You dont have javascript enabled! Please enable it!
শফিউল্লাহ সাহেব আমাকে কোনাে অর্ডার করলেন না -কর্নেল শাফায়াত জামিল
[১৯৭৫ সালের ঢাকার কমান্ড ছিল একাত্তরের মুক্তিযােদ্ধা এবং পরবর্তীকালে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শাফায়াত জামিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও লেখক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য উদঘাটনের লক্ষ্যে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক সাইয়িদ-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পূর্বক পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে আলােচ্য সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ উপস্থাপিত করছি।-লেখক] অধ্যাপক সাইয়িদ : লে. কর্নেল রশীদ নিজ জবানীতে বলেছেন, ভারতের গানারি স্টাফ কোর্স সমাপ্ত করে আসার পর স্বভাবতই তাকে যশােরের গানারি স্কুলে পােস্টিং করা হয়। কিন্তু রশীদ উক্ত কর্মস্থলে যােগদান না করে ঢাকায় থাকার চেষ্টা চালায়। এরই এক পর্যায়ে সে দাবি করেছে যে, আপনার সঙ্গে দেখা করেছে এবং সে সাক্ষাতের বদৌলতে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। তার পূর্বের পােস্টিং বাতিল হয় এবং ঢাকায় তাকে নতুনভাবে পােস্টিং করা হয় এবং ১৯৭৫ সনের এপ্রিল মাসে সে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। লে. কর্নেল রশীদ-এর এই বক্তব্য সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে কি? শাফায়াত জামিল : আবদুর রশিদ নামে সামরিক এই অফিসারটি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পাদে অর্থাৎ অক্টোবরে এসে যােগদান করে। নভেম্বরে তার কথা জানতে পারি। দেশ স্বাধীন হবার পর কক্সবাজার ও রংপুরে আমি কর্মরত ছিলাম।
রশিদ-এর সঙ্গে আমার কোনাে সাক্ষাৎ ঘটেনি। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে রশিদ ঢাকায় আসে। চিফ অব স্টাফের অধীনে মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রাঞ্চের এক অর্ডারে আমি দেখতে পেলাম, তাকে যশােরে পােস্টিং করা হয়েছে। তখন মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন এ, এস, এম, নাসিম। ১৫/২০ দিন পর দেখলাম রশিদের ঐ পূর্বের পােস্টিং ক্যান্সেল করা হয়েছে। পােস্টিং অর্ডার করার দায়িত্ব ছিল চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর। তার অধীনে সাধারণত মিলিটারি সেক্রেটারি এসব কাজ করে থাকেন। রশিদের যশােরের পােস্টিং ক্যান্সেল করার ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই–করণীয় কিছু ছিল না। রশিদ যা বলেছে তা মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণােদিত। ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার হিসাবে আমার অধীনে ফাস্ট বেঙ্গল, সেকেন্ড বেঙ্গল, ফোর্থ বেঙ্গল, সিক্সটিন বেঙ্গল, সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার অফিসারদের দেখা প্রায় প্রতিদিনও হতাে। সিও হিসাবে রশিদের সঙ্গেও দেখা হতাে। আরও ১০/১২ জন ও, সি ছিলেন, তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হতাে। তবে রশিদ যেভাবে সাক্ষাতের কথা বলেছে। তা একেবারেই মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণােদিত। উদ্দেশ্য প্রণােদিত কেন তা পরে বলছি। এ প্রসঙ্গে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব ও জোরের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই-রশিদের যশােরে পােস্টিং কেন চিফ অব স্টাফ শফিউল্লাহ সাহেব ক্যান্সেল করেছিলেন—এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হওয়া উচিত। কেননা এই ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত। জনাব শফিউল্লাহ কেন অথবা কোন উর্ধ্বতন ব্যক্তির নির্দেশে অথবা চাপের মুখে রশিদকে ঢাকায় রেখেছিলেন আজ তা প্রকাশ হওয়া উচিত।
অধ্যাপক সাইয়িদ : ১৫ই আগস্ট সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন? শাফায়াত জামিল : ১৪ই আগস্ট রাত বারােটার সময় তদানীন্তন চিফ অবলজিস্টিক ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত আমাকে নিয়ে সি, এম, এইচ-এ গেলেন। সেখানে দুর্ঘটনাকবলিত ভারতীয় হেলিকপ্টারের ক্রুদের ছিন্নভিন্ন লাশগুলাে ভারতে পাঠানাের ব্যবস্থা হচ্ছিল। এসব ছিন্নভিন্ন লাশের গন্ধে আমি বমি করতে থাকি। অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং রাত দুটোয় বাসায় এসে ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ি। সকাল ৬-১০ মিনিটে হন্তদন্ত হয়ে রশিদ আমার ঘরে ঢুকে বলে, “উই হ্যাভ কিল্ড শেখ মুজিব” (আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি)। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে। আমি টেলিফোন ধরতে শফিউল্লাহ সাহেবের কান্নাভেজা বিমর্ষ কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি বললেন—বঙ্গবন্ধু আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। তার বাড়িতে কারা যেন গােলাগুলি করছে। উনি তাে আমাকে বিশ্বাস করলেন না; বিশ্বাস করলেন না। টেলিফোনে তার ধরা গলা শুনতে পারলাম। শফিউল্লাহ সাহেব আমাকে ফোন করলেন না অথবা তৈরি হতে বা প্রতিহত করতে হবে—এমন কিছুই বললেন না। আমার বাসা থেকে ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান সাহেবের বাসা প্রায় ১০০ গজের দূরত্ব। আমি জিয়াউর রহমান সাহেবের বাসায় গেলাম। ডাকাডাকি করলাম। তিনি বেরিয়ে এলেন। অর্ধেক শেভ। শফিউল্লাহ সাহেবের কথা বললাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘সাে হােয়াট! প্রেসিডেন্ট নেই—ভাইস প্রেসিডেন্ট তাে আছেন—ইউ এলার্ট ইয়াের ট্রপস (তুমি তােমার সৈন্যদের প্রস্তুত করাে)। ফার্স্ট বেঙ্গলে গেলাম। তাদের অর্গানাইজ করলাম ।
৮-৩০ মিনিটের দিকে চিফ শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান, বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, নৌ-বাহিনী প্রধান এম এইচ খান এলেন। আমি তখন ফাস্ট বেঙ্গলে। এদের সঙ্গে ডালিম ছিল। ডালিমের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হলাে; বলতে পারেন ভালাে রকম ঝগড়া হয়ে গেল। আমাকে কিছুই বলা হলাে না। তারা চলে গেলেন। পরে দেখলাম সবাই খােন্দকার মােশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মেনে নিয়ে আনুগত্যের শপথ নিল। ঐ সময়ই সংবাদ পেলাম কুমিল্লা থেকে কিছু টুপস আসছে। তারা নাকি ডালিমের লােক। আমি কর্নেল আমজাদের সঙ্গে কথা বলি এ বিষয়ে। তিনি ট্রপসদের কন্ট্রোল করেন। সারাদিন রেডি থাকলাম। এই জঘন্য বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রস্তুত থাকলাম। এ সময় হতেই খালেদ মােশাররফ ফাস্ট বেঙ্গলে থাকতে শুরু করেন। আমার বুঝতে বাকি রইলাে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে কী ঘটে গেল । মােশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে দেখে বুঝতে বাকি রইল না তারা দেশটাকে প্রি-৭১-এর (একাত্তরের পূর্ববর্তী পাকিস্তান আমল) অবস্থায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই মােশতাককে জানতাম।
অধ্যাপক সাইয়িদ : পরবর্তী কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা কিছু থাকলে অনুগ্রহ করে বলবেন কি? শাফায়াত জামিল : দেখুন তারিখটা মনে নেই। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যেই হবে। আমাদের বলা হলাে, ১৫ই আগস্ট কেন সংঘটিত হলাে এ সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের পক্ষে আমাদের ব্রিফ দেয়া হবে সেনা সদর দফতর-এ। সকাল ১০টা। সেনাবাহিনী চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান, খালেদ মােশাররফ, লে, কর্নেল নূরুদ্দিন (তখন ডি, এম, ও), কর্নেল মইনুল হােসেন সহ ঢাকায় উপস্থিত সিনিয়র অফিসারবৃন্দ ঐ মিটিং-এ উপস্থিত। আমিও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে সেখানে আছি। দেখলাম, রশিদ ও ফারুক এল। প্রেসিডেন্ট মােশতাকের পক্ষে তারা আমাদের ব্রিফ দেয়ার জন্য এসেছে। রশিদ কথা বলা শুরু করলাে। দেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ধ্বংসসম্মুখ ইত্যাদি বলার পর সে বলল, শেখ মুজিবকে উৎখাতের বিষয়টি এখানে উপস্থিত সিনিয়র অফিসারদের কাছে আগেই জানানাে হয়েছিল। একথা বলার সাথে সাথে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম। বললাম, বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করা হবে একথা কবে, কাকে, কখন জানানাে হয়েছে তা আমার। জানা নেই। তবে এটা আমার সম্পূর্ণ অজানা। আমি বললাম, মােশতাক আমার প্রেসিডেন্ট নয়। হি ইজ এ মার্ডারার (তিনি একজন হত্যাকারী)। আমি প্রথম সুযােগেই তাকে ওভার থ্রো (হটিয়ে দিবাে) করব। তােমাদের অন্যায় বিদ্রোহ ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য তােমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। তােমরা মনে করেছে ইউ আর ডেসপারেট, বাট দেয়ার আর ডেসপারেট পিপল ইন দ্যা আর্মি, হু উইল ওভার থ্রো ইউ (তােমরা মনে করেছে যে, তােমরা বেপরােয়া, কিন্তু সামরিক বাহিনীতে আরও বেপরােয়া লােক আছে যারা তােমাদের হটিয়ে দেবে)।’ এ কথায় রশিদ স্তম্ভিত হয়ে যায়। আমি বললাম, তােমরা সেনাবাহিনীর চেইন ইন কমান্ড ব্রেক করেছ, শৃঙ্খলা ভেঙেছ এবং সাংবিধানিক আনুগত্য বিনষ্ট করেছ।
অধ্যাপক সাইয়িদ ! আজকাল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী ফারুক রহমানকে মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে দেখানাে হচ্ছে। আপনার অভিমত কী? শাফায়াত জামিল প্রকৃত প্রস্তাবে ফারুক মুক্তিযােদ্ধা নয়। সেজন্য মুক্তিযােদ্ধাদের ২ বছরের সিনিওরিটি সে পায়নি। ঐ সময়ে আর্মিতে নিয়ম ছিল, ২১শে নভেম্বরের (১৯৭১) আগে যেসকল সামরিক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিল কেবল তারাই দু’বছরের সিনিয়রিটি পাবে। সে হিসেবে ফারুক সিনিয়রিটি পায়নি। অধ্যাপক সাইয়িদ সম্প্রতি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম লে. কর্নেল শাহরিয়ার বলেছে যে, ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ঐ সময় ঢাকার সকল উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারবৃন্দ জানত। এমনকি ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডারে সঙ্গে আলাপ করে ১৫ই আগস্ট সংঘটিত হয়েছিল? এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? শাফায়াত জামিল : দেখুন এ ব্যাপারে ঐ পত্রিকায় আমি একটি প্রতিবাদ পাঠিয়েছি।… বিবৃতির অংশবিশেষ নিম্নরূপ : ১৫ই আগস্ট বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ড আমি এবং তঙ্কালীন সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাপরায়ণ, বিবেকবান অফিসারেরা কেউই মেনে নিতে পারিনি। ১৫ই আগস্ট যারা সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করিয়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, তাদেরকে প্রথম সাক্ষাতেই আমি আমার মনােভাব খােলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম। সেনাসদর দপ্তর তৎকালীন সেনাপ্রধান ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের উপস্থিতিতেই। আমি কখনও ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী নই। অতীতে যখন যা করেছি নিঃসংশয়চিত্তে, উন্নত শিরে এবং খােলাখুলিভাবে বলে-কয়েই করেছি।…. সত্য শাশ্বত এবং চিরন্তন। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হবে না। ইতিহাস নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়ন করে পরম শ্রদ্ধার আসনটি দেবে ভবিষ্যতে। লে. কর্নেল শাহরিয়ার ও তার সহযােগিরা তাদের কৃতকর্মের যথার্থ বিচারের অপেক্ষায় থাকতে পারেন।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!