়ে মওলানা ভাসানী ১৪ দফা কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, যদিও তাঁর ১৪ দফা তৎকালীন জনমানসকে আন্দোলিত করতে পারেনি। ওই সময়ে ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কৌতূহলােদ্দীপক মন্তব্য পাই মযহারুল ইসলামের লেখায়।
লেখকের সাথে কথাপ্রসঙ্গে ভাসানী নাকি বলেছিলেন, “আমি ঐ-সব বাংলা ফাংলা বুঝি না—বর্তমান দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কই হলাে আসল।… পৃথিবীর মজলুম মানুষ সবই এক, তারা যেখানেই বাস করুক। তাছাড়া বেশি বাংলা বাংলা করলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। এটা আল্লাহর দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র, এই দেশকে তােমরা ভাঙতে চাও? তা আমি হতে দেব না।’ (বঙ্গবন্ধু, পৃ. ৩১৪)। ‘৭০এর ডিসেম্বর মাসে, পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে নির্বাচনী ভাষণে ভাসানী যে উক্তি করেছিলেন, তাতেও তার পাকিস্তানপ্রীতি গদগদভাবে প্রকটিত হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘Even if there are thousands of difference among us, all should love Pakistan. … The name of this country is Pakistan, there is no such country anywhere in the world.’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৫৫৭)। ‘৭১-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়, আবুজর গিফারীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে মুজিব-ভুট্টোকে উদ্দেশ করে ভাসানী বলেছিলেন, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব খর্ব হলে তােমাদেরও রেহাই দেওয়া হবে না। (দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ‘৭১)। বস্তুত রাজনীতির ‘দুর্বোধ্য পুরুষ’ ভাসানীর পাকিস্তানপ্রীতিতে কবে ছেদ ঘটেছিল (কিংবা আদৌ। ঘটেছিল কি না), তা বােঝা খুবই কঠিন। খুবই অপ্রিয় সত্য কথা হলাে, মুজিব-পূর্ববর্তী বিখ্যাত তিন বাঙালিনেতা, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী—তাঁরা কেউই জাতীয়তাবাদী, দৃঢ়চেতা, আপসহীন চরিত্রের নেতা ছিলেন না। প্রথম দুজন আমজনতা অপেক্ষা নিজের পদ ও দলের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিতেন; আর তৃতীয় জনতার অবশ্য ক্ষমতার প্রতি মােহ ছিল না, তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণে তিনি এমনই। অস্থির ও পটুত্ববর্জিত ছিলেন যে, তাঁর বেশ ক’টি সিদ্ধান্ত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসরতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!