You dont have javascript enabled! Please enable it!
সৈয়দ নজরুলের কাছেও প্রস্তাব এসেছিল
আশি দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নাম বিস্মৃতির অন্তরালে প্রায় হারিয়ে গেছে।  কিন্তু মাত্র দেড় যুগ আগেও ভদ্রলােক ছিলেন একজন তুখােড় রাজনীতিবিদ। দিনাজপুরের সন্তান জনাব ইউসুফ ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় হিসাবে অনেক ক’টা ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। কৈশাের থেকে যৌবনে পদার্পণকালে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন এবং সে আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবুর রহমানের অন্ধ অনুসারীতে পরিণত হন।  ষাট দশকে ছ’দফা আন্দোলনের সময় অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসাবে চিহ্নিত হন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পশ্চাতে অন্যান্যদের সঙ্গে অধ্যাপক ইউসুফ-এর অবদান অনস্বীকার্য। এ সময় উত্তরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ত্রয়ী নেতা ছিলেন যথাক্রমে সর্বজনাব এম মনসুর আলী (পাবনা), এ এইচ এম কামরুজ্জামান হেনা ভাই (রাজশাহী) এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী (দিনাজপুর)। একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্ব দানকারী নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এই অধ্যাপক ইউসুফ। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের ঐতিহাসিক আম্রকাননে মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। তৎকালীন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী হিসাবে বহাল থাকেন। অনেকের মতে মন্ত্রী হিসাবে অধ্যাপক ইউসুফ বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সুবক্তা ও সংগঠক এবং নম্র ও বিনয়ী স্বভাবের অধ্যাপক ইউসুফ আলীর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিপর্যয় দেখা দেয় বলা যায়। এ সময় থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের পদস্খলনের সূচনা। তিনি খন্দকার মােশতাক আহম্মদ-এর মন্ত্রিসভায় অন্যতম সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং নানা ঘটনা প্রবাহে স্বীয় রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। শেষ অবধি অধ্যাপক ইউসুফ আলী আশি দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিছুদিনের জন্য এরশাদমন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। কিছুদিন পূর্বে তিনি রাজনীতি থেকে প্রায় অবসর গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি অধ্যাপক ইউসুফ পরলােকগত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কিত অধ্যাপক ইউসুফ আলীর চাঞ্চল্যকর বক্তব্যের অংশ বিশেষ নিম্নে বর্ণিত হলাে। লেখক]।  “সামনে গিয়ে দরজা খুলে দেখি তখন শপথ গ্রহণ চলছে। দেখলাম, সামনে অনেক অফিসার। তাদের মধ্যে চিনি কেবল জিয়াউর রহমান আর শফিউল্লাহকে। অন্য কেউ চেনা থাকলেও তখন পর্যন্ত নজরে আসেনি বা আমার মনে পড়ছে না এখন। তখন শফিউল্লাহ সাহেব আমাকে ইশারা করে কাছে। ডাকলে এরপর আমার শপথ হয়ে গেল। যখন শপথ হলাে তখন মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্টের দু’জন এডিসি এই মুহূর্তে উপস্থিত।
তাদের একজনকে ডেকে আমি বললাম : আমি নামাজ পড়তে যাব পাশে কোথাও। প্রেসিডেন্ট সাহেব যদি আমার খোঁজ করেন তাহলে জানাবেন। আমি উঠতে যাব এমন সময় দেখি, এডিসি সেই মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট সাহেবের কানে আমার নামাজ পড়ার কথাই বলছে। কানে কানে বলার সঙ্গে মােশতাক সাহেব আমাকে হাত ইশারা করে বসতে বললেন। তখনও তিন চারজনের শপথ গ্রহণ বাকি। শপথ গ্রহণ করানাের পর আমরা নামাজ পড়লাম। নামাজ পড়ার পর প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের সাথে কথা বলবেন। বঙ্গভবনের যে রুমে এখন প্রেসিডেন্ট সাহেবের চেম্বার, সেই রুমে মােশতাক সাহেবও বসতেন। তার সিটিং এরেঞ্জমেন্ট চেঞ্চ হয়েছিল। সব শপথ নেওয়া মন্ত্রী সাহেবরা গেলেন। অনেক সিভিল ও ইউনিফরমড অফিসাররা আছেন। আমরা ওখানে গেলে খন্দকার মােশতাক সাহেব কাকে যেন বললেন, একটু চা খাওয়া যাক। একজন অফিসার তখন সালাম করে চলে গেলেন। তারপর আরও দু’তিন মিনিটের সাইলেন্স। একেবারে সবাই চুপচাপ; কেউ কোনাে কথা বললেন না। তখন খন্দকার মােশতাক সাহেব বললেন, শফিউল্লাহ যা হবার তা হয়ে গেছে। আর যেন একটাও গুলি ছোড়া না হয়। আর যেন একফোটা রক্ত না ঝরে। অবস্থা ‘নরমাল’ করার জন্য যা প্রয়ােজন তা তােমরা করাে। এমনি করে কয়েক মিনিট কথাবার্তা বললেন। এর মধ্যে চা এসে গেল। চা খেলাম। তখন উনি বললেন : আমাদের উঠতে হবে। তার আগে একটা কথা। আমার খেয়াল নেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বা মুজিব ভাই কীভাবে তিনি তখন সম্বােধন করেছিলেন। বললেন, ওনার ডেড বডি টুঙ্গীপাড়া যাবে। আপনারা কেউ ‘একমপেনি’ করবেন? আমাদের কেউ কোনাে উত্তর দিলেন না। খন্দকার সাহেব কয়েক মিনিট চুপচাপ ছিলেন আমাদের উত্তরের প্রতীক্ষায়। আমাদের কেউ প্রশ্ন করেননি, ঢাকায় দাফন হবে না কেন? বলেননি, আমরা কেউ সঙ্গে যাব। অতঃপর তিনি কাকে যেন ডেকে বললেন, টুঙ্গীপাড়ায় লাশ পাঠানাের ব্যবস্থা করুন।
বেরিয়ে যাবার আগে বললেন আপনাদের যার যা পাের্টফলিও ছিল আপাতত সেটাই থাকবে। যে যে বাড়িতে আছেন, সে সেই বাড়িতেই থাকবেন। আপনারা অফিস করতে থাকেন। পরে দেখা যাবে কী করা যায়… খন্দকার সাহেবের বক্তব্য হলাে । ১৫ই আগস্ট সকালে এসে আমাকে নিয়ে গেছে। দেশকে রক্ষার জন্য তিনি সেই সময় বিপদ এবং বদনাম আসবে জেনেও রাজি হয়েছেন। আল্লাহ সবকিছুই জানেন। তবে হেনা ভাই (মন্ত্রী এ এইচ কামরুজ্জামান) আমাকে জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে হেনা ভাইয়ের তিন নাম্বার রােডের (ধানমন্ডি) বাসায় ডালিম তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।
ডালিম তাকে ডেকেছে। হেনা ভাই নামেননি। হেনা ভাই বললেন, ডালিম আমার সাথে আগেও যােগাযােগ করেছিল এবং প্রস্তাবও নিয়ে এসেছিল। তাই জানতাম, সে কী কথা বলতে এসেছিল। তাই দরজা খুলিনি। হেনা ভাই আমাকে বললেন, ডালিমরা জানিয়েছিল এরকম একটা ঘটনা ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে, তা বলেনি—তবে তাকে নিয়ে যাবে এবং হেনা ভাইয়ের নেতৃত্বে পাওয়ার (ক্ষমতা) নেওয়া হবে। হেনা ভাই আমাকে বললেন, আমি তাতে তখন রাজি হইনি। ১৪ই আগস্ট তারিখে তাই নিচে নামিনি। ডালিম পরে গালাগালি করে চলে যায়। ১৩ই কিংবা ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট। পুরাতন গণভবনে থাকেন। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। আমি দেখি উনি পাঞ্জাবী-লুঙ্গি পরে পায়চারী করছেন। সালাম দিলাম । কোনাে উত্তর দিলেন না। খুব গম্ভীর। উনিতাে এমনি একটু কানে কম শুনতেন। আর একবার সালাম দিলাম। তারও কোনাে উত্তর নেই। বুঝলাম খুবই উত্তেজিত। নজরুল ভাইয়ের বাসায় প্রায় ডেইলি যেতাম। যখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল, রােজ বিকেলে গণভবনে গিয়ে ৪৫ মিনিট তাকে নিয়ে পায়চারী করতে হবে। সেখানেও যেতাম। শেষের দিকে তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা মনে হয় ১৩ তারিখে দিবাগত রাত্রে। চৌদ্দ তারিখ তাে ওনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। 
এদিকে সেদিন নজরুল ভাই গম্ভীর হয়ে চুপচাপ পায়চারী করছেন। আমিও উনার সঙ্গে পায়চারী করছি। কোনাে কথা বললেন না। নজরুল সাহেবকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করতাম। বঙ্গবন্ধুও ওনাকে ‘স্যার’ বলতেন। মােশতাক, তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান বা মনসুর বলতেন, আমরাও স্যার বলতাম।  তিনি খুব লার্নেড় লােক ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে খুব মন খারাপ করে অভিমান করে থাকতেন। তার কারণ যখনই তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু কারও প্রভাবে এমন একটা পথে গেছেন, যে-পথ আমাদের কারও জন্য ভালাে বা কল্যাণ বয়ে আনবে না, তখনই তিনি অভিমান করে দূরে সরে থাকতেন। সেটা আরও খারাপ হলাে আমাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর অন্তরের বন্ধু, প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ সাহেব ছিলেন। সৈয়দ নজরুল সাহেব বললেন, কী ভাবছেন? কী করছেন? প্রশ্নের জবাবে বললাম, স্যার কী হয়েছে? তিনি বললেন, কী হতে বাকি আছে? আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই—নিজেদের ঘর সামলাতে পারি না, আমরা আবার কথা বলি। তখন বুঝলাম উনি তাে খুব রেগে আছেন। কারণ জানি না। চিন্তা করার জন্য বললাম : স্যার উপরে চলুন চা খাব।
উপরে গেলাম দুজনে। উপরের এক ঘরে বসলাম। এই দেখেন আমি আপনাকে বলি নাই আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে? দিনের পর দিন কী হচ্ছে? কেউ কথা শােনে না আমার। কারাে কথা শােনে না। এখন কী। অবস্থা হবে? আমি বললাম কী হয়েছে? কী হবে? নজরুল সাহেব বললেন : পায়ের তলায় মাটি আছে? আমি বললাম, স্যার কার কথা বলছেন আপনি? সৈয়দ সাহেব বললেন, কার আবার? বঙ্গবন্ধুর কথা। আমি বললাম, কেন? কী হয়েছে? বললেন, যা দেখছি, এ তাে ভালাে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে লােক এসেছিল। আমার কাছে পাওয়ার (ক্ষমতা) নেবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কেন? কামরুজ্জামান হেনা সাহেবও ঐদিনই আমাকে বলেছিলেন “আজকেও উনি আমাদের নেতা। ওনাকে দিয়ে চলবে না। ক্ষমতা আমাকে নিতে হবে এটা কেমন কথা। এদিকে উনি তাে (বঙ্গবন্ধু) আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান না। আমি বললাম, আপনিই ৩২ নাম্বারে যান; সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। দেখেন কী করতে পারেন। সৈয়দ সাহেব বললেন, না তিনি যখন সব কথা খুলে বলতে চান না, তখন আর কী করবাে। তখন আমি বললাম : তাহলে তাে চলবে না। আপনার জন্য আপনি নাই বা গেলেন; কিন্তু দেশের জন্য আমাদের জন্য যান। আজকে যাবেন কিন্তু তিনি বললেন, না। তারপর ঠিক হলাে, পরদিন উনি যাবেন। সে সুযােগ মনে হয় আর হয়নি। হেনা ভাই আর সৈয়দ সাহেবের কথায় মনে হয় খন্দকার মােশতাক সাহেব ছাড়াও অন্য যে কাউকে দিয়ে তারা টেক ওভার করে ফেলতাে।” (সংগৃহীত ও সংক্ষেপিত)

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!