বাঙলাদেশের স্বীকৃতি চাই
মুজিবের বাঙলাদেশেকে স্বীকৃতি জানাবার যে দাবি সারা দেশ জুড়ে উঠেছে তার সঙ্গে আমাদের ক্ষীণ কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা গর্ব অনুভব করছি। সারা দেশের এই দাবি আমাদের সরকার কোনােক্রমেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
সত্য বটে, আমাদের সংসদ সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা জানিয়েছেন। এই একটি বিষয় নিয়ে সংসদে সমস্ত দল যে এক হতে পেরেছেন এতে আমরা খুশী। কিন্তু এই প্রস্তাব যথেষ্ট নয়। মুক্তিযােদ্ধারা বারবার করে বলতে চান তাঁরা চান অস্ত্র, ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। বাঙলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে না নিলে অস্ত্র এবং অন্যান্য ধরণের প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রেরণ কি সম্ভব?
ভারত সরকারের হয়তাে দ্বিধা, বাঙলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নিলে অন্য দেশর আভ্যন্তরিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে কিনা এবং তার ফলে আন্তর্জাতিক জটিলতা সৃষ্টি হবে কিনা। কিংবা বাঙলাদেশের রাষ্ট্র সত্তাকে মেনে নিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবিকে মেনে নেওয়া হবে কিনা।
স্বাভাবিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে বিচার করলে এই সব সংশয় নিতান্তই ভিত্তিহীন। মুজিবের আন্দোলন। মােটেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়। বিগত নির্বাচনে শুধু পূর্ব বাঙলার নয়, সমস্ত পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল মুজিবের দর আওয়ামী লীগ। ন্যায়সঙ্গতভাবে সমগ্র পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের উপরই বর্তানাের কথা। কিন্তু ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র বেয়নেটের জোরে নিজেদের কর্তত্ব বজায় রেখেছে। তাদের কতৃত্বকে অস্বীকার করে মুজিবুর রহমান শুধু ন্যায়সঙ্গত নয়, আইনসঙ্গত কাজ করেছেন।
কিন্তু এ সব চুলচেরা আইনের তর্কের এটা সময় নয়। সীমান্তের ওপারে নরমেধ যজ্ঞ চলছে। একটা স্বাধীনতাকামী, নিরস্ত্র গর্বিত জাতিকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে মারার চেষ্টা হচ্ছে। চোখের উপর এ দৃশ্য দেখে আমরা কিছুতেই চুপ থাকতে পারি না। আমরা বাঙালিরা তাে কিছুতেই নয়-কেননা, সীমান্তের ওপারে যে রক্ত ঝরছে সে যে আমাদেরই রক্ত, আমার ভাইয়ের রক্ত।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলাে, আমরা নিজেদের গণতন্ত্রী, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বলে পরিচয় দিয়ে থাকি এবং এই পরিচয় নিয়ে গর্ব অনুভব করি। আমাদের চোখের সামনে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত একটা একটা জাতিকে তিল তিল করে হত্যা করা হবে আর আমরা শুধু সংহতির প্রস্তাব পাস করেই মনে করব কর্তব্য পালন করেছি?
পৃথিবীর আর যে জাতিই পারুক ভারত এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। বাঙলাদেশের পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। তারই প্রথম ধাপ বাঙলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেওয়া।
ভারত সরকারের দ্বিধাকে অতিক্রম করার জন্য তাই দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য প্রয়ােজন এপারের সমস্ত বাঙালি তথা ভারতবাসীর সর্বাঙ্গীণ, সর্বাত্মক ঐক্য। দুঃখের বিষয় এই একটা দাবি নিয়েও এপারের আমরা সবাই এক হতে পারলাম না। একাধিক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে- এমনকি তাদের প্রয়াসকে সংহত করার কোনাে চেষ্টাই এখনও হচ্ছে না। বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণের ঐক্য ও যদি আমাদের মেলাতে না পারে তার চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
সূত্র: সপ্তাহ, ৯ এপ্রিল ১৯৭১