বঙ্গবন্ধুকে যেমনটি দেখেছি
১। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ভারত উপমহাদেশে যখন ইংরেজি আমলের অন্তিম সময় সেই ১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কোলকাতা মহানগরীর মির্জাপুর এলাকার কারমাইকেল হােস্টেলের একটি কক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেদিন থেকেই আমি তাঁর অমায়িক হাসি এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা আর নেতা-সুলভ ব্যক্তিত্বে বিমুগ্ধ হয়েছি। মুজিব ভাই তখন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) ছাত্র আর আমি পড়াশােনা করতাম দিনাজপুর রিপন কলেজ ব্রাঞ্চ-এ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তখন আমার সবেমাত্র ছাত্র রাজনীতিতে হাতে খড়ি। দিনাজপুরের কৃতি সন্তান মরহুম দবিরুল ইসলাম আমাকে নিয়ে কোলকাতায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মুজিব ভাই-এর সঙ্গে। আমরা তখন ছিলাম মুসলিম লীগ রাজনীতিতে সােহরাওয়ার্দী হাশিম গ্রুপের সমর্থক। তাই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগে আমাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল হাশেমাইট” হিসাবে।এরপর নানা ঘটনা প্রবাহে পাকিস্তানি জামানার কথা। অচিরেই মুসলিম ছাত্রলীগ দুভাগে বিভক্ত হলাে। এর একটি উপদল নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নাম গ্রহণ করে শাহ মােহাম্মদ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সমর্থন জোগালে ক্ষমতাসীন নাজিমউদ্দিন-নূরুল আমীনের প্রতি। আর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের মূল অংশের নতুন নামকরণ হলাে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সর্বজনাব নঈমউদ্দিন আহম্মদ, আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), খালেক নেওয়াজ খান (ময়মনসিংহ), আজিজ ভাই (নােয়াখালী), মােল্লা জালালউদ্দিন (গোপালগঞ্জ), গাজী গােলাম মােস্তফা (ঢাকা), আবদুল হামিদ চৌধুরী (ফরিদপুর) প্রমুখ সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করলেন শেখ মুজিব-এর। দবিরুল ইসলামের নেতৃত্বে দিনাজপুর থেকে আমরা দল বেঁধে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে যােগ দিলাম শেখ মুজিবের প্রতিষ্ঠিত এই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ-এ।এদিকে একটার পর একটা ছবির মতাে সব রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত হলাে। ১৯৪৮-৪৯ সালে প্রথম ভাষা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ধর্মঘট ছাড়াও উত্তরাঞ্চলে শুরু হলাে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। নিরাপত্তা আইনে দিনাজপুরে গ্রেফতার হলাে ছাত্রলীগের ১৭ জন। আমি এদের মধ্যে অন্যতম।
এসব হচ্ছে ১৯৪৮ সালের কথা। ঢাকার খাজা দেওয়ান থার্ড লেন থেকে সুদূর দিনাজপুরে ছুটে গেলেন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জনাকয়েক ছাত্রনেতা। এঁদের মধ্যে ছিলেন নােয়াখালীর আজিজ ভাই (মরহুম) এবং ফরিদপুরের আবদুল হামিদ চৌধুরী (জিয়ার আমলে নেপালে রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে আইনজীবী)। সঙ্গে আরাে এলেন আমার অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুস্তফা নূর-উল ইসলাম। কিন্তু দিনাজপুর জেল গেটে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ তাে দূরের কথা, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আবদুল্লাহেল বাকির সুপারিশে তৎকালীন জেলা অধিকর্তা আবদুস সােবহান-এর নির্দেশে দবিরুল ইসলামকে গ্রেফতার এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্যরা দিনাজপুর – জেলা থেকে হলেন বহিস্কৃত। দিনাজপুর জেলেই পরিচিতি হলাম উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট কমুনিস্ট নেতা আর আন্দামান ফেরৎ রাজবন্দিদের সঙ্গে। সান্নিধ্য লাভ করলাম তেভাগা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের। এঁদের মধ্যে কমরেড হাজী মােহাম্মদ দানেশ, কমরেড গুরুদাস তালুকদার, কমরেড কম্পরাম, কমরেড অভরণ, কমরেড অরুণ রায়, কমরেড ঋষিকেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ অন্যতম। এখানেই দীক্ষা লাভ করলাম মার্কসীয় দর্শনে আর অবসর সময়ে তন্ময় হয়ে শুনতাম সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ংকর জীবনের কাহিনী।তখন হচ্ছে কমরেড পিসি জোশীর পর কমরেড বি টি রণদিভে-এর থিসিস-এর যুগ। এই থিসিসের মােদ্দা কথা হচ্ছে, ‘উপমহাদেশে বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত। অতএব রক্তাক্ত শ্রেণী-সংগ্রামের মাঝ দিয়ে মুক্তির লড়াই। প্রায় এক বছরের মতাে কারাগারে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি জীবন যাপনকালে ১৯৪৯ সালে দিনাজপুর জেল থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। মুক্তিলাভের পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যয়নের জন্য এলাম, তখন ভারত ও পাকিস্তান দুটো দেশেই শুরু হয়েছে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের ছাত্র হিসাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণের পর পিতার প্রেরিত অর্থের সূত্র বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষিতে জীবিকার সন্ধানে লিপ্ত হলাম। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে শেষ অবধি সাংবাদিকতা পেশাকেই বেছে নিলাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতা অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সুপারিশে যােগ দিলাম দৈনিক ইত্তেফাক-এ। সেদিনের তারিখটা হচ্ছে ১৯৫৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। এরপর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম আত্মপ্রকাশ ২৫শে ডিসেম্বর। ঠিকানা : প্যারামাউন্ট প্রেস, ৯ হাটখােলা. রােড, ঢাকা। সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন এবং প্রকাশক মুদ্রাকর ইয়ার মােহাম্মদ খান।দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ছাপা হতাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম। দৈনিক ইত্তেফাকের জন্মকালীন সময়ে আমরা যে কজন যােগ দিয়েছিলাম, তারা হচ্ছেন খণ্ডকালীন বার্তা সম্পাদক পদে পাবনার আবদুল কাদের, সহকারী সম্পাদক পদে কুমিল্লার আবদুল আওয়াল, রিপাের্টারের দায়িত্বে ঢাকার ফয়েজ আহমদ এবং সাব এডিটর হিসাবে যশােরের আবদুল হাফিজ, বগুড়ার এম আর আখতার মুকুল, বরিশালের নুরুল ইসলাম এবং ঢাকার ভবেশ চন্দ্র। জেনারেল সেকশন আবদুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী আর খণ্ডকালীন বিজ্ঞাপন ম্যানেজার চলচ্চিত্র শিল্পের মহিউদ্দিন আহম্মদ এবং পিওন চট্টগ্রামের মাে. বশীর। তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক ভাই-এর নেতৃত্বে এই ছিল সেদিনের ইত্তেফাক-পরিবার।
সাংবাদিকতা পেশায় যােগ দেয়ায় নিবিড়ভাবে সম্পর্ক স্থাপিত হলাে বহু রাজনীতিবিদ-এর সঙ্গে। সফরসঙ্গী হলাম শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আর শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের। অন্তরঙ্গ আলােকে অবলােকন করলাম এঁদের কর্মকাণ্ড। নীরব সাক্ষী হয়ে রইলাম বহু দুর্লভ মুহূর্তের। তখন আমি দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপাের্টার। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পূর্ববঙ্গে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। একদিকে ধর্মের আড়ালে রাজনৈতিক স্লোগানএর মাতম এবং আর এক দিকে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ২১ দফার সােচ্চার আহ্বান।একদিকে সবুজ কাপড় পরিহিত মুসলিম লীগের ভাড়াকরা গ্রীন শার্ট’ প্লাটুন; অন্য দিকে শেখ মুজিবের সংগঠিত যুক্তফ্রন্ট-এর বিশাল কর্মী বাহিনী। শেষ অবধি হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীনে যুক্তফ্রন্ট-এর মােকাবেলায় সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলাে। ২৩৭টি মুসলিম আসনের ২২৮টিতে মুসলিম লীগ পরাজিত। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খানের নিকট পরাজিত হলে দৈনিক ইত্তেফাক-এর হেডিং হচ্ছে, ‘পূর্ব বঙ্গের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশ থেকে অশুভ নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি।” ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথি হিসাবে স্টকহোেম-এ আয়ােজিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যােগ দেয়ার জন্য লন্ডন রওনা হলেন। সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে গােপনে সফরসঙ্গী ইত্তেফাক-এর রিপাের্টার ফয়েজ আহমদ। ফলে ১৯৫৪ সালের মে মাস নাগাদ দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপাের্টারের দায়িত্ব পেলাম। এরপর ১৯৬০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত একই পদে ৬ বছর এক নাগাড়ে বহাল ছিলাম । এই বছরগুলােতে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিম্নরূপ : ১৯৫৪ ১৯শে মে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত। কলমের এক খোঁচায় পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত ও গভর্নরের শাসন জারি এবং শেরে বাংলা ফজলুল হক ঢাকার কে এম দাস লেনে স্বগৃহে অন্তরীণাবদ্ধ। শেখ মুজিবসহ বিপুলসংখ্যক নেতা ও কর্মী গ্রেফতার।১৯৫৫ ১লা জুন ৮০ সদস্যের নয়া গণপরিষদ গঠন। যুক্তফ্রন্ট দ্বিখণ্ডিত এবং কেন্দ্রে শেরে বাংলা ফজলুল হকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ। পূর্ববঙ্গ থেকে গভর্নরের শাসন প্রত্যাহার ও রংপুরের আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে কে এস পি মন্ত্রিসভা গঠন। ১১ই আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর বিদায় এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পশ্চিম পাঞ্জাবের চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর শপথ গ্রহণ। পূর্ববঙ্গ থেকে কে এস পি’র সমর্থন দান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৫টি প্রদেশ ভেঙে এক ইউনিট গঠন।
ভাসানী-মুজিব যৌথ প্রচেষ্টায় আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের নাম সংশােধিত এবং মুসলিম’ শব্দ বাদ। প্রতিবাদে সালাম খান-এর নেতৃত্বে বেশ কিছুসংখ্যক দক্ষিণপন্থী মনােভাবাপন্ন নেতা ও এমএলএ’র দলত্যাগ।১৯৫৬ সংখ্যাসাম্য (পূর্ববঙ্গের হিস্যা ৫৬%-এর স্থলে ৫০% ভাগ) এবং এক ইউনিট-এর ভিত্তিতে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রণীত। শেখ মুজিবের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের বিলে দস্তখত দানে অস্বীকৃতি। এদিকে দ্রুত ঘটনা প্রবাহে ৫ই সেপ্টেম্বর পূর্ববঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ এবং নয়া মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের শপথ গ্রহণ। পশ্চিম পাকিস্তানে নবগঠিত রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে সমঝােতার জের হিসাবে পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দায়িত্ব লাভ। ১৯৫৭ ৭ই ও ৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল-এর কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীদের মধ্যে তীব্র মতবিরােধ। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র মােতাবেক সংগঠনের অফিস বেয়ারার পদে অধিষ্ঠিত কোনাে নেতা মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করলে পার্টির উল্লেখিত পদ থেকে পদত্যাগ করা বাধ্যতামূলক বিধায় বামপন্থী উপদল একরকম সুনিশ্চিত যে, প্রাদেশিক শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে বামপন্থীদের নমিনী হচ্ছেন দক্ষিণপন্থী মনােভাবাপন্ন নেতা অলি আহাদ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে (মওলানা ভাসানীর ইঙ্গিতে) মন্ত্রীত্ব পদ থেকে শেখ মুজিবের পদত্যাগের ঘােষণায় বামপন্থী উপদলে বিভ্রান্তি। সম্মেলন। শেষ হবার পর বামপন্থী উপদলীয় চাপে মওলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র দাখিল।কিন্তু পদত্যাগপত্রে বহুল প্রচারিত পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্ন অনুপস্থিত। পাটির সাধারণ। সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেরিত মওলানা সাহেবের পদত্যাগপত্র ছিল নিম্নরূপ : ‘আরজ এই যে, আমার শরীর ক্রমেই খারাপ হইতেছে এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবার খুলিতে হইবে। তদুপরি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার লিডার-সদস্যদের নিকট আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব, ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জুয়া, ঘােড়দৌড় বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারামি কাজ বন্ধ করিতে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবাহবন্ধনের উপর টাকা ধার্য করা জনমত অনুযায়ী বাতিল করিতে আবেদন জানাইয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভয়াবহ খাদ্য সংকটেরও কোনাে প্রতিকার। দেখিতেছি না। ২১ দফা দাবির অন্যান্য দফা, যাহাতে অর্থ ব্যয় খুব কমই হইবে, তাহাও কার্যকরী করিবার নমুনা দেখিয়া আমি আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম ।
আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।”ইতি-স্বা, আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮/৩/৫৭ । ১৩ই ও ১৪ই জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে মওলানা সাহেবের পদত্যাগপত্র গৃহীত। বিপুল সংখ্যক কর্মী, নেতা এবং ১৮জন এমএলএ সহ মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ ত্যাগ। পার্টির নতুন সভাপতি মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ। অন্যদিকে নব্য শিল্পপতি এবং সামরিক ও সিভিল ব্যুরােক্রেসির আওতায় কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে কক্ষচ্যুত পশ্চিমাঞ্চলের সামন্তবাদের প্রতিভূদের সক্রিয় সমর্থন এবং পূর্ববঙ্গে সাচ্চা বামপন্থীদের উদ্যোগে ঢাকায় ২৬শে জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত। উপরন্তু কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা ও চন্ডীগড় মন্ত্রিসভার পতন এবং ফিরােজ খান নুনের নয়া মন্ত্রিসভা।১৯৫৮ ১৮ই জুন পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ। ২০শে জুন কেএসপি মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ এবং মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ২৩শে জুন পদত্যাগের ফলে পুনরায় আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আগমন। ২১শে সেপ্টেম্বর পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা। ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা কর্তৃক পার্লামেন্ট ও সংবিধান বাতিল, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেআইনী ঘােষণা এবং সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি। মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট মির্জার এক বস্ত্রে দেশত্যাগ এবং আইয়ুব কর্তৃক সর্বময় কর্তৃত্ব দখল। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবসহ বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক থাকার বছরগুলাে বাদ দিলে একদন সাংবাদিক হিসাবে ১৯৭১-এর প্রারম্ভিক সময় পর্যন্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত একজন সরকারি আমল হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে অবস্থান করায় বহু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের আমি হচ্ছি নীরব সাক্ষী। মনে হয় মাত্র সেদিনের কথা। অথচ মহাকালের গর্ভে এক এক করে প্রায়। ৩০টি বছর গত হয়ে গেছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তারিখটা ছিল ১৯৫৮ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর। ২০শে জুন আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে কেএসপি কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর আতাউর রহমানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা তখন ক্ষমতায়। এক নাজুক অবস্থায় সেদিন শুরু হলাে প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। এ সময় স্পিকার আব্দুল হাকিম প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের বিরােধীতার কথা ঘােষণা করেছেন। ফলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে পরিষদের বাজেট অধিবেশনের ব্যবস্থা হলাে। এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রতি ঢাকার জগন্নাথ হলের যে ভবনটি ধ্বসে ৩৭জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহত হয়েছেন, ১৯৫৮ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর সেই ভবনটিতেই অনুষ্ঠিত হলাে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। বিরােধীদলীয় সদস্যরা তখন প্রচণ্ড মারমুখী। এঁদের বক্তব্য, কিছুতেই পরিষদের অধিবেশন করতে দেয়া হবে না। এ সময় পরিষদের করিডাের-এ উভয় পক্ষের সশস্ত্র বাহিনীর আনাগােনা। এটা এমন এক সময়, যখন কংগ্রেস ও তপশিল ফেডারেশন দ্বিধা-বিভক্ত এবং নব্য গঠিত ন্যাপ দলীয় এমএলএ-দের মধ্যে দোদুল্যমান মনােভাব। এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষা করার পুরাে দায়িত্বটাই ছিল দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের উপর অর্পিত। তিনি দলীয় সদস্যদের এ মর্মে ব্রিফিং দিলেন, ‘যে কোনাে অবস্থার মােকাবেলায় আওয়ামী লীগ এমএলএ-দের শান্ত থাকতে হবে। কারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ এবং প্রস্তাবিত বাজেট পাস করানােটাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অধিবেশন। মনে রাখবেন, উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে সরকার সমর্থক এমএলএ’রা পরিষদে সামান্যতম হট্টগোল করলে বিরােধী দলই লাভবান হবে।
এজন্য পরিষদের অভ্যন্তরে আমাদের স্ট্রাটেজি হচ্ছে—নিজ নিজ সিটে শান্তভাবে বসে থাকা। এর অন্যথা যেন হয় না।”চারদিকে তুমুল উত্তেজনা। ঢাকার প্রেস ক্লাবে বসে দেশী-বিদেশী সমস্ত সাংবাদিকদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, “নিরাপত্তার অভাবে পরিষদ অধিবেশন বর্জন।” দৈনিক ইত্তেফাক-এর চিফ রিপাের্টার হিসাবে আমি বহু যুক্তিতর্ক দিয়ে সবাইকে বােঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। আমার বক্তব্য ছিল, যেখানে জীবন বিপন্ন করে পেশাগত কারণে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা কোরিয়া আর ভিয়েতনাম-এর যুদ্ধের রিপাের্ট সংগ্রহ করছে, সেখানে এ ধরনের বয়কট-এর সিদ্ধান্ত অর্থহীন। কিন্তু আমার কথায় কোনাে কাজ হলাে না। কেননা পরােক্ষভাবে সাংবাদিকরাও তখন বিরােধী দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে বলা যায়। সাংবাদিকদের এ ধরনের বয়কটের সিদ্ধান্তে একথাটাই প্রমাণ করবে যে, “আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শান্তি ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে।” | শেষ অবধি ইত্তেফাক বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হােসেন আর সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে আলােচনার পর আমি আলােচ্য বয়কট-এর সিদ্ধান্ত করে একাই পরিষদের রিপাের্ট সংগ্রহ করতে গেলাম। একমাত্র ‘ইউপিপি” সংবাদ সংস্থার আব্দুল মতিন (‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু’ লেখক) ছাড়া আর কোনাে রিপাের্টার আমার সঙ্গে ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান পরিষদের অভ্যন্তরে যেয়ে নিজের কক্ষে বসে রইলেন। অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মুখ্য মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করে বললেন, ‘ভাই সাহেব দোয়া কইরেন। সেশন ঠিকভাবে যেন চালাইতে পারি। আমি কিন্তু চেয়ার ছাইড়া উইম। না।” | ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী তার কথা রেখেছিলেন।তিনি চেয়ার ছেড়ে ওঠেননি। পরিষদ কক্ষের একদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শান্তভাবে বসে সরকার সমর্থক সদস্যবৃন্দ আর অন্যদিকে পুলিশের আইজিসহ উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও বিরােধী দলীয় সদস্যবৃন্দ কর্তৃক অসংখ্য কাষ্ঠখণ্ড এবং ভাঙা চেয়ার দিয়ে ডেপুটি স্পিকারের উপর উপর্যুপরি হামলা। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য! ব্যাপক হৈ-হল্লার মাঝে নিক্ষিপ্ত কাঠখণ্ডে জনাব শাহেদ আলী পাটোয়ারী তখন মারাত্মকভাবে আহত আর তার নাক দিয়ে রক্তের ধারা। তিনি স্পিকারের চেয়ারের উপর এলিয়ে পড়লেন। মারাত্মকভাবে আহত শাহেদ আলীকে রাস্তার ওধারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে। ঘণ্টা কয়েক পর তার ইন্তেকাল। বিশ্বের ইতিহাসে এভাবে পিটিয়ে স্পিকার হত্যার ঘটনা বিরল। এরপরও ঢাকার অন্য সব সংবাদ পত্রগুলাে শাহেদ হত্যার ব্যাপারেও আওয়ামী এবং বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের উপর দোষারােপ করার কতই না প্রচেষ্টা করলাে, আর সাংবাদিক হিসাবে আমি এসবের নীরব সাক্ষী হয়ে রইলাম। এক্ষণে আবারও কিছু আত্মকথা। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সম্মেলন এবং এর মাত্র ১৮ সপ্তাহের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক সমর্থকসহ, মওলানা ভাসানীর পার্টি ত্যাগের সময় পর্যন্ত প্রতিনিয়তই শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ড অন্তরঙ্গ আলােকে পর্যবেক্ষণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এটা ছিল ভাসানী-মুজিবের যুগ। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর আমি দৈনিক ইত্তেফাক চিফ রিপাের্টার। তাকে ছায়ার মতাে অনুসরণ করেছি কিছুটা পেশার তাগিদে আর বাকি সবটুকু ছিল নেশার মতাে।জেনেছি অসংখ্য অজানা তথ্য আর অবলােকন করেছি বহু সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কলা-কৌশল। মুজিব ভাই সানন্দ চিত্তে বিশ্লেষণ করেছেন বহু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের তাৎপর্য। এরপরেই তাে পূর্ব বঙ্গের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে কালাে মেঘের আনাগােনা। শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের বামপন্থী মহলের কর্মকাণ্ডে কাগমারী সম্মেলনেই এতােদিনের জাতীয়তাবাদী-বামপন্থী মাের্চায় অসময়ে ফাটল হয়ে গেল। অচিরেই মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত হলাে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি’। একজন সাংবাদিক হিসাবে সব কিছুই লক্ষ করলাম। কিন্তু সে আমলের রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এ মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, নবগঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মােকাবেলায় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের ব্যাপক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখা আর সম্ভবপর হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালের ইতিহাস একথা প্রমাণিত করেছে যে, সে আমলের রাজনৈতিক পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী ভ্রমাত্মক ছিল।
পুরাে ঘাট দশকে পূর্ব বাংলা তথা সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতির গতিধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাজনীতিতে তখন ত্রিধারা। একদিকে ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ক্ষমতার দাপট এবং এরই পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট শিবির-এ রুশ-চীন নীতিগত বিরােধের জের হিসাবে পূর্ব বাংলায় কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে চরম বিভ্রান্তি ও বিভেদ-এর ভয়াবহ প্রক্রিয়া আর অন্যদিকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির দ্রুত উন্মেষ। | অবস্থাদৃষ্টে একথা বলতেই হয় যে, উনসত্তরের গণ-অভুথানের পূর্ব পর্যন্ত যাট দশকের বছরগুলােতে ছাত্র সমাজের সমর্থনে একমাত্র শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগই অকুতােভয়ে একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। হাসিমুখে বরণ করেছে বহু অত্যাচার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অত্যাচার চিরকালই সুপ্ত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ষাট দশকে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। | এটা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার।১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বামপন্থী মহলের অভিযােগ হচ্ছে, এরা স্বায়ত্বশাসনের দাবির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ষাট দশকে মুজিবের নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগই স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে আরাে উগ্র চেহারার ৬ দফা দাবিতে পরিণত করে সােচ্চার কণ্ঠে ঘােষণা করলাে, “৬ দফা দাবি হচ্ছে বাঙালির মুক্তির সনদ” । এটা হচ্ছে মুজিব-তাজউদ্দিনের যুগ। এই দাবির জন্যই শেষ অবধি শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী হিসাবে গ্রেফতার হলেন। এই দাবির ভিত্তিতেই (ছাত্র সমাজের সম্পূরক ১১ দফার দাবিগুলাে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) সংঘটিত হলাে উনসত্তরের আইয়ুব বিরােধী ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুথান। এই দাবির ভিত্তিতেই ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ লাভ করলাে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই ৬ দফা দাবিকে নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েই ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত থেকে শুরু হলাে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা। আর এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে সবশেষে এই ৬ দফা দাবিই রূপান্তরিত হলাে এক দফায়। সেই দফাটাই হচ্ছে প্রবাসী মুজিবনগর আওয়ামী লীগ সরকারের সার্বিক নেতৃত্বে একাত্তরের সফল মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বের মানচিত্রে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ তার স্থান করে নিলাে। এজন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং বাঙালি জাতির পিতা। তাহলে তাে এ কথাটা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে বলতেই হচ্ছে যে, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের বামপন্থী মহলের উথাপিত আলােচ্য অভিযােগ (স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবির প্রতি আওয়ামী লীগ।বিশ্বাসঘাতকতা করেছে) হয় সম্পূর্ণ মিথ্যার বেসাতি ছিল আর না হয় ছিল ভ্রমাত্মক। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বামপন্থী মহলের এ মর্মে আরাে একটি সুস্পষ্ট অভিযােগ ছিল যে, আওয়ামী লীগ পরােক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে একই মাের্চায় অবস্থান সম্ভবপর নয়। কিন্তু এতােগুলাে বছর পরে এ কথাটা এখন সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মার্কিনী মহলের যােগসাজশ ছিল। তাহলে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ মার্কিন তাবেদার ছিল—এ অভিযােগ বিভ্রান্তিকর’ এবং বামপন্থী মহলের ভুল মূল্যায়ন বলা যায়। সবশেষে যদি কেউ এ মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, ১৯৫৭ সালের কাগমারীতে যখন বামপন্থী মহল প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল, তখন সেই বামপন্থী গােষ্ঠী ১৯৭৪-৭৫-এ এসে (ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার উদগ্র বাসনায়) কেন গণ-ঐক্য জোট আর বাকশাল গঠনের সুপারিশ করলো আর ৮০ দশকে এসে আবার আওয়ামী লীগের সমর্থক গােষ্ঠী হবার লক্ষ্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে? ১৯৬১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেরে বাংলা ফজলুল হকের পরলােকগমন এবং ১৯৬৩ সালে সুদূর বৈরুত নগরীর এক হােটেল কক্ষে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর এদেশীয় রাজনীতিতে শুরু হলাে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়। একদিকে আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট শিবিরে রুশ-চীন বিরােধের দ্রুত অবনতির প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসীদের মধ্যে ব্যাপক ভাঙনের প্রক্রিয়া এবং ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুরােধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের সরকারি প্রতিনিধি দলের মহাচীন সফর ও ‘ডােন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ নীতি গ্রহণ আর অন্যদিকে শেখ মুজিব কর্তৃক দলবলসহ ‘এনডিএফ’ ত্যাগ ও আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির নয়া উন্মেষের সূচনা।১৯৬৪ সাল নাগাদ ‘কুখ্যাত গভর্নর মােনেম খানের কথিত পৃষ্ঠপােষকতায় ঢাকা ও খুলনায় নৃশংস সামপ্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে আওয়ামী লীগের নয়া সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক ঐতিহাসিক প্রচারপত্র বিলি এবং একযােগে ঢাকার প্রতিটি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশ। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ।
বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং বিরাট প্রতিভাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকাল আর মওলানা ভাসানীর পুরােপুরিভাবে কম্যুনিস্ট শিবিরে যােগদানের প্রেক্ষাপটে ৬০ দশকের মাঝামাঝি সময় নাগাদ একজন সাংবাদিক হিসাবে আমার মনে হলাে পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে পূর্ণ অবয়বে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভাস্কর-এর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে এবং ইনিই হচ্ছেন ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক মাত্র ৪৪ বছর বয়স্ক শেখ মুজিবুর রহমান।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়ক আইয়ুব খানের সরকারকে (শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সমর্থনে) একাকী মােকাবেলার অদম্য সাহস এই শেখ মুজিবের বুকে এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কার্যক্ষেত্রেও তিনি তা বহুবার প্রমাণ করেছিলেন। এবার পাকিস্তানি জামানার রাজনীতির নতুন অধ্যায়।১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের কথা। মাকিনী সমর্থনে পাকিস্তানের ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের তখন এশিয়ার নেতা হওয়ার স্বপ্ন। আকস্মিকভাবে শুরু হলাে পাক-ভারত যুদ্ধ। সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলাের একতরফা প্রচারণা সত্ত্বেও এ কথা প্রকাশ পেলাে যে, পাকিস্তানি অধিকৃত আজাদ কাশ্মীর থেকেই ভারত অধিকৃত কাশ্মীর’-এ প্রথম আক্রমণ করার জের হিসাবেই অত্যন্ত দ্রুত এই যুদ্ধ সমগ্র পশ্চিম রণাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ১৭ দিন। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অংশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত পূর্ব বাংলা আক্রমণে বিরত ছিল। ফলে দেখা দিলাে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। ১৯৬৬ সালের শুরুতেই মস্কোর উদ্যোগে সুদূর রাশিয়ার তাসখন্দ নগরীতে স্বাক্ষরিত হলাে পাক-ভারত শান্তি চুক্তি। দস্তখত করলেন পাকিস্তানের ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। এশিয়ার নেতা” হওয়ার স্বপ্ন ভগ্ন হলাে আইয়ুব খান-এর। এখন ঘর সামলানাের পালা। পশ্চিম পাকিস্তানে তাসখন্দ চুক্তির প্রতিবাদে পদত্যাগকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আর পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান—এ দুজনের তখন জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।ঘটনা প্রবাহে এ বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি লাহাের বিমানবন্দরে এক অনির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করলেন ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি-বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। যেখানে ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ ৯ বছর ধরে বামপন্থী মহল থেকে অবিরামভাবে একটি কথা বেশ জোরের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে যে, “স্বায়ত্বশাসনের দাবির প্রতি পেটি বুজোয়ার প্রতিভূ আওয়ামী লীগ বিশ্বস্ত নয়” এবং যেখানে মার্কসিস্ট লেখক ও গবেষকরা নানা সূত্রের জের ধরে বারংবার একটি বিষয়ই বােঝাতে চেয়েছেন যে, স্বায়ত্বশাসনের দাবির প্রতি আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেখানে কিন্তু বাস্তবের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নতর।অন্যদিকে পূর্ব বাংলার শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্বে প্রগতিশীল মহল ও পশ্চিম। পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের প্রতিনিধিদের সমবায়ে ১৯৫৭ সালে গঠিত ‘বিশাল সম্ভাবনাময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে এক ত্ৰিশংকু অবস্থা। ‘ন্যাপ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার তখন চরম পর্যায়। ১৯৬৭ সালের ৩০শে নভেম্বর রংপুরে প্রখ্যাত জোতদার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার উদ্যোগে আয়ােজিত ‘ন্যাপ’-এর ‘তলবী’ কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীর বক্তব্য হচ্ছে, “কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, উক্ত বন্ধুরা (রুশপন্থী) অধুনা মরিয়া। হইয়া উঠিয়াছেন এবং দলীয় নিয়ম-শৃঙ্খলার মাথায় পদাঘাত করিয়া তাহারা তাঁহাদের স্বীয় শ্রেণীর স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন। ন্যাপকে বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া, কায়েমী স্বার্থবাদীদের সংকীর্ণ গােষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করিতে না পারিয়া তাহারা ন্যাপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং উহার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যা ও কুৎসা রটনায় মত্ত হইয়াছেন।১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর রুশ সমর্থক ন্যাপ-এর উপদল থেকে প্রকাশিত হলাে ২১ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা। নাম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অভ্যন্তরে মতবিরােধ’। এর অংশ বিশেষ নিম্নরূপ : “..বর্তমানে অবশ্য তাঁহারা (চীনপন্থী) আইয়ুব সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেন কিনা বা আইয়ুব সরকারের সাম্রাজ্য বিরােধী’ ভূমিকা আছে কিনা, তাহাও প্রকাশ্যে বলেন না। তবে তাহারা এখনাে পূর্বের মতােই আইয়ুব সরকারকে বিব্রত না করার নীতি অনুসরণ করিয়া চলিতেছেন।এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব-এর ৬ দফা সম্পর্কে বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠীর মতামত বিশেষভাবে লক্ষণীয় : (ক) “অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দেয়া হবে।”-আইয়ুব খান (খ) ৬ দফাকে নিয়ে আমি ঢাকার পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবের সঙ্গে ‘বাহাস’-এ (বিতর্কে) অবতীর্ণ হতে রাজি আছি।’—ভুট্টো। (গ) ৬ দফা দাবি উত্থাপন করায় পশ্চিম পাকিস্তানে সরকার বিরােধী। ‘ আন্দোলন পরিচালনা মুস্কিল।”-নসরুল্লাহ। (ঘ) “৬ দফা হচ্ছে সিআইএ প্রণীত দলিল।”-কমরেড তােয়াহা এতদিন (১৯৬৬) পর্যন্ত পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবি বলতে যেটুকু বলা হয়েছিল, সুষ্ঠু বিশ্লেষণের পর দেখা গেল যে, ৬ দফা দাবিগুলাে আরও উগ্র ও যুক্তিপূর্ণ। স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে যেখানে কেন্দ্রের হাতে ৩টি বিষয় থাকবে বলা হয়েছিল; সেখানে ৬ দফায় দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয়ই প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি করা হলাে। এমনকি শেখ মুজিব তার প্রণীত ৬ দফায় দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক স্টেট ব্যাংক ও মুদ্রা চালু করা ছাড়াও সমস্ত রকমের কর ধার্য্য করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারভুক্তের দাবি জানালেন। এর পরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আতংকিত হয়ে যখন ৬ দফা দাবির তীব্র বিরােধিতা করে “গৃহযুদ্ধের হুশিয়ারী উচ্চারণ করছিলেন এবং “অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে বলে হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, তখনও বামপন্থী নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই হয় এই ৬ দফা দাবিকে অবজ্ঞা করেছেন, না হয় সিআইএ’র প্রণী দলিল” হিসাবে আখ্যায়িত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। হিসাব করলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় ৬ দফা দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য মাত্র ৫ সপ্তাহের মতাে সময় পেয়েছিলেন।১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের শুরু থেকে ৮ই মে পর্যন্ত সময়ে শেখ সাহেব উল্কার মতাে পূর্ব বাংলার অনেক কটা জেলাতে বিরাট আকারের জনসভায় বক্তৃতাদানে সক্ষম হন। দক্ষিণ ও বামপন্থী দলগুলাে সঠিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নের আগেই বাঙালি জনগােষ্ঠী ৬ দফাকে অর্থনৈতিক ও মুক্তির সনদ হিসাবে গ্রহণ করে নিল। ধর্মীয় স্লোগান এবং মার্কসীয় ব্যাখ্যা কোনাে কিছুই আর ৬ দফার জয়যাত্রাকে রােধ করতে পারল না। পূর্ব বাংলার ‘কুখ্যাত গভর্নর মােনেম খানের নির্দেশে এ সময় শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে মােট ১২টি মামলা দায়ের করে পৃথক পৃথক হুলিয়া জারি করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই এবং তা হচ্ছে মুজিবের সােচ্চার কণ্ঠকে স্তব্ধ করা। শেষ অবধি ১৯৬৬ সালের ৮ই মে গভীর রাতে পাকিস্তানের দেশরক্ষা আইনের ৩২নং বিধিতে মুজিবকে আটক করা হলাে। এছাড়া কারারুদ্ধ হলাে আওয়ামী লীগের প্রায় ৮ শতাধিক নেতা ও কর্মী। অথচ বামপন্থীরা অর্থবহ কারণে আইয়ুব বিরােধী ভূমিকা পালনে প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চে অনুপস্থিত। তখনও রুশ-চীন মতবিরােধের কারণে বামপন্থী মহলে ভাঙনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এই পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথমে দেশরক্ষা আইনে এবং পরবর্তীতে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মােট ২ বছর ৯ মাস ১৪ দিন এক নাগাড়ে আটক ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের আহ্বানে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হলাে ছেষট্টির রক্তাক্ত ৭ই জুনের সর্বাত্মক হরতাল। মুজিবের ৬ দফা-দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালি ছাত্র-জনতা একযােগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের বেপরােয়া গুলিবর্ষণের মােকাবেলা করল। সরকারি হিসাবে সেদিন নিহতের সংখ্যা ১৩ জন ও বিপুল সংখ্যক আহত। এসব ঘটনা একের পর এক করে সিনেমার পর্দায় ছবির মতাে আমার চোখের সামনে ঘটে গেল। একজন সাংবাদিক হিসাবে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ আলােকে এসবই নিরীক্ষা করলাম।এরপর হচ্ছে ১৯৬৮ সালের কথা। সেদিনের তারিখটা হচ্ছে ১১ই এপ্রিল। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এক ঘােষণায় বলা হলাে যে, মােট ৩৫ জন বিবাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে সরকার এক মামলা দায়ের করেছে। ইতিহাসে এটাই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। তবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের নথিতে মামলার শিরােনাম হচ্ছে, “পাকিস্তান রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য।”এটা এমন এক সময় যখন পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী শক্তি আইয়ুব-মােনেম চক্রের ভয়াবহ অত্যাচারে স্টিম রুলারে নিষ্পেষিত। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা ও কর্মী আটক করা ছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক ও সাপ্তাহিক নিউ নেশন পত্রিকা বন্ধ। সর্বোপরি তথাকথিত এই ষড়যন্ত্র মামলা। রাজনীতিতে অসাধারণ পরিপক্ক মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বিরাজমান পরিস্থিতিতে ঠিকই বুঝতে পারলেন যে, এখন আইয়ুব খানের অন্তিম সময়। মওলানা সাহেব তাঁর “ডােন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব (আইয়ুবকে বিরক্ত করাে না) নীতি নর্দমায় নিক্ষেপ করে বিরােধী দলীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন। এরপর আর তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি।
আমার স্থির বিশ্বাস নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও আমার জীবন সার্থকতায় ভরপুর। কেননা, একজন সাংবাদিক হিসাবে অন্তরঙ্গ আলােকে লক্ষ করেছি বহু ভাঙা-গড়ার ঘটনা। আমি অবলােকন করেছি নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দুর্লভ মুহূর্ত। এ ধরনের এক অন্যতম ঘটনা হচ্ছে, ঢাকার কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনীতে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার প্রহসন। এই বিচার চলাকালীন সময়ে অন্যান্য সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সংগ্রহ করেছি প্রতিদিনের মামলার রিপাের্ট। প্রত্যক্ষ করেছি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অসীম সাহসী এক বীর বাঙালি যােদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের বালকসুলভ অমায়িক হাসি আর প্রয়ােজনীয় সময়ে বজ্রকণ্ঠের সােচ্চার প্রতিবাদ।যে সময়ের কথা বলছি, তখন স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবি বাঙালি জনগােষ্ঠির মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল আর তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষিতে ধূমায়িত অসন্তোষ প্রতিবাদের পাথেয় সন্ধানে ছিল উন্মুখ। সবার অলক্ষেই পূর্ব বাংলা একটা বিস্ফোরণােন্মুখ আগ্নেয়গিরিতে রূপান্ত রিত হয়েছিল। স্বল্প দিনের ব্যবধানেই আমরা দেখতে পেলাম এসব কিছুর রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশ। এক্ষণে ১৯৬৮-৬৯ সালে সংঘটিত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর কথা। একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা আওয়ামী লীগের প্রায় সমস্ত নেতা ও বিপুল সংখ্যক কর্মী ৬ দফা আন্দোলনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত এবং তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ঢঙ্কা-নিনাদ আর অন্যদিকে মার্কসীয় দলগুলাে উপদলীয় কোন্দলে দারুণভাবে বিপর্যস্ত; ঠিক এমনি এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে এগিয়ে এল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৬ দফা দাবির সম্পূরক হিসাবে উত্থাপিত হলাে ছাত্রদের ১১-দফা। নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন সর্বজনাব তােফায়েল আহমেদ (সহ-সভাপতি, ডাকসু), নাজিম, কামরান চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু), আবদুল রউফ (সভাপতি, ছাত্রলীগ), খালেদ মােহাম্মদ আলী (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ), সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (সভাপতি, রুশপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন), সামসুজ্জোহা | (সম্পাদক, রুশপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন), মােস্তফা জামাল হায়দার (সভাপতি, চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন) এবং দীপা দত্ত (সহ-সম্পাদিকা, চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন)।১৯৬৯ সালের ১৭ই জানুয়ারি থেকে ২৪শে মার্চ। সময়ের দূরত্বে মাত্র ৬৭ দিন। এই ৬৭ দিন ব্যাপী রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বিদায় গ্রহণ করলেন। তবে একথা বলতেই হয় যে, আলােচ্য ৬৭ দিনের প্রায় প্রতিদিনই হয়েছে ধর্মঘট, কারফিউ, রক্তপাত আর সংঘর্ষ। এসবের মধ্যে প্রথম ৩৩ দিনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে : ২০শে জানুয়ারি জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর কর্তৃক পিস্তলের গুলিতে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে হত্যা, ২৫শে জানুয়ারি সেনাবাহিনী তলব ও ঢাকাবাসীর কারফিউ ভঙ্গ, ৬ই ফেব্রুয়ারি প্রায় ১০ হাজার মারমুখী জনতা কর্তৃক দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও বাংলাদেশ টাইমস) অফিস ভস্মীভূত আর তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের এক বস্ত্রে ঢাকা থেকে পলায়ন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে সামরিক হেফাজতে হত্যা, ১৮ই ফেব্রুয়ারি সৈন্য বাহিনীর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা, ২০শে ফেব্রুয়ারি নাগাদ কারফিউ ভঙ্গ করে ঢাকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার গগনবিদারী শ্লোগান “জেলের তালা ভাঙবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে” এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও ৪ জন বিবাদীর মুক্তিলাভ প্রভৃতি। | ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। রমনা রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহুত জনসভায় সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিব তার ৫০ মিনিটের বক্তৃতায় ৬ দফা দাবি নিয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে ‘গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের কথা ঘােষণা করলেন। এই বিশাল জনসভায় পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হলাে।পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে বামপন্থীরা আর এক দফা পিছিয়ে পড়লাে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আমার কাছে মনে হলাে আইয়ুব বিরােধী বামপন্থী দলগুলাের শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কেননা, ২৩শে ফেব্রুয়ারির জনসভায় আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্বের দায়িত্ব “সােনার থালায়” বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করে শহুরে মধ্যবিত্ত মার্কসিস্ট নেতৃবৃন্দ, আবার ‘লেজুড় বৃত্তির রাজনীতিতে লিপ্ত হলাে।বছরের পর বছর ধরে আন্দোলনের মাঝ দিয়ে মার্কসিস্ট দলগুলাে নেতৃত্ব সাচ্চা কৃষাণ আর শ্রমিক কমরেডদের হাতে ছেড়ে না দিলে এ ধরনের পরিণতি কেউই রােধ করতে পারে না। “ডি-ক্লাসড-বিহীন” মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের শ্রেণী চরিত্রের মূল উপসর্গই হচ্ছে রক্তাক্ত আন্দোলনের চরম পর্যায়ে মার্কসীয় দর্শনের অপব্যাখ্যা এবং প্রগতিশীল কথাবার্তার ফুলঝুরিতে পলায়নী মনােবৃত্তি আর পেটিবুর্জোয়াদের উপর দোষারােপ । ১৯৬৯ সালেও এর ব্যতিক্রম হলাে না। এতগুলাে বছর পরে আইয়ুব শাসনের অন্তিম সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালােচনা করলে চাঞ্চল্যকর তথ্য ও দিক নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। তখন অবস্থা ছিল “কুয়াে ভেদিস”! অর্থাৎ আইয়ুব খানের পর কী হতে যাচ্ছে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কার প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে সেটাই তখন বড় প্রশ্ন। রাজনীতির হিসাবের খাতা থেকে আইয়ুবকে বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে এ সময় শুরু হয়েছে রাজনৈতিক খেলাধুলার সূক্ষ্ম মারপ্যাচ। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে জুলফিকার আলী ভুট্টো হচ্ছে ‘উদীয়মান সূর্য’। “রােটি কাপড়া আউর মাকান’-এর স্লোগান দিয়ে ভুট্টোর পিপলস পার্টি এ সময় নিশ্চিন্তে ‘ফিউডাল লর্ড’দের (বিত্তশালী জমিদার) নেতৃত্বে গঠিত রুশপন্থী ওয়ালী ন্যাপকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এহেন ভুট্টোর সাফ জবাব হচ্ছে, ‘আইয়ুব-এর সঙ্গে কোনাে বৈঠকে বসব না।” এদিকে পূর্ব বাংলায় তখন দুইনেতা যথাক্রমে মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিব—এই দুজনেই জনপ্রিয়তার শিখরে। এদের মধ্যে কে অগ্রগামী হবেন সেটাই প্রশ্ন। মওলানা ভাসানী আগেই ঘােষণা দিয়েছেন যে, তিনিও ভুট্টোর মতাে পিন্ডির বৈঠকে যাবেন না। আর ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা ভিন্নরূপ। তাঁর কথা হচ্ছে, ৬ দফা দাবি নিয়ে তিনি গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দিবেন। | প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলােকে এক দুর্লভ ঘটনার উল্লেখ করছি। সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। রেসকোর্স ময়দানের জনসভার পর বঙ্গবন্ধু কার সঙ্গে দেখা করতে যান, সেটা জানার ইচ্ছা হলাে। নিজের ছােট্ট ‘ফিয়াট’ গাড়িতে আর্ট কলেজের রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় একটা পুরনাে টয়ােটা গাড়ি ভিড়ের মাঝে এগিয়ে এল। সামনের সিটে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বসে রয়েছেন। পিছু নিলাম। আজকের বাংলা মােটরস-এর কাছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের গলিতে এ সময় মওলানা ভাসানী অবস্থান করছিলেন ন্যাপ-এর কোষাধ্যক্ষ সাইদুল হাসানের বাসায়। বঙ্গবন্ধু সরাসরি গেলেন মওলানার সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য। একটু পরেই হাসান সাহেবের বাসায় গুরু-শিষ্যের মিলনের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অবলােকন করলাম। শেখ সাহেব ‘কদমবুচি’ করতে উদ্যত হলে মওলানা সাহেব। বুকে জড়িয়ে তাঁকে আশির্বাদ করলেন। এরপর সবার সামনেই শুরু হলাে দুজনার মধ্যে রাজনৈতিক কথাবার্তা। মওলানা : মুজিবর মিয়া, তুমি আর টিসিতে (গােলটেবিল বৈঠক) যাইয়াে না। মুজিব : হুজুর, আমি তাে কথা দিছি, মামলা উঠাইয়া নিলে রাওয়ালপিন্ডি যামু। মওলানা : ভুট্টো যাইবাে না।আমিও বয়কট করছি। তুমি না গেলেই ‘আর টি সি’ শ্যাষ। মুজিব : তবুও ওয়াদা রাখতে দোষটা কী? মওলানা মুজিবর মিয়া, রাওয়ালপিন্ডিতে যাইয়া তুমি ‘আর টি সি’ ভাঙবা ক্যামনে? মুজিব : কির লাইগ্যা? আমি ৬ দফার সব কিছু—দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন দুই হাতে জাবড়াইয়া রাখুম। হুজুর তা হইলেই গােল টেবিল শ্যাষ। মওলানা : আর পিন্ডি যাইয়া লাভ আছে? প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাে এখন মরা লাশ? মুজিব : হুজুর, হেই মরা লাশের জানাজা পড়তে দোষটা কী? আমাকে দোয়া কইরেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীকে প্রদত্ত তাঁর ওয়াদা রেখেছিলেন। যেখানে মওলানা ভাসানী এবং ভুট্টো আইয়ুব-এর প্রস্তাবিত গােল টেবিল বৈঠক ‘বয়কট’ করেছিলেন, সেখানে শেখ মুজিব দলীয় সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬৯ সালের ১০ই মার্চ পিন্ডির বৈঠকে যােগ দিলেন। রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মতে শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত ছিল রাজনীতিতে ‘জুয়া খেলার মতাে। আর এই ‘জুয়া’ খেলায় শেখ মুজিব বাজিমাত করলেন। গােল টেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রণীত ৬-দফা দাবিতে অটল রইলেন। ফলে বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে। মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪শে মার্চ তারিখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দোর্দণ্ড ক্ষমতাশালী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হলেন। আর এই পদত্যাগের প্রায় পুরাে কৃতিত্বই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ফলে মুজিবের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাসানী-ভুট্টোর চেয়ে তিনি বহুদূর এগিয়ে রইলেন।আইয়ুব খান-এর পর সামরিক বাহিনীর সমর্থনে অখণ্ড পাকিস্তানে ক্ষমতায় এলেন লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এই ফৌজি প্রেসিডেন্টের ৩৩ মাস সময়কাল ছিল সর্বাধিক ঘটনাবহুল। দেশবাসীর কাছে দেয়া ওয়াদা মােতাবেক ১৯৭০ সালে। সাধারণ নির্বাচনের তােড়জোড় শুরু হলে দ্রুত ঘটনা প্রবাহের অবনতি হলাে। বারংবার চেষ্টা করেও জামাতে ইসলামীর প্রধান মওলানা মওদুদী ঢাকা তথা পূর্ব। বাংলার কোথাও কোনাে জনসভা করতে সক্ষম হলেন না। সর্বত্রই বিক্ষুব্ধ জনতার মারাত্মক বিক্ষোভ ও প্রতিরােধ। এদিকে সত্তরের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রথম নির্বাচনী জনসভায় বললেন, “৬ দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনাে পথ নেই। ইসলাম বিপন্ন’ কথাটা যাঁরা বলছেন তাঁদের ‘ধাপ্পাবাজ রাজনীতিবিদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।” এই জনসভাতেই সর্বপ্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসাবে গগনভেদী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হলাে। ২৮শে অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ৩০ মিনিটের ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণের সমাপ্তি হচ্ছে ‘জয় বাংলা’ ‘খােদা হাফেজ’। এসব ঘটনা প্রবাহের প্রতিটি মুহূর্তই হচ্ছে আমার নিজের চোখে দেখা এবং মর্মে উপলব্ধি করা। – এর পরেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচারিত হলাে সেই ঐতিহাসিক পােস্টার “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন?” (বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ ইতিহাস-দলিলপত্রে এই পােস্টারের কোনাে উল্লেখ নাই ।-লেখক] এই ঐতিহাসিক পােস্টারের মর্মকথা হচ্ছে এক নজরে পূর্ব বাংলাকে শােষণের ইতিহাস। রাজনৈতিক মহলের মতে সে আমলে ইসলাম পছন্দ’ নামে ইসলামপন্থী জোট আর বামপন্থী দলগুলাে সর্বশক্তি দিয়েও জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের এই একটি মাত্র পােস্টারের মােকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি। – এমনি এক সময়ে ১১ই নভেম্বর দিবাগত রাতে দক্ষিণ বাংলায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লােক নিশ্চিহ্ন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমাহীন ঔদাসিন্যের দরুন পূর্ব বাংলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলাে। মওলানা ভাসানী ছুটে গেলেন দুর্গত এলাকায়। শেখ মুজিব তার নির্বাচনী অভিযান স্থগিত ঘােষণা করে নিমগ্ন হলেন আর্ত মানুষের সেবায়। | এর স্বল্প দিনের ব্যবধানে ১৯৭০ সালের ৯ই ডিসেম্বর সামরিক প্রহরায় অনুষ্ঠিত হলাে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন। দক্ষিণ ও বামপন্থী দলগুলাে নির্বাচনী ফলাফলে স্তম্ভিত হলাে আর সামরিক জেনারেলরা ভ্র কুঞ্চিত করল। এঁদের সবার মনে একই প্রশ্ন, ব্যাপার কী? পশ্চিম পাকিস্তানে একটা আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেও আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল কীভাবে? নির্বাচনী ফলাফল দাঁড়ালাে নিম্নরূপ :তবে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে অকম্যুনিস্ট মওলানা ভাসানীর পদক্ষেপগুলাে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিষয়গুলাে উপস্থাপনার পূবে আবারাে বলতে হচ্ছে যে, পূর্ব বাংলার মার্কসীয় মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব কোনাে সময়েই মওলানা সাহেবের রাজনীতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি এবং ভাসানী-মুজিবের অলিখিত সমঝােতার রাজনীতি কোনােদিন আন্দাজই করতে পারেননি ১৯৫৭-র কাগমারী থেকে ১৯৭০-এ ইয়াহিয়ার সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের দূরত্ব ১৩ বছরের মতাে। এতগুলাে বছর পরে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের ৫ই নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দানের প্রাক্কালে মওলানা ভাসানী আসন্ন নির্বাচনী ফলাফল কী হতে যাচ্ছে তা ঠিকই আন্দাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন যে, তারই এককালীন রাজনৈতিক শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিগুলাের আরও উগ্ররূপ ৬-দফার দাবি নিয়ে বাঙালি জনগােষ্ঠীর হৃদয় জয় করে নিয়েছে। তাই পরােক্ষভাবে হলেও মুজিবকে “সহযােগিতা ও সমর্থন দেয়ার মহামুহূর্ত সমাগত। এজন্যই মওলানা ভাসানী সেদিন আকস্মিকভাবে গর্জন করে উঠেছিলেন, “ভােটের আগে ভাত চাই”। বাহ্যত এই স্লোগান নকশাল মার্কা’ হওয়ায় এতেই কাজ হলাে। খুলনায় অনুষ্ঠিত ন্যাপ-ভাসানীর কাউন্সিল অধিবেশনে মতিনআলাউদ্দিন উপদলের সমর্থনে “ভােটের আগে ভাত চাই” (দানেশ-মশিউরসুলতান-মির্জা-জাহিদ প্রমুখের বিরােধীতা সত্ত্বেও) স্লোগানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে।চীনপন্থী মার্কসীয় নেতৃবৃন্দ বুঝতেই পারলেন না যে, মওলানা ভাসানীর স্বার্থটা কোথায়? নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাঙালি জাতীয়তাবাদী গগাষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়ার স্ট্রাটেজি হিসাবে মওলানা সাহেব দলীয় “বয়কট” সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চীনপন্থী প্রগতিশীলদের সযত্নে নির্বাচনী ডামাডােল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এছাড়াও তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আকুল আবেদন জানালেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, মওলানা ভাসানী কোনাে দিনই কম্যুনিস্ট ছিলেন না এবং এ ধরনের কোনাে দাবিও তিনি করেননি। বিগত কয়েক যুগ ধরে | যেখানে মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী এবং উগ্র বামপন্থীদের মধ্যে এ মর্মে বিশ্বাস রয়েছে যে, তাঁরা মওলানা ভাসানীকে নিজেদের প্রয়ােজনে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, সেখানে কিন্তু বাস্তবে মওলানা সাহেবই দিব্যি দফায় দফায় প্রগতিশীলদের মঞ্চই ব্যবহার করে গেছেন। অথচ এজন্য মওলানা সাহেবকে কোনাে সময়েই স্বীয় মতাদর্শ বিসর্জন করতে হয়নি। বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বামপন্থীরাই বারবার মওলানার সঙ্গে “আপােস করেছেন।এখানেই শেষ নয়। সত্তর-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের অব্যবহিত পরে সাধারণ নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় আর গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনে বাঙালি জাতির ইস্পাত-কঠিন একতায় মওলানা ভাসানী এক কথায় বিমুগ্ধ হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন শেখ মুজিবের কর্মকাণ্ডে বাঙালি জাতির সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসের মহামুহুর্ত আসন্ন। বামপন্থী সহকর্মীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে এবার শ্রদ্ধাভাজন মজলুম নেতা অবতীর্ণ হলেন সম্পূরকের ভূমিকায়। প্রকাশ্যে ঘােষণা করলেন সক্রিয় সহযােগিতা প্রদানের কথা। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৫ লক্ষাধিক লােকের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সােচ্চার কণ্ঠে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” কথাগুলাে উচ্চারিত হবার পর ঘটনা প্রবাহের দ্রুত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানী। ছুটে এলেন ঢাকা মহানগরীতে। ৯ই মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা সাহেব সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে বললেন : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলি, অনেক হইয়াছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লাকুম দ্বীনুকুম অলইয়া দ্বীন’-এর (তােমার ধর্ম তােমার, আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও। … মুজিবের নির্দেশ মতাে আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনাে কিছু করা না হইলে আমি শেখ মুজিবের সহিত মিলিত হইয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন শুরু করি। (বামপন্থীদের উদ্দেশে) খামােকা কেহ মুজিবকে অবিশ্বাস করিবেন মুজিবকে আমি ভালাে করিয়া চিনি।. “৬ দফা থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোত হতে যেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত মার্কসিস্ট নেতৃত্বের জের হিসাবে প্রগতিশীল কর্মীরা উনসত্তরের পর প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেখানে বিলম্বে হলেও মওলানা সাহেবের এ ধরনের পরিচ্ছন্ন বক্তৃতায় মার্কসিস্ট সমর্থকদের চিন্তাধারায় বিরাজমান বিভ্রান্তির কিছুটা অবসান হলাে। পরাধীন পূর্ব বাংলায় এর পরের ইতিহাসের সময়কাল মাত্র হপ্তা দুয়েকের মতাে। অথচ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ঘটনাবহুল এবং রক্তাক্ত ইতিহাস। এ সময় বাঙালি জাতির একমাত্র চালিকা শক্তি উপমহাদেশের সবচেয়ে ‘ডিসিপ্লিনড’ পার্টি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। | ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মারাত্মক প্ররােচনার মুখেও সেদিন বঙ্গবন্ধু ও তার। সহকর্মীরা স্বীয় দাবিতে অটল থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে গেছেন—কোনােরকম হটকারী সিদ্ধান্তের পথে পরিচালিত হননি। শেষ অবধি পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকারই আলােচনা অসমাপ্ত রেখে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে গণহত্যায় লিপ্ত হলে এর মােকাবেলায় নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হলাে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক প্রহরায় সুদূর পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালী জেলে আটক থাকা সত্ত্বেও তারই নির্দেশিত পথে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলাে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। রাজনৈতিক মহলের মতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে পরিপক পদক্ষেপের পরিচয় প্রদান করলেন।মওলানা ভাসানী একরকমভাবে বলতে গেলে চীন-সমর্থক “অস্থির চিত্ত” প্রগতিশীল গােষ্ঠীকে তালাক দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের ‘গার্জিয়ান’-এর ভুমিকা পালন করলেন। এ সময় তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বে সিরাজগঞ্জ ন্যাপ-এর (রুশপন্থী) সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম ছায়ার মতাে সর্বক্ষণ মওলানা সাহেবের সঙ্গী। একাত্তরের ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার মুখে টাঙ্গাইল-এর কাগমারী থেকে যমুনা নদী (ব্রহ্মপুত্র) দিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের প্রাক্কালে কেন মওলানা ভাসানী নৌকা ঘুরিয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে কট্টর রুশ-সমর্থক সাইফুল ইসলামকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কেন তিনি এই সাইফুলকে সবচেয়ে বিশ্বাসী সঙ্গী হিসাবে ব্যক্তিগত সচিব করে রেখেছিলেন? আর কেনই বা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মওলানা সাহেব বাংলাদেশের চীনপন্থী মার্কসিস্ট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে রইলেন? | এক কথায় বলতে গেলে এসবই হচ্ছে, অত্যন্ত ধীর-স্থির চিত্তে প্রবীণ অকম্যুনিস্ট রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঠিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানী কোলকাতায় বাঙালি শরণার্থী চীনসমর্থক মার্কসিস্টদের কোনাে বৈঠকেই যােগ দিলেন না। এমনকি ন্যাপ ভাসানীর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া ‘অর্থবহ কারণে গােপনে কোলকাতা থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে মওলানা সাহেব জনাব রহমানকে পার্টি থেকে অবিলম্বে বহিষ্কার করতে দ্বিধা করলেন না। উপরন্তু কোলকাতার বেলেঘাটায় এদের আয়ােজিত সমাবেশে পর্যন্ত হাজির হলেন না। শুধু তাই-ই নয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর স্বার্থে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের (আওয়ামী লীগ ছাড়া সত্তরের নির্বাচনে অন্যান্য সমস্ত দলের নেতৃবৃন্দ পরাজিত) বামপন্থী মহলের প্রচেষ্টার পথ রুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালাে, তখন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা প্রদানের লক্ষ্যে স্বয়ং চেয়ারম্যান হয়ে মওলানা ভাসানী গঠন করলেন ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি।’ বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি হলেন শেখ মুজিবের প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার-এর ‘গার্জিয়ান’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুচিকিৎসার জন্য সুদূর দেরাদুন-এ অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী যখনই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ-এর টেলিগ্রাম পেয়েছেন, তখনই ছুটে এসেছেন এই নির্বাসিত সরকারের সুদৃঢ় অস্তিত্বকে অটুট ও অক্ষুন্ন রাখার জন্য। পর্দার অন্তরালে সংঘটিত সেদিনের এসব ঘটনা তাে আজও পর্যন্ত আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের পরিচালক হিসাবে আমি এসব ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।এরপর পূর্ণোদ্যমে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের লড়াই-এর ময়দানে অস্ত্র হাতে মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা কয়েক লাখের মতাে। মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এরা আঘাতের পর আঘাত হেনে বিজয়কে ছিনিয়ে আনলাে। মুখে তাদের উচ্চারিত গগনবিদারী স্লোগান “জয় বাংলা’। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী। আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করলাে। একদিকে যুদ্ধবন্দি হলাে ৯১,৫৪৯ জন। হানাদার সৈন্য আর অন্যদিকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশ, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ তার স্থান করে নিলাে। বাংলাদেশের আকাশে তখন স্বজন। হারার ক্রন্দন আর বিজয় উল্লাসের ধ্বনি। যে বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রাম এবং তাঁর নির্দেশিত পথে নিপীড়িত জনগােষ্ঠীর বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হলাে এবং যে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধ। চলাকালীন সময়ে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি মাত্রই আল্লাহর দরগায়। প্রতিনিয়ত ফরিয়াদ করেছে, অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৫ দিন পর। সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তার প্রাণপ্রিয় দুঃখী বাঙালির মাঝে ফিরে। এলেন। ধর্মের মুখােশ পরে সে আমলে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল-চক্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগােষ্ঠির উপর জগদ্দল পাথরের মতাে যে শাসন ও শােষণ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং যার বিরুদ্ধে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আর মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রতিবাদে সােচ্চার কণ্ঠস্বর; সে সব চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের সাফল্য আর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অকুতােভয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় পদ্ধতির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটা নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখায় সৃষ্টি করলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। অবশ্য এর পিছনে ২৪ বছরের নিরলস সাধনার প্রয়ােজন হয়েছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাই, আটচল্লিশের প্রথম ভাষা-আন্দোলন ও ভাসানীর নেতৃত্বে সরকার-বিরােধী আওয়ামী লীগ গঠন, উনপঞ্চাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্নতন কর্মচারী ধর্মঘট এবং রাজশাহী ও দিনাজপুরে ছাত্র-বিক্ষোভ, পঞ্চাশে দাঙ্গা-বিরােধী বক্তব্য পেশ, একান্নতে বিপিসি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও খাদ্যের দাবিতে ভূখা-মিছিল, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে কারাগারে অনশন, পঞ্চান্নতে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রতিবাদ,চুয়ান্নতে সাধারণ নির্বাচন, ছাপ্পান্নতে স্বায়ত্বশাসনের দাবি, সাতান্নর কাগমারীতে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগের ঘােষণা, আটান্নতে আইয়ুব-এর সামরিক শাসনে কারাজীবন, বাষট্টিতে শিক্ষানীতি-বিরােধী ছাত্র বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন, তেষট্টিতে আইয়ুব-সংবিধানের বিরােধীতা, ছেষট্টিতে ৬-দফা আন্দোলন, সাতষট্টিতে ১২টি মিথ্যা মামলার মােকাবিলা, আটষট্টিতে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কাঠগড়ায়, ঊনসত্তর-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতিতে রাওয়ালপিণ্ডির গােল টেবিল বৈঠক ও আইয়ুবের পদত্যাগ, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়-এর বিপন্ন এলাকা সফর ও সামরিক প্রহরায় সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়, একাত্তরে স্বাধিকার ও অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে ৭ই মার্চে যুগান্তকারী ভাষণ এবং হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার মােকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার উদাত্ত আহ্বান—সর্বত্রই আমার হৃদয়ে এক মহান ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের মুখচ্ছবি ভেসে উঠে। তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্রষ্টা ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।আমার সৌভাগ্য এ কারণেই যে, আমি কখনও ছাত্র হিসাবে, কখনও সাংবাদিক হিসাবে আবার কখনও বা সরকারি কর্মচারী হিসাবে সে আমলের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর সমস্ত কর্মকাণ্ডই অন্তরঙ্গ আলােকে দেখতে সক্ষম হয়েছি। ঘন কুয়াশা আর ভয়ঙ্কর তুষার ঝঞার আবরণ ভেদ করে আমি হিমালয় দর্শন করেছি। সুদীর্ঘ দুই যুগ ধরে ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মাঝ দিয়ে অকুতােভয় এক মানব-সন্তান কীভাবে মহামানবে পরিণত হয়, তা আমি অবলােকন করেছি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ অবয়ব দেখেছি। আমার জীবন ধন্য—আমি ছিলাম তার স্নেহসিক্ত। মহানুভব বঙ্গবন্ধুর সেই সব হাসিমাখা কথা আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলব না। “মুকুল তুই আর ফুটলি । মুকুলই থেকে গেলি।” | সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, আমি বিশাল হিমালয়ের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি। বঙ্গবন্ধুর ভালােবাসায় আপুত। এখানেই আমার জীবনের সার্থকতা। তাই কবির ভাষায় বলতে হচ্ছে :দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গারক্তগঙ্গা বহমান তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়জয় মুজিবুর রহমান।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল