পাকিস্তান মঞ্চে এবার উর্দিধারী আইয়ুব খান
দেশবিভাগের আগেই ভারতীয় কংগ্রেস দলের দূরদর্শী রাজনীতিক মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পাকিস্তানের ‘অযােগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসন ডেকে আনবে, যা নাকি অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ঘটেছে।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একযুগও অতিক্রান্ত হলাে না, এরই মধ্যে মওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে গৃহীত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে। পরে তা পিছিয়ে নেয়া হলাে ১৯৫৮ সালে; কিন্তু না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে না। বলা ভালাে, গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা এবং সেনাপ্রধান আইয়ুব খান—ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দিলেন না। কারণ, ওই শাসনতন্ত্রের বিধি মােতাবেক গভর্নর জেনারেলের পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই ইস্কান্দর মীর্জা যদি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ—প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীন হতে চান, তাহলে অবশ্যই তাকে নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। কিন্তু নির্বাচনে যেতে ইস্কান্দর মীর্জা একদমই নারাজ; তাহলে রাষ্ট্রীয় শীর্ষপদ কজায় রাখার উপায় কী? আইয়ুব-ইস্কান্দর মিলে উপায় একটা বের করলেন, সে উপায়ের নাম-ষড়যন্ত্র। দেশে এমন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যাতে নির্বাচন ঠেকিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলাে, ইস্কান্দর মীর্জা যার সহায়তায় প্রেসিডেন্ট পদে স্থায়ী হতে যাচ্ছেন, সেই আইয়ুবের চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ।
কাজেই নিজের প্রয়ােজনেই ইস্কান্দর মীর্জা (জুলাই ‘৫৮) তার সহযােগী ও সেনাপতি আইয়ুব খানের চাকরিকাল আরাে দু’বছর বাড়িয়ে দিলেন (এর আগে ‘৫৬-তে আইয়ুবের চাকরিকাল দু’বছর বাড়ানাে হয়েছিল)। ৭ অক্টোবর ‘৫৮ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বানিয়ে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করলেন ইস্কান্দর মীর্জা। সেইসাথে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রিসভাও বাতিল করা হলাে। কিন্তু যে আইনের ওপর ভর করে ইস্কান্দর মীর্জা প্রেসিডেন্ট হয়ে সামরিক শাসন জারি করলেন, সেই আইন (‘৫৬-এর শাসনতন্ত্র) বাতিল করে দেয়ায় তিনি। নতুন পদে থাকার আইনি অধিকার হারিয়ে ফেললেন, ফলে নিজের তৈরি করা ফাঁদে আটকে গেলেন ইস্কান্দর মীর্জা এবং নতুন দৃশ্যপটে নতুনভাবে হাজির হন জেনারেল (পরবর্তী পর্যায়ে নিজেই নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে ফিল্ড মার্শাল পদবি গ্রহণ করেন) মােহাম্মদ আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দর মীর্জাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। নতুন শাসনতন্ত্র এবং ঘােষিতব্য নির্বাচন সম্পর্কে জাতির কাছে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘দেশ যা পেল তা কোন শাসনতন্ত্র নয়,… একটি হতাশাপীড়িত দলিল, একটি জগাখিচুড়ি… একজন সৈনিকের অবস্থান থেকে আমার কাছে এ-কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাধারণ নির্বাচনে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। দেশজুড়ে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেবে…।’ (ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস, পৃ. ৫৪)। রাজনীতির শােচনীয় অস্থিরতার মধ্যে বাংলা ভাষাকে আরবিয়ায়নের উদ্যোগ গতি হারিয়ে ফেলেছিল। নতুন শাসক আইয়ুব খান এবার নতুন অভিমত প্রকাশ করেন, উর্দু কিংবা বাংলা, কোনােটাই এককভাবে সমগ্র পাকিস্তানের মূল ভাষা হতে পারে না।
কাজেই আমাদেরকে বাংলা ও উর্দুর মধ্যকার সাধারণ উপাদানগুলাে খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলােকে একটিমাত্র সাধারণ লিখন-রীতির মাধ্যমে (রােমান হরফে) একত্রে বর্ধিত হতে দিতে হবে।’ [ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস, পৃ. ১৩২]। প্রেসিডেন্টের এমন অভিমত পেয়ে তার সৃষ্ট ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন ও বাংলা একাডেমি’ রােমান হরফ প্রবর্তন ও বাংলা বর্ণমালা সংস্কার, বাংলা সাহিত্যকে ইসলামিকরণ প্রভৃতি অপকর্মে আদাজল খেয়ে লেগে যায়। এরই অংশ হিসেবে সীতানাথ বসাকের জনপ্রিয় ছড়া ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি সংশােধন করে পুনঃলিখিত হয় ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি/ সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি’। আইয়ুবি শাসনের প্রেক্ষাপটে, আন্দোলনের গতিধারা পর্যালােচনাপূর্বক, নতুন কর্মসূচি স্থির করার জন্য ‘৬২-এর ২৪ জানুয়ারি আতাউর রহমান খানের বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এক গােপন আলােচনায় মিলিত হয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়, ৩০ জানুয়ারি সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় করাচি থেকে, ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হলাে শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া)সহ অনেক নেতাকে। আইয়ুবশাহির এই দমন-পীড়ন এবং ১ মার্চ তার প্রণীত পাকিস্তানের নয়া সংবিধান বা তথাকথিত বুনিয়াদী গণতন্ত্র চালু করার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে নতুন করে ছাত্র আন্দোলন শুরু হতে থাকে।
২ এপ্রিল আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন। এবং এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সম্মানিত সহযােগী হিসেবে বাস না করলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা হিন্দুদের গােলামে পরিণত হবে।… কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানকে তার পশ্চাদভূমি হিসেবে ফিরে পেতে চায়।’ (বাংলাদেশে নবজাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলন : জি পি ভট্টাচার্য, পৃ. ১৯৬)। ক্ষমতার কেন্দ্রে অপ্রতিরােধ্য হয়ে যাওয়ার পর সকল স্বৈরশাসক যেমন বিবেচনাবর্জিত ভুল পদক্ষেপ নিতে থাকেন, আইয়ুবও তা-ই করলেন; জম্মু ও কাশ্মীর দখল করতে গিয়ে পরাজয়ের কালিমা গায়ে মাখলেন, শেখ মুজিব উত্থাপিত ছয় দফাকে অস্ত্রের ভাষায় পরাজিত করতে গিয়ে কোটি কোটি জনগণের চোখে ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচিত হলেন এবং ইয়াহিয়া ও ভুট্টো যে দুজনকে তিনি খুবই বিশ্বাস করতেন, বিভিন্ন রকম সুযােগ-সুবিধা প্রদান করতেন-অবশেষে তাদেরই বিশ্বাসঘাতকার ছুরিতে বিদ্ধ হয়েছেন এক সময়ের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক—আইয়ুব খান।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র