অফিসার হিসাবে ১৯৫৫-তে জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪, এই ক’বছর তিনি সেনা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। এসময় তিনি সিআইএ’র গোপন অপারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই অতি গোপন অপারেশনটির নাম ছিল ST CIRCUS। এই অতি গোপন অপারেশনের আওতায় সিআইএ তিব্বতীদেরকে ভারতের মধ্যে দিয়ে চিলমারী এবং একই সঙ্গে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসতো। কিছু তিব্বতী কে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে নাশকতা করার জন্য আবার তিব্বতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। প্রয়োজনে কোনো কোনো তিব্বতী দলকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ সাইপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের ক্যাম্প হেইল নামের জায়গাতেও পাঠানো হত। প্রশিক্ষণের কাজে সিআইএ’র এই অপারেশনটি শুরুতে ভারতীয়দের কাছে গোপন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ও চীনের হৃদ্যতার কারণে। যাই হোক, এ সময় অন্যান্য বেশ ক’জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াও সিআইএ’র এই অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বেশ ক’বছর এই ST CIRCUS নামের তিব্বতি অপারেশন চালিয়ে যান। সম্ভবত তখন থেকেই জিয়া সিআইএ অনুকূল্যের দলিলে স্থান করে নেন নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য।
জিয়াউর রহমানের আদর্শিক লাইনের বিষয়টি আজ অনেকটা তর্কের ঊর্ধ্বে। তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, ধর্মানুরাগী এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা। দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করে তিনি যা কিছু করেছেন, তা ছিল প্রাকারান্তরে পাকিস্তান এর অনুকরণে একটি মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার শামিল। তারপরও একাত্তুরে তার মুক্তিযুদ্ধের যোগদান এবং রণাঙ্গনে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি প্রশ্নাতীত রয়ে গেছে।
জিয়াউর রহমানের জন্ম বগুড়ার বাঘবাড়িতে। বাবা মনসুর রহমান ছিলেন একজন রসায়ন কুশলী। জিয়ার শৈশব কেটেছে কলকাতায়। লেখা-পড়া করেছেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। ‘৪৭’র পর চলে যান করাচীতে। স্কুলের পাঠ শেষ করেন করাচির একাডেমি স্কুলে। তারপর ডিজে কলেজে। তারপর ‘৫৩-তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
আসলে জিয়াউর রহমান ব্যক্তি হিসেবে তেমন প্রগতিশীল কোন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তেমনি মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও তিনি প্রসারিত ছিলেন না। শুরু থেকেই জিয়াউর রহমান বাঙালির বিবর্জিত পরিবেশে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবনের প্রারম্ভে পা রেখেছেন এবং সেখান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটি জনবিরোধী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, যাদের মূল্যায়নে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি আগাগোড়াই ছিল পাকিস্তান তথা ইসলামবিরোধী। যে কারনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মত একটি ব্যাপক জন্য জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও তার পশ্চাৎপদ মানুষই দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি মিত্রদেশ ভারত বিরোধিতা যথেষ্ট লজিক রেখেছেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তার অনাস্থার বিষয়টিও সর্বজনবিদিত। এমনকি রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর সঙ্গেও তিনি অনেক বিষয়ে কঠোর ভাবে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং তাদের মধ্যকার বিরোধ এ সময় বেশ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ন’মাসের প্রক্রিয়ার মধ্যে তিনি রাজনৈতিকভাবে চৈনিক লাইনের অনুসারীদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে কাজী জাফর আহমেদের সঙ্গে তার নিবিড় ঘনিষ্ঠতার কথা অনেকেই জেনেছেন।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে যে সত্যটি এখানে স্পষ্টতর হচ্ছে তা হলো, পাকিস্তানি আদর্শের কাঠামোয় জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশের বিষয়। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তার সক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া তার আচরণের কোন অংশের সঙ্গেই বাংলাদেশের জনযুদ্ধের বিশাল অংশের কোনো সাদৃশ্য নেই। কিন্তু তা সত্বেও তার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির এই বহিঃপ্রকাশ যুদ্ধে লিপ্ত জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা স্বাধীনতার চার যুগ পরেও আজও দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে একইভাবে সুবিদিত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে জিয়াউর রহমান আপামর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তো বটেই, ভিন্ন চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের একাংশের কাছে ও নিজের সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলতে সমর্থ হন। বাংলাদেশের ইতিহাসের চরম সন্ধিক্ষণে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের মধ্যদিয়ে আবির্ভূত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে এককভাবে একটি নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্বেও তাকে পাশ কাটিয়ে সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ- এসব কিছু জিয়াউর রহমানকে সবদিক থেকে অধিকতর সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছে দেয়। এ অবস্থায় তিনি প্রতিবাদী হওয়ার চেয়ে সহনশীল আচরণের প্রতিফলনকেই কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন। জিয়ার জন্য তখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল সুযোগ সৃষ্টিতে খানিক অপেক্ষার। আর সেই লক্ষ্যে জিয়া তখন সুযোগের জন্য অপেক্ষা আর ধৈর্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। বলাবাহুল্য, এই দুটো পরীক্ষাতেই জিয়াউর রহমান উত্তীর্ণ হন।
সেনাপ্রধান নিয়োগ প্রশ্নে তার প্রতি কথিত অনিয়মের ব্যাপারে তিনি নীরব থাকলেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন তুলনামূলক বিচারে তিনি অনেকের চেয়ে সহনশীল। এর ফলে তার উপর সবার সহানুভূতি বৃদ্ধি পেল। এ সময় সরকারের উচ্চ মহলের সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন ওসমানী সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম নিল, অন্যদিকে জিয়া সম্পর্কে এমন উপলব্ধি সৃষ্টি হল যে, জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেনাপ্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে তার ওপর সুবিচারের প্রয়োগ ঘটেনি। পরিস্থিতির এমন পর্যায়ে জিয়া রহমানকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আনা হলো। ভাবে প্রতীক্ষার পরীক্ষায় কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন জিয়া। কিন্তু তখনও তার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনের পথ ছিল দীর্ঘ।
ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে জিয়াউর রহমানের সমকক্ষতা অর্জনে সক্ষম কোনো ব্যক্তি তখন সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কোনো পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। অধিকন্তু সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধে লড়াকু একটি বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ সফলতার স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
ইতোমধ্যে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়ার কমপক্ষে ১ ডজন সেনা অফিসার চাকরি থেকে অপসারিত হয়েছেন। এটা ‘৭৪’র কথা। ঢাকা ব্রিগেড অধিনায়ক জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের ও মেজর জলিলকে আগেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো। যশোরের ব্রিগেড অধিনায়ক মঞ্জুর চাকরিচ্যুতি থেকে বেঁচে গেলেও দেশ থেকে বিতাড়িত হন এবং তাকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া দেশের সর্বত্রই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সংঘাতের ঘটনা ক্রমাগত ঘটে চলেছিল। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যদের মধ্যে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর নেতৃত্বের প্রশ্নে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টির পাশাপাশি জিয়ার অপেক্ষার দিনগুলো দ্রুত অতিক্রান্ত হয়ে চলেছিল। তিনি নেপথ্যে সেনাবাহিনী বিরাজমান অসন্তোষকে আরও তীব্র করে তুললেন। সঙ্গে যুক্ত করলেন ভারত বিরোধিতার বিষবাষ্প। ফলে অচিরেই জিয়াউর রহমানকে ঘিরে একটি ভিন্নধর্মী চিন্তা-চেতনার উদ্রেক ঘটল সেনাবাহিনীতে এবং এর প্রভাব নৌ ও বিমান বাহিনীকেও স্পর্শ করল। এছাড়াও জনসমক্ষে ততদিনে তাকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনার অপর একটি রাজনৈতিক মাত্রার সংযোজন ঘটেছিল। এভাবে পুরো সশস্ত্র বাহিনীসহ দেশের একটি প্রভাবশালী মহলের অবিকল্প নেতৃত্বের দায়ভার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অর্পিত হয়ে পরে জিয়াউর রহমানের ওপর। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি এদের কাউকেই হতাশ করেননি। তিনি এক ধরনের আশার বাণী নিয়ে সহসাই আবির্ভূত হন রাজনৈতিক মঞ্চে। এ মঞ্চ যেন তার জন্য তৈরিই হয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার বিপরীতে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি সমস্যার গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হন। সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার মাত্রা যে দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল, তা তিনি বুঝে উঠতে সক্ষম হননি। আর সক্ষম হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিরত থাকেন। তাছাড়া জিয়া রহমান যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সম্পর্কেও তার কোনো সম্যক ধারণা ছিল না। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে যেভাবে আচরণ করতে দেখেছেন, তারই অনুকরণে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে চলেন। ফলে শুধু সাধারণ সৈনিকই নয়, অফিসারদের থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল শুধু ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা কর্মকর্তারা। মুক্তিযুদ্ধে এই ইউনিটের অধিনায়কত্ব তার ওপর অর্পিত ছিল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এই ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টই তার ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
সূত্র – মেজর নাসির উদ্দিন – বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর