একুশােত্তর পূর্ব বাংলা নতুন চেতনার উন্মেষ
যে বাঙালি জনগােষ্ঠী ইসলামি ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিমের কাঁধে কাঁধ । মিলিয়ে মাত্র ক’বছর আগে ‘লড়কে ল্যাঙ্গা পাকিস্তান’ শ্লোগানে আন্দোলিত হয়েছিল, সময়ের স্বল্প ব্যবধানে তারা অনুভব করল—দেশবিভাগ তাে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা, ওদেরই ক্ষমতাচর্চার উন্মুক্ত আবাসভূমি, এ অর্জন বাঙালির ভাগ্যে কোনাে প্রকার পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। এর মধ্য দিয়ে। তারা কেবল সিংহের খাঁচা থেকে প্রবেশ করেছে হিংস্র নেকড়ের খাঁচায়। তারা আরাে অনুভব করল, যে রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মাতৃভাষার ন্যায্য মর্যাদা রক্ষা করবার জন্য বুকের রক্ত দিতে হয়েছে, সে রাষ্ট্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তা আদায় করে নিতে হবে। বস্তুত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ‘দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির মােহভঙ্গের প্রথম পর্যায়, যা বাঙালির স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবােধকে নাড়া দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। নতুন একটা স্বপ্ন তার সামনে উন্মােচন করে দিয়েছিল। বিশিষ্ট বাম তাত্ত্বিক অনিল মুখার্জি ঠিকই বলেছেন, “একুশে ফেব্রুয়ারীর চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সমগ্র জাতি যেন রাতারাতিই পঞ্চাশ বছর এগিয়ে গেল। ভাষা আন্দোলন সকল প্রকার বাধা ভেঙে দিল। এই আন্দোলনের পূর্বে দেশের যে চেহারা ছিল আন্দোলনের পরে সে চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। কারণ এই প্রথমবার শুধু শত শত মুসলমান ছাত্র ও যুবকরাই নয়—এমন সব ব্যক্তি জেলে এলেন যারা সারা জীবন মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন এবং কোনােদিন জেল খাটার কথা কল্পনাও করেননি। শুধু রাজনীতি নয়, জনতার সমগ্র। চিন্তাজগতেই এর প্রভাব পড়ল। মুসলমান মেয়েরা পর্দা ছেড়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় চলাফেরা করতে, এমনকি সভা-সমিতিতে যােগ দিতে শুরু করলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইংরেজি স্যুট ছেড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি ধরলাে, শিক্ষিত সমাজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা শুরু হলাে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ার সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেল। এমনকি, সময় উল্লেখের ক্ষেত্রে সাধারণ কথাবার্তায় দুটো নতুন বাক্যাংশ এসে গেল, ভাষা আন্দোলনের আগে এবং ভাষা। আন্দোলনের পরে’।” (স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রামের পটভূমি, দ্বিতীয় বাংলাদেশীয় সংস্করণ, ১৯৮০) রাজনীতি বৃহত্তর পর্যায়ে যখন ভাষা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক নানাবিধ দ্বন্দ্ব চলছিল, পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ এবং কমিউনিস্ট পার্টি তখন দুই পাকিস্তানের অভাবনীয় বৈষম্যনীতি-বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন। করে যাচ্ছিল। রাতের মনােমুগ্ধকর, প্রীতিপ্রদ স্বপ্নের আবেশ যেমন ঘুমভাঙার পর হতাশার ঝাকুনি দেয়, স্বপ্ন এবং বাস্তবের দোলার মধ্যে প্রকৃতিস্থ হতে যেমন সময় লাগে বেশ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক’বছরের মধ্যেই বাঙালি। পুরােপুরি স্বপ্নচ্যুত হয়ে যায় এবং মর্মে মর্মে অনুধাবন করে নেয়—দেশবিভাগের মধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ ও প্রাপ্তি যতটুকু—এর সবটুকুই। কজা করে নিয়েছে পশ্চিমের দুঃশাসকরা। শিক্ষা-অর্থ-স্বাস্থ্য-চাকরি, কোনাে ক্ষেত্রেই সমতার ছাপ নেই—কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে, আশ্বাসে-ওয়াদায় বাঙালিকে মায়াবি শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে, যা পরাধীন অবস্থারই অন্যরূপ মাত্র—এই জাল থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তৃতি ঘটিয়ে, শােষণ ও অপশাসনের খবর ও পরিসংখ্যান চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে, সবাইকে টানতে হবে ঐক্যের বলয়ে, যার প্রথম উদ্বোধন ঘটেছিল। বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে বাঙালি তখন স্বাধিকার ও স্বাজাত্য বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে থাকে। এরই মধ্যে কেউ কেউ পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। একান্ত গােপনীয় আড্ডা বা বৈঠকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি নিচুস্বরে উচ্চারিত হতে লাগল।
১৯৫৬ সালে, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যে বৈঠকটি কলকাতায় বসেছিল, সেখানে দেবেন সিকদার পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। এ সম্পর্কে গ্রহণযােগ্য তথ্য হলাে, “দেবেন সিকদারের ১৯৫৬ সালের স্বাধীনতার দাবির প্রশ্নটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে হয়তাে, তবে এ ব্যাপারে কোনাে বিতর্ক নেই যে, দেবেন সিকদার বরাবরই প্রথম থেকে বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়টি পার্টিতে তুলেছেন এবং কর্মী মহলে প্রচার করেছেন। তিনি একটি বিশ্বাস তার মস্তিষ্কে প্রােথিত করে নিয়েছিলেন যে, শােষকশ্রেণীর সাথে বাংলার মানুষের যে দ্বন্দ্ব তা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অবসান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলতেন, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনেও এ সংকট ও দ্বন্দ্ব যাবে না। (সাক্ষাৎকার : মাহফুজ উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, ১৯৭২) অন্যদিকে ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অবিলম্বে মেনে না নিলে পূর্ব বাংলা ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতে পারে।
১৯৬১ সালে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের সময় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, একটা কথা আমি খােলাখুলি বলতে চাই, আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র স্বায়ত্তশাসন এসব কোনাে দাবিই পাঞ্জাবিরা মানবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখা দরকার।’ (খােকা রায়, সংগ্রামের তিন দশক, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ দল থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার যে আলােকিত উদ্যােগ নেয়া হয়েছিল, এর প্রত্যাশিত প্রভাব, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে ধীরে ধীরে লক্ষণীয় হতে থাকে। ধর্মের ঐক্য অপেক্ষা ভাষা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য বাঙালির জীবনাচরণকে প্রভাবিত করতে থাকে। এর ফল হিসেবে বাঙালি মুসলমান শিশুর নাম আরবি ফারসি ভাষার পরিবর্তে বাংলায় রাখার ধুম লেগে যায়। দোকানপাটে, গাড়ির নম্বরে বাংলা লেখার লক্ষণীয় প্রবণতা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হয় এবং বিপুল আগ্রহ-উল্লাস নিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনসহ বাঙালিয়ানাযুক্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বাঙালি ক্রমশ ধর্ম অপেক্ষা সংস্কৃতিনির্ভর জাতিসত্তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র