পাকিস্তান বনাম ষড়যন্ত্রের রাজনীতি
বস্তুত পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি, যার জন্ম হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে—বাস্তবে ওই রাষ্ট্রের আপাদমস্তকে ধর্মের কোনাে ছোঁয়াও ছিল না। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা—জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, নাজিমউদ্দীন—সবাই ছিলেন অসৎ, অধার্মিক, ক্ষমতালােভী, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রে সিদ্ধহস্ত। জিন্নাহর মৃত্যুর পর [সেপ্টেম্বর ১৯৪৮; ১৯৪৬ সালের মে মাসে ডাক্তার পটেলের চিকিৎসায় প্রথম ধরা পড়ে যে, জিন্নাহ ভয়াবহ যক্ষ্মারােগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্গিন অবস্থায় আছেন। এ খবরটি জানাজানি হয়ে গেলে কংগ্রেস বা মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন—এই আশঙ্কায় জিন্নাহর ইচ্ছে অনুসারে খবরটি চেপে রাখা হয়েছিল (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, পৃ. ১৩০), নতুন গভর্নর জেনারেল হন নাজিমউদ্দীন। এর এক বছর পরে (অক্টোবর ‘৪৯) লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর নাজিমউদ্দীন ফিরলেন প্রধানমন্ত্রীর পদে, আর গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্তি পান গােলাম মােহাম্মদ। কিন্তু অতি পাকিস্তানি সেজেও নাজিমউদ্দীন তার পদ ধরে রাখতে পারলেন না। ১৮ এপ্রিল ‘৫৩ তিনি ওই পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের নেতৃত্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পান বগুড়ার মােহাম্মদ আলী। জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান রাজনীতির মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, কথায় কথায় ভারত বিরােধিতা’ আর ইসলাম গেল, ইসলাম গেল’ বলে ভিত্তিবর্জিত উচ্চরব। এটা অবশ্য রাজনীতির বাইরের দিক, ভেতরের দিকটা আরাে ভয়াবহ। কে কাকে ল্যাং মেরে গর্তে ফেলবে, কে কাকে উৎখাত করে ক্ষমতার চেয়ারে অধিষ্ঠিত হবে, সামরিক বাহিনীর সাথে কীভাবে সখ্য গড়া যাবে—এই ছিল রাজনীতিকদের মূল ভাবনা।
সে সময়কার পাকিস্তানি রাজনীতির অস্থিতিশীলতা—তা বােঝা যাবে নিমােক্ত পরিসংখ্যানে : পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভার আয়ুষ্কাল ছিল চার বছর, ১৫.৮.১৯৪৭ থেকে ১৬.৮.১৯৫১ পর্যন্ত।…প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় ১৯.১০.১৯৫১ তে, টিকে থাকে দুই বছরেরও কম সময়, ১৭.৪.১৯৫৩ পর্যন্ত। পরবর্তী দেড় বছর, অর্থাৎ ১৭.৪.১৯৫৩ হতে ২৪.১০.১৯৫৪ পর্যন্ত কার্যকর থাকে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার। মােহাম্মদ আলীর অধীন তৃতীয় মন্ত্রিপরিষদ। পরবর্তীতে বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হয়ে টিকে থাকে এক বছরেরও কম সময় ১১.৮.১৯৫৫ পর্যন্ত। পঞ্চম মন্ত্রিসভাটি গঠিত হয় চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে। তার আয়ুষ্কাল মাত্র এক বছর, ১১.৮.১৯৫৫ থেকে ১২.৯.১৯৫৬ পর্যন্ত। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত ষষ্ঠ মন্ত্রিপরিষদের মেয়াদকাল ১২.৯.১৯৫৬ থেকে ১৮.১০.১৯৫৭ পর্যন্ত, এক বছর। সপ্তম। মন্ত্রিপরিষদের প্রধানমন্ত্রী হন আই. আই. চুড্রিগর। সেটিও একবছর পার করে আর বেশি দূর এগােতে পারেনি, ১৬.১২.১৯৫৭-তেই ভেঙে পড়ে। বেসামরিক মন্ত্রিসভার শেষ প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরােজ খান নুন। তাঁর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ টিকে থাকে এক বছরেরও কম সময়, ১৬.১২.১৯৫৭ থেকে ৭.১০.১৯৫৮ পর্যন্ত।’ (মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ও রাজনীতি : মজিবর রহমান, পৃ. ০৫)। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বা প্রেসিডেন্ট পদের দখল নিয়ে বারবার হয়েছে অন্তহীন ষড়যন্ত্র আর অভ্যুত্থান। ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছে ছিল, দেশ বিভাগের পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন অন্তর্বর্তীকালের জন্য ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেলের পদে থেকে যাবেন।
ভারত এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল, বাস্তবায়নও করেছিল; কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক জিন্নাহ ব্রিটিশ প্রস্তাব মেনে নেননি, পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভের পরপরই তিনি হন নতুন রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল এবং দেশের রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক-সাংবিধানিক সকল ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল হন নাজিমউদ্দীন, এর একবছর পর গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্তি পান গােলাম মােহাম্মদ (লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর নাজিমউদ্দীন ফিরে যান প্রধানমন্ত্রীর পদে), এরপর ১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট, গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ বিদায় নেয়ার পর উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হন মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা। তিনি নতুন সংবিধানের আওতায় গভর্নর জেনারেল পদবি পরিবর্তন করে সৃষ্টি করেন প্রেসিডেন্ট পদ এবং নিজেই হন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ইস্কান্দর মীর্জা পদচ্যুত হন আইয়ুব খান কর্তৃক ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ এবং দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর আইয়ুবকে সরিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়ার আগমন (২৬ মার্চ ১৯৬৯) আর ইয়াহিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে। (২০ ডিসেম্বর ‘৭১) সামরিক বাহিনীর বেশ ক’জন কর্মকর্তা মিলে এবং তারা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বসায় প্রেসিডেন্টের পদে। সেই ভুট্টোকে। ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়াউল হক। গভর্নর জেনারেল আর প্রধানমন্ত্রী, এ দুটো অতিগুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় পদ। তবে ওই দুটো পদ নিয়ে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদটি নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন (১৪.০৮.১৯৪৭-১১.০৯.১৯৪৮), দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন (১২.০৯.১৯৪৮-০২.০৪.১৯৫৪)।
‘৫৪-এর নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণের এক মাস সাতাশ দিনের মাথায় (৩০ মে ১৯৫৪) পদচ্যুত হন; এরপর তাঁরই অনুগত আবু হােসেন সরকার শপথ নেন ৫ জুন, ১৯৫৫ (মাঝখানের সময়টুকুতে ইস্কান্দর মীর্জা কর্তৃক গভর্নরের শাসন চালু ছিল)। আওয়ামী লীগের অনাস্থা প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ৩০ আগস্ট ‘৫৬-তে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আবু হােসেন সরকার। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে বরখাস্ত করে (৩০ মার্চ ‘৫৮) আবু হােসেন সরকারকে আবারও ওই পদে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ২২ জুন অনাস্থা ভােটে হেরে আবু হােসেন ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ২২ জুলাই আবারও মুখ্যমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন আতাউর রহমান খান। বস্তুত কেন্দ্রের শাসন নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনায় সােহরাওয়ার্দী বা ফজলুল হক—দুজনেরই ভূমিকা ছিল সীমিত। কিন্তু তারা যখনই কেন্দ্রীয় কোনাে পদ বা প্রাদেশিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তখন ক্ষমতাপ্রাপ্তির ভয়ানক কুপ্রভাব পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে। তাদের দুজনের ক্ষমতা-লড়াই’-এর বারবার বলি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ, ফজলুল হকের আনুকূল্য পেয়েছেন আবু হােসেন সরকার আর আতাউর রহমান খান পেয়েছেন সােহরাওয়ার্দীর আনুকূল্য। ওই দুই নেতার আনুকূল্য বা বিরাগের প্রভাবে সরকার ও খান সাহেবরা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বারবার শপথ নিয়েছেন এবং বারবার পদচ্যুত হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে ব্যক্তিপরিবর্তন হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
ফ্রেডরিক বাের্ন (১৯৪৭-১৯৫০), ফিরােজ খান নুন (১৯৫০-১৯৫৩), চৌধুরী। খালিকুজ্জামান (১৯৫৩-১৯৫৪), মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা (১৭.৫.১৯৫৪-২৫.১০,১৯৫৪), জাস্টিস টমাস ইলিস (২৫.১০.১৯৫৪২২.১২.১৯৫৪), এরপর বিচারপতি শাহাবউদ্দীন (২৩.১২.১৯৫৪-?), বিচারপতি আমিরউদ্দিন (?-০৪.০৩.১৯৫৬)। এ কে ফজলুল হক (০৫.০৩.১৯৫৬-০১.০৪.১৯৫৮), আব্দুল হামিদ (০১.০৪.১৯৫৮০৩.০৫.১৯৫৮), সুলতান উদ্দিন আহমেদ (০৩.০৫.১৯৫৮-১১.১০.১৯৫৮), এরপর সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তা জাকির হােসেন (১৩.১০.১৯৫৮-১৪.০৪.১৯৬০), আজম খান (১৫.০৪.১৯৬০১০.০৫.১৯৬২), গােলাম ফারুক (১১.০৫.১৯৬২-২৭.১০.১৯৬২), আবদুল মােমেন খান (২৮.১০.১৯৬২-২২.০৩.১৯৬৯), এম. এন. হুদা (২৩.০৩.১৯৬৯-২৫.০৩.১৯৬৯), রিয়াল এডমিরাল এ এস আহসান (২৫.০৩.১৯৬৯-০১.০৩.১৯৭১), লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান (০১.০৩.১৯৭১-০৬.০৩.১৯৭১), টিক্কা খান (০৭.০৩.১৯৭১-) (বাংলাদেশের ইতিহাস : ড. মাে. মাহবুবর রহমান, পৃ. ৩২১)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র