বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১লা সেপ্টেম্বর, শনিবার, ১৫ই ভাদ্র, ১৩৮০
ভাড়াটেরা আজ আইনের আশ্রয় চায়
সংবাদপত্রে প্রতিনিয়তই বাড়িভাড়া প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ, ঢাকা শহরে আবার বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা কার্যকরীও তারা করেছেন। ফলে ভাড়াটেদের মধ্যে এক নিদারুন উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। এক অভিযোগে জানা গেছে, ঢাকার বাড়িওয়ালারা তৃতীয় পর্যায়ের শেষে এবার চতুর্থ পর্যায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করছে। বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গ নিয়ে বহুবার বহু পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছে কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। আমাদের সরকারও এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে একটি আইনও দেশে প্রচলিত রয়েছে অথচ তা কার্যকরী নয় বলেই অনুমেয়। কেননা বাড়িওয়ালারা ওই আইনকে মোটেই গ্রাহ্য করে না। তৃতীয় ও পরে চতুর্থবার বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর দরুন ভাঢড়াটের অবস্থা আজ সঙ্গীন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নি মূল্য ও তার সঙ্গে অত্যধিক বাড়ি ভাড়ার দরুণ নগরের জীবন সম্পূর্ণ অচল হতে চলেছে। জীবনধারণের সঙ্গতি মানুষ হারিয়ে ফেলতে বসেছে। যারা বাড়ি ভাড়া দেন তারা নিশ্চয়ই ভাড়াটেদের স্তরের মানুষ নন। বাড়িওয়ালারা নিঃসন্দেহে অবস্থাম্পন্ন মানুষ। যারা ভাড়াটে তারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। যা তারা বেতন পায় তার ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। জীবনধারণের জন্য যেসকল জিনিসের প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম একটি বাসস্থান। জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যদি বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি পায় তাহলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো জীবন অতিবাহিত স্বাভাবিকভাবে আর হতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের আইনের আশ্রয় প্রতিটি ভাড়াটে চায়। অথচ আমাদের সরকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার প্রচলিত আইনের ব্যবহার করছেন না। ফলে দিন দিন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে নগরের লোকা লোকা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো। স্বাধীনতার পর অনিবার্য কারণবশতঃ বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণে প্রথম পর্যায়ে বাড়ি ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর যতই দিন অতিক্রান্ত হয়েছে তবে বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতায় পর্যবসিত হচ্ছে। ভাড়া বাড়ানো আজ তাদের একটা নেশা। এখানে এসে ভুক্তভোগী মানুষেরা আইনের সাহায্য চায়। আমরা সরকারকে বলব অবিলম্বে শহরের বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুন। এবং মানুষের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে হাঁপিয়ে ওঠা জীবনের উপর থেকে রাহু-গ্রাস স্বরূপ বাড়িভাড়া রোধ করুন। নাগরিক জীবনের অসহায়ত্ব মোচনের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ ভাড়াটেদের আজ আশু কাম্য।
এবার দু’নম্বরে চৌ এন লাই
চীনের ক্ষমতার আসনে এবার দুই নম্বর লোক হলেন মিঃ চৌ এন লাই। কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের তাকে এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান সেই মাও সেতুং। চল্লিশ বৎসরেরও বেশি সময় তিনি এই পদে আসীন আছেন। এই চল্লিশ বৎসরে চীনের রাজনীতিতে কত উত্থান-পতন হয়েছে, ঘটে গেছে একাধিক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব। সেদিন যারা কমরেড মাও সেতুং এর সঙ্গে ছিলেন, আজ তাদের অনেকেই নিখোঁজ। কেউ মারা গেছেন, কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কেউ আবার নিরবে সরে গেছে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে। গত এক দশকে কি কম ধকল গেছে পার্টির উপর দিয়ে।
সাতষট্টির রক্তক্ষয়ী তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে লিন পিয়াও চীনা ক্ষমতা মঞ্চের সবচাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তাকেও একদিন ক্ষমতার চক্রান্তেই হারিয়ে যেতে হবে এটা কি সেদিনকার ভেবেছিলেন? ভাবেননি সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হবার পূর্বে চীনা রাষ্ট্রপ্রধান কমরেড লিউ শাউ চিও। তার লেখা ‘হাউ টু বি এ গুড কমিউনিস্ট’ চীনের নয়া আর হবু কমিউনিস্টদের দীক্ষা মন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতো। শিক্ষায়তন গুলোতে তরুণ চীনারা মনোযোগের সাথে তা রপ্ত করতেন। সাতষট্টির সাংস্কৃতিক বিপ্লবে সেই স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে ‘শোধনবাদীদের’ উৎখাত করার নাম করে চীনা তরুণদের দ্বারাই একে একে উধাও করে দেয়া হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের। লিউ শাউ চি সব হারালেন আর ক্ষমা প্রার্থী হয়ে টিকে রইলেন চৌ এন লাই।
পর্দার আড়ালে শুরু হলো নয়া চক্রান্ত। ধীরে ধীরে ক্ষমতা সঞ্চয় করতে থাকলেন চীনের ক্ষমতাহীন প্রধানমন্ত্রী। সুযোগ এলো। একাত্তুরের শেষাশেষি মাও সেতুং-এর উৎখাতের ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকার অভিযোগ এলো লিন পিয়াও এর বিরুদ্ধে। দু’বৎসর আগে ঊনসত্তরের এপ্রিলে নবম জাতীয় কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের এক অদ্ভুত ধারা সংযোজন করে লিন পিয়াওকে করা হয়েছিল মাও সে তুংয়ের উত্তরাধিকারী। মঙ্গোলিয়া পালিয়ে যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলেন লিন পিয়াও। সামরিক বাহিনী থেকে লিন পিয়াও সমর্থকদের হটিয়ে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন চৌ এন লাই।
চব্বিশে আগস্ট থেকে আটাশে আগস্ট -এই চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে মিঃ চৌ এন লাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের দু’নম্বর ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। চীনের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আগামীতে মিঃ চৌ এন লাই কতটুকু সুবিধা করতে পারবেন আমরা জানি না। কিন্তু একটা কথা সত্যি পার্টিকে বাদ দিয়ে যখন একপার্টি শাসিত কোন দেশে ব্যক্তি প্রাধান্য উৎকট হয়ে দেখা দেয় সেখানে প্রাসাদ চক্রান্ত সক্রিয় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। দশম পার্টি কংগ্রেসে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের মুখে চীনা জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে’ যে একটা উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তা থেকে একটা কথা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে চীনা জনগণের বাস্তব অভাব-অভিযোগ থেকে তাদের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে রাখার প্রয়াস চীনা নেতৃত্ব আগামীতেও চালিয়ে যাবেন। এটা সুস্থ চিন্তা নয়, এটা রাষ্ট্র অথবা পার্টি কোনটার ভিতরেই গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে সহায়তা করবে না। আর যতদিন পার্কের ভিতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা না যাবে ততদিন চীনা নেতৃত্ব জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হঠকারী ভূমিকাই পালন করে চলবেন। এর অন্যথা হবার নয়, ইতিহাস আমাদের তেমন শিক্ষা দেয় না।
নিক্সন সাহেবও শান্তি পুরস্কার পাবেন?
অবশেষে নিক্সন সাহেবও শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন অর্থাৎ নোবেল পুরস্কার দান কমিটি নাকি তারও যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর নাম এ ব্যাপারে সিলেক্ট করছেন বলে গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। মার্শাল টিটোকে যদি এ পুরস্কার দেওয়া হয়, সে জন্য কারো কোন ক্ষোভ থাকবেনা বরং দেশের শান্তিপ্রিয় এবং শান্তিকামী মানুষ তার জন্য আনন্দিতও হবেন। কিন্তু নিক্সন সাহেব? নিক্সন সাহেব কি করে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন? নোবেল পুরস্কার কমিটি কি জন্য এ ব্যাপারে তাঁর নাম চিন্তা করতে পারেন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে আমরা বাংলাদেশের লোকেরাও তা ভেবে পাইনে।
অবশ্য নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটির যদি নিক্সন সাহেবকে পুরস্কার দিতেই হবে এমন একটা গোঁ ধরে বসেন এবং সেজন্য যদি শান্তি পুরস্কার প্রদানের পূর্ববর্তী আদর্শ-উদ্দেশ্যকে রদবদল করে থাকেন-অন্য কথায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানের কথা বলে থাইল্যান্ডের আস্তানা শক্তিশালী করে ও কম্বোডিয়ার লাখ লাখ টন বোমাবর্ষণের মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামী ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি করা, মধ্যপ্রাচ্যে আরব ইসরাইল যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রেখে অস্ত্র বিক্রয় আর তেল কেনার রাজনীতি অব্যাহত রাখা, লাতিন আমেরিকা বিশেষ করে চীনের সমাজতন্ত্রী শান্তিকামী জনগণের বিরুদ্ধে গোষ্টিবিশেষকে মদদ যুগিয়ে একটা গৃহযুদ্ধ চাপানোর সযত্ন তৎপরতা চালানো ছাড়াও বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাপট আর দাসত্ব নিগার ছলে-বলে-কৌশলে পরিচালনা করে উন্নতিশীল শান্তিপ্রিয় মানুষ সমাজের হেনস্থা করাটা যদি নিক্সন সাহেবের শান্তি প্রতিষ্ঠার তৎপরতা বলে নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি মনে করে থাকেন, তবে নিক্সন সাহেবকে যথাযথই এ পুরস্কার দেয়া যেতে পারে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির ভিয়েতনামের যুদ্ধ অবসানের জন্য প্যারিস চুক্তি এবং সাম্প্রতিককালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান লিওনিদ ব্রেঞ্জনেভের ওয়াশিংটন সফরকালে দু’নেতার স্বাক্ষরিত পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিকেই যদি নিক্সন সাহেবের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করে থাকেন, তবে তাদের উপরোক্ত বিষয়াবলীও ভেবে দেখতে হবে। তদুপরি নিজের দেশে নিক্সন সাহেব ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘোলা জলে এখন যেভাবে হাবুডুবু খাচ্ছেন এবং এই কেলেঙ্কারির প্রধান নায়ক যে তিনি সে বিষয়ে আজ তাঁর দেশের জনমত ও বিশ্ব জনমত যখন ঐক্য রায় দিচ্ছেন, তখন তিনি কি করে এ পুরস্কার পাবার জন্য নির্বাচিত হতে পারেন?
কেননা, ওয়াটারগেট মামলার মাধ্যমে আজ একথা সুস্পষ্ট যে গদীর লোভে নিক্সন সাহেব বর্তমানকালের সবচাইতে জঘন্য রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি করে নিজ দেশের জনগণের শান্তি ও নৈতিকতাবোধ বিঘ্ন করে যখন বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হতে যাচ্ছেন, তখন নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি সেটাকেই কি তার কৃতিত্ব বলে ধরে নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করতে চাচ্ছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কারে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক