বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩রা জুন, রোববার, ১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
রত্নগর্ভা আর নেই
“যে হাতে দোলনা দোলে সেই হাতই বিশ্ব শাসন করতে সক্ষম” প্রবাদ বাক্যটি বহুল প্রচলিত। কোমলে কঠোরে এই আদর্শ মাতৃ চরিত্র বিশ্ববরেণ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহীয়সী মাতার প্রয়ণ উপলক্ষে উক্তিটি উল্লেখ্য। গত শুক্রবার ৩১শে মে বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিট সময়ে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাসভবনে রত্নগর্ভা জননী বেগম সাহেরা খাতুন ইন্তেকাল করেন (ইন্না…………. রাজেউন) । মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস বলে, যুগে যুগে দেশ-দেশান্তরে বহু পুণ্যের ফলে এক একজন রত্নপ্রসূ মা তার আবির্ভাব হয়। যুক্তি বুদ্ধি সমৃদ্ধ জ্ঞান যখন মানুষের ছিল না তখনও জ্যোতিষ ও গণনায় সম্ভাব্য রত্নগর্ভা জননীর বিপুল সমাদর ছিল কারণ তার কল্যাণ স্পর্শে, তার মহিমা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী হয়ে যে সন্তান এই মর্তের জগতে আসবেন তিনি যে ত্রাণকর্তা হবেন। আর একটা দেশ একটা জাতি সেই অগ্নি সন্তানের পদধ্বনি শুনবার জন্য তো তপস্যা করে। সেই জননীর সমাদর তাই সর্ব কালের সর্ব দেশে সর্বযুগের।
মরহুমা বেগম সাহেরা খাতুনকে আমরা তেমনি আদর্শ ও বরণীয়া মাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করি। তিনি এমন এক অগ্নি সন্তান বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন যিনি এ জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা সূর্যপথের স্বর্ণ সোপানের ঠিকানা। যার আদর্শ নীতি ত্যাগ ও তিতিক্ষার আদর্শ দিয়েছে এ জাতিকে সংগ্রামের দৃপ্ত প্রেরণ্য। যার বজ্রকন্ঠে বেজেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম কালের রণ দামামা। অনার্য আদৃত বঙ্গভূমি কতভাবে দেশি-বিদেশিদের হাতে কত ভাবে লাঞ্চিত হয়ে পেয়েছে এই সন্তান। সবুজ বনানী দেশে যিনি অবশেষে রক্ত লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন এমন সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য তাই মরহুমা আজ সমগ্র জাতির কাছেই গৌরব ও শ্রদ্ধার পাত্রী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামের পাশে তার জননীও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণরেখায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
মনীষীদের জীবনী পাঠে জানা যায়-তাদের অধিকাংশেরই ব্যক্তি জীবনে মায়ের প্রভাব অপরিসীম। সততা, নিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ঐকান্তিকতা, মনোবল, নীতিজ্ঞান, আদর্শ চেতনা সব গুণাবলীর তারা যেন মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ভ্রণ অবস্থাতেই পান। পরবর্তী জীবনে তার মূল্যায়ন করতেও তারা কুণ্ঠিত করেন না। এর্ং দেখা যায় কর্মজীবনের নিশিছদ্র ব্যস্ততার মধ্যে জননীর প্রসঙ্গ তাদেরকে অতিশয় ব্যাকুল করে তোলে।
বেশি দিনের কথা নয় বঙ্গবন্ধু তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সেই সময় মায়ের অসুখ সংবাদে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদ্যত খরগ মাথায় নিয়ে গিয়েছিলেন জননী দর্শনে। তিনি নিজে উল্লেখও করেছেন যে, তার সারা জীবনের সকল সংগ্রাম ত্যাগ ও তিতিক্ষায় তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে নয়নের মনি মুজিবকে একনজর দেখার জন্য তিনি বারবার আকুতি জানিয়েছিলেন কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য সে খবর যথাসময়ে ঢাকা পৌঁছেনি। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়নি সকল অনুপ্রেরণার উৎস শেষবারের মতো এক নজর দেখা। এ যে কত বড় মর্মবেদনা তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জাতির সেবায় বৃহত্তর দায়িত্বে নিযুক্ত বঙ্গবন্ধু কল্পনাও করতে পারেননি এমন একটি আকস্মিক আঘাতের সম্মুখীন হবেন তিনি।
একথা অনস্বীকার্য যে, মহীয়সী মাতাই পারেন দেশবরেণ্য বা বিশ্ববরেণ্য সন্তানের জন্ম দিতে। আর মানব জন্মের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা হলো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য একটি সুসন্তান পেছনে রেখে যাওয়া দেশ জাতি ও বিশ্বের কল্যাণে যে সন্তান তিল তিল শুভকর্মের নৈবেদ্য অর্পণ করবে। যার আশীষ ধারায় স্নাত হবে মানবতা ও বিশ্ব শান্তি। ধন্য স্বর্ণ মরহুমা বেগম সাহেরা খাতুন। এমন সন্তানের গর্ব বুকে ধারণ করে তিনি এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পেরেছেন। আমরা এই মহীয়সী জননীর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি প্রার্থনা করছি দরবারে।
শান্তির পদক্ষেপ
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ৩৩ দিনব্যাপী শান্তি প্রচেষ্টা ফলশ্রুতি হিসেবে অবশেষে রণক্ষেত্রে শান্তির ছায়া নেমে এসেছে। গত ৩১শে মে সিরিয়া ও ইসরাইল সৈন্য পৃথকীকরণ সম্পর্কিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
সিরিয়া-ইসরাইল ও জাতিসংঘ বাহিনীর প্রতিনিধিত্বকারী তিনজন জেনারেল এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সিরিয়ার পক্ষে জেনারেল আদনান সাইয়ারা, ইসরাইলের পক্ষে জেনারেল এইচ সাফির এবং জাতিসংঘের জরুরী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এন সি ও সিলাসভো স্বাক্ষর করেছেন তিনটি ঐতিহাসিক দলিল। দলিল তিনটি যুদ্ধবিরতি সৈন্য পৃথকীকরণ এবং জাতিসংঘ বাহিনীর অবস্থান ও প্রটোকল চুক্তির। দলিল তিনটি স্বাক্ষরের পর পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষকদের হাতে দলীল গুলির একটি করে কপি দেওয়া হয়। সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে গোলান মালভূমি এলাকার উভয়পক্ষে দীর্ঘ ৮১ দিনের তীব্র সংঘর্ষের অবসান ঘটল। শুধু তাই নয় ইসরাইলের জন্মের পর থেকে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন এর দুটি দেশ গত ২৬ বছর পর এই প্রথম একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো।
সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদনের গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উভয়পক্ষ অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধ ও ৬৪ কিলোমিটার ফ্রন্টে সৈন্য পৃথকীকরণে ব্যবস্থা করবে। ইসরাইল গত অক্টোবর যুদ্ধে অধিকৃত এলাকার ত্যাগ করবে এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত কানতারা শহর ও ৬৭টি গ্রাম প্রতর্পণ করবে। এক হতে চার মাইল প্রশন্ত বাফার জন্য জাতিসংঘ বাহিনী উভয় পার্শ্বে স্বল্পসংখ্যক সিরীয় ইসরাইলি সৈন্যের নতুন অবস্থান তদারক করবে।
দুটো দেশের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির পথ প্রশস্ত হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন এর ছোঁয়া সারাবিশ্বে এসে লেগেছে। সারা বিশ্বের মানুষ মনেপ্রাণে কামনা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি ছায়া নেমে আসুক। এই চুক্তি সেই শান্তির প্রাথমিক পদক্ষেপ রূপে চিহ্নিত হতে পারে। জাতিসংঘ জরুরী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এনসিও সিলাসভোর সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়- এ চুক্তি কোন শান্তিচুক্তি নয়, তবে এ কথাকে অস্বীকার করতে পারবে না যে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
চুক্তি সম্পর্কে মিশরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব ফাহমী বলেছেন, সৈন্য পৃথকীকরণ চুক্তি হলেও মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও প্যালেস্টাইনকে ছাড়া জেনেভায় যাবেনা। তিনি বলেন, ইসরাইলকে পশ্চিম এশিয়ায় অস্তিত্ব রাখতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, সিরিয়া ইসরাইল সৈন্য পৃথকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সমস্যা যে নেই এমন নয়। সমস্যা রয়েছে এবং এর সমস্যার সমাধান না হলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে না।
এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সব সমস্যার মূল সূত্র হল ইসরাইল। সবকিছুই নির্ভর করছে ইসরাইল আগামী দিনগুলোতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কি ভূমিকা নেবে। এটাও আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইসরাইল জন্মের পর থেকেই পরের হাতে অন্য ভক্ষণ করে এসেছে ইসরাইলের প্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব স্বার্থেই ইসরাইলকে লালন পালন করে এসেছে এবং এখনো করছে। গত অক্টোবর যুদ্ধের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েছিল তা কারও অজানা নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে অনেক কিছুই করতে পারেন কিসিঞ্জার সাহেবের ৩৩ দিনব্যাপী শান্তি প্রয়াসীই তার প্রমান। উল্লেখ্য মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নও আগ্রহী। সিরিয়ার ইসরাইল চুক্তির বিষয়ে সাময়িকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো দামেস্কে যান এবং সিরীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের শান্তি প্রয়াসকে আমরা অভিনন্দন জানিয়ে বলবো যে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্যালেস্টাইনীদের যে ন্যায়সঙ্গত দাবি দাওয়া রয়েছে তা পুংখ্যানুপুংখরূপে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্যালেস্টাইনীদের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে উপেক্ষা করে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জেনেভা সম্মেলনের দিন এগিয়ে আসছে। এ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবার আগেই প্যালেস্টাইনীদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর একটা সুষ্ঠু সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক