You dont have javascript enabled! Please enable it!
ফিলিপস চেরি-লিফসুজ সাক্ষাৎকার
[এক্ষণে লিফসুজ-এর রচিত ‘বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন’ গ্রন্থ থেকে ‘চেরি লিফসুজ সাক্ষাৎকার পরিচ্ছদের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত হলাে। অংশটি বাংলাদেশের বামপন্থী লেখক আশফাক আলম স্বপন রচিত “মুজিব হত্যা চক্রান্ত গ্রন্থ থেকে নেয়া।-লেখক]
লিফসুজ : … পররাষ্ট্র (মার্কিনী) দফতরের জনাকয়েক অফিসার আমাদের সাথে ১৯৭৫-এর আগস্টের (মুজিব হত্যা) ঘটনাবলীর আলাপ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ১৯৭৪-এর শরৎকালে মুজিবকে উৎখাত করতে ইচ্ছুক একটি দলের প্রতিনিধি দূতাবাসের (ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে) সঙ্গে। যােগাযােগ স্থাপন করে। আমরা জানতে চাচ্ছি যে, এই বৈঠক সম্পর্কে আপনি কতদূর অবগত আছেন? অথবা আপনি আদৌ এই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন কিনা?  চেরি : না, নেইনি। আমি তাে ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর-এর আগে সেখানে
পৌছাইনি। তখন আমি ছিলাম রাজনৈতিক অফিসার। কোনাে বাঙালি আমাদের অফিসে এসে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বা এ ধরনের কিছু নিয়ে আলাপ করেনি। অফিসে তাে নানা ধরনের বাঙালির আগমন হতাে; তবে এ কারণে নয়। অবশ্য আমার যেসব সহকর্মী আগে কাজ করেছেন, তাদের কাছে শুনেছি যে, এ ধরনের কারাে আগমন হলে তাদের কথা শােনা হতাে বটে; কিন্তু তারপরেই বিদায় করে দেয়া লিফসুজ : মার্কিনী পররাষ্ট্র দফতর-এর সূত্র আমাদের এ মর্মে জানিয়েছে যে, ১৯৭৪ সালের শরৎকালে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলােচনায় (ঢাকা দূতাবাসে) বসা হয়েছিল এবং সম্ভাব্য ক্ষমতা বদলের পর যুক্তরাষ্ট্রের কী মনােভাব হবে এই কথাটাই তারা জানতে আগ্রহী ছিল। পররাষ্ট্র দফতর-এর সূত্রে আমাদের আরও জানিয়েছে যে, ১৯৭৪-এর শেষ কিংবা ১৯৭৫-এর একেবারে প্রথম দিকে ওরা (ঢাকা দূতাবাস) আলােচ্য দলটির সঙ্গে যােগাযােগ ছিন্ন করে।
এর পর সিআইএ স্টেশন (পৃথকভাবে) ১৫ তারিখ অর্থাৎ অভ্যুত্থানের দিন পর্যন্ত যােগাযােগ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই প্রসঙ্গেই আপনার নাম শােনা যায়। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? চেরি : না, আমার জানা মতে না। আমার মনে হয় না। আপনি পররাষ্ট্র (মার্কিন) দফতরে কার সঙ্গে কথা বলেছেন? লিজ: নামগুলাে স্পষ্টভাবে আপনাকে বলতে পারলে ভালাে হতাে। কিন্তু
আমাদের প্রাপ্ত সংবাদের সূত্রগুলাে তাদের নাম উচ্চারণ না করার অনুরােধ করেছেন। তাদের কথা হচ্ছে, যােগাযােগ রক্ষার কাজে জড়িত ছিল বলে অভিযােগ রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, এ বি এস সফদার প্রমুখ। অন্যতম। আপনি কি এদের কাউকে চেনেন? বাংলাদেশে অবস্থানকালে এদের কারাে সাথে আপনার দেখা হয়েছে কি? চেরি : এদের কারাে কারাে নাম আমি জানি। তবে আপনি যেসব নাম। বললেন, তাদের কারাে সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। লিসুজ : আপনার বিবেচনায় আগস্ট অভ্যুত্থান কীভাবে ঘটেছিল? চেরি : আরে বাবা, সে এক চমকপ্রদ ব্যাপার। অভ্যুত্থান হওয়ার পর ঘটনা সম্বন্ধে জানার বহু চেষ্টা করেছি বটে; কিন্তু এ ধরনের একটা ঘটনা যে হতে যাচ্ছে তার কিছুই আমরা জানতাম না। অগ্রিম কোনাে ধরনের সতর্ক সংকেতই আমরা পাইনি। আমার মনে পড়ছে, ঘটনার পরপই কিছু গুজব (ঢাকায়) ছড়িয়ে পড়েছিল। ওখানকার (ঢাকা-ওয়াশিংটন) আমাদের যােগাযােগ এতাে ভালাে যে, আমরা এই অভ্যুত্থানের সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে বেশ আগেই। পাঠাতে সক্ষম। মানে একটা অভ্যুত্থান যে হচ্ছিল, সেটা বেশ বােঝা যাচ্ছিল। সেদিন প্রচুর গােলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের একজন রাজনৈতিক অফিসারের (সিআইএ এজেন্ট) বাসার কাছেই একটা পরিবারকে হত্যা করা হয়।
এ সময় আমরা সবাই দূতাবাসে চলে এলাম। তখন ভাের ৪টা কি ৫টা হবে। আমরা তক্ষুণি খবর পাঠালাম (ওয়াশিংটনে) যে, একটা অভ্যুত্থান হচ্ছে। গােলাগুলির শব্দ শােনা যাচ্ছিল; কিন্তু ঠিক কী হচ্ছিল, তা বুঝতে পারছিলাম না। যা হােক, টাইম জোনের একটা ব্যাপার আছে তাে? খবরটা ওয়াশিংটনে সন্ধ্যের সংবাদ প্রচার হবার আগেই পররাষ্ট্র দফতরের হাতে চলে আসে। আর তাতেই বহু লােক ভেবে বসে আছেন যে, মার্কিন দূতাবাস আগে ভাগেই সব জানতাে। আমি আপনাকে বলতে পারি যে, আমরা

জানতাম না। লিফসুজ : তাহলে ঢাকার স্টেশন চিফ (সিআইএ) হিসাবে অভ্যুত্থানের কোনাে সংবাদ পাননি? চেরি : ঢাকায় একজন রাজনৈতিক অফিসার (সিআইএ এজেন্ট) হিসাবে অভ্যুত্থানের কোনাে আগাম সংবাদই আমি পাইনি। আপনি ঠিকই
বলেছেন। লিফসুজ : তাহলে আপনি এমন অভিযােগ অস্বীকার করছেন যে, সিআইএ’র ঢাকা স্টেশনের সদস্যরা মুজিব উত্থাত চক্রান্তে জড়িত মােশতাকের দলভুক্ত লােকজন যেমন চাষী, সফদার ও অন্যান্যদের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ রক্ষা করেছিল?
চেরি : একজন রাজনৈতিক অফিসার (সিআইএ এজেন্ট) হিসেবে এ সম্বন্ধে আমার কোনাে সংবাদই জানা নেই। ব্যক্তিগতভাবে এদের কাউকেই আমি চিনি না। এদের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু কখনাে এদের সাথে আমার দেখা হয়নি। লিফসুজ । দেখুন ‘রাজনৈতিক অফিসার’ পদটা নিয়ে আমরা একটু ধান্দায় পড়েছি। পররাষ্ট্র দফতরের কিছু লােক আমাদের সরাসরি বলেছে যে,
আপনি তখন সিআইএ স্টেশন চিফ ছিলেন। চেরি । তারা এ কথা কেন বললেন আমি জানি না। লিফসুজ : কথাটা কি মিথ্যা? চেরি : জ্বী? লিফসুজ; এটা কি ভুল তথ্য? চেরি দেখুন, আমার ফাইল ঘাটলে দেখতে পাবেন, আমি রাজনৈতিক অফিসার। ঢাকাতেও তাই ছিলাম। লিফসুজ । আপনি তাহলে সে সময় ঢাকায় সিআইএ স্টেশন চিফ ছিলেন না?
চেরি ; এসব খবর আপনি কোথায় পেলেন, তা আপনিই জানেন। লিজ : আমাদের বিবেচনায় কিছু উচু পর্যায়ের সূত্র (মার্কিনী) আমাদের জানিয়েছে, আপনি মুজিব বিরােধী অভ্যুথানে জড়িত ছিলেন। চেরি : বাজে কথা। লিসুজ । এ ব্যাপারে আপনার দ্ব্যর্থহীন অস্বীকৃতি চাই। চেরি ; আমি আপনাকে এ মর্মে অস্বীকৃতি জানাতে পারি যে, মুজিব উৎখাতকারী অভ্যুত্থানের সাথে আমি বা দূতাবাসের আর কেউ জড়িত ছিলাম না। মুজিব সরকারের সাথে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সরকার বদল হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আমাদের নয়; আমরা কোনাে অভুথান পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলাম না।
এটুকু আমি হলপ করে বলতে পারি। লিসুজ। পররাষ্ট্র দফতর (মার্কিনী) কর্মকর্তা ও অন্যান্য সূত্র হতে আমরা খবর।
পেয়েছি যে, কোলকাতায় মােশতাক চক্রের সাথে ১৯৭১-এই যােগাযােগ ছিল। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার গোপনে আলাদা শান্তি চুক্তি করার লক্ষ্যে আলাপ-আলােচনা চালাচ্ছিলেন। এখন আমাদের বিবেচনায় ১৯৭১-এ যাদের সাথে যােগাযােগ ছিল; (ঢাকায়) ১৯৭৪ এ শরৎকালে তাদের সাথেই যুক্তরাষ্ট্র যােগাযােগ পুনরুজ্জীবিত করে। অভিযােগ হচ্ছে যে, এরা সম্ভাব্য ক্ষমতা বদলে যুক্তরাষ্ট্রের কী অভিমত হতে পারে, তা জানার জন্য দূতাবাসের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। | চেরি : ডাহা মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে। আপনি তখনকার রাষ্ট্রদূত বােস্টারের সাথে কথা বলেছেন?
লিফসুজ : আমরা যতজন রাজনৈতিক অফিসার ও দূতাবাস কর্মীর সাথে
যােগাযােগ করতে পেরেছি তাদের সাথে কথা বলেছি। চেরি আপনি যদি রাষ্ট্রদূত বােস্টার বা অন্য কারাে সাথে কথা বলে থাকেন,
আমি জানি ওরাও আমার মতাে বলেছেন যে, সব মিথ্যে কথা। আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় নয়াদিল্লীতে কর্মরত ছিলাম। কোলকাতায় মােশতাকের সাথে কোনাে কাজকারবার ছিল নাতাে! আমার মােশতাকের সাথে কখনাে দেখা হয়নি। তার নাম শুনেছি।
ঠিকই, কিন্তু এসব কিছুই ঘটেনি। লিজ । রাজনৈতিক অফিসার হিসাবে যা বুঝতে পেরেছেন, তাতে কি
আপনার মনে হয় কিছু আজ্ঞাধীন সেনা নিয়ে দুজন মেজর মুজিবের বাড়ি হানা দিয়েই একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেছিলেন? মােশতাক ও তার চক্রের আগাম রাজনৈতিক যােগসাজশ সম্বন্ধে আপনার
বিবেচনা কী? এ সম্বন্ধে আপনার কোনাে উপলব্ধি আছে? | চেরি : দেখুন, ওরা ক্ষমতায় আসার পর খোঁজ নিয়ে আমি যতটুকু জানতে
পেরেছি, তাতে মনে হয় এটা সম্পূর্ণ একটা সামরিক অভিযান ছিল। পরে মােশতাককে ধরে আনা হয়; নাকি তার সাথে আগেই বন্দোবস্ত ছিল, সেটা আমরা ঠিকমতাে জানতে পারিনি। কিন্তু এসব কথা তাে সে সময় কাগজেই উঠেছে। আরে বাবা, ওরকম দেশে নাক গলিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের কি ফায়দা হতে পারতাে? এমন সমস্যা জর্জরিত দেশ! লিসু । চেরি সাহেব, সে সময় আমি যখন এসব বিষয়ে প্রতিবেদন
লিখেছিলাম, তখন শ্রীমতী গান্ধী আর মস্কোপন্থী দলগুলো এই ধরনের অভিযােগ করেছিল। আমি সেসব অভিযােগ নিজের
প্রতিবেদনে বাজে কথা বলে খারিজ করে দিয়েছিলাম। চেরি : আমি বরাবরই আপনার প্রতিবেদনের মূল্য দিই। লিজ । ধন্যবাদ। কিন্তু এখন যেসব নতুন খবর পাচ্ছি, অনেকে যেসব নতুন।
প্রমাণ উপস্থিত করছেন, তাতে শুরুতে যেমনটা ভেবেছিলাম যে, শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও রাগের কারণে দুজন মেজর মুজিবের বাড়িতে যেয়ে হানা দিয়েছিলেন, সে ধারণা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য
হচ্ছি। চেরি : হ্যা, তা দেখুন, আমার জানা মতে যেকোনাে অভ্যুত্থানেই খানিকটা
আগাম পরিকল্পনা থাকে… লিফসুজ : আর আমরা যেটা নিয়ে বেশি খোঁজ-খবর নিচ্ছি তা হলাে
অভুত্থানকারীদের সাথে মােশতাক-চক্র ও আওয়ামী লীগের ভেতরের অংশের অভ্যুত্থান পূর্ব যােগসাজশের ব্যাপারটা। তার উপর ১৯৭১-এ যােগসাজসের কিছু কৌতূহলােদ্দীপক ইতিহাস আছে, যার কথা আপনি জানেন না বলে দাবি করলেও তার প্রমাণ আমাদের

কাছে আছে। মােশতাককে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বরখাস্ত করেন। আটটি গােপন যােগাযােগের জন্য তিনি (মােশতাক) বরখাস্ত হন। এ ব্যাপারটা আমরা।
সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। চেরি : ঠিক এ ব্যাপারটা নিয়ে একটা কথা বলতে চাই। দেখুন,
রাজনীতিবিদরা প্রায়ই দূতাবাসের দ্বারস্থ হন এবং সেখানে খানিকটা যােগাযােগ হয়তাে হবে, তখন তারা ভাবেন যে, তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল। কিন্তু এ ধরনের একটা অবস্থা এবং কোনাে দূতাবাসের পক্ষে অভ্যুত্থানে মদদ দেয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। একজন রাজনৈতিক অফিসারের কাজ হলাে কোথায় কী ঘটছে না ঘটছে তার সরকারকে সেই সংবাদ জানিয়ে রাখা। একটা ভালাে রাজনৈতিক অফিসারের বহু জায়গাতেই যােগসাজশ থাকতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, আলােচ্য রাজনৈতিক অফিসার এসব রাজনীতিবিদ কিংবা অভ্যুত্থানে লিপ্ত ব্যক্তিদের সরকার উৎখাত-এর
পরামর্শ দিচ্ছেন। যােগাযােগটা এ পর্যন্ত এসেই থেমে যায়। লিজ : আমরা যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চাইছি, তা হলাে যুক্তরাষ্ট্র আগে
থেকে জানতাে কিনা; আর জেনে থাকলে সেটা মােশতাক-চক্রের
প্রতি সম্মতিসূচক ইশারার রূপ নিয়েছিল কিনা। চেরি : একেবারেই না। ১৯৭৪ বা ১৯৭৫-এ বাংলাদেশে এরকমটি হয়নি।
অথবা আমার জানা মতে অন্য কখনাে না। আপনি তাে জানেন, বেশ কটা অভ্যুত্থান হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সেগুলাের কোনােটা সম্বন্ধেই আগে থেকে কিছুই জানতে পারেনি। অভ্যুত্থানগুলাে কখন হতে যাচ্ছে তা আমরা জানতাম না। আরেকটা কথা বলতে চাই—তখনকার বছরগুলােতে নানারকম অভ্যুত্থানের গুজব সব সময় লেগেই ছিল। অনেক সময়ই রাজনৈতিক অফিসাররা, আমরা যারা দূতাবাসে ছিলাম, নানারকম লােকের কাছ থেকে প্রাপ্ত নানা সংবাদের ভিত্তিতে। রিপাের্ট তৈরি করতাম। কিন্তু আমার জানামতে কখনােই মােশতাক
বা তার নির্দেশনাধীন কেউ দূতাবাসে এসে আমাদের কিছু বলেননি। লিজ : আমরা কিছু লােক সম্বন্ধে অভিযােগ শুনেছি, যেমন এ বি এস
সফদার, যিনি এনএসআই-এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছেন। [চেরি : হ্যা] অভিযােগ করা হয়েছে যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ পরিচালিত স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং ১৯৭৫-এর আগস্টে কী হতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সংবাদ সরবরাহ করেছেন। এ ধরনের অভিযোেগ সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?

চেরি । আমি কখনাে এমন অভিযােগ শুনিনি। আমি জানি কথাটা মিথ্যে।
সফদার একটা স্পাের্টস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। বােধ হয় প্রেসিডেন্টই। ক্লাবে যােগদানের সময় আমার তার সাথে দেখা হয়। কিন্তু আমার জানামতে সফদার যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে কখনােই কোনাে সংবাদ সরবরাহ করেননি। যদি করে থাকেন, তাহলে সেটা আমি
আসার আগে করেছেন। আমি কিছুই জানি না। লিজ : আপনি কি আব্দুর রহিম নামে আরেকজন ব্যক্তি সম্বন্ধে কিছু জানেন?
ইনিও ১৯৭১-এ সফদারের সাথে আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমিতে
আইপিএ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। চেরি : আমি একে চিনি না। আমি ওর নামও শুনিনি। লিজ । আমি যে কথাটা আপনাকে বােঝাতে চাইছি তা হলাে—আমার কাছে
‘৭১-এর ঘটনার একটা নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করানাে হয়েছে, যেটা সাংবাদিক হিসাবে আমাকে খুবই উৎসুক করে তুলেছে। চেরি : আমাকেও] আমি ঘটনাটি সম্বন্ধে একটা সঠিক ধারণা চাই। এই ব্যাখ্যায় মার্কিন যােগসাজশের অভিযােগ রয়েছে। এক সময় এ ধরনের ভাবনা আমি শ্রীমতী গান্ধী এবং বাংলাদেশ ও ভারতের
ক্যুনিস্ট পার্টির অপপ্রচার হিসাবে খারিজ করে দিয়েছিলাম…। চেরি : ঠিক বলেছেন। আমি শুনেছি কমুনিস্ট সংবাদপত্র গুলােতে, ব্লিটজ-এ
এবং কোলকাতার কাগজগুলােতে ঘটনার সাথে আমার নাম জড়ানাে হয়েছে। সম্পূর্ণ উদ্ভট কথা। প্রথম কথা হলাে, আমাদের দটা কিসের? আমরা মুজিব শাসিত বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে সাহায্য পাঠাচ্ছিলাম । লিফসুজ : প্রশ্নটা নিজেকেও আমি বেশ কবার করেছি। এক্ষেত্রে আমাদের সূত্র জানাচ্ছে যে, আমি আপনি যেমনটি জানি, ১৯৭৪-এর শেষে এবং পুরাে ১৯৭৫-এ মুজিব গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিলেন… পুরাে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল।… [চেরি : সে তাে বটেই। পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। সেটা ডানপন্থীরা করবে না, বামপন্থীরা করবে তা বােঝা যাচ্ছিল না। আমাদের সূত্র জানিয়েছে যে, মােশতাক-চক্র এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা করবার জন্য পরবর্তীকালে তাদের মার্কিন সমর্থনের নিশ্চয়তা দরকার ছিল। এ ব্যাপারটা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব রেখেছিল। আমি এ ব্যাপারটাই খোজ নিয়ে দেখছি। আর আমাদের কিসের দায়, সে প্রসঙ্গে বলছি যে, দক্ষিণ এশিয়ার এমন অস্থিতিশীল এলাকায় একটা সম্ভাব্য পালা বদলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় উদ্দেশ্য। অক্যুনিস্ট স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
চেরি : হ্যা দেখুন, সে সময় ঠিক এই জিনিসটা নিয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ আলােচনা করেছি। আমরা জানতাম এমন সম্ভাবনা আছে। আমরা জানতাম মুজিব খুব বিপদে পড়েছেন। আমরা এও জানতাম যে, ওখানে (টাকায়) যাই হােক না কেন, মুজিবকে যিনিই উৎখাত করুন।
কেন, দোষটা আমাদের ঘাড়েই পড়বে। মার্কিন দূতাবাসের উপর সব দোষ চাপানাে হবে। কারণ শ্রীমতী গান্ধীর সমর্থন ছাড়াও মুজিবের উপর বেশ ভালাে সােভিয়েত প্রভাব ছিল। যাই হােক না কেন (আমাদের দোষ দেওয়া হবে)। তাই সম্পূর্ণ নিষ্কলংক থাকার। জন্য আমরা বিশেষভাবে সাবধান ছিলাম। আমাদের সব নির্দেশ যেন রাষ্ট্রদূত বােস্টারের কাছ থেকে আসে সে বিষয়টা নিশ্চিত করেছিলাম। অদ্যুথানের ব্যাপারে আমরা আগেই জানতাম—এরকম ধারণা সমর্থন করতে পারে এমন সব যােগাযােগ ছিন্ন করেছিলাম।
আমরা সত্যি সত্যি রাষ্ট্রদূত ৰােস্টারের নির্দেশ মেনে চলেছি। লিফসু। তাহলে উচ্চ পর্যায়ের একজন দূতাবাস কর্মকর্তা কেন আমাকে একথা
বললেন যে, চার পাঁচ মাস ধরে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি জানতে আগ্রহী দলটির সাথে বৈঠক হয়েছে এবং ওয়াশিংটনে ‘চার্চ কমিটি’র শুনানী যখন তুঙ্গে তখন ডিসেম্বর/জানুয়ারিতে দূতাবাস এদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়? দূতাবাসের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা
কেন এ কথা বলেছেন? চেরি : আমি জানি না কেন বলছেন। লিসুজ। এরা আরও অভিযােগ করেছেন যে, আপনি ও আপনার স্টেশন
অ্যুথানের দিন পর্যন্ত এদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করেছেন। চেরি দেখুন, এটা একেবারে মিথ্যা। আমি জানি না কেন। এমনও হতে
পারে, এখানে কারাে ওপর কেউ রাগ পুষে রেখেছেন। আর তাই এখন এসব কথা বলছেন। তবে আমার খুব ইচ্ছে আপনার সামনে এ ব্যাপারটা নিয়ে দ্রলােকের সাথে আলাপ করার। | লিসু । আমরা ওর বক্তব্যের পাশাপাশি আপনার অস্বীকৃতির কথা উপস্থিত
করতে চাই। আমরা যা তথা পাচ্ছি সে ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি যথাসম্ভব সত্য ও সঠিক রাখতে চাই। আমরা কোনাে মিথ্যে
অভিযােগ করতে চাই না। | চেরি । তা ঠিক। আমি আপনার দিকটা বেশ বুঝতে পারছি। কারণ আপনার
লেখা বহুদিন ধরে পড়ছি—লাগোসে থাকায় এখন আর পড়তে পারি । অবশ্য আমি আপনার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি-আপনি যেমনটা বলছেন ঠিক তেমনই সুবিবেচিত মনে হয়েছে আপনার প্রতিবেদনগুলাে। কিন্তু এখন যদি আর সবাইকে বাদ দিয়ে সেই
ব্যক্তিটির (দূতাবাসের সূত্র) কথা বিশ্বাস করেন—আমি জানি আপনি আমার সাথে ছাড়াও অনেকের সাথে আলাপ করেছেন—তবে প্রতিবেদনটা সঠিক হবে কিনা তাই ভাবছি। লিজ : আচ্ছা, একটা কথার জবাব দিন। এসব ব্যাপার কি আপনার অজান্তে
হতে পারতাে? আপনার অধীনস্থদের মধ্যে কেউ কি যােগাযােগ করছিলচেরি : রাজনৈতিক সেকশনে আমার অধীনস্থ কেউ এসবের মধ্যে ছিলেন । আমার অজান্তে এসব হবার সম্ভাবনা ছিল না।…তা এই প্রতিবেদনটা যে আপনি লিখছেন, এটা কি ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক
রিভিউ’-এর জন্য? লিজ : আমরা এখনাে ঠিক করিনি কোথায় ছাপবাে। কয়েকজন সম্পাদকের
সাথে আলাপ চলছে। সত্যি বলতে কী, রচনাটা ১৯৭৫-এর
ঘটনাবলী নিয়েই। চেরি : আপনি নিজে লিখছেন? লিজ : আমি মি. বার্ডের সাথে মিলে লিখছি (সহকারী সম্পাদক ‘দি নেশন’,
নিউইয়র্ক)। উনি গত ছয় থেকে আট মাস ওয়াশিংটনে অনেক খোঁজ
খবর নিচ্ছেন এবং বহুলােকের সাক্ষাৎকারও নিচ্ছেন। চেরি : আপনি যা বললেন, তার কিছু ব্যাপার সম্বন্ধে আমি জানি, একদম
আজগুবি। লিসুজ : ঠিক আছে, আমি সত্য কথাটাই জানতে চাই। আমার কারাে ওপর
| এক হাত নেওয়ার কোনাে খায়েশ নেই। চেরি : বেশ, এখন কী করবেন? … যুক্তরাষ্ট্র সরকার অথবা অন্য কোনাে
সরকার সেখানকার (বাংলাদেশের) অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল না।… আমরা প্রতিটা অভ্যুত্থান থেকে দূরে ছিলাম পুরােপুরিভাবে। আপনি যদি কোনাে প্রতিবেদনে ভিন্ন ধরনের অভিযােগ করেন আর স্বপক্ষে যুক্তি দেখান, তাহলে কিন্তু পুরাে রিপাের্টটা বিকৃত হয়ে যাবে। কাহিনীটা দারুণ! আমিও গল্পটা ভালােভাবে জানি।…একবার কথাটা
(মার্কিনী যােগসাজশ) তুললেই বিবরণটা বরবাদ হয়ে যাবে। লিজ ; কোন কাহিনীটা দারুণ? চেরি ; ওখানে যা ঘটেছিল তার ইতিহাস। ১৯৭৫-এর বাংলাদেশ। খুবই
কৌতূহলােদ্দীপক ঘটনা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বিদেশের অন্য কোনাে সরকারের এতে কোনাে হাত ছিল না। সবই বাঙালিদের নিজেদের কীর্তি। এই যে একটা ধারণা রয়েছে যে, বিদেশী সরকারের উসকানিতে অভ্যুত্থান হয়ে থাকে—এসব আসলে গুজব মাত্র। প্রায় সব সময়ই স্থানীয় মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই অভ্যুত্থান ঘটে।

লিফসুজ : চেরি সাহেব, আপনি জানেন এবং আমিও জানি, কিছু গুরুত্বপূর্ণ
অভ্যুত্থান মার্কিন সরকারের মদদ ছিল। আলেন্দের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়ােজন আছে কি? আরাে অন্যান্য কজনের নাম….
দিয়েম… চেরি : সেসব বহু বছর আগে হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ও বাবা, সেসব তাে
বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। অনেক বছর আগে। | লিসুজ: ‘৭৫-এর যে ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে তা হলাে ওইসব
বিষয়ে (বিদেশী রাষ্ট্রের সরকার উৎখাতে সিআইএ মদদ দান সম্পর্কিত) চার্চ কমিটির শুনানি যখন তুঙ্গে তখন আমরা (মার্কিনীরা)
এ ব্যাপারে কী করে জড়িত হলাম?… চেরি : হক কথা। লিজ : আমি জানতে চাইছি মােশতাক কী ধরনের আগাম রাজনৈতিক | পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন? … সেই ১৯৭১ থেকেই শুরু করা যাক। চেরি : যেমনটা বলেছি, একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে : উনি হয়তাে
ভেবেছিলেন ওর যােগাযােগ আছে, কিন্তু সত্যিকার কোনাে কর্মকাণ্ড
চলছিল কিনা সে বিষয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে। লিজ : তাহলে আপনার যেমন মনে আছে, সেই স্মৃতি থেকে বলুন তাকে
(মােশতাককে) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল কেন? চেরি : অতাে খুঁটিনাটি আমার মনে নেই। ব্যাস। লিজ : ঘটনা দুটোর সঙ্গে একটা অপূর্ব মিল হচ্ছে, কোলকাতার মােশতাক
ত্রয়ীতে যে তিনজন ছিলেন, তারাই যেদিন প্রত্যুষে মুজিব খুন হন সেদিন ঢাকার বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হলেন—চাষী, ঠাকুর ও মােশতাক। আর আমাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে যে, ১৫ তারিখের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এরা কুমিল্লায় ও অন্যান্য স্থানে বেশ
ক’মাস আগে থেকে বৈঠকে মিলেছেন ও পরিকল্পনা ফেঁদেছেন। চেরি : তা তারা করতে পারেন, তবে আমার জানা মতে তারা মার্কিন
| দূতাবাস কর্মচারীর সাথে মিলিত হননি। যতদূর আমি জানি। লিফসুজ: অথবা কোনাে যােগসূত্রের মাধ্যমে?
চেরি : আমার জানা মতে না। না।’ লিজ : ঠিক আছে। দরকার হলে আবার আপনার সাথে যােগাযােগ করবাে।
আপনি যদি নতুন কিছু চিন্তা-ভাবনার কথা জানাতে চান তবে আমাদের সাথে যােগাযােগ করবেন। আমি শর্টহ্যান্ডে আপনার অস্বীকৃতির কথা টুকে নিয়েছি। আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময়
সেটা ছাপতে চাই। ঠিক আছে? চেরি : ছাপার আগে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা দেখতে পারলে
বেশ হতাে।
লিফসুজ : ঠিক আছে, আমরা আপনার সাথে যােগাযােগ করে আপনার বক্তব্য
ঠিক আছে কিনা সেটা দেখিয়ে নেবাে। অথবা যদি কোনাে লিখিত | বিবৃতি দিতে চান, তাহলে মেহরবানী করে তাই দেবেন। চেরি : আমার তেমন কোনাে ইচ্ছেই নেই। | লিজ : ঠিক আছে, ধন্যবাদ। চেরি : গুডবাই।
এ ধরনের একটা তথ্যবহুল সাক্ষাৎকারের পর মার্কিনী সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ তার রচিত আলােচ্য গ্রন্থে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন।
… বাংলাদেশের ঘটনার বেলায় সবচেয়ে মারাত্মক প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মুজিব। সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে সৃষ্ট একাধিক চক্রান্তে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে ঢাকার সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপস চেরি এবং তার অধীনস্থ কর্মচারীরা কিংবা সিআইএ-র কন্ট্রোল বহির্ভূত অন্যান্য মার্কিন যােগসূত্র কোন কোন পদ্ধতির যােগাযােগ রক্ষা করেছিল।
“সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পূর্বে এ সম্পর্কে কিছু জানার কথা ফিলিপস চেরি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের মাত্র মাস কয়েক পরে ১৯৭৫-এর ডিসেম্বর মাসে নিজের বাসায় (ঢাকায়) আয়ােজিত এক মদের পার্টিতে জনৈক মার্কিনী সাংবাদিকের কাছে আলােচ্য অভ্যুত্থানের সংবাদ প্রচার সম্পর্কিত বিষয়ে আলােচনাকালে তিনি বলেছেন যে, আসলে কোনাে সাংবাদিকই পুরাে ঘটনার হদিস পায়নি। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আগে থেকে তিনি কিছু জানতেন কিনা; জবাবে তিনি উল্লেখিত সাংবাদিককে বলেছেন যে, ঠিক কখন হবে, না জানলেও তারা বিলক্ষণ জানতেন যে, কিছু একটা হতে যাচ্ছে।”

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!