You dont have javascript enabled! Please enable it! নবাব সিরাজ -বারােজ- মাউন্টব্যাটেন  বাঙালি জাতি - সংগ্রামের নোটবুক
নবাব সিরাজ -বারােজ- মাউন্টব্যাটেন  বাঙালি জাতি
২৩ জুন ১৭৫৭; পলাশীর আম্রকানন। দুই প্রতিপক্ষ মুখােমুখি। একপক্ষের ডানে-বাঁয়ে স্বদেশের সোঁদাগন্ধ, মাতৃভূমির আজন্মচেনা নিবিড় স্নেহচ্ছায়া। তাদের আছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য, তিপ্পান্নটি কামান এবং প্রচুর গােলাবারুদ। অন্যপক্ষটি সাতসমুদ্র তেরাে নদী পার হয়ে আসা বহিরাগত, ওদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছিল ব্যবসা করতে, ভারতীয়দের সরলতার সুযােগ। নিয়ে বংশপরম্পরায় ওরা অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে, সেইসাথে অর্জন করেছে বেশ সামরিক শক্তি। ওদের আছে তিন হাজার সৈন্য, আর মাত্র আটটি কামান। শক্তি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে প্রথম পক্ষের তুলনায় দ্বিতীয়টি খুব দুর্বল, অগণ্য। বলা যায়, এ এক অসম শক্তির সমাবেশ, বাঘ-শেয়ালের লড়াই। কিন্তু হায়, প্রকৃত যুদ্ধ শুরুই হলাে না, এর আগেই, যুদ্ধ না করেই প্রায়, প্রথম পক্ষটি হেরে গেল। কিন্তু কেন? আসলে, যুদ্ধের ময়দানে আসার আগেই দ্বিতীয় পক্ষটি গােপন একটা যুদ্ধ করে এসেছে, অন্তরালের যুদ্ধ; সেই আড়ালযুদ্ধে কৌশল ও অর্থ খাটিয়ে প্রথম পক্ষের প্রায় পুরাে শক্তিকে বশ করে নিয়ে তবেই এসেছে উন্মুক্ত ময়দানে, যুদ্ধ করতে নয়—নিছক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে। তারা নিশ্চিত হয়েই এসেছে, বিপক্ষ শক্তির থাকুক না অর্ধলক্ষ সৈন্য, কামানের বিশাল বহর, আর অপরিমেয়। গােলাবারুদ, চূড়ান্ত মুহূর্তে ওই সৈন্যদলের মধ্য থেকে এক-দশমাংশও ছুড়বে। কোনাে গুলি, বেশিরভাগ কামান থেকে বেরােবে না সামান্য বারুদ। যুদ্ধমাঠে প্রধান প্রধান সেনাপতি প্রাণহীন পুতুলে পরিণত হয়ে থাকবেন, প্রধানদের নিষ্ক্রিয়ভাব দেখে অন্য সেনাপতিরা হতভম্ব হয়ে পড়বেন, বিস্ময়ের বিমূঢ়তায় হয়তাে ভুলেই যাবেন সমরাস্ত্রের ব্যবহার, তখন হয়তাে বা বিনা যুদ্ধেই করতলগত হয়ে যাবে অগাধ সম্পদ, সিংহাসনসহ অনেককিছু। তাদের এই আশাবাদ পুরােপুরি বাস্তবায়িত হলাে না, দুজন সেনাপতি ক্ষণিকের হতবিহ্বলতা কাটিয়ে সাধ্যমতাে যুদ্ধ করে গেলেন, এদের একজন শহীদও হলেন, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল পাওয়া গেল না, পলাশীর আম্রকাননে।
প্রতিপক্ষের তুলনায় বহুগুণ শক্তি নিয়েও নবাব সিরাজ হেরে গেলেন, সেইসাথে অস্তমিত হয়ে গেল বাংলার স্বাধীনতাসূর্য । ওই যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়—এর জন্য তার সৈন্যবাহিনীর অদক্ষতা, দুর্বলতা বা কাপুরুষতা দায়ী? নিশ্চয়ই নয়, কারণ এটি তার শক্তির পরাজয় নয়, এটি কেবল রাজনৈতিক পরাজয়; প্রধান ও অন্য ক’জন সেনাপতি শক্রর সাথে হাত মিলিয়ে অর্থ লেনদেন ও সিংহাসন প্রাপ্তিবিষয়ক গােপন চুক্তি করে, নীতিবর্জিত, ষড়যন্ত্রমূলক, বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ যে কাজটি আগেই সমাধা করে এসেছে, এর ফলে পলাশী প্রান্তরে কোনাে শক্তিপরীক্ষাই হয়নি, তাই শক্তির জয়-পরাজয়ও হয়নি, যা হয়েছে, তা হলাে—ক্ষমতালিপ্সা, শঠতা ও ধূর্ততার কাছে সরলতা ও বিশ্বাসের পরাজয়। প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের ক্ষমতালিপ্সা, অন্যতম সেনাপতি মানিক চাঁদের শঠতা, উমিচাঁদ-জগৎশেঠ-রাজবল্লভ-রায় দুর্লভের অর্থলােলুপতা, ঘসেটি বেগমের জিঘাংসাপ্রবৃত্তি—সবকিছুর যােগফল ছিল এক ও অভিন্ন, কেবল ‘সিরাজ-বিরােধিতা বা সিরাজের পতন’; এই অন্দরের অপশক্তি সিরাজের চারপাশে ষড়যন্ত্রের যে ব্যুহ রচনা করেছিল, সেটি ক্লাইভ-ওয়াটসনরােজার ড্রেকের সামরিক শক্তি অপেক্ষা বহুগুণ শক্তিশালী ও লক্ষ্যভেদী ছিল। এই ঘরের শত্রুরা দেশরক্ষার জন্য প্রকাশ্য-শপথ নিয়েছে, কিন্তু গােপনে হাত মিলিয়েছে বহিঃশত্রুর সাথে। এই গভীর ষড়যন্ত্র, বা যুদ্ধের আড়ালে বিশ্বাসঘাতকতাসূচক যে যুদ্ধ, যা সংঘটিত হয়েছিল যুদ্ধময়দানে আসার অনেক আগেই, বস্তুত পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়ের মূল কারণ এই ‘আড়ালযুদ্ধের প্রভাব। আমরা, এমনকি অনেক ইতিহাসবেত্তাও, পলাশীআম্রকাননের যুদ্ধের স্বরূপটি নিয়ে কত কথা বলি, সিরাজের পরাজয়ের কত কারণ খুঁজে বের করি, কিন্তু এ যুদ্ধে তাে শক্তির পরীক্ষা হয়নি বললেই চলে, যুদ্ধের নামে সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছে প্রহসন, বা ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা’, যাতে সিরাজের পরাজয় নির্ধারিত ছিল আগে থেকেই, সরল নবাব সেটা বুঝতে পারেননি বলেই তথাকথিত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাকে সত্যিকারের যুদ্ধ মনে করেছেন এবং অর্থ ও ক্ষমতার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া তার অধীন সেনাপতি ও অমাত্যবর্গের কাছে বারবার নিষ্ফলা সহায়তা কামনা করে গেছেন। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭, দীর্ঘ একশ নব্বই বছর; দশ কম দুশাে বছর আমরা ইংরেজদের অধীনে থেকেছি। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, পিষ্ট হতে হতে ভেবেছি, ‘স্বদেশের কুকুর ধরি বিদেশী ঠাকুর ফেলিয়া’ ।
তাই সুযােগ আসা মাত্র দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান নামক একটা অদ্ভুত অপরাষ্ট্রের অংশ (অধীন) হয়ে আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম; মাত্র ক’বছরের মধ্যেই আমরা অনুধাবন করলাম—ভূখণ্ডের অবস্থানগত দিক থেকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে দূরত্ব, এর চেয়েও বেশি দূরত্ব পূর্ব ও পশ্চিমের বােধ, মনন ও চেতনায়। ভাষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, প্রাত্যহিক জীবনাচরণে দুই অঞ্চলের অধিবাসীরা এমনই ভিন্নমুখী যে, তা কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে গ্রন্থিবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। শুরুতেই দেখা গেল অজস্র বিপত্তি, পশ্চিম অংশটি সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও, তারা ক্ষমতাকেন্দ্রে একক আধিপত্য কায়েম করে নিয়েছে এবং সমতাভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ ছুড়ে ফেলে দিয়ে পূর্বকে যেন ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করছে। কথিত স্বাধীনতা লাভের পর বছর মাত্রও অতিক্রান্ত হয়নি, পশ্চিমের ফন্দিবাজরা বাঙালির মাতৃভাষাকে বদলে দেবার স্পর্ধিত অপচেষ্টা শুরু করে দিল। পশ্চিমের পর্যায়ক্রমিক নীতিবিগহিত, দাম্ভিক, কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত আচরণের প্রেক্ষিতে এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে একটি সর্বগ্রাসী আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল, যা রূপ ও চরিত্র বদল করে করে রূপান্তরিত হলাে সশস্ত্র যুদ্ধে বা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে, এর বীজ মূলত রােপিত হয়েছিল বায়ান্নে, ভাষা-শহিদদের রক্তভেজা জমিনে। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতাকে ধরে রাখার জন্যে, আর এই নতুন যুদ্ধটি ছিল স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনবার জন্য। লক্ষ্যের চারিত্রগত দিক এবং সামরিক শক্তির পরিসংখ্যান—উভয়ের বিচারে প্রথমটি অপেক্ষা দ্বিতীয়টি ছিল অনেক বেশি কঠিন যুদ্ধ’। যুদ্ধের আড়ালে সংঘটিত যুদ্ধের প্রভাবে নবাব সিরাজ হেরে গিয়েছিলেন। পলাশীর আম্রকাননে; ১৯৭১ সালে, পলাশীর অদূরে আম্রকাননবেষ্টিত এলাকা।
মুজিবনগর থেকে পরিচালিত যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের আড়ালে সারাক্ষণ যুদ্ধ চলেছে, কখনাে বহিঃশত্রুর বিপক্ষে, কখনাে-বা মীরজাফর-উমিচাদের মতাে গৃহশত্রুর বিরুদ্ধে; নবাব সিরাজ ওই আড়ালের যুদ্ধকে মােকাবিলা করতে পারেননি, কিন্তু মুজিবনগরের প্রাজ্ঞ নেতৃবৃন্দ অতি দক্ষতার সাথে দৃশ্যমান ও আড়ালযুদ্ধ—দুটিকেই মােকাবিলা করতে পেরেছেন, তাই মাত্র ন’মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে একটা রক্তখেকো দানবশক্তিকে পরাজিত করে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। সত্যিকার অর্থে, ইংরেজ শাসনাধীনে নির্যাতিত বাঙালিকুল, বিশেষত হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় ‘যেনতেন প্রকারেণ’ বিলেতি শাসনমুক্ত হতে চেয়েছিল, তাই বাংলা-বিভাজনের মতাে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, বিপরীতধর্মী দুই মেরু—ঢাকা-পিন্ডির অলীক ঐক্য—ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা তখন মাথা ঘামায়নি। কংগ্রেস কিংবা মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ (ব্যতিক্রম মাত্র কয়েকজন) ক্ষমতার স্বাদ নেবার জন্য এমনই বিভাের ছিলেন যে, ভারত বিভক্তি বা বারােশ মাইল দূরবর্তী দুই। ভূখণ্ড নিয়ে একটি আজব রাষ্ট্রের উদ্ভব—এর পরিণাম কী হতে পারে, তা তারা ভেবেও দেখেননি। তবে দুজন ইংরেজ এবং একজন ভারতীয় ‘দেশ। বিভাজন’ তথা বাংলা বিভাজন সম্পর্কে আগাম কিছু কথা বলেছিলেন, যা পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। এঁদের মধ্যে একজন, স্যার। ফ্রেডরিক বারােজ, যিনি ছিলেন বাংলার শেষ গভর্নর, ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, যদি ভারত ভাগ হয় তবে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাংলা, যার নিয়তি হলাে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া।’ (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট : ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের, অনুবাদ-রবিশেখর সেনগুপ্ত, পৃ. ১২৮)।
এ সম্পর্কে আরাে সুস্পষ্ট কথা বলেছিলেন ভারতের শেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন, জিন্নাহর দুই মাথাবিশিষ্ট কল্পলােকের মুসলিম রাষ্ট্র পঁচিশ বছরও টিকবে না, পূর্ব বাংলা পৃথক হয়ে যাবে (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, পৃ. ১৫৩)। মাউন্টব্যাটেন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, জিন্নাহ-কল্পিত মুসলিম রাষ্ট্রের একদিকে থাকবে ক্ষমতালিন্দু দাম্ভিক পাঞ্জাবি, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় বাঙালি। কোথাও এতটুকু মিল নেই পাঞ্জাবি আর বাঙালির মধ্যে। না পােশাক-আশাকে, না ভাবনাচিন্তায়, না চেহারাআকৃতিতে। পরম করুণাময় আল্লাহর কৃপাটুকু ছাড়া দু-অংশের মানুষ বােধহয় একসঙ্গে আর কোনােকিছুই ভাগ করে নিতে পারে না। দুই অধিবাসীদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যগত এমন কোনাে মিলনের বস্তু নেই যা দিয়ে তাদের মধ্যে ভাবের বিনিময় হয়। এমনকি একই ধর্মভুক্ত হলেও পাঞ্জাবি ও বাঙালিদের মধ্যে বিবাহসম্বন্ধ স্থাপন হয় না, কারণ তেমন মিলন প্রচলিত নীতি নির্দেশের বিরােধী।’ (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, পৃ. ১২৫)। বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক গােখলের একটি বিখ্যাত উক্তি, বাঙালিরা আজ যা চিন্তা করে, ভারতের বাকি অংশ তা চিন্তা করে আগামীকাল। বস্তুত গােখলের এ কথা যে অসত্য নয়—এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে তাকালে। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে যখন অন্য কোনাে জাতি বা জাতিগােষ্ঠী পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার কথা চিন্তাও করেনি, যখন অন্যরা রাষ্ট্রিক সুবিধাদি ও কৃপালাভের জন্য ব্যস্ত থেকেছে কর্তাভজনায়—তখন বাঙালিরা তিতুমীরের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে দেশমুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। স্বাজাত্য বা স্বাধিকার বিষয়ে অন্যরা যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন বা অচেতনপ্রায়—বাঙালিরা তখন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল, দীনেশ হয়ে রাজশক্তির ভিত বারবার কাঁপিয়ে দিয়েছে, দেশমুক্তির জন্য হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করে ভারতের অন্যান্য জাতিগােষ্ঠীর সামনে দেশপ্রেমিক’-এর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়েছে।
এবং এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে বাঙালি জাতি জন্ম দিতে পেরেছে সুভাষ বসুর (পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিব) সততা অকুতােভয় জাতীয়তাবাদী নেতার। মহাত্মা গান্ধী আর জিন্নাহ—যে দুই ভূখণ্ডে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে জাতির পিতা’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন, সেই পতাকাশশাভিত আলােকোজ্জ্বল অনুকূল মঞ্চের ক্ষেত্রটি কিন্তু তৈরি করে দিয়েছিল বাঙালিরাই, অগণিত প্রাণ ও অফুরন্ত ত্যাগের বিনিময়ে।  ইংরেজ রাজত্বে, অনেক বাঙালি স্বীয় মেধা ও দক্ষতার গুণে অনেক উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজশক্তির সেবাদাসে পরিণত হয়েছে বটে, কিন্তু গড় বাঙালি বরাবরই ছিল রাজশক্তির বিপক্ষে, অন্য যে কোনাে জাতিগােষ্ঠী অপেক্ষা আন্দোলন সংগ্রামে সােচ্চার। বাঙালি জাতির প্রতি ইংরেজ রাজশক্তির বৃহদাকার বিরূপতা প্রথম পরিস্ফুট হয় ১৯০৫ সালে, ‘বঙ্গবিভাজন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে, সেই বিরূপতার চরম-শােচনীয় প্রকাশ ঘটে ১৯১১ সালে, যখন কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লিতে, বাংলা মুলুক থেকে অনেক অনেক দূরে। ইংরেজদের কূটরাজনীতি-আবৃত দ্বিতীয় পদক্ষেপটি আরাে বেশি ভয়াবহ—ভারতবিভাগ, তৎসূত্রে বাংলাবিভাজ।
বস্তুত ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা কেবল ভারতবর্ষকেই দ্বিখণ্ডিত করেনি, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দ্বিখণ্ডিত করেছে। রাজনীতিসচেতন দুটি জাতি—বাঙালি আর পাঞ্জাবিকে, যদিও এই বিভাজন সংক্রান্ত পুরাে দায় তারা চাপিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাধে। কংগ্রেস ও লীগের সিংহভাগ নেতা তখন বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের প্রশ্নে নিশ্ৰুপ ও নির্বিকার ভূমিকা পালন করে গেছেন, হাতে গােনা এক-দুইজন ছাড়া বাকি নেতৃবৃন্দ বুঝতেই পারলেন না সীমানা-বিভাজনের নামে কী ভয়ানক বিষবৃক্ষ রােপণ করলেন তারা। হিন্দু এবং মুসলমান—দুই সম্প্রদায়ের সূত্র ধরে যে ভূখণ্ডকে ব্যবচ্ছেদ করা হলাে, এদের সংস্কৃতি অভিন্ন।  দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষা এক। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ধুমধামের সঙ্গে ১ বৈশাখ দিনটি নববর্ষের দিন হিসেবে পালন করে এবং সব শ্রেণীর বাঙালির কাছেই পরম গর্বের মানুষ হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।… ১৯০৫ থেকে ১৯১১, বঙ্গ-বিভাজনের সময় বাঙালিরা প্রমাণ করেছিল যে, ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, জাতীয়তাবাদী আবেগেই তারা আত্মহারা (ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, পৃ. ১২৭)। কিন্তু কৌশল করেও লর্ড কার্জন যা পারেননি, কংগ্রেস ও লীগ। নেতাদের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে কত সহজেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল বাংলার বুক।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র