পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও এনএসআইয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক
অনেকেই জানে না যে ইতিহাসঃ
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও এনএসআইয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হককে ২৪ এপ্রিল পুলিশ গ্রেফতার করে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ১৯৭১ সালে ২৮ মার্চ রংপুর সেনানিবাস ঘেরাও অভিযানে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেন। ঘেরাও অভিযানে আনুমানিক ৬০০ নিরস্ত্র বাঙালি ও উপজাতীয় শাহাদতবরণ করেছিলেন।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ ১৯৬৬ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১১ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে (ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট) কমিশন পান। পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ সালে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে বদলি হয়ে রেজিমেন্টের সঙ্গেই পাকিস্তান থেকে রংপুর সেনানিবাসে চলে আসেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছাড়াও ক্যাপ্টেন সহূদ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নাসির উদ্দিন, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হাশেম ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান নামে আরও চারজন বাঙালি অফিসার একই রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধকালীন যে ক’জন বাঙালি সামরিক অফিসার পাকিস্তানিদের পক্ষালম্বন করে বাঙালি নিধন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে রংপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সর্বদলীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের ছায়াতলে কীভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করা যায় তার একটি উপায় বের করার জন্য যখন পরিকল্পনা করছিলেন, তখন রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত জনৈক বাঙালি সৈনিক তাদের কাছে এক গোপন বার্তা পাঠান।
ওই গোপন বার্তায় তিনি বিপুলসংখ্যক বাঙালি সমাবেশ করে রংপুর সেনানিবাসকে চারদিক থেকে ঘেরাও করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ করেন। বার্তায় আরও জানান, সেনানিবাসে কর্মরত সব বাঙালি সেনাসদস্য তাদের নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে এ ঘেরাও অভিযানে অংশগ্রহণ করবে এবং সেনানিবাস দখল করে নেবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বার্তা পাওয়ার পর সর্বসম্মতিক্রমে ২৮ মার্চ সেনানিবাস ঘেরাও অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮ মার্চ অপরাহ্নে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সেনানিবাসের আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি ও উপজাতীয় সাঁওতাল এবং ওঁরাও সম্প্রদায়ের প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী সমাবেশ ঘটান এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি তীর-ধনুক, দা-বল্লম, বাঁশ ইত্যাদি নিয়ে সেনানিবাস ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করেন।
অপরদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সগির ঘেরাও অভিযানের তথ্যটি নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে পেয়ে যান এবং সে অনুসারে এ অভিযান বানচালের এক গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ঘেরাও অভিযান বানচালের পরিকল্পনাটি তিনি গুটিকয়েক বিশ্বস্ত অফিসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন।
২৮ মার্চ সেনানিবাস ঘেরাও অভিযান শুরু হলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি স্বয়ংক্রিয় ব্রাউনিং মেশিনগানসজ্জিত ১০টি সামরিক জিপ অগ্রসরমান মানুষের মিছিল বরাবর তাক করে স্থাপন করা হয়। এ ১০টি জিপের মধ্যে একটি ছিল ক্যাপ্টেন ওয়াহিদের নিয়ন্ত্রণে।
ঘেরাও অভিযানে অংশগ্রহণকারী বাঁধভাঙা মানুষের ঢল ক্রমেই সেনানিবাসের সীমানার নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। একটানা অবিশ্বাস্য বৃষ্টির মতো ঘন গুলিবর্ষণে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ৫০০ থেকে ৬০০ স্বাধীনতাপ্রত্যাশী মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গুলিবিদ্ধ আহত মানুষের আর্তচিৎকার চারদিকের পরিবেশকে ভারি করে তোলে। মুহূর্তে সেনানিবাসের দক্ষিণের সবুজ মাঠ তাজা লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
তৎকালীন ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে কর্মরত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নাসির (বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির উদ্দিন, যিনি আড়াই মাস রংপুর সেনানিবাসে বন্দি থাকার পর পালিয়ে গিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন) ২৮ মার্চ ঘেরাও অভিযানের সময় ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : ‘আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, মেশিনগানসজ্জিত যে জিপগুলো এতক্ষণ বাঙালিদের বেশুমার হত্যা করেছে তারই একটি জিপ থেকে সদর্পে নেমে আসছেন একজন বাঙালি অফিসার এবং ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ। মুখে তার কর্তব্য পালনের পরিতৃপ্ত হাসি। জিপ থেকে নেমে কোমরে হাত রেখে বুক ফুলিয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন অদূরে মাঠের দিকে, যেখানে অসংখ্য বাঙালির মৃতদেহ পড়ে আছে লাল রক্তের স্রোতের মধ্যে।’
এ মর্মান্তিক ঘটনার পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নাসির রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন সহূদের কাছে যান এবং এ হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে পরামর্শ তো দূরে থাক, কোনো উত্তর দেয়া থেকে সহূত বিরত থাকেন।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ ঘেরাও অভিযানের পরবর্তী দু’দিনের মধ্যে অফিসারসহ সব বাঙালি সেনাসদস্যকে নিরস্ত্র করে বন্দি করে। তবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ এবং ক্যাপ্টেন সহূদকে বিশেষ বিমানে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টই ছিল একমাত্র ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, যেখানে মোট ৫৫টি ট্যাঙ্ক ছিল। ট্যাঙ্কের অংশ হিসেবে সঙ্গে ছিল ৫৫টি হেভি মেশিনগান, ১১০টি লাইট মেশিনগান এবং এর সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ৫৫টি কামান।
একটি আধুনিক কনভেনশনাল যুদ্ধে ট্যাঙ্ক যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আয়তন ও জনবলের দিক থেকে রংপুর সেনানিবাস ছিল অন্যান্য সেনানিবাসের তুলনায় ছোট। একটি ব্রিগেড গ্রুপের অবস্থান করার মতো পরিধি ছিল এর।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে রংপুর সেনানিবাসে মেজর আমজাদ (প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আমজাদ হোসেন চৌধুরী)সহ ১২ বাঙালি অফিসার ছিলেন এবং সেনানিবাসের সর্বমোট জনবলের ৫০ ভাগ ছিল বাঙালি সেনাসদস্য।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে শতকরা হিসেবে রংপুর সেনানিবাসের মতো অন্যান্য সেনানিবাসে মোট জনবলের তুলনায় বাঙালি সেনাসদস্যের আধিক্য না থাকা সত্ত্বেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অথচ রংপুর সেনানিবাসের স্বার্থপর কিছু বাঙালি অফিসারের নির্লজ্জ বেহায়াপনা, নিজ জীবন রক্ষা এবং সিদ্ধান্তহীনতার জন্য ৫০ ভাগ বাঙালি সেনাসদস্যের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বিশাল এ ট্যাঙ্কশক্তি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই হাতছাড়া হয়ে যায়।
উপরন্তু ক্যাপ্টেন ওয়াহিদের মতো বাঙালি অফিসার স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এপ্রিল মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে তিনজন জ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসার মেজর আমজাদ, মেজর মাহতাব এবং মেজর শরীফ বদলি হয়ে রংপুর সেনানিবাস ত্যাগ করে চলে যান।
সে সময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নাসিরসহ সাতজন জুনিয়ার অফিসার এবং আনুমানিক ৫০০ সৈনিক পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি অবস্থায় থেকে যান। পরবর্তী সময়ে জুন মাসে নাসিরসহ তিনজন অফিসার পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অবশিষ্ট অধিকাংশ বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে পাকসেনারা পর্যায়ক্রমে গুলি করে হত্যা করে।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে হাত করে বদলি হয়ে যাওয়া বাঙালি অফিসারদের প্রসঙ্গে মেজর নাসির তার লেখা ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন : ‘আশ্চর্যজনকভাবে স্বার্থপর ছিল এসব বাঙালি কর্মকর্তা। তাদের সবাই যে যার মতো করে নিজেরাই বাঁচলেন কেবল, পেছনে ফেলে যাওয়া তাদের অধস্তন স্বজাতীয় সৈনিকদের কথা একবার মনে করার প্রয়োজনও তারা অনুভব করলেন না।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ ১৯৭৪ সালে অন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আর গ্রহণ করা হয়নি।
পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন এবং বর্তমানে প্রমাণিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আমলাদের মতোই সব সরকারের শাসনকালে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ক্যাপ্টেন ওয়াহিদের মতো এমন আরও অনেক সরকারি আমলা এখনও আমাদের সমাজে মাথা উঁচু করেই বেঁচে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এদের অনেকের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তারা আসলেই স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কিনা তা বের করতে হবে। এরই মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিকে ব্যবহার করে মন্ত্রিত্ব, এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন হয়ে দেশ শাসনও করেছেন।
এসব অচ্ছুত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে দেশবাসীর কাছে তাদের কদর্য মুখখানা উন্মোচন করে দিতে হবে, আনতে হবে আইনের আওতায় এবং একই সঙ্গে সরকারি সুযোগ-সুবিধা লুণ্ঠনকারী প্রমাণিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শুধু রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যক্তিবিশেষকে ছাড় দেয়া হবে; তা হতে দেয়া যাবে না। তাহলে সরকারের সদিচ্ছা ও কর্মপরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। এবং বর্তমানে পরিত্রাণ পেয়ে গেলেও ভবিষ্যতে আগামী প্রজন্ম আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
লেখক – একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা
Post link
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও এনএসআইয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হকঅনেকেই জানে না যে…
Posted by Tashrique Mohammed Sikder on Monday, April 30, 2018